(সূফীবাদ নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। এই নিয়ে কিছু পড়া লেখাও করেছি। বাংলায় এই সংক্রান্ত ভাল কোন বই পাওয়া যায় না, কেন যায় না সেটার একটা বিশেষ কারন ও আছে। এই বিষয়ে আমি যতগুলি বই বা আটিকেল পড়েছি তার সবই ইংরেজিতে লেখা। ইংররেজিতে এমন কিছ শব্দ ব্যাবহার করা হয় যার বাংলা পরিশব্দ খুজে পাওয়া কঠিন। যদিও আমি প্রচলিত অর্থে কোন লেখক না (জীবনে কোনদিন হতেও পারবনা, বা হওয়ার ইচ্ছাও নাই), এই বিষয়ে মানুষের ভুল ধরনা দেখে আমার এই লেখার প্রয়াস। যেহেতু আমি কোন একাডেমিক পেপার লিখতে বসিনি, আমি আমার লেখা যতটুকু সম্ভব সহজ ভাবে লেখার চেষ্টা করব। আমার লেখার বিষয়ে যদি কারোও কোন প্রশ্ন থাকে বা আপত্তি থাকে, দয়া করে জানাবেন, সাধ্যমত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। দয়া করে ব্যক্তিগত আক্রমণ, বা গালাগালি করবেন না।)
Mysticism (অতিন্দ্রীয়তাবাদ) ঃ
আমি এর সংজ্ঞা, উৎপত্তি, ব্যাকরণগত ব্যাখা কি সেদিকে যাবনা। শুধু এতটুকু বলব যে, এই Mysticism নিজেই একটা স্বতন্ত্র ধর্ম যার উৎপত্তি প্যাগানিজম থেকে। যুগে যুগে এই Mysticism বিভিন্ন ধর্মের সাথে মিশে সেই ধর্মের রুপ ধারন করেছে। সেজন্য আমরা বিভিন্ন ধর্মে যেমন সনাতন, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রীস্টান এবং ইসলাম ধর্মে এর প্রভাব দেখতে পাই। ইসলাম ধর্মে এই Mysticism সুফীবাদ বা সুফীজম নামে পরিচিত। একটা খুব লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই Mysticism যেভাবে ইহুদীদের মধ্যে প্রবেশ করেছে, ঠিক একই ভাবে এটা ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছে। এই মিল এত বেশি যে, যদি কেউ ইহুদী Mysticism পড়েন এবং ইহুদী শব্দের জায়গায় ইসলাম শব্দটা বসিয়ে দিলে, মূল কাহিনীর খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। ইসলামের ব্যবহারিক প্রয়োগের সাথে এই সুফীবাদ এমনভাবে মিশে গেছে, যে একে আলাদা করা খুব কঠিন একটা কাজ। তাই ইসলামের প্রচলিত প্রথা ( যা আমরা ইসলাম মনে করে পালন করি) থেকে নয়, বরং এর মৌলিক দিক থেকে সূফীবাদের পার্থক্য বের করতে হবে। কারন, আমরা অনেকেই অনেক সুফী ধারনা ইসলামী বিশ্বাস বলে মনে করি, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইসলামের সাথে সূফীবাদের কোন মৌলিক মিল নেই। আমি শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের মধ্যে এই Mysticism এর আবির্ভাব এবং পরে ইসলাম ধর্মের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
দুই প্রকারের ওহীঃ
যেহেতু আমি ইহুদীদের উপর এই Mysticism এর আবির্ভাব এবং প্রভাব এখানে বর্ণনা করছিনা, তবু বোঝার সুবিধার জন্য আমি তাদের মধ্যে ওহী সংক্রান্ত ধারনা একটু সংক্ষেপে বলছি, এইটা আমাদের পরে কাজে লাগবে।
ইহুদীদের মধ্যে তাওরাত (Old Testament) এসেছিল মুসা (আঃ) এর মাধ্যমে। ইহুদীরা মুসা (আঃ) এর পাশাপাশি আরও অনেক নবীকে মানত যারা আল্লাহর কাছ থেকে কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন। এছাড়াও তাদের উপাসনালয়ের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিল যারা ভবিষ্যৎবাণী করত। তাদেরকে বলা হত প্রফেট (Those who prophesies- this is how the word “prophet” came in to place). যদিও নবী শব্দের অর্থ বা সমার্থক শব্দ কোন ভাবেই prophet নয়, এবং যেহেতু এই নবী শব্দের ইংরেজীতে বা অন্য ভাষায় কোন আলাদা শব্দ নেই, তাই নবীর সমার্থক শব্দ হিসাবে prophet শব্দটি প্রচলিত ভাবে ব্যবহার করা হয়।
ইহুদীরা বিশ্বাস করত এই prophet রা বাস্তব এবং ভবিষ্যৎ দিব্য চোখে দেখতে পেত। সেই জন্য তাদের বিশ্বাস ছিল ওহী (Revelation) দুই প্রকার।
১। ওহী জালি ঃ যা রাসুলদের নিকট সরাসরি বিশেষ ওহী হিসাবে প্রেরিত হয়েছে।
২। ওহী কাফিঃ এক প্রকার ওহী যা ইহুদিদের মত অনুযায়ী তাদের প্রফেটদের কাছে এসেছে। (বিঃদ্রঃ এইখানে প্রফেট বলতে নবী বোঝানো হয় নাই)
সুফীবাদের উৎপত্তি :
কোরআনে কোথাও তাসাউফ বা Mysticism বলে কোন শব্দ নেই, তাই এই সূফীবাদের ধারনাও কোরআনে নেই। এর কাছাকাছি যে শব্দটা কোরআনে এসেছে তা হল “রাহবান” (Monasticism)। আল্লাহ বলেছেন”
“আর বৈরাগ্য, সে তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে; আমি এটা তাদের উপর ফরজ করিনি; কিন্তু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে এটা অবলম্বন করেছে” (৫৭:২৭)
কোরআন একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান এবং এর বিধান সম্পূর্ণ পরিষ্কার। ইসলামে বৈরাগ্য অথবা সূফীবাদের কোন স্থান নেই।
আমরা জানি জ্ঞান হচ্ছে দুই প্রকার। প্রথম প্রকার জ্ঞান সরাসরি সৃষ্টিকর্তা থেকে প্রাপ্ত (Divine Knowledge)। এই প্রকার জ্ঞান সৃষ্টিকর্তা বিভিন্ন সময়ে তার প্রেরিত মানুষের দ্বারা মানুষের কল্যাণে পাঠিয়েছেন। যাদের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা এই জ্ঞান আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তাদেরকে নবী বা রাসুল বলা হয়। মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইন্তিকালের পরে, এই সরাসরি প্রাপ্ত জ্ঞানের অবসান ঘটে। এর পর সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আর কোন সরাসরি জ্ঞান আসবেনা। দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞান হচ্ছে মানুষ তার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার কাজ, গবেষণা, সময়ের সাথে সাথে যে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান লাভ করে। এই জ্ঞান ( Perpetual Knowledge) সময়ের সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান।
এক পর্যায়ে কোরআনের খতমুন নব্যুয়াত (seal of the prophet) কে পাশ কাটিয়ে ইহুদীদের দুই ধরনের ওহী মতবাদ ইসলামেও প্রসার লাভ করে। শিয়া এবং সুন্নী এই দুই মতবাদই খতমুন নব্যুয়াত কে পাশ কাটিয়ে সরাসরি সৃষ্টিকর্তা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান (Divine Knowledge) পাওয়া সম্ভব- এ বিশ্বাস স্থাপন করে, যেখানে কোরআন সরাসরি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের পথ বন্ধ করে দিয়েছে সেখানে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন সম্ভব- এই বিশ্বাসই সুফীবাদের মুল ভিত্তি।
দুই ধরনের ওহী মতবাদ:
এই দ্বিতীয় ওহীর ক্ষেত্রে, শিয়ারা বিশ্বাস করে তাদের ইমামগন এই প্রকার জ্ঞান সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত। এই ক্ষেত্রে তারা “মুহাদ্দাস” শব্দটি ব্যবহার করে। সাধারণত এই “মুহাদ্দাস” শব্দটি তারা তাদের ইমামের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এই অর্থে যে তাদের ইমামগনও একই উৎস থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত।
অন্যদিকে সুন্নীরাও এই মতবাদ ধারন করে। সুন্নীদের বেলায় বলা হয়, দুই প্রকারের ওহী আছে, একটা হল ওহী জালি- যা নবীর উপর সরাসরি এসেছে (কোরআন)। অন্যটি হল ওহী কাফি, যা নবী এবং উনার পরবর্তীগন সরাসরি একই উৎস থেকে প্রাপ্ত। এই জন্য হাদিসও বানানো হয়েছে। এই বিষয়ে আরও জানতে আপনি নিচের লিঙ্কে যেতে পারেন। Click This Link
http://www.somewhereinblog.net/blog/hanifdhaka/30030621
গোপন জ্ঞান/ গুপ্ত বিদ্যাঃ
সুফীবাদের একটা মতবাদ হচ্ছে যে গোপন জ্ঞান/ গুপ্ত বিদ্যা সাধারনের জন্য নয়, শুধুমাত্র বিশেষ কিছু মানুষের জন্য। এই জন্য তারা হাদিস বানিয়েছে। আমি এখানে একটা হাদিসের উল্লেখ করছিঃ
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিতঃ নবী আমাকে দুইটি জ্ঞানের পাত্র দিয়েছেন, যার একটি আমি প্রকাশ করেছি (প্রকাশ্য জ্ঞান), কিন্তু যদি অপরটি (গোপন জ্ঞান) প্রকাশ করি তবে আমার গলা কেটে ফেলা হবে। (বুখারী, মিসকাত- কিতাব উল উলম)
আহলে ত্বরিকা (সুফীবাদের অনুসারী) এই হাদিসটিকে তাদের মতবাদের প্রমান হিসাবে পেশ করেন।
কিন্তু আল্লাহ বলেছেন
“হে রসূল, পৌছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না”।(৫:৬৭)
“অতঃপর যালেমরা কথা পাল্টে দিয়েছে, যা কিছু তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল তা থেকে। তারপর আমি অবতীর্ণ করেছি যালেমদের উপর আযাব, আসমান থেকে, নির্দেশ লংঘন করার কারণে”।(২:৫৯)
সুতরাং কোরআনের এই আয়াত (৫:৬৭) অনুযায়ী যদি উপরোক্ত হাদিস সঠিক দাবী করা হয়, তবে এই দ্বারা কোরআন অনুযায়ী নবীর উপর কঠিন অভিযোগ/দোষারোপ আরোপ করা হবে যে উনি উনার উপর অবতীর্ণ ওহীকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। একভাগ সবাই কে বলেছেন, আরেকভাগ বিশেষ কয়েকজন কে। কোরআনের এই আয়াত অনুসারে, এমন কোন কিছ আল্লাহ নবীকে দেন নাই যা উনি সকল মানুষের কাছে পৌছে দেন নাই।
সুফিরা বিশ্বাস করে তারা সরাসরি ঈশ্বর থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত। এই জ্ঞানের বিভিন্ন নাম আছে। তবে সাধারণত “ওহী”,“কাশফ” অথবা “ইলম” বলা হয়। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আমাদের নবী যে উৎস থেকে এই ওহী প্রাপ্ত, তারা এই সব জ্ঞান/ওহী একই উৎস থেকে প্রাপ্ত দাবী করে। এই জ্ঞান কোথাও লিখে রাখা হয় না বরং যুগ যুগ ধরে সুফী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হস্তান্তর হয়। এই জ্ঞান যে শুধুমাত্র মুর্শিদ (master) এর মাধ্যমে অনুসারীদের মধ্যে হস্তান্তর হয় তা নয় বরং গোপন পদ্ধতিতে দ্বীর্ঘ সময়ে অর্জন করা যায়। যেমন, বলা হয়, জুনাইদ বাগদাদী (মৃত ২৯৮ হিজরি) এই জ্ঞান লাভ করেছিল আনাস বিন মালিক, নবীর একজন সাহাবার কাছ থেকে। সুফিরা বলে থাকে যে এই গোপন জ্ঞান আলী(রাঃ) পায় নবীর কাছ থেকে এবং আলী(রাঃ) এর মাধ্যমে এই জ্ঞান মৌখিক ভাবে হস্তান্তর হয়। এই জন্য শিয়ারা তাদের ইমামদের কে বলে মুহাদ্দাস। অন্যদিকে সুন্নীদের মধ্যে প্রধান চারটি ত্বরিকার (কাদেরিয়া, নক্সবন্দী, চিশতিয়া, সোহ্রদিয়া) শুধুমাত্র “নক্সবন্দী” ত্বরিকা বাদে সবাই তদের পূর্বপুরুষদেরকে আলী(রাঃ) থেকে আগত বা আলী(রাঃ)এর উত্তরসূরি মনে করে।(এই মতবাদের সাথে খৃস্টানদের ট্রিনিটি একসাথে করলে, নবী নুরের তৈরি এই ধরনার উৎস সহজেই পাওয়া যায়, আমি সেদিকে যাচ্ছিনা।) এই গোপন জ্ঞানের সাথে তারা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে যা দ্বারা তারা কোরআনের গোপন অর্থের অর্থ অনুধাবন করতে পারে।
বিখ্যাত সুফী “মহিউদ্দিন বিন আরাবী” তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ ফাহসুল হুকম” এ এই বিষয়ে বলেনঃ “সুফীরা নবীদের মত একই উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করে থাকে”।(“Sufis get (knowledge) from the same source from which the Prophet got.”)।
একই গ্রন্থে সে বলেছেঃ “as far as the Ahadts (traditions) are concerned.some of them may be forged ones but the knowledge which the saints get directly from God can never be so”
এর ফলে যে দরজা নবীর ইন্তিকালের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা আবার সুফী মতবাদ অনুযায়ী খোলা হল, এবং এই তথাকথিত দরজার মাধ্যমে যুগে যুগে বিভিন্ন প্রকার ওহী, নবী পরিচয় দানকারী মানুষ এবং তাদের বিভিন্ন প্রকারের মুযেযা/কেরামতের পথ উম্মুক্ত হল।
পারট- ২: Click This Link