somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এলোমেলো স্মৃতিকথা-১: রেলগাড়ী ঝমঝম

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আমার এই সিরিজের লেখাগুলো প্রচলিত অর্থে কোন আত্নজীবনী নয়। এর কোন ধারাবাহিকতাও নেই। জীবনের বিভিন্ন সময়ের কিছু কিছু ঘটনা যা আমাকে আজও কোনও না কোনও ভাবে নাড়া দেয় এসব তারই বর্ণনা মাত্র।)


আর কদিন পরেই বাড়ী যাব। প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর মাসের এই সময়টাতে আমাদের সব ভাইবোনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়। তারপর লম্বা ছুটি। তাই এটাই উৎকৃষ্ট সময়। বাড়ী যাওয়ার সবচেযে সস্তা মাধ্যম রেলগাড়ী। গন্তব্য উত্তর বাংলার বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দী থানা। সময়টা ১৯৮৪-৮৫ সালের। তখন বগুড়া যেতে সময় লাগত ১৫/১৬ ঘন্টা। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ভয়ংকর রকম খারাপ।

আমার বয়স তখন ছয় কি সাত। বাড়ী যাওয়া মানে তখন আমাদের কাছে তৃতীয় ঈদ! স্বাধীনতা কি জিনিষ তা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতাম। যমুনায় ঝাপাঝাপি, রাখালের সাথে গরু চড়ানো, কলাগাছের ভেলা নিয়ে বিলের মধ্যে ঘুরাফিরা, গাছে চড়া, বিকাল বেলা হাটে যাওয়া, নানার বাড়ীতে রাতের বেলায় হারিকেনের টিমটিমে আলোয় নানার দরাজ কন্ঠের পুঁথি শোনা- আরও কত কি! যদিও আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকায় কিন্তু যমুনাপাড়ের এই মানুষগুলোর প্রভাব আমার জীবনে অত্যন্ত প্রবল।

আমাদের পরিবার সম্পর্কে একটু ধারনা দেয়া দরকার। আমরা চার ভাই-বোন, বাবা, মা এবং আমাদের দাদী-এই সাতজন মিলে আমাদের পরিবার। বাবা সরকারী পোষ্টাল ডিপার্টমেন্টের খুব সাধারণ একজন কর্মচারী। মা গৃহবধূ। আমাদের মধ্যে বোন সবার বড় এবং ভয়ংকর রকম জেদী। তারপর আমার বড় ভাই। মানুষ হিসেবে খুবই দায়িত্বশীল। তারপর আমি। মানুষ হিসেবে খুবই দুষ্ট। তারপর আমার ছোট ভাই- মস্ত বড় গাধা।

বাড়ী যাওয়ার কদিন আগে থেকেই চলত প্রস্তুতি। ওসব প্রস্তুতিতে আমি খুব একটা মাথা ঘামাতাম না। আমার লক্ষ্য ট্রেনের জানালার ধারের আসন। তখন দেশে কোন আন্ত:নগর ট্রেন ছিল না। সবই লোকাল ট্রেন। আমাদের সাতজন মানুষের জন্য ছয়টি টিকেট কাটা হতো। এরমধ্যে দুটি সীট থাকতো জানালার সাথে। এর একটি বারাবরই আমার বড়ো বোনের দখলে। ওটা অন্য কারও পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়টি আমার বড়ো ভাইয়ের। আমার নজর সেটার দিকে। কিন্তু সে আমাকে ডেকে আগেই ঘোষনা করে রাখত -খবরদার এটা নিয়ে কোনও কথা আমাকে বলবিনা। আমিতো প্রচন্ড হতাশ- জানালার ধারের সীট না পেলে বাড়ী যাওয়ার আনন্দটাই বৃথা।

আমি মনমরা হয়ে থাকতাম কয়েকদিন আর ফন্দি আঁটতাম কিভাবে ওই সীটটা পাওয়া যায়! কোনও ঘুষ দিলে কেমন হয়? তখন আমার কাছে এক দেড় টাকা জমানো পয়সা থাকতো। পরেরদিন ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম -''ভাইয়া আইসক্রীম খাবি"? সে উত্তর দেয়-''আচ্ছা নিয়ে আয়"! আমি তো খুশিতে ডগমগ-এবার কাজ হবে! আট আনা দিয়ে ভাইয়াকে আইসক্রীম কিনে দিলাম সে খেয়ে দেয়ে বলল ''আইসক্রীমটা স্বাদ লাগলো না"। আমি আবারও হতাশ। ''অন্য কিছু কিনে দেই''? সে বলতো -''না"। আমি মোটামুটি নিশ্চত হতাম জানালার ধারের সীট আমার কপালে নেই!

ট্রেনের নাম উত্তরবঙ্গ মেইল। ছাড়বে রাত ১১:৩০ মিনিটে। আমরা ষ্টেশনে উপস্থিত হতাম রাত ১০ টার মধ্যে। আমাদের সবার প্রশ্ন এত আগে গিয়ে কি লাভ? বাবার এক কথা- ''কখনও কোথাও গেলে লেট করে যেতে নেই। আগে গেলে কোনও ক্ষতি নেই এবং তাড়াহুড়া করে কোনও কাজ করতে নেই''। আমরা বিরক্ত হতাম। কিন্তু কথাগুলো অনেক বড় সত্য। আমার বাবা তার চাকরী জীবনে কোনওদিন দেরী করে অফিসে যান নি। এবং নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগেও অফিস থেকে বের হতেন না।

ট্রেন ছাড়ল। আমার মন খারাপ। বড় ভাই বোন দুজনের দখলে দুই সীট। তারা মনের আনন্দে বাইরের দৃশ্য দেখছে আর সেগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। আমি মাঝে মাঝে সীট থেকে একটু উঠে গলা লম্বা করে কিছুটা দেখার চেষ্টা করি। আমার বড়ো ভাই আমাকে সরিয়ে দেয়। আমার মন এতে আরও খারাপ হতে থাকে। আধাঘন্টা যাওয়ার পর আমার মন যখন চূড়ান্তরকম খারাপ তখন হঠাৎ ভাইয়া বলে উঠে ''এবার তুই বস এখানে''-এই বলে সে মাথার উপড়ে ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত জায়গায় চলে যায় (আগেকার দিনে প্রত্যেক ট্রেনে ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল)। আমার আনন্দ দেখে কে! ট্রেন যাত্রার বাকীটা সময় সে কখনই তার জায়গা ফেরত চাইত না।

আমার বড় ভাইটা প্রত্যেক বছরই এই কাজ করত। আমার মন চূড়ান্ত রকম খারাপ করে দিয়ে হঠাৎ আমাকে চমকে দিত! তারপরও প্রত্যেক বছরই আমার মনে ভয় থাকতো-এবার যদি না দেয়! সে ছিলো সত্যিকার অর্থেই দায়িত্বশীল এবং বরাবরই আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করত। তখন বুঝতাম না।

কালের স্রোতে যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। কত ট্রেন কত কত ষ্টেশন ছাড়িয়ে কত দিকে ছুটে গেল- তার হিসাব কে রাখে! আধুনিক সব বিলাশ বহুল বাসের ভীড়ে ট্রেনে চড়া হয় না আজকাল! যাত্রাকাল কমে দাঁড়িয়েছে চার ভাগের একভাগে। যাত্রপথও হয়ে গেছে ভিন্ন।

সেই মানুষগুলোও আজ কে কোথায় চলে গেছে! কেউ ভীন দেশে, কেউবা না ফেরার দেশে! দাদী, বাবা, বড় ভাই তারা আজ আর কেউ নেই। নামহীন কোনও এক রেলগাড়ীতে চড়ে তারা যে কোথায় চলে গেল-কোন অচীন দেশের নাম না জানা ইষ্টিশনের দিকে! আর ফিরে আসেনি। বড় বোনটা সেই কবে লাল শাড়ী পড়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে নতুন স্বপ্নের দিকে। সে এখন স্বামীর সাথে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের গাধা ভাইটা প্রকৌশলী হয়ে উড়াল দিলো সাদা চামড়াদের দেশে। তাও অনেক বছর হয়ে গেলো। বাসায় শুধু আমি আর মা। আমাদের স্বপ্নের রেলগাড়ীতে এখন আমরা দুইজন মাত্র যাত্রী।

এখনও রেলগাড়ীতে চড়লে কিংবা ঘুম না হওয়া কোন মধ্যরাতে যদি দূর থেকে কানে ভেসে আসে রেলগাড়ী ছুটে চলার শব্দ তখন স্মতির মাঝে ডুব সাঁতার দিয়ে খুঁজে ফিরি কমলাপুর রেল ষ্টেশন, টিং টিং ঘন্টা বাজার শব্দ, ধীরাশ্রম, গফরগাঁও, জামালপুর, মেলান্দহ, বাহাদুরাবাদ ঘাট, লাল পোশাকের কুলি, ষ্টীমার, বোনারপাড়া জংশন..........।

আহা! আর একটিবারের জন্য যদি সেই সাতজনসহ স্বপ্নের ট্রেন যাত্রাটা ফিরে পেতাম!

''বেলা যায় আনমনে বেলা যায়
পথে পথে কথা নূড়ি ফেলে যায়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেহুলার ভেলা যায়
বেলা যায় আনমনে বেলা যায়” (সংকলিত)


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৫:০৯
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×