somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প ....... পল বোমার ....

২১ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমি সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি । তাকে অবশ্য মানুষ বলে চেনার কোন উপায় নেই । বাম পায়ে স্পিন্টারের একটি বড়সড় ক্ষত। মুখের চোয়ালের একপাশ উড়ে গেছে ।' বিরাশি মিলিমিটার মর্টারের স্পিন্টার খুব খারাপ জিনিস .... স্বগোতক্তি করলাম আমি। আমার পাশে দাড়ানো মনসুর একরাশ বিরক্তি নিয়ে এতোক্ষন তাকিয়ে ছিলো অর্ধমৃত মানুষটার দিকে । শেষমেষ বলেই ফেললো......'ঝামেলাটারে শেষ করে দিলেই তো হয় ....তুই বেশি বেশি করতাছস। ..... আমি মনসুরের কথায় কিছু মনে করলাম না । ওর জায়গায় আমি হলেও হয়তোবা একই কথা বলতাম। বেচারা গতো চারদিনে মাত্র দুইঘন্টা ঘুমিয়েছে।

আমরা আছি সিলেটের হরিপুর থেকে আরো মাইল দুয়েক সামনে। জায়গাটার নাম দরবশত । গতো সাতদিন যাবত আমরা এইখানে অস্হায়ী ক্যাম্প বানিয়েছি। আমরা আছি মোট পনেরজন। আমি, মনসুর, জালাল, মজিদ, কাওসার, মতিনভাইসহ আরো অনেকে। আমাদের মধ্যে বয়েসে মতিন ভাই একটু বড়। ভার্সিটিতে মতিন ভাই আমাদের চেয়ে তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন। অবশ্য আমরা বয়েসের জন্য না হলেও ওনার উপস্হিত বুদ্ধি আর নেতৃত্বপরায়নতার জন্য সবাই উনাকে লিডার হিসেবে মেনে নিয়েছি।

আমাদের এই অস্হায়ী ক্যাম্পে আসার উদ্দেশ্য হলো বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া যাওয়া। সেখানে জাফলং থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে মিত্রবাহিনীর ক্যাম্প হতে কিছু নতুন গোলাবারুদ আসবে । সেইসাথে আসবে সদ্য ট্রেনিং পাওয়া আরো বিশজন। তাদেরকে নিয়ে আবার মৌলভীবাজারে আমাদের বেস ক্যাম্পে পৌছে দিতে হবে ।

গতকাল পর্যন্ত কোন ঝামেলা ছাড়াই আমরা হরিপুর ক্রস করি। তারপর দুপুরের একটু পরে জালালের ছোট্ট একটা ভুলের জন্য আমারা হানাদারদের এক রেকি এয়ারক্রাফটের নজরে পড়ে যাই । শালারা মহা হারামি । আমাদের গ্রুপটাকে দেখামাত্রই দুমদাম গুলি শুরু করে । আমরাও কম যাই না । এস এমজি, এলএমজি যা ছিলো হাতের কাছে তাই দিয়ে ফড়িংটাকে নামানোর জন্য পাল্টা ফায়ার করি । আমাদের মধ্যে কাওসারের হাতের নিশানা সবচাইতে খারাপ । ওর গুলি লেগে সামনের ডোবার পাশে দাড়ানো নারকেল গাছ থেকে টুপটাপ দু তিনটে ডাব পড়ে যায় । তাই দেখে এই টেনশনের মধ্যেও মজিদ খিক খিক করে কাওসারের উদ্দেশ্যে এক গা জ্বালানো হাসি ছুড়ে দেয় । অবশেষে কার ফায়ার লেগে যে রেকি ক্রাফটের লেজে আগুন ধরে যায় তা বলা কঠিন। আগুন লেগে বো বো করে আওয়াজ ছাড়তে ছাড়তে সামনের বিলে গিয়ে পড়ে ওটা । ঠিক তখুনি দেখি প্যারাসুটে করে পাইলট বাবাজি নেমে আসছেন । মজিদ ওকে ঐ অবস্হায়ই গুলি করে ফেলে দিতে চেয়েছিলো । কিন্তু লিডার মতিন ভাই নিষেধ করলেন ।

তাই মতিন ভাইয়ের কথামতো যখন আমরা সামনের বিল থেকে পাইলটকে বেধে নিয়ে আসলাম ততোক্ষনে ওর দম যায় যায় অবস্হা। পরনে ফ্লাইটস্যুট । সেটি জায়গায় জায়গায় ছিড়ে গিয়েছে। বাম চোয়ালের অবস্হা ভয়াবহ । মনে হয় গুলি লেগে হাড় গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছে । মুখের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায়না । ঐ অবস্থায় মনসুরের বক্তব্য ...... ঝামেলাটারে শেষ করে দিলেই তো হয় ।

কিন্তু ঝামেলা আর শেষ হয়না । সন্ধ্যা মিলতে না মিলতেই শুরু হলো পাইলটের অসহ্য গোঙানি । হারামজাদা মনে হয় এই অবস্হায় কিছু গিলতেও পারবে না । চোয়ালটার বারোটা বেজে গেছে । রাতটা কোনমতে কাটানোর জন্য আমরা পাশের এক ভাঙা স্কুলঘরে আশ্রয় নিলাম ।

রাতে শুরু হলো অসহ্য মশার কামড় । সেইসাথে পেটের ভেতর গনগনে ক্ষুধা । সারারাত আমরা পালা করে পাহারা দিলাম । ভোরের দিকে পাইলটের অবস্হা খুবই খারাপের দিকে মোড় নিলো । গলা দিয়ে গোঙানির সাথে সাথে ফেনা বেরুতে লাগলো । এমন সময় মজিদ বলে উঠলো .... দ্যাখ , দ্যাখ .... ওর পকেটে যেন কী দেখা যাইতেছে । মনে হয় ওয়ালেট টাইপ কিছু হইবো ।
মজিদের কথা শুনে মতিন ভাই পকেট থেকে ব্যাগটা টেনে বার করলেন । দেখি একটা ম্যাপ । ফ্লাইং এর সময় চার্ট করার জন্য লাগে । ম্যাপটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আবিস্কার করলাম এক কোনায় একটা মেয়ের ছবি । বয়েসটা চব্বিশ পচিশের মতো হবে । হাসিখুশি মায়াবী চেহারা । কেমন যেন একটা সারল্যের ঝিকিমিকি চোখ দুটোতে । পাইলটের হাতে এনগেজমেন্ট রিং দেখে ধারনা করলাম হয়তো মেয়েটা ওর হবু স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা হবে ।

ততোক্ষনে হঠাত করে পাইলটের গা - হাত পা যেন বিবর্ন হয়ে গেলো । ঘন ঘন খিচুনি শুরু হলো । গলার নীচের ফর্সা ত্বকে নীলচে ধমনীগুলো ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো ।

আমরা গতো কয়েকমাসে বহু অপারেশন করেছি। ব্রাশ ফায়ার করে উড়িয়ে দিয়েছি শত্রুসেনার খুলি । গ্রামকে গ্রাম দখল করে থাকা হানাদার বাহিনীকে কোনঠাসা করেছি । এমনকি হারিয়েছি প্রানের চেয়ে প্রিয় সহযোদ্ধাদের .... চোখের সামনে ... রক্ত দেখেছি ... আর্তনাদ শুনেছি .... আগুন দেখেছি ..
তবু আজ চোখের সামনে শত্রু বাহিনীর পাইলটকে মরতে দেখে কেমন যেন একটু মন খারাপ হলো ।

হয়তো বেচারা আর্মিতে আসতে চায়নি । এক বাবার এক আদরের ছেলে ... বাবা মায়ের শখ মেটাতে পাইলট হয়েছে । হয়তো ওর মা এখনো প্রতিদিন ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকে। ওর হবু বধূ শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে দাড়িয়ে থাকে । অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কোন প্লেনের ককপিটে কল্পনার তার প্রিয় মানুষটির ফিরে আসার স্বপ্ন দ্যাখে ......

ভোর রাতের দিকে পাইলট মারা গেলো । শেষদিকে ও একটু পানি খেতে চাচ্ছিলো । কিন্তু বুলেটের আঘাতে চোয়ালের নীচটা ছিড়ে যাওয়ায় পানি ভেতর পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি । তার আগেই গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলো .....

ও মারা যাওয়ার পর আমরা মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় পেলাম না । এম্নিতেই আমাদের অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে । আর দেরি করাটা রিস্কি হয়ে যাবে । তাই অর্ধভাঙা স্কুলঘরটার বারান্দায় ওকে শুইয়ে দিলাম । বুকের উপরে দিলাম সেই ঝিকিমিঝি চোখের হাসিখুশি প্রেমিকার ছবি .....

বাইরে তখন রোদ উঠে গেছে .........
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×