somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রীনগর শহর পরিভ্রমনঃ হযরতবাল মসজিদ এবং শঙ্কর আচার্য পাহাড় চূড়া-মন্দির (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আগের পর্বঃ শ্রীনগর এর দুই বিস্ময় - নাগিন এবং ডাল লেক (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই হাউজবোটের সামনের বারান্দা বা ব্যালকনি, যাই বলি না কেন, সাজানো ফাঁকা জায়গাটায় চলে এলাম। সামনের নাগিন লেকের পুরোটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ঘোরলাগা হয়ে আছে, আকাশ মেঘে ঢাকা, সেই সাথে শীত একটু বেশী মনে হল। আজ আমাদের শিডিউল মুঘল গার্ডেনসমূহ ঘুরে দেখার, আর আজই কি না এল বৃষ্টি! সবই হল কপাল, কপালের নাম গোপাল!!! :P । আগের লেখায় বলেছিলাম, আমাদের দশজনের গ্রুপের জন্য দুটো হাউজবোট ছিল, যার একটিতে আমি আর মুক্তার ছিলাম, অন্যটিতে বাকী সবাই। একটু পর অন্য বোটে চলে এলাম সবার খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখি ইয়াসমিন আপা ফুলের নৌকায় (শিকারা) চড়ে ঘুরে এসেছে ভোরবেলার নাগিন লেক, কিনেছে বাহারি রঙ্গিন সব ফুল, সদ্য বাগান থেকে তোলা। আমি যখন ওখানে পৌঁছলাম, তখন আরেক শিকারা করে একজন স্যুভেনিয়র আইটেম নিয়ে এসেছে। লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, অর্নামেণ্টস বক্স, কাঠের খেলনা শিকারা, ছেলেদের মাথার টুপি এরকম নানান জিনিষ রয়েছে তার কাধের বিশাল ঝলার মাঝে; ঠিক আমাদের দেশে আগে যেমন ‘লেইসফিতা’ওয়ালাদের কাঁধে সাদা কাপড়ে বাঁধা ঝোলা দেখা যেত, তেমনটা। এই সাত সকালেও টুকটাক শপিং হয়ে গেল কারো কারো। সাড়ে আটটা নাগাদ নাস্তা করে সবাই ব্যাগপত্তর নিয়ে যখন তৈরি হাউজবোট থেকে চেক আউট করতে, তখন শুরু হল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কি আর করা! এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই শিকারা করে নাগিন লেকের অপর পাড়ে গিয়ে উঠে পড়লাম সাহিলের টেম্পু ট্র্যাভেলার এ; বেশ আগেই সে ওখানে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।











আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল হযরতবাল মসজিদ, কাশ্মীরের অন্যতম ধর্মীয় তীর্থস্থান, যা শ্রীনগরে অবস্থিত। উর্দু শব্দ Hazrat অর্থ ‘সম্মানিত’ আর bal অর্থ স্থান; যার সার্বিক অর্থ দ্বারায় সম্মানিত স্থান। ডাল লেকের বাম তীরবর্তী এই দরগা শরিফ এবং মসজিদ অবস্থিত। এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একগাছি পবিত্র চুল মোবারক সংরক্ষিত আছে পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। ১৬৩৫ সালে মুসলিম ধর্ম প্রচারক সৈয়দ আবদুল্লাহ মদিনা হতে ভারতে আসেন ইসলাম ধর্মের প্রচারের জন্য; সাথে করে উনি নবীজির এই স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে আসেন। উনি ভারতের হায়দ্রাবাদের বিজাপুরে আস্তানা গড়েন। উনার মৃত্যুর পর উনার ছেলে সৈয়দ হামিদ পারিবারিক অসামর্থ্যের দরুন এই পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন বিক্রি করে দেন ধনী কাশ্মীরি ব্যবসায়ী খাজা নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী’র নিকট। পরবর্তীতে যখন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এটা জানতে পারেন, তখন উনি তা বাজেয়াপ্ত করেন উক্ত ব্যবসায়ী’র নিকট হতে এবং তা প্রেরণ করে দেন আজমীরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর দরগায়; সাথে নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী’কে প্রেরণ করেন জেলখানায়। পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজের ভুল অনুধাবন করেন এবং নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী’কে মুক্ত করে দিয়ে পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন’টি উনাকে বুঝিয়ে দিতে মনঃস্থ হন। কিন্তু ইতোমধ্যে নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী বন্দী থাকাকালীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৭০০ সালে নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী’র মৃতদেহের সাথে এই স্মৃতিচিহ্নটি পুনরায় পৌঁছে কাশ্মীরে। সেখানে ‘ইনায়াত বেগাম’, নূর-উদ-দ্বীন ঈসায়ী’র কন্যা, ঐ স্মৃতিচিহ্নের অধিকার বুঝে নেন এবং এটাকে কেন্দ্র করে একটি দরগা নির্মাণ করেন; যা আজকের বিখ্যাত হযরতবাল মসজিদ। পরবর্তী সময়ে তার বংশধর এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এটার তত্ত্বাবধান করে আসছেন।









হযরত বাল মসজিদ পৌঁছলাম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। কয়েকজন গাড়ী হতে নেমে কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকল, আমি পাশের পুলিশ ফাঁড়ির মত একটা ক্যাম্পের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। স্থানীয় পুলিশের কাছে গতকাল রাতের গুলির শব্দের কারণ জানতে চাইলে বলল, সেরকম কিছু ঘটার খবর পায় নাই। হয়ত অন্যত্র হয়েছে, কিংবা কোন বিয়ের অনুষ্ঠানের আতশবাজির শব্দ, রাতের বেলা গুলির মত শোনা গেছে। যাই হোক, এখান হতে আমরা রওনা হলাম সঙ্করচারিয়া (শঙ্কর আচার্য) হিল’এর উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে গাড়ী থামানো হল এজেন্টের অফিসের সামনে। আমি সাহিল’কে নিয়ে নেমে গেলাম, অফিসে ঢুঁকে ছোট রিসিপশন রুমে বসলাম। মিনিট খানেকের মধ্যে সুমায়রা জারগার রুমে ঢুকল, কালো এরাবিয়ান বোরকা পরিহিত, হিজাব দিয়ে মাথা আবৃত, বছর বিশ-পচিশের কাশ্মীরি তরুণী। এর আগে ফোনে একদিন কথা বলেছিলাম, আর টানা দুই মাস মেইল আদান প্রদানের মাধ্যমেই আমাদের এই কাশ্মীর ট্যুর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। ঢাকা থেকে কিনে নেয়া গিফট তাকে দিলাম আমাদের দলের পক্ষ হতে, সাথে বকেয়া পেমেন্ট পরিশোধ করলাম। সাথে করে অফিসে ভেতরে ঢুকলাম, পরিপাটি গোছানো সুন্দর অফিস, পনেরজনের মত যুবক-যুবতী ভিন্ন ভিন্ন ডেস্কে কাজ করছে। লেনদেন শেষ হলে আমরা বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের গাড়ীতে, সাথে নিয়ে এলাম সুমায়রা’র সুন্দরতম মুখচ্ছবির স্মৃতি এই হৃদয় ললাটে। :P











গাড়ী এবার সোজা রওনা হল সঙ্কারচারিয়া হিলের দিকে। পথ ডাল লেকের পার ঘেঁষে পিচ ঢালা রাস্তা, গাড়ীর জানালা দিয়ে দেখছিলাম মেঘে ঢাকা আকাশ আর পাহাড়ের কোল জুড়ে স্থির দারিয়ে থাকা ডাল লেকের অপার সৌন্দর্য। একসময় পাহাড়ের গা বেয়ে চমৎকার বাঁকানো রাস্তা দিয়ে গাড়ী উঠতে লাগল। সিকিউরিটি চেকিং এর পর একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব গাড়ী উঠল, এর পরের বাকী পথটুকু হেঁটে উঠতে হয়। মিতা রায় সহ বেশ কয়েকজন উপরের দিকে হাঁটা শুরু করল। আমি গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে পাখীর চোখের এঙ্গেলে শ্রীনগর শহর দেখতে লাগলাম।













শ্রীনগরের ‘জাবারওয়ান’ পর্বত যা ‘সুলায়মান হিল’ এবন ‘শাঙ্কারায়া হিল’ নামেও পরিচিত, এর চূড়ায় রয়েছে শঙ্কর আচার্য মন্দির, হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান। শ্রীনগরের সমতল ভূমি হতে প্রায় ১,০০০ ফিট উপরে অবস্থিত এই শিব মন্দির দর্শনে হিন্দু পুন্যার্থীদের সাথে অসংখ্য পর্যটক এরও সমাগম ঘটে। এই চূড়া হতে শ্রীনগর শহরের ভিউটা অসাম। ধারনা করা হয় খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমান স্থাপনাটি ৯০০ খৃষ্টাব্দের।। ইতিহাস হতে জানা যায়, এটি ছিল মুলত বৌদ্ধ তীর্থ, পড়ে নবম শতকে শিখদের দ্বারা নবম শতকে এখানে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পাহাড় এবং মন্দির নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে মতানৈক্য এবং বিতর্ক। অনেক ডকুমেন্ট এবং ফিচার পাবেন এই বিসয়ে নেটে সার্চ করলে।









এই পথেই রয়েছে একটি মুঘল গার্ডেন ‘পরিমহল’ যা আমার আর সাহিলের মিস-কমিউনিকেশনের জন্য এবার আর দর্শন করা হয় নাই। আগামী দুই পর্বে থাকবে শ্রীনগরের চারটি মুঘল গার্ডেন আর মেঘ-পাহাড়ের কোলে তাদের অপরূপ ফুল-ফোয়ারা’র ছবিসব।

পরের পর্ব কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেনস (প্রথম পত্র) - পরিমহল এবং চাশমেশাহী (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)

এই পর্বের ছবিঃ
মিতা রায়
রওশন আরা ইয়াসমিন (আপা)
বোকা মানুষ বলতে চায় এবং
কিছু নেট থেকে ধার নেয়া (মসজিদ আর মন্দিরের ছবিগুলো)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৭
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×