somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ: ইতিহাস লুকিয়ে রাখা যায় না

২৮ শে মে, ২০১২ বিকাল ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মই ১৯৭১ সালের ঘটনা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে। বাংলাদেশের অন্যসব পরিবারের মতো যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিবারও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনে এই ভূখন্ডের কোন পরিবারটি শোক, অনাহার, মৃত্যু বা রক্তক্ষরণের মুখোমুখি হয়নি? স্বাধীনতালাভের জন্য বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি ছিল বিশ্বের সব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম। আর মুক্তিবাহিনীই আমাদের সেই জাগরণের গান শুনিয়েছিল।

১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর চলমান হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন সম্পর্কে আমার মা বলতেন, “বাতাসে আত্মবিশ্বাসের আভাস ছিল, আমরা জানতাম আমরা পারব। আর সবাই তখন জানতাম স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

কিন্তু যুদ্ধ সম্পর্কে আমরা যতটা শুনেছিলাম, তেমনটা শুনিনি ধর্ষণের কাহিনীগুলো। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালেই প্রথম ধর্ষণকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

নতুন প্রজন্মকে যে যুদ্ধের গল্প শোনানো হচ্ছে তা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতনের কাহিনীগুলো। যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও তাদের আত্মত্যাগের গল্পে ঠিকই আলোকপাত করা হচ্ছে কিন্তু ধর্ষণ, ক্যাম্পের কাহিনী বা যুদ্ধশিশুর গল্প চাপা পড়ে যাচ্ছে সচেতনভাবে।

কিন্তু আমরা সবাই জানি, যত চেষ্টাই করি না কেন ইতিহাস নতুন করে লিখতে পারব না। সত্য টিকে থাকবেই এবং কোনও না কোনও সময় তা প্রকাশিত হবেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বিশেষজ্ঞই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ও নারীবাদীরা সঠিক তথ্যের দাবি জানিয়ে আসছেন।

বাংলাদেশে যখন গেলাম, আমার এক চাচা আমার আগ্রহ দেখে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে যুদ্ধকালীন ধর্ষণের কিছু গল্প বললেন। তার গল্প শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্তূপীকৃত ধর্ষিতা নারীর লাশ, যারা শুয়ে আছে হয়তো কোনও সেতুর নিচে, কোনও এক গণকবরে। তাকে প্রশ্ন করি “কতজন নারী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিতা ও হত্যার শিকার হয়েছিলেন?” চাচা গলার স্বর নিচু করে বললেন, “তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, মা।”

কিন্ত এখন বাংলাদেশেরই একজন বিশেষজ্ঞ আমাদের সেই অজানা তথ্য জানাতে চান, তার নাম বিনা ডি’কস্তা। তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ) ও জাতিসংঘের আমন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিসকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে গর্ভপাত ও যুদ্ধশিশু জন্মদানের ক্ষেত্রে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি সাময়িকীতে ডা. ডেভিসের সঙ্গে ডি কস্তার কথোপকথনটি প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এটি সবচেয়ে মূল্যবান প্রকাশনা বলা যায়। তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে লোমহর্ষক সব নির্যাতনের কাহিনী- গাছের সঙ্গে বেঁধে নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা, নারীর দেহে অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা, ধর্ষণের পর গণকবরে পুঁতে ফেলা, পাকিস্তানের ধর্ষণ ক্যাম্পে আটকে রাখা ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি বিষয়।

ডেভিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সাধারণত বলা হয় ২ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছিল, এই সংখ্যাটি কি ঠিক? জবাবে ডা. ডেভিস বলেন, সঠিক সংখ্যাটি অজানা।

… যে বিপুল সংখ্যক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সম্ভবত সে তুলনায় এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। তারা শহর দখল করত এভাবে। প্রথমে পাক সেনারা পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীকে সামনে পাঠাত। তারা শহরের স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে গোলা নিক্ষেপ করত যেন সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর সেই সুযোগে পাক পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে নারীদের ওপর হামলে পড়ত। শিশু ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সব নারীই নির্যাতনের শিকার হতেন। এরপর তাদের ধরে সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হত সাধারণ সেনাদের সম্ভোগের জন্য। তারা এমন কিছু গল্প শুনিয়েছেন যা মর্মবিদারক; কোনও কোনও নারী বারবার ধর্ষিত হয়েছেন, বারবার। অনেকেই ওইসব ক্যাম্পে প্রাণ হারিয়েছেন। এ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে তখন একটা ধোঁয়াশা ছিল। কেউ বিশ্বাস করতে পারত না এমন কিছু ঘটছে। কিন্তু প্রমাণ বলছে, হ্যাঁ, তাই ঘটেছে।

যুদ্ধশেষে শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ষিতা নারীদের সমাজে পুনর্বাসনের জন্য কীভাবে তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করেন সে কথা শুনিয়েছেন ডা. ডেভিস। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে কাজে লাগেনি। পকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতন ও গর্ভধারণের পর বাংলাদেশি ওই নারীরা সমাজের চোখে পুরোপুরি অস্পৃশ্য হয়ে যান। অনেকেই তাদের স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন অথবা তারা নিজেরাই তাদের আধা-পাকিস্তানি শিশুদের হত্যা করেছেন। কেউ কেউ পাকিস্তানি ক্যাম্পে থাকার পর এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন যে তারা আর ঘরে ফিরতে চাননি, পাক সেনাদের অনুরোধ করেছেন যেন তাদের সঙ্গে করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমি প্রবন্ধটি পড়ার সময় এর অনলাইন সূত্রেও চোখ বুলিয়েছি। অনলাইনে এনবিসির একটি ভিডিওতে দেখলাম একটি আশ্রয় কেন্দ্রের দৃশ্য, পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে গর্ভধারণ করা অনেক নারী প্রসবের আগ পর্যন্ত যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের হাতে ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা সাধারণত যুবতীদের কথা বুঝি, অনেক সময় মাত্র ১৩ বছরের কিশোরীও নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু ওই ভিডিও চিত্রটি আমাদের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আবেগের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে হঠাৎ থেমে যাই, চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকি, ‘আমি কী করছি?’ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, ‘হৃদয় খুঁড়ে এই বীভৎস ব্যাপারগুলো অনুভবের মানে কী?’

তখন বুঝতে পারি মনের ব্যথাটাই হৃদয় খোঁড়ার অর্থ। নির্যাতিত ওই নারীদের সহজভাবে আমাদের সমাজের অংশ করে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা কেন নিভৃতে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবেন? যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বীভৎসতা সম্ভবত তারাই বহন করছেন। আমাদের উচিত তাদের খুঁজে বের করা, তাদের অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।

হ্যাঁ, আমরা একটি রক্ষণশীল দেশ। হ্যাঁ, আমরা মুসলিমপ্রধান দেশ। হ্যাঁ, ১৯৭১ সালের সেই বেদনাদায়ক ও মর্মভেদী ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে না তাকানোর জন্য আমাদের কাছে হাজারো অজুহাত আছে। কিন্তু এভাবে আমরা আমাদের ইতিহাসের এক বিস্তর অধ্যায় হারিয়ে ফেলছি। যেমনটি ডি’কস্তা বলেছেন, আমার সচেতনভাবে এক ‘ঐতিহাসিক ভ্রান্তি’তে ভুগছি।

যেহেতু এখনও বাংলাদেশে ওই নির্যাতিত নারীরা বেঁচে আছেন, তাই তাদের আত্মত্যাগের প্রতি আমাদের সঠিক সম্মান দেখানো উচিত। অবশ্য স্বাধীনতার ৪০ বছর পর হলেও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই ইস্যুটি উঠে এসেছে।

মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন কি পারবে আমাদের এই ঐতিহাসিক দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে? আমরা যদি সত্যিই সামনে এগিয়ে যেতে চাই, তবে পেছন ফিরে তাকানো উচিত। ১৯৭১ সালে যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের সবার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই আমরা এই দায় থেকে মুক্ত হতে পারব।

(যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইন্টারনেট নিউজপেপার হাফিংটন পোস্টে আনুশে হোসাইনের ব্লগে ২১ মে প্রকাশিত ‘১৯৭১ রেপস: বাংলাদেশ কান্ট হাইড স্টোরি’ শীর্ষক লেখাটির ভাষান্তর করেছেন বিধান চন্দ্র সাহা)

বিস্তারিত এখানে
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×