সামছু মিয়া যখন বাড়ি ফিরছিল তখন অনেক রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হাটবারের দিন রাত করেই বাড়ি ফেরে সামছু মিয়া, বাড়ি ফেরার এই পথটা তার মুখস্ত। সরু রাস্তাটা ধরে কয়েক মাইল হাঁটতে হবে, সঙ্গী থাকলে ভালো, না থাকলে অসুবিধা নেই। লাল শেখ টানতে টানতে গুন গুন করে গান ধরে সে, তার গান শেষ হওয়ার আগেই পথ শেষ হয়ে যাবে, কোন সমস্যা নেই, স্টকে অনেক গান আছে। মাঝপথে যখন এলো সামছু মিয়া দেখল সিগারেট নিভে গেছে, গুন গুন করতে করতে সিগারেটে টান দিতে ভুলে গিয়েছিল। লুঙ্গির গিটে দেয়াশলাই থাকে, হাত দিয়ে দেখল নেই। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল সামছু মিয়ার। এখনো অনেকটা পথ বাকি, সিগারেট একটার পর একটা ধরিয়ে পুরো পথ হেঁটে যাওয়ার মজাই অন্যরকম। বাকি পথটা শুকনো মুখে হাঁটতে হবে। কী গান গাইছিল সেটাও ভুলে গেছে এখন।
সামনে, পথের ধারেই, মা শীতলার ছোট মন্দির, অনেক পুরানো, মন্দিরকে চারপাশ দিয়ে আকড়ে ধরে বেড়ে উঠেছে এক অশ্বত্থ গাছ, বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, দিনের বেলা পথের উপর ঝুঁকে থাকা এই অশ্বত্থের ছায়ায় অনেকেই বিশ্রাম নেয়। কিন্তু রাতের কথা আলাদা। সন্ধ্যার পর একা এই অশ্বত্থ গাছের নীচ দিয়ে একা যাওয়ার সাহস কেউ করে না, কেবল মাত্র সামছু মিয়াই পার হয় এবং অবধারিতভাবে তার হাতে থাকে জ্বলন্ত আগুন, মানে সিগারেট। অথচ আজ এই প্রথমবারের মতো সিগারেটের আগুন নিভে গেল।
এমন নয় যে অশ্বত্থ গাছের নীচ দিয়ে একা একা গেলে কোন সমস্যা হয়, কিংবা হাতে আগুন না থাকলে কোন ঝামেলা হতে পারে, তবু সাবধানের মার নেই বলে, সামছু মিয়ার হাতে সবসময় লাল শেখ থাকে। রাতের বেলা যাদের নাম মুখে আনতে নেই, তারা নাকি আগুন দেখে ভয় পায়। কথাটার সত্যতা এতোদিন পুরোপুরি বোঝা যায় নি। আজ যাবে হয়তো।
সামছু মিয়ার হাঁটার গতি কমে গেছে, তার বয়স সবে ত্রিশ পেরিয়েছে, গ্রামে বেশ কিছু জমি-জমা আছে, গঞ্জে আছে একটা মনোহারি দোকান, এই অল্প বয়সেই চার-চারটা ছেলেপুলে তার, সামনে আরেকজন আসছে। ঘর-ভরা মানুষজন পছন্দ করে সামছু, তাই বউয়ের শত আপত্তিও সে কানে নেয় না। এই যুগে চার-পাচজন ছেলেপুলে কারো হয় নাকি! যাই হোক, সামছু বলশালী পুরুষ, ঘাড় পযন্ত বাবরি চুল, যত্ন করে ছাটা গোঁফ আর গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। কোন কিছুকেই ভয় পায় না, তবে আজ, এক সিগারেট নিভে গেছে এবং দুই, দেয়াশলাই পাওয়া যাচ্ছে না, এতেই কেমন অদ্ভুত এক ভয় তাকে জাঁকিয়ে ধরেছে।
মনে হচ্ছে সামনে খারাপ কিছু হবে, খুব খারাপ কিছু।
অশ্বথ গাছটার নীচে আসতেই গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল সামছু মিয়ার, হঠাত করেই শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে, বৃষ্টির দিন নয়, তাই ধুলোবালি উড়ছে চারপাশে, প্রায় দেখা যাচ্ছে না কিছু। হাঁটা থামিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। দেখা যাক না কী হয়! সবাই বলে তার কলজে ভরা সাহস, কথাটা যে মিথ্যে নয় তা প্রমান করা হয় না অনেকদিন। এর আগে সাহস দেখিয়েছিল মোল্লা বাড়ির লড়াইয়ের কালো ষাড়টাকে শায়েস্তা করে। লড়াইয়ের ময়দানে গিয়ে প্রতিপক্ষ সলেমন মিয়ার ষাঁড়ের সাথে লড়াই না করে সে চারপাশ ঘিরে থাকা জনতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল শিং বাঁকিয়ে। সামছু মিয়া না আটকালে দু’একজন ঐ শিঙের গুতো খেয়ে মারা যেতো নিশ্চিত। কালো পেশিবহুল ষাড়টা সেদিন সলেমন মিয়ার ষাড়টাকে দেখে কেন ভয় পেয়েছিল কে জানে। যাই হোক, দুই হাতে শিঙ ধরে একটা শিঙ ভেঙে দিয়েছিল সামছু মিয়া, তারপর শান্ত হয়েছে রুস্তম, মোল্লা সাহেব বেশ আদর করে রুস্তম নামে ডাকতেন ষাড়টাকে। রুস্তমের আসলে বয়স হয়েছিল, গত শীতে মারা গেল।
তো, কলজেভরা সাহস নিয়ে সামছু মিয়া ধুলোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল, ঠায়। দেখা যাক না কী হয়!
কিছুই হলো না। কিছুক্ষনের মধ্যেই সব দাপাদাপি থেমে গেল। পরিষ্কার হয়ে এলো চারপাশ, শীতল হাওয়াও আর বইছে না। বাড়ির পথে হাঁটতে থাকল সে।
তবে সে একা হাঁটছিল না, তার পেছন পেছন লাল শেখ ধরিয়ে হাঁটছিল অন্য একজন, তার নামও সামছু মিয়া, বলশালী পুরুষ, বাবরি চুল, যত্ন করে ছাটা গোঁফ। সুর করে একটা গানও গাইছিল। বিরহের গান।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০২