নতুন বছর নিয়ে অনেকের অনেক প্রত্যাশা! কিছু প্রত্যাশা সত্যিই পূরণযোগ্য, শুধু চাই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আর মনোবল, ব্যাস!
কিছু কাজ আছে আমরা চাইলেই পারি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি সেইরকম। প্রশ্ন কেন ফাঁস হয়? জানতে হবে পুরো প্রসেসটা।
পাবলিক পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোতে একটি প্রশ্নপত্র প্রনয়ন কমিটি আছে। সেই কমিটি বিভিন্ন বিদ্যালয় বা কলেজের কাছ থেকে প্রশ্ন আহবান করেন। প্রতিটি বিষয়ের উপর কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু কিছু প্রশ্ন জমা পড়ে। এরপর ঐ কমিটি সেই জমা পড়া প্রশ্ন থেকে বাছাই করে সাজিয়ে কয়েক সেট চুড়ান্ত প্রশ্নপত্র তৈরী করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের জানার উপায় নেই তাদের প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছে কিনা। জানবেন শুধু প্রশ্নপত্র প্রনয়ন কমিটির ব্যক্তিবর্গ। আর উনাদের অফিসের কম্পিউটার টাইপিষ্টরা। এরপর সকল সেট চলে যায় প্রেসে। প্রেসে ফাক ফোকর গলিয়ে প্রশ্ন বের হয়ে যেতে পারে কিন্তু সব সেট প্রশ্ন ফাঁস করা কিছুটা কঠিন বটে। তবে সে যাইহোক, অতীতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের বেশীর ভাগ ছিল এমন যেখানে একসেট প্রশ্নপত্র ছাপা হয়, যেমন বিভিন্ন সরকারী নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা। তাই প্রেসকে সন্দেহের বাইরে রাখার উপায় নাই। ছাপা হওয়া প্রশ্ন এরপর খামে সিলগালা হয়ে চলে যায় সকল জেলা, উপজেলার সংশ্লিষ্ট ট্রেজারিতে। পরীক্ষার আগের দিন প্রতিটি কেন্দ্র থেকে একজন যথাযথ প্রতিনিধি ট্রেজারীতে গিয়ে তার কেন্দ্রের প্রশ্ন পত্র আলাদা করে আসেন যাতে পরদিন প্রশ্নপত্র আনতে গিয়ে সময়ের অপচয় না হয়। মজার বিষয় প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে "যথাযথ প্রতিনিধি" হিসেবে অনেক কেন্দ্রের অফিস সহকারী বা পিয়ন এই দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, পরীক্ষার আগের দিন সিদ্ধান্ত হয় কোন সেটে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার দিন সকালে সেই সকল প্রতিনিধিরা ওই সেটটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এত স্টেপ কেন ভায়া! প্রশ্নপ্রত্র প্রণয়ন কমিটি, প্রেস, ট্রেজারী, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়, পরীক্ষা কেন্দ্র। স্টেপ যত বেশি ফাঁক ফোকর তত বেশি। একবিংশ শতাব্দির প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো ছাপাছাপি টানাটানিতে না গিয়ে কি পারিনা। প্রশ্নপত্র প্রনয়ণ কমিটি যখন প্রশ্ন নির্ধারণ করবে তারা কয়েকটি সেট করতে পারে, কারণ সর্ষেতে ভুত আছে আমরা জানি। এরপর পরীক্ষার আগের দিন রাত ১২ টার পর (প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর) কিংবা ভোরবেলা ইমেইল কিংবা ফ্যাক্সের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলাতে নির্দিষ্ট সেটের প্রশ্ন পাঠিয়ে দিতে পারে। যা অতি সহজেই প্রিন্ট কিংবা ফটোকপি করে পরীক্ষা নেয়া যায়। কয়েক সেট করার কারণে প্রশ্নপত্র প্রনয়ণ কমিটির লোকজনের কাছে সব সেট থাকলেও ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় নির্দিষ্ট সেটটি। আর এত লম্বা লাইন এভয়েড করা গেলে চোর ধরাও সহজ হয়ে যাবে। কারন সন্দেহের তীর কেবল থাকবে ছোট্ট একটা কমিটির দিকে। তবে হ্যাঁ, তখন কিন্তু এক্কেবারে আসল সেট পাওয়া যাবে না। প্রশ্ন ফাঁস হবে তিন বা চার সেট। মার্কেটে খুব চলবে বলে মনে হয় না তেমন। বিজি প্রেসে প্রশ্ন ছাপানোর দিন আর আছে বলে মনে হয় না। অনেকে প্রশ্ন ছাপানোতে অসুবিধার অযুহাত তুলতে পারে। কিন্তু যেখানে একঘন্টায় সারাদেশে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে যায় ফটোকপি, প্রিন্টার, ফেসবুক, স্মার্টফোন আর স্মার্টবয়দের কল্যানে; সেখানে ইউএনও অফিসে একখানা প্রিন্টার বা ফটোস্ট্যাট মেশিন না থাকার দোহাই দেয়াটা যুক্তিতে টিকবে কি!
আর এইটা জাস্ট একটা উপায়মাত্র। এরচেয়ে ভালো উপায় হয়তো আছে। প্রতিবার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের পর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী "কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়নি"- জাতিয় ঢাহা মিথ্যা না বলে, উর্বর মস্তিস্কখানা ব্যবহার করে আরো ভালো উপায় চিন্তা করতে পারেন। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা রাতজেগে টকশোতে লেকচার না দিয়ে এ নিয়ে ভাবতে পারেন। সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ একদিনের জন্য পলিটিক্স বাদ দিয়ে এটা নিয়ে ভাবতে পারেন। দেশ ও দশের কল্যান বৈ অকল্যান হবে না। কারণ প্রশ্নফাঁসের চেয়েও মারাত্বক খারাপ হলো এটাকে অস্বীকার করে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করা। উল্লেখ্য ফাসঁকৃত প্রশ্নে পরীক্ষা হচ্ছে এবং শতভাগ প্রমান পাওয়ার পরেও পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে না। এর ফল যে কতটা সুদূরপ্রসারী সেটা বোঝার ক্ষমতাও কারো আছে বলে মনে হয় না। সভ্য কোন সমাজ বা রাস্ট্রে এমন ঘটনা এত সহজে হজম করা কল্পনার অতীত। বাংলাদেশে হচ্ছে। আমার আপনার চোখের সামনে হচ্ছে। আমাদের ভাই-বোনেরা জিপিএ ফাইভ পেয়ে যাচ্ছে, শতভাগ পাস করে যাচ্ছে। কেউ ফেল করছে না।
যাই হোক, আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। নতুন বছরের প্রত্যাশা রইলো কেউ কেউ ফেল করুক, যারা সারা বছর পড়াশোনা না করে আগের রাতে প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকে তারা ফেল করুক, নকলের মহোতসবকারীরা ফেল করুক। যারা প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত তারা ফেল করুক। যারা এঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলকে অবজ্ঞা করে তারাও ফেল করুক। শিক্ষক পলিটিক্স আর দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে নিমগ্ন ভাতারের দলেরা ফেল করুক। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুয়োরছানাগুলাও ফেল মারুক।
নতুন বছর হোক ফেলের বছর। এমন অনেক অনেক ফেল ছাড়া একটা বিবেকবান জাতি গঠনের পরীক্ষায় যে আমরা পাস করতে পারবো না!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:২৭