


সিরিজের সব লেখা: Never Underestimate Anybody: জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প
২০০১ সালের জুলাই মাসের কোন এক মধ্য দুপুর, আমি ঢাকা শহরের অন্যতম সেরা বাসগুলোর একটি, সদরঘাট টু গাবতলী ভায়া আজিমপুর এর সাত নম্বর
বাস বকশীবাজার আসতে আমার পাশের সিটে বছর পঞ্চাশ কি ষাটের এক পৌঢ় লোক এসে বসল। একবার মাথা তুলে দেখে নিলাম। একটু পর শুরু হল যন্ত্রণা, লোকটা ঝুঁকে পরে আমার নোট দেখতে লাগলো, কি পড়ছি তার পাঠোদ্ধারে যেন নেমে পড়েছে। এমনিতেই গরমে ভালো লাগছে না, বাইরে এক ফোঁটা বাতাস নাই, তার উপর শুরু হয়েছে এই নতুন উপদ্রব। মেজাজ একটু একটু করে চড়তে লাগলো। আড় চোখে দেখে নিলাম লোকটাকে। চোয়াল ভাঙ্গা হালকা পাতলা গড়নের মানুষ, পড়নে মলিন সাদার মাঝে চিকন কালো স্ট্রাইপের একটা শার্ট, কুচকে যাওয়া কালো প্যান্ট। মুখে দু’তিন দিনের শেভ না করা সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা। আমি মনে মনে তাকে গালি দিচ্ছি আর চোখ বুলাচ্ছি আমার নোটে। উফ! কেন যে এই ব্যাটা আমার পাশের সিটে এসে বসলো। আরে আঙ্কেল এটা ফিজিক্সের নোট, কোন গল্প উপন্যাস বা চটি নয়, যে কি পড়ছি তা আপনার অনুসন্ধান করতে হবে।
একসময় বিরক্তির চরমে পৌঁছে নোট বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি হেনে বসে রইলাম। দরকার নাই আমার রিভিশন দেয়ার, মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা রাখি। নাহলে এক্সাম পুরোই লাটে উঠবে। গাড়ী ঘণ্টাখানেক চলে এখন হোটেল আল রাজ্জাকের সামনে বংশালের সংযোগ মুখটায় জ্যামে আটকে আছে। সিদ্দিকবাজারের এই সিগন্যালে অনেক সময় নেয়। এমন সময় পাশ থেকে ঐ বয়স্ক আঙ্কেলের ডাকে যেন বাস্তবে ফিরলাম, এতক্ষন কি ভাবছিলাম যেন? ও হ্যা, ইকুয়েশনগুলো মনে আছে কিনা নিজে নিজে টেস্ট করছিলাম মনে মনে...
‘বাবা, তোমার কি আজ পরীক্ষা? ফিজিক্সে পড়? কোথায়?” ও মোর খোদারে। আমি পুরাই টাস্কি খেয়ে গেলাম। ব্যাটা কয় কি মামা! আমি ফিজিক্সে পড়ি উনি জানলো কেম্নে? একটু ভাবতেই কেমন সন্দেহ হল... তাহলে কি...
‘জী, জগন্নাথে, সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল...’
‘ও...’ বলে লোকটা একটা মায়া মায়া মুখ করে হাসি দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল। এদিকে আমি মনে মনে হিসেব চালিয়ে গেলাম, এবং সন্দেহ অমুলক কি না জানতে, উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনি কি করেন আঙ্কেল?’
‘আমি? আমি এখন রিটায়ার্ড পারসন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে ছিলাম’ আমি একটা ঢোক গিললাম। সাহস করে প্রশ্ন করে বসলাম...
‘আপনি কিসে পড়াশোনা করেছেন আঙ্কেল?’
‘আমি... বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিলাম.....’
এটুকু শুনেই আমি এতো লজ্জা পেলাম যে, মনে হল জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালাই। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়। আঙ্কেল উনার গল্প যত বলে যেতে লাগলেন আমি তত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে লাগলাম। একসময় মনে হল আমি গালিভার’স ট্র্যাভেল এর লিলিপুট হয়ে গেছি।সেদিন আমি কোনমত এক্সাম দিলাম, এক্সাম খুব খারাপ হল। আমার মাথায় একটা জিনিষ ঢুকে গেল... নেভার আন্ডার এসটিমেট এনিবডি।এরপর থেকে একটা রিকশাওয়ালা দেখলে, এমন কি ভিক্ষুক দেখলেও মনে হত এর পেছনে না জানি কোন সত্ত্বা লুকিয়ে আছে।
২০১৩
এরপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’য় অনেক পানি গড়িয়েছে। আমি ভাগ্য অন্বেষণে ফিজিক্স বাদ দিয়ে আইবিএ থেকে এমবিএ করে সাথে প্রফেশনাল একাউণ্টেন্সি কোর্স করে একটা মাঝারী মানের কোম্পানি’তে ফাইন্যান্সের ইনচার্জ হিসেবে যব করছি, তখন একযুগ পেরিয়ে ২০১৩। সেই ঘটনার আগে আমার লাইফ ইস্টাইল ছিল পুরাই উরাধুরা, লম্বা চুল, জিন্স-টি শার্ট, হাত ভরা ব্রেসলেট; পড়ালেখা কম, আড্ডাবাজী বেশী। আজ স্টেডিয়ামে খেলা তো কাল কোনখানে কনসার্ট; তার পরের দিন হয়তো চলে গেলাম কোন দোস্তের সাথে তার গ্রামের বাড়ী বেড়াতে। সংক্ষেপে খাও-পিয়ো-মৌজ কারো। কিন্তু ঐদিনের সেই ধাক্কা আমার লাইফ স্টাইলে সজোরে একটা ধাক্কা দেয়। আমি বদলে যেতে থাকি একটু একটু করে।
২০১৩’তে এসে আজ আমার প্যান্ট গোড়ালির উপর ফোল্ড করা থাকে, সাথে সাদামাটা পাঞ্জাবী। আমার এমডি স্যার একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। তার কাছে কাজ আর মেধাটাই মুখ্য। ফলে আমার ড্রেসআপ নিয়ে তিনি কোন কমপ্লেইন করেন নাই, আগের দুটো যবে যা খুব বেশী ফেইস করতে হয়েছে। এমন নয় যে আমি ফরম্যাল অফিশিয়াল ড্রেস পড়ি না, কিন্তু আমি এই ড্রেসেই কমফোর্ট ফিল করি। এই কোম্পানিতে জয়েন করার সময় এমডি স্যারকে ব্যাপারটা বলতেই উনি নির্ভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি যে পোষাকে সাচ্ছন্দ বোধ করেন, তাই পড়ে অফিস করবেন। আমার দিক থেকে কোন অবজেকশন নেই’।
তো জয়েন করার পরপরই একটা বেসরকারি ব্যাংকের সাথে দশ কোটি টাকার একটা লোণ প্রসেসিং দিয়ে আমার কাজ শুরু হয়। লোণ প্রোফাইল তৈরি থেকে শুরু করে সিআইবি রিপোর্ট পর্যন্ত সব কাজ আমি নিজেই করতে থাকি। প্রায় দিনই ব্যাংকে যাই, লোণের প্রসেসিং রিকয়ারমেণ্ট এর জন্য নানান ডকুমেন্টস নিয়ে, কখনো কোন ম্যাটার ক্লারিফিকেশনের জন্য। তো ব্যাংকের পক্ষ থেকে একজন এক্সিকিউতিভ অফিসার আমার সাথে ডিল করতো শুরু থেকেই। ফলে সরাসরি প্রথম দিকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সাথে আমার কাজ করতে হয় নাই, আর আমি নিজেও আগ বাড়িয়ে গিয়ে পরিচিত হই নাই। কেননা ম্যানেজারের সাথে ইনিশিয়াল ডিলটা এমডি স্যার নিজে করেছেন।
তো যাই হোক, ফাইন্যালি একসময় কিছু কিছু কাজে আমাকে ম্যানেজারের কাছে যেতে হয়েছে, বিভিন্ন রিপোর্ট আর ডকুমেন্ট নিয়ে। আমি আগেই বলেছি আমি নিজে সব কাজ করতে পছন্দ করি, ফলে বড় কাজ – ছোট কাজ বলে কিছু মাথায় থাকে না। ফলে এমনও হয়েছে আমি একটা ডকুমেন্ট হ্যান্ড ওভার করতে গিয়ে ম্যানেজারের রুমের বাইরে আধঘণ্টা অপেক্ষা করেছি, কখনো তার রুমে গিয়ে পাঁচ-দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেছি... উনি তখন মহাব্যাস্ত ব্যাক্তিগত ফোনালাপে। হয়ত আমারই ভুল, কিন্তু একটা মানুষকে দশ মিনিট দাঁড় করিয়ে না রেখে একটু বসতে বলার ভদ্রতাটুকু তো দেখাতে পারতেন। যাই হোক, পরে জেনেছি উনি আমাকে আমাদের অফিসের পিয়ন ভেবেছিলেন
লোণ হেড অফিস থেকে স্যাংশান হয়ে আসার পর এমডি স্যার আমাকে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন, সাথে কিছু উপঢৌকন
(ঘটনাটি আমার খুব কাছের এক বন্ধুর জীবন থেকে নেয়া)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




