গল্প নং : ০০১
প্রিয় মা,
কেমন আছো? জানি ভালো নেই । কিভাবে থাকবে বলো? সন্তান কথার অবাধ্য হলে কি মা ভালো থাকে? তুমি তো জানো আমি ছোটবেলা থেকেই কথা কম শুনি । এবার না হয় একটু বেশিই অবাধ্য হলাম তোমার ।
জানো মা দূরে থেকেও তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে । মনে পড়ে ছোটবেলায় আমি রাত জেগে একা পড়তে ভয় পাবো বলে, তুমি আমার পাশে বসে থাকতে । তুমি কুপি বাতির নিভু নিভু আলোতে আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়তে । তুমি সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত জেনেও স্বার্থপরের মত তোমায় বারে বারে জাগিয়ে দিতাম । একা একা খুব ভয় পেতাম যে । আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তুমি কি যে খুশি হলে । সেদিন তুমি আমার পছন্দের পিঠা আর গোশত রান্না করেছিলে । এখনও সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে । কতদিন যে হলো খাই না তোমার হাতের রান্না, কতদিন দেখি না তোমায় । মনে আছে মা, আমি যখন না জানিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম, তুমি সে কি হুল স্থূল কান্ডই না ঘটাতে । আমার সামান্য জ্বরে তুমি সারারাত জেগে মাথায় পট্টি দিতে, কিন্তু এখানে জ্বর এলো নাকি এলো না তা দেখার সময় নেই । যখন খেলাধুলো করে ঘেমে নেয়ে বাসায় ফিরতাম তোমার আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতে । সে আঁচলে থাকত এক মা মা মেশানো গন্ধ । জানো মা সেই গন্ধের অনেক অভাব অনুভব করি আজ ।
মা নাফিসা কেমন আছে? শেষবার ও আমার কাছে একটা লাল জামা চেয়েছিল । আনতে পারি নি । বোনটা আমার যে ঐ বার আর কথাই বলল না । ওর অভিমান কি আজও ভেঙ্গেছে?
মা, তুমি কি তোমার এই অবাধ্য ছেলেকে ক্ষমা করতে পেরেছো? কি করি বলো? এক মা কে খুশি করতে যেয়ে আর এক মাকে দুঃখী করতে হলো । তুমি তো তাও অভিযোগ করতে পারো, প্রয়োজনে কিছু চাইতে পারো । এই মা যে তাও পারে না । জন্ম থেকেই নিরবতাই যে তার ভাষা । রাগ করো নাকো মা । তোমার রাগে যে আমার জীবনটা পাপে ভরে যাবে । তুমিই বলো, মা এর বিপদে কি সন্তান নিরব থাকতে পারে? মায়ের কষ্টে কি সন্তান বসে থাকতে পারে? পারে না । এ শিক্ষা তো তুমি দাও নি আমায় । তাই না হয় এবার তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিলাম ।
জানো মা, ওরা আমার মাতৃভূমিকে মেরে ফেলতে চায় । ওদের কালো হাতের থাবা আমার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিতে চায় । আমি সন্তান হয়ে তা কিভাবে মেনে নেই বলো? তাদের লোলাপু দৃষ্টি যে চিরতরে শেষ করে দিতে হবে । যেন কোনদিন আর আমার মায়ের দিকে তাকাবার সাহস না পায় । তাই তো তোমায় না জানিয়েই চলে এলাম । আমি জানি তুমি আমায় আসতে দিতে না ।
মনে আছে মা? ছোটবেলায় একবার আম গাছ থেকে পড়ে যেয়ে শরীরের কয়েক জায়গায় কেঁটে ফেলেছিলাম । আর তোমার সে কি বকা আর মার । এত মারার পরেও তুমি ঠিকই ঔষধ আর ব্যান্ডেজ নিয়ে কাজে নেমে যেতে । মনে আছে বাবার মার থেকে তুমি আমাকে কতবার বাঁচিয়েছিলে । যত দুষ্টুমিই করি আমার বাঁচবার আশ্রয় তো একমাত্র তুমিই । কিন্তু সেদিন আমার পায়ে যে বুলেট এসে বিঁধল তার ব্যাথা-কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না । এরপর হাতে । এরপর বুকে । একটার পর একটা বুলেট এসে বিঁধতে লাগলো । জানো মা কেন? আমি আমার সাথীদের খোঁজ দেই নি বলে ।
তারা বারবার বলেছে, "মুক্তি কিদার হে । বলো ।"
কিন্তু আমি বলি নি । আমার নিরবতার পুরস্কার হিসেবে প্রতিবার আমার উপর কত যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে । তারা জানে না আমি কার গর্ভে ছিলাম । যদি জানতো তাহলে বুঝতে পারতো এ মুখ দিয়ে কথা বের হবে না ।
খুব রক্ত বের হচ্ছে মা । কোথায় তুমি? এবার তো ব্যান্ডেজ নিয়ে এলে না । বকা ও দিলে না । চোখের সামনে শুধু তোমার চেহারাই ভেঁসে উঠছে । হঠাৎ করেই চোখটা বুঁজে যাচ্ছে । খুলতে পারছি নি । তোমায় একবার দেখতে চাই মা । একবার । শুধু একবার ।
ইতি,
তোমার "খোকা" ।
বি.দ্র. : লেখা সম্পর্কে মন্তব্য আশা করছি ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:১১