somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেনস (প্রথম পত্র) - পরিমহল এবং চাশমেশাহী (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বঃ শ্রীনগর শহর পরিভ্রমনঃ হযরতবাল মসজিদ এবং শঙ্কর আচার্য পাহাড় চূড়া-মন্দির (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)

শঙ্করাচার্য হিল এবং টেম্পল দেখে আমরা রওনা হয়েছিলাম মুঘল গার্ডেন দেখতে। সমস্যা হয়েছিল আমার আর আমাদের ড্রাইভার এবং গাইড সাহিলের ভুল বুঝাবুঝি’তে। শঙ্করাচার্য মন্দিরের সাথে একই পাহাড়ের পাশেই রয়েছে পরিমহল নামক একটি মুঘল স্থাপনা কাম গার্ডেন, আমরা সেটা ভ্রমণ না করে এগিয়ে গিয়েছিলাম চাশমেশাহী, নিশাত আর শালিমার; এই তিন মুঘল গার্ডেনের দিকে। ফলে, শেষে যখন শালিমার গার্ডেন পৌঁছে সাহিলকে বলা হল এরপর যাব পরিমহল, ও বলল, ‘স্যার জী, উও তো বাহুত পিছে ছোর আয়ে, শাঙ্কারিয়া হিল কা নাজদিক। আপকো পাহেলে বোলনা চাহিয়েথা না’। আমি আর কি করি, আমি তাকে বলেছি মুঘলা গার্ডেন মে চালো, পরিমহল যে ঐ পথেই সে তো আর আমার জানা নেই। ফলে কি আর করা এই একটা মুঘল গার্ডেন দর্শন বাদ গিয়েছিল এবারের কাশ্মীর দর্শনের তালিকা থেকে। কিন্তু আপনাদের কি আর বঞ্চিত করতে পারি? চলুন এর ইতিহাস আর ছবি দেখে নেই প্রথমে, এরপরে না হয় করব ‘চাশমেশাহী’র গল্প।





পরীমহল অনিন্দ্য সুন্দর একটি মুঘল স্থাপনা। সাতটি ছাঁদের উপর সুসজ্জিত এই স্থাপনার পরতে পরতে রয়েছে মোঘল স্থাপত্যের ছোঁয়া। ‘জাবারওয়ান’ পর্বতশ্রেণীর কোলে অবস্থিত এই স্থাপনা ও বাগান ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এই বাগানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, এখান থেকে পুরো শ্রীনগর শহর দেখা যায়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সময়ের স্থাপত্যকলা এবং চিত্রকলার অনন্য নিদর্শন’র ছায়া এখানে দেখা যায়। মুঘল যুবরাজ দারাশিকো’র জন্য এটা নির্মাণ করা হয় ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এটা মূলত ছিল যুবরাজের পাঠাগার এবং তাকে ঘিরে সাজানো বাগান। ১৬৪০, ১৬৪৫ এবং ১৬৫৪ সালের দিকে যুবরাজ দারাশিকো এখানে বসবাস করেছিলেন বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। পরবর্তীতে এই মহল আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে এস্ট্রোলজি এবং এস্ট্রনমি’তে এটার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে এই বাগান শ্রীনগর সরকারের অধীনে রয়েছে।





ভূস্বর্গ কাশ্মীরে পরীর নিবাসখ্যাত এক মুঘল স্থাপনা এবং তার সন্নিকটস্থ বাগান’কে কেন্দ্র করে এই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ‘পরীমহল’ অবস্থিত। শ্রীনগরের ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের ‘জাবারওয়ান’ পর্বত শ্রেণীর এই মুঘল স্থাপনায় দেখা মেলে ষোড়শ শতকের মুঘল স্থাপত্য এবং চিত্রকলার অনন্য নিদর্শন। সুপ্রশস্ত বাগান ঘেরা এই স্থাপনায় একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মঠ ছিল, পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র দারাশিকো’র পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে এস্ট্রোলজিকাল স্কুল গড়ে তোলা হয়। শ্রীনগরের অন্যান্য মুঘল গার্ডেনগুলোর মত এখানে কৃত্রিম ঝর্ণা বা ফোয়ারা দেখা যায় না। এর মূল কারণ, এখানে বাগানে পানি প্রবাহিত হয় মাটির তলদেশে স্থাপিত পাইপ দিয়ে প্রবাহিত পানির ধারা হতে। এখানে মোট সাতটি চত্বর দেখা যায়, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ ফিট এর কাছাকাছি এবং প্রস্থ ১৭৯ ফিট থেকে ২০৫ ফিট পর্যন্ত বিস্তৃত।





উপরের দিকের চত্বরগুলো দুটি ভিন্ন স্থাপনায় বিভক্ত; ডাল লেকের দিকে মুখ করা ‘বারাহদ্বারি’ নামক কক্ষ এবং পাহাড়ের দিকে ছিল জলাধার যেগুলো পর্বতের উপর হতে প্রবাহিত ঝর্ণা হতে প্রবাহিত পানিতে পূর্ণ হত। আজ আর সেই জলধারা নেই, আছে শূন্য জলাধারগুলো। এগুলো পাথরচূর্ণ আর চুনা দিয়ে তৈরি মিশ্রন দ্বারা নির্মিত এবং দুটি ছোট খিলানযুক্ত। একটি চত্বর এর নীচে অন্য চত্বর, এমন করে তৈরি হয়েছে এগুলো। প্রতিটি হতে নিম্নের চত্বরে প্রবাহের জন্য নালা কাঁটা আছে। প্রতিটি স্তরের নির্মাণ কৌশল এবং স্থাপত্যকলা তৎকালীন অনন্য নির্মাণশৈলী’র সাক্ষী দেয়। স্থাপত্যকলা এবং তদসংলগ্ন বাগানের অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে আজও এই পরিমহলে ছুটে আসে হাজারো পর্যটক।







পরিমহল না দেখেই আমরা ছুটেছিলাম ‘চাশমেশাহী’র পাণে। ডাল লেক ঘেঁষে চলে যাওয়া পিচঢালা পথে, মেঘলা আকাশ আর ডাল লেকের জলে তার প্রতিচ্ছবি, সম্মুখে পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের খেলা, অপরূপ ছিল সেই ছুটে চলা। শঙ্কর আচার্য হিল হতে অতি অল্প সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম মুঘল গার্ডেন ‘চাশমে শাহী’র প্রাঙ্গনে।











রাজকীয় বসন্তের আবেশে সাজানো মুঘল গার্ডেন ‘চাশমে শাহী’র স্থাপনাটি ১৬৩২ সাল নাগাদ সম্রাট শাহজাহানের তৎকালীন গভর্নর আলী মারদান খান নির্মাণ করেন। মূলত এটা নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল সম্রাট কর্তৃক তার প্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকো কে উপহার দেয়া। ডাল লেকের প্রান্ত ঘেঁষে ‘রাজ ভবন’ সংলগ্ন এই মোঘল বাগানটিও ‘জাবারওয়ান’ পর্বতশ্রেণীর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।





এই বাগানের নামকরণ নিয়ে যে ইতিহাস পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক এই বাগানের নামকরণ করা হয় কাশ্মীরের বিখ্যাত মহিলা ধর্মীয় সাধক ‘রুপা ভবানী’র বংশীয় উপাধি ‘সাহিব’ থেকে। ‘চাশমে সাহিবি’ নামে খ্যাত এই বাগান যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়ে আজ ‘চাশমেশাহী’ নামে পরিচিত। চাশমে শাহী বলতে মূলত বুঝায় রাজকীয় ঝর্ণাধারা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্ণার প্রবাহিত জলধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই বাগানের ফুলের বাহার দেখলে আপনিও এর নামের সার্থকতা খুঁজে পাবেন। এই চাশমেশাহী’র পূর্ব দিকে গড়ে তোলা হয়েছিল পরিমহল, যা ছিল সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো’র এস্ট্রলজি শিক্ষার জন্য নির্মিত। চাশমেশাহী বাগানটি ১০৮ মিটার লম্বা এবং ৩৮ মিটার প্রশস্ত; এবং পূর্ণ বাগান এলাকা এক একরের বেশী জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে; যা অন্য দুটি বাগানের চেয়ে অনেক ছোট আয়তনের।





অন্যান্য মোঘল বাগান স্থাপনাগুলোর মত এই বাগানের স্থাপনাশৈলীতেও ইরানীয় শৈল্পিক এবং স্থাপত্যকলার ছাপ সুস্পষ্ট, দেখতে পারস্যের বাগানগুলোর অনুরূপ। স্থাপনার মূল মধ্য অংশ দিয়ে প্রবাহিত জলধারা এই বাগানকে দিয়েছে অনন্য রূপ। পাহাড়ি ঝর্ণাধারাকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করে তিনধাপে এই বাগানটি সাজানো হয়েছে। দ্বিতল একটি স্থাপনা রয়েছে প্রথম ধাপে, যা মূল ঝর্ণাধারার সাথে সংযুক্ত। একটি বিস্তৃত জল প্রবাহ পথে ঝর্ণাধারা হতে পানির ধারা পরের অংশে প্রবাহিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে একটি কৃত্রিম জালাধার, যার মাঝে রয়েছে একটি কৃত্রিম ফোয়ারা, এখানে প্রথম অংশ হতে জল এসে জমা হয় এবং পরবর্তীতে একটি মসৃণ পথ বেয়ে শেষ ধাপে নেমে আসে ঝর্নার জল। শেষাংশ রয়েছে প্রবেশ পথের সম্মুখে, এর তলদেশ দিয়ে পানি গিয়ে মিশে বিখ্যাত ডাল লেকে। এই বাগানের মূল পাহাড়ি ঝর্ণার জলকে পবিত্র এবং রোগমুক্তি গুণ সম্পন্ন মনে করা হয়। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই জলের গুণে মুগ্ধ হয়ে সাথে করে দিল্লী পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন।





চাশমেশাহী বাগানটি শ্রীনগর এয়ারপোর্ট হতে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে রাজভবনের সন্নিকটে অবস্থিত। ডাল লেকের তীর ঘেঁষে এই বাগান হতে ডাল লেকের অপূর্ব রূপ দেখা মেলে। এই বাগান মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে ভ্রমণের সেরা সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর। আমরা গিয়েছিলাম অক্টোবর এর দ্বিতীয় সপ্তাহে। ফুলে ফুলে ছেয়ে ছিল পুরো বাগান। তাই তো দলের সবাই বাগানে ঢুঁকে যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছবি তুলতে, সাথে রূপের সাগরে ডুব দিতে।

পরের পর্বঃ নিশাতবাগ - কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেন (দ্বিতীয় পত্র) (কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)















সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২০
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×