নিয়াজের সাথে আমার দেখা হল প্রায় বিশ বছর পরে। প্রথম দেখায় চমকে উঠি। কি ভয়ংকর করে ফেলেছে চেহারা । চাপা ভেংগে গেছে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,চোখ বসে গেছে।ঝাকড়া চুলগুলো বহু দিনের অযত্নে আগের জৌলুশ হারিয়েছে। দৃষ্টি উদভ্রান্ত। নিয়াজ বক্তৃতা দেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেছে। মফস্বল শহরের একটা অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে এসেছি আমি। সরকারী চাকুরির সুবাধে পদাধিকার বলে পেয়েছি এই সম্মান । এত বছর পরে নিয়াজকে দেখে চিনতে একটু ও কষ্ট হয়নি আমার। নিয়াজ বক্তৃতা দিচ্ছে । তার আগের তেজ নেই কন্ঠ স্বরে। কেমন যেন লড়াইয়ে হেরে যাওয়া বিড়ালের মত মিউ মিউ শব্দ। ভার্সিটির দিন গুলোর কথা মনে পড়ে গেল। নিয়াজ আর আমি বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। সে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল।কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল ওর।বেশির ভাগ কবিতার বিষয় বস্তু ছিল প্রতিবাদ। সমাজের অন্যায় ,অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।ঝাকড়া চুল ভার্সিটি লাইফ থেকেই ছিল। ছোট পাঞ্জাবী,আর কাধে ঝোলা ব্যাগ থাকতো একটা। তাতে কবিতা লেখার সরঞ্জাম। চুলের অসম্ভব যন্ত করতো নিয়াজ। সব সময় চুল পরিপাটি রাখতো। চেহারা সুন্দর হওয়ায় মেয়েদের ও আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল কিছুটা।আমরা ওকে মনে মনে ঈর্ষা করতাম। কিন্তু কখনো কোন নারী কেলেংকারীতে জড়াতে দেখিনি তাকে। একটা মেয়েকে ভাল বাসত। নিরুপমা। অসম্ভব ভালোবাসা যাকে বলে।অনেক দিন ধরেই তাদের প্রেম চলছিল। ভাবুক টাইপের ছিল নিয়াজ।তাই তার বন্ধু বান্ধব বলতে আমিই ছিলাম।ওর সব বিষয় আমার সাথে শেয়ার করতো । মাঝে মধ্যে আমি দুই চার লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা যে করিনি। তা না। কিন্তু আল্লাহ সবাইকে সব প্রতিভা দেয় না।কয়েকদিন লিখেই বুঝেছি এগুলো অখাদ্য।যেটা আমাকে দেয়া হয়নি সেটা জোড় করে আদায় করতে যাওয়া পাগলামো বই কিছু না।ভার্সিটি ছাড়ার পরেও নিয়াজের সাথে দুই তিন বছর যোগাযোগ ছিল।পরে জীবনের আর জীবিকার তাগিদে ,ব্যস্ততায় যোগাযোগের পরিমান কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় গিয়ে নামে।অনুষ্ঠান শেষ হলে নিয়াজের সাথে কুশল বিনিময় করলাম ।আমাকের পেয়ে সে খুব খুশি হল।আসার সময় তার ঠিকানা নিয়ে আসলাম ।
২
কাজের চাপে প্রায় ভুলে গেলাম নিয়াজের কথা।একদিন ছুটির দিনে গিয়ে হাজির হলাম ওর বাসায়। টিন শেডের জরাজীর্ণ একটা বাড়ী । তার এক রুমে থাকে সে। একটা খাট আর আলমারী রুমে। সব কিছুতে কেমন অযত্নের ছাপ। অসম্ভব গোছালো নিয়াজের এই রকম রুমের অবস্থা, সত্যি বেমানান।আমাকে দেখে নিয়াজ শশব্যাস্ত হয়ে উঠলো।
-তুই আসবি ফোন দিয়ে আসবি না?
-আমি এমন কি ভি আই পি যে ফোন দিয়ে আসতে হবে ?
-বাজার টাজার করে রাখতাম।
-এত ব্যস্ত হতে হবে না তোকে ।বস এখানে ।
-চুলায় ভাতের সাথে ডিম আর আলু সেদ্ধ দিয়েছি।
-তুই বস এখানে নিয়াজ।
-নিয়াজ আমার পাশে বসল।
- তার পর তোর খবর কি বল ?
-গরীবের খবর কে নেয় বল। ভার্সিটি পাশ করার পর কত স্বপ্ন ছিল ।সমাজ বদলে দিব,আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটা প্রজন্ম গড়বো।
-পেরেছস?!!
- নাহ। তোর ও তো স্বপ্ন ছিল,ফিল্মের হিরো হবি।নতুন নতুন কি ফ্যাশন আসছে ,সেগুলা পত্রিকা দেখে দেখে খবর রাখতি।আর এখন হয়েছিস কি ? আটপৌরে এক সরকারী অফিসার।
বলে হাসলো তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে নিয়াজ। সত্যিই মানুষ যা চায় তা পায়না ,যা পায় তা চায় না।অদ্ভুত মানুষের জীবন।নিয়াজের দিকে তাকালাম।দৃষ্টি তার উদভ্রান্ত।আগের সেই হাজারো স্বপ্নওয়ালা চোখ না এটা। স্বপ্ন বোধ হয় মরে গেছে অনেক আগেই ।স্বপ্নরা মাছের মত।বেশিক্ষণ জীবিত থাকতে পারে না।
- তোর কবিতা লেখার কি খবর ?
- আগে লিখতাম।এখন লিখি না।যে বস্তুর বাজারে চাহিদা নেই,মানুষের আগ্রহ নেই।সেটা আঁকড়ে পড়ে থাকার কোন মানে নাই।কমার্সের স্টুডেন্ট হয়েও লাভ-লসের এই হিসাব বুঝতে সময় লেগে গিয়েছিল। জীবন পদ্যের মত সুন্দর না।গদ্যের মত কঠিন।
- এগুলো হতাশার কথা।হতাশা চোরা বালুর মত।যত ভাববি ,ততো আটকে যাবি।
- নিরূপমা যেদিন পাঁচ বছরের প্রেমকে ইগনোর করে বড়লোক জামাইর সাথে বিদেশ পাড়ি দিল ।তখনো বুঝতে পারি নাই।তখনো চোখে স্বপ্ন ছিল অনেক।ব্যতিক্রম কিছু করে সমাজ বদলে দিব।কখন যে নিজেই বদলে গেছি।সেই হিসাব নেই।
-বিয়ে শাদী করলি না কেন পরে ?
-একটা কথা কি জানিস ?
-কী ?
- আমরা বলি মেয়েদের আবেগ বেশি।আসলে মেয়েরা বাস্তবতা অতি দ্রুত বুঝতে শিখে ।নিরুপমা আমকে কত বুঝাত ।একটা চাকরি নেয়ার জন্য।কই শুনলাম তার কথা। মেয়েটার পরাজিত মুখ এখন ও মুখে ভাসে।কষ্ট লাগে তখন ওর জন্য।ঘৃণা জাগে নিজের প্রতি ।একটা ছেলে একটা মেয়ের থেকে বুদ্ধিতে দশ বছর পিছিয়ে ।
-হুম।
আমার মুখে কোন কথা জোগায় না।নিয়াজ বলে যাচ্ছে।
-পান্ডুলিপি গুলা সব ট্রাংকে তালা মেরে রেখেছি।কোন প্রকাশকই ছাপতে রাজি হল না।কবিতা নাকি বিলাসী দ্রব্য।বিলাসী দ্রব্যের তো আবার ক্রেতা কম জানিস ই।
আচ্ছা বন্ধু,বিএমডব্লিউ গাড়ি,এসি এগুলো ও তো বিলাসী দ্রব্য।কিন্তু বাজারে তো এগুলোর ব্যাপক চাহিদা তাই না!!
অকাট্য যুক্তি নিয়াজের ।কথা যোগায় না ।তাকিয়ে থাকি ওর দিকে।
-বাবা-মা মারা গেছে অনেক আগেই।যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিল।তা দিয়ে তাদের রেখে যাওয়া দেনা মিটিয়েই শেষ হয়ে গেছে।অনেক চেষ্টা করে ও একটা ভালো চাকরি পেলাম না।যত ভালো ডিগ্রীই থাকুক না কেন।মামা-খালুর হিসাবটা না মিলাতে পারলে চাকরি সোনার হরিণই থেকে যায়।
-পরে কিভাবে কি হল ?
- পরে আর কি, গ্রামের লোকজন স্থানীয় এক প্রাইমারী স্কুলে একটা চাকরি ম্যানেজ করে দিল।সেটা দিয়েই কোন রকম চলে যাচ্ছে।
-হুম।
হঠাৎ নিয়াজ গলার স্বর নামিয়ে ফেলল।এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার স্বর।
-আমি আর বেশি দিন বাচবো না রে বন্ধু।
-কেন ,কি হয়েছে তোর ?
-আমাদের পারিবারিক ব্লাড ক্যান্সারের ইতিহাস জানা আছে তোর। দাদা-বাবা দুই জনেই মারা গেল এই ক্যান্সারে ।আমারও ক্যান্সার ধরা পরেছে।
-চিকিৎসা করাচ্ছিস ?
- চিকিৎসা করিয়ে কি লাভ বল ? মরতে তো হবেই।একদিন আগে আর পরে।
একজন মানুষ কিভাবে নিজের মৃত্যুর কথা বলে ফেলতে পারে ।মহামানব ছাড়া সম্ভব না।
-আমার হারানোর কিছু নাই আর ।তাই যতো তারা তারি সম্ভব বিদায় নিতে পারলেই বাঁচি।
অসম্ভব প্রতিভা ধর ব্যাক্তি নিয়াজ।আমাদের মত সরকারী চাকরিজীবী প্রতিবছর ডজনে ডজনে বের হয়।কিন্তু নিয়াজদের মত লোক বছরে একটা জন্মায় কিনা সন্দেহ।অবহেলায় আমরা হারিয়ে ফেলি এদের।
-তোর পান্ডুলিপি গুলো দিস ।আমার পরিচিত একজন প্রকাশক আছেন।তাকে দিয়ে দেখব।
- এই চাবিটা রাখ তোর কাছে।ওই ট্রাঙ্কে আমার পান্ডুলিপি আছে।আমার মৃত্যুত পর যা করার করিস।
আর অনেক কথা হল নিয়াজের সাথে ওই দিন।এত দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে।পুরনো সুখ দুঃখের স্মৃতি চারণ করলাম।ওর হাতের ডিম ভর্তা আর আলু ভর্তা দিয়ে সাদা ঝর ঝরে ভাত অপূর্ব লাগলো।কিছু সময়ের জন্য হল লাইফে ফিরে গেলাম।হলের ক্যান্টিনে কোন দিন খাবারের টান পরলে নিয়াজ আমাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াত ।ওর হাতের আলু ভর্তা আর ডিম সবার প্রিয় ছিল।পার্থক্য শুধু একটাই।তখন আমাদের সবার মনেই স্বপ্ন ছিল।সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের টান। এখন দুই বন্ধু এক সাথে ভাত খাচ্ছি।এখন স্বপ্ন নেই।মানুষ বাঁচে কয়দিন। গড় আয়ু পয়ষট্টি বছর ।আর বেশি হলে পনের বিষ বছর বাঁচবো।জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে আজ নিজেকে তুচ্ছ লাগছে।
নিয়াজ হঠাৎ বলে
- আচ্ছা বন্ধু, রবীন্দ্র নাথের যদি জমিদারী না থাকত।তাহলে কি সে বিশ্ব কবি হতে পারতো ?!
চমকে উঠি ওর কথা শুনে।মানুষ চমকে উঠতে ভালো বাসে।কিন্তু আজ নিয়াজের প্রতিটা কথা অস্তিত্বে গিয়ে আঘাত করছে ।নিয়াজ আপন মনে কবিতা আবৃতি করছে ।স্বরচিত কবিতা
মাটির প্রদীপ নিভিয়া গেল
কোন পবনে ভাও
আমায় তুমি নিয়া যাবা
স্বপন পুরীর গাঁও।
খেতে খেতে চোখ দিয়ে কখন পানি গড়িয়ে পরলো খেয়াল করিনি।
৩
এর পর প্রায় ছয়মাস কেটে গেল।এর মধ্যে সুযোগ পেলেই নিয়াজের সাথে দেখা করতাম।এই পৌঢ়ত্বে এসেও দুই বন্ধু গল্প,আড্ডা দিতে দিতে হারিয়ে যেতাম সেই ভার্সিটির দিনগুলোতে।নিয়াজ গল্প শুনাতো,তার স্বপ্নের কথা বলতো, নিজের গল্প, প্রজন্মের গল্প,দেশের গল্প।আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম।এর মধ্যে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম।সে যেতে চায় নি।আত্ম মর্যাদা অনেক নিয়াজের।অন্যের টাকায় চিকিৎসা করানোটা মেনে নিতে পারছে না হয় তো। এক সময় আমি ও হাল ছেড়ে দিলাম। একদিন গভীর রাতে ফোন বেজে উঠলো।গভীর রাতের ফোন গুলো সব সময় দুঃসংবাদ নিয়ে আসে।এটা ও ব্যতিক্রম হল না।নিয়াজ মারা গেছে ।তাড়া তাড়ি বের হয়ে গেলাম।নিয়াজের লাশ শেষ বারের মত দেখলাম। হাসি খুশি নিয়াজ।মারা যাওয়ার পরে ও একটুকরো হাসি লেগে আছে ওর মুখে । ব্যাঙ্গের হাসি। এই দুনিয়াকে ব্যাঙ্গ করছে যেন।চোখ দুটো খোলা, ঘোলাটে চোখে কোন স্বপ্ন নেই ।আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখে আছে একরাশ হতাশা।আছে ব্যাঙ্গ ।এই ব্যাঙ্গ আমাদের জন্য,এই ব্যাঙ্গ সমাজের জন্য,এই ব্যাঙ্গ পুরো দেশের জন্য ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৫২