somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তির সংগ্রাম

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

***

মাথার যন্ত্রণা বেড়েই যাচ্ছে। অথচ আজকে কী ভীষণ খুশি হওয়ার কথা আমার! খুশি পালন করবো দেখে অফিসে যাই নি। মুক্তি-ও সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তি আমার মেয়ে। ক্লাস সিক্সে পড়ে সে। কালকে একটা লাল-সবুজ ব্যানডানা কিনে দিয়েছি। সেটা মাথায় বেঁধে বেশ শক্ত একটা মুখ করে ওর ব্যাডমিন্টন ব্যাটের মাথায় পতাকা লাগিয়ে পাশের বাড়ির জয়ীর সাথে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে মুক্তি। জয়ীর ফোলা ফোলা গালে জলরং দিয়ে একটা আঁকাবাঁকা পতাকা আঁকা। এখন নিজমনে ওরা মিছিল করছে। গান গাচ্ছে...


***

সুফিয়া খালা। মা'র বড় বোন। তাঁকে মনে পড়ছে আজকে।


আমার বয়স যখন চার-পাঁচ তখন ঢাকায় আমরা সরকারী কোয়ার্টারে থাকতাম। আমাদের বাড়িটা বেশ বড়-ই ছিল। ছোটচাচা ছিল, বাবার এক বন্ধু - ইব্রাহীম কাকা ছিলেন একটা ঘরে আর আমরা থাকতাম আরেকটা ঘরে। ছোটচাচা রেডিও শুনতেন প্রতিদিন সকালে, আমি কোলে বসে শুনতাম। একদিন সকালে গিয়ে দেখি চাচা নেই। নেই যে নেই-ই। আর দেখি নি সেদিনের পর। তারপর একদিন দেখি ইব্রাহীম কাকাও কাজ থেকে ফেরেন নি। এভাবে আমাদের একটা একটা ঘর যখন খালি হতে শুরু করলো তখন একদিন নানা আসলেন আমাদের নিতে। নানা আমাদের বাড়িতে এলে একটা উৎসব মনে হতো। গল্প হতো, পড়াশোনা মাফ, ঘুরতে যাওয়া... কতকিছু! কিন্তু সেবার এমন কিছুই হল না। বাবা মা আর আমাকে পাঠিয়ে নিজে থেকে গেলেন। মনে আছে মা খুব কাঁদতো বাবা আসছে না দেখে। চিঠি পেতো মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে। চিঠি পেলেও কাঁদতো, না পেলেও কাঁদতো।


নানাবাড়িতে সুফিয়া খালা আর আমরা ছিলাম। সুফিয়া খালার ছেলে ছিল একটা- নাজিম। আমার চে' বড় নাজিম ভাই। নাজিম ভাইয়ের বাবা মারা গেছেন ওর জন্মের কিছুদিন পরপর। আমি আর নাজিম ভাই খেলতাম, ঘুরতাম। আমরা ভাল-ই দিন কাটাচ্ছিলাম। নানা খুব নামাজ পড়তেন। বসার ঘরটাতে নামাজ হতো; বেশ কয়েকজন একসাথে নামাজ পড়তো। আর রেডিও শুনতেন ওঁরা, কিন্তু লুকিয়ে। নানার সাথে গ্রামের আরো কিছু মানুষ-ও শুনতো রেডিও। নানার কোলে বসে আমি আর নাজিম ভাই-ও শুনতাম রেডিও। মুজিব সাহেব নামের একজন গমগমে গলায় কীসব বলতেন। তাতেই নানা আর বাকীরা "ঠিক ঠিক" বলে মাথা নাড়তেন। নানার এক বন্ধু - কাফী সাহেব - নানাদের হুশিয়ারী করে দিতেন। বলতেন শান্তি চাইলে শান্তি কমিটি যেতে হবে। নানা তাঁর বন্ধুর পাগলামিতে হাসতেন। তাঁর বন্ধুটা নাকি ছোট থেকেই এমন খামখেয়ালী। নানা কাফী সাহেবকে নামাজ পড়তে বলতেন। কাফী সাহেব নামাজে আসতেন না। নানা বলতেন আল্লাহ-ই পারবেন সবাইকে এই বিপদ থেকে রেহাই দিতে।


হুট করে শুনলাম গ্রামে বিশাল বিশাল কুকুরমুখো মানুষগুলো এসেছে। মানুষ মারতে এসেছে। ক্যানো মানুষ মারবে কেউ জানে না। সেদিন রাতেই নানাবাড়ির বাইরের দরজায় ধুমধুম কিল পড়তে লাগলো। কাফী সাহেব ওদের নিয়ে এসেছেন নানাবাড়িতে। নানা খুব অবাক হয়ে গেছিলেন। তাঁর বন্ধু কাফী সাহেব-ই নাকী নানাকে প্রথম গুলিটা মেরেছিল। আমরা শুনতে পাই নানার চিৎকার। আমরা শুনতে পাই অনেক অনেক জোড়ে লাথির শব্দ। আমি মা'র হাত ধরে দৌড়ে পেছনের দরজার দিকে যেতে থাকি। আমি, মা আর নাজিম ভাই। আমার মা ঠিকমতো হাঁটতেই পারছিলো না। মা'র ভেতরে আমার একটা বোন ছিল যে। হঠাৎ দেখি সাথে সুফিয়া খালা নেই আমাদের সাথে। পেছন ফিরে দেখি খালা বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে "আব্বাজী" "আব্বাজী" করে কাঁপছেন। আমার নানাকে সেদিন তাঁর খুব প্রিয় আল্লাহ-ও বাঁচাতে পারেন নি। আমরা দেখলাম সুফিয়া খালাকে টেনেহিঁচড়ে বসার ঘরে নিয়ে গেল ওরা। মা নাজিম ভাইয়ের মুখ চেপে রেখেছিল। নাজিম ভাই থরথর করে কাঁপছিল। আমরা তখন পালিয়ে গিয়েছি। নাজিম ভাই খুব কেঁদেছিল ওর মা-র জন্যে। আমরা এরপর কোনদিন জানি নি নানার কথা বা সুফিয়া খালার কথা বা আমার বাবার কথা। আমরা জেনেছিলাম যে আমরা বেঁচে গেছি কোনভাবে। কতদিন পানিতে, কতদিন বর্ডারে... যেকোনভাবে যেকোনখানে আমরা বেঁচে গেছিলাম।


নাজিম ভাই আজকেও কেঁদেছেন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছেন। আজ ওঁর নিজের ছেলে-মেয়ে আছে। তাও কেঁদেছেন। চিৎকার করে কেঁদেছেন। আজকে সেই ভয়ানক দিনের ৪২ বছর পর সেই কাফী সাহেবের ফাঁসী হয়েছে। আমি জানি না নাজিম ভাই বা আমার মতো আজকে ঠিক কতজন এভাবে কাঁদছে। আমরা কীভাবে বেঁচে ছিলাম গত ৪০ বছর আমরা জানি না। আমার মা বেঁচে ছিলেন। পাথরের মতো বেঁচে ছিলেন। যখন আমরা বাবার লাশ চিনতে গিয়েছিলাম তখনো মা কাঁদে নি। মা ক্যামন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতো না। আঙুল দিয়ে কীসব দেখাতো। ঘুমের মধ্যে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কীসব বলতো। আমি ভেবেছিলাম মা বোধ হয় আর কোনদিন স্বাভাবিক হবে না। আমি আজকে সেই ৪২ বছর পর আমার মাকে কাঁদতে শুনেছি। মা’র কান্না দিয়ে সব ঘৃণা, চেপে রাখা রাগ, প্রচন্ড কষ্ট টপটপ করে পড়ছে। মা আমার একটু হালকা হয়েছে আজকে।


আমরা ঐ কুকুরমুখো মানুষগুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছি একাত্তরে। কিন্তু কাফী সাহেবের মতো খুনীরা কী অহং নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারা সমাজের কাছে এখনো "কাফী সাহেব"। কী ঘেন্না নিয়ে বেঁচে ছিলাম এতোদিন। কী লজ্জা নিয়ে বেঁচেছিলাম। দেশ স্বাধীন হয় নি আমার কাছে কক্ষনোই। আমার চোখের সামনে আমার বাবা-খালার খুনী বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাড়ি চড়ে সেই গাড়িতে "স্বাধীন" বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে টুপী পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। কী প্রচন্ড অসহায়ভাবে জীবন কাটিয়েছি। যখন মুক্তি, মুক্তির বাবা, নাজিম ভাই সহ সবাইকে নিয়ে শাহবাগ গিয়েছি, তখন প্রথমবারের মতো দেখেছি আমরা একা নই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো আমাদের সাথে, ওদের বাবা-মা আমাদের সাথে... পুরো দেশটা আমাদের সাথে! মাকে নেই নি সাথে। বয়স হয়েছে তো। মা দেখি নিজেই চলে এসেছেন। প্রতিদিন। পাথরের মতো মুখ করে বসে থাকতেন। মনে হচ্ছিলো এবার আমি যুদ্ধে নেমেছি। আমার জিততেই হবে।


হুট করে মুক্তি আমাকে ধাক্কা দিল... জয়ী-ও পাশে জড়োশড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

- মা শুনেছো?

- কী?

- আজকে নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে আগুন দিচ্ছে কারা যেনো

- ক্যানো?

- খারাপ লোকটার ফাঁসী হয়েছে যে সেজন্যে। মা জানো দেশ স্বাধীন হয় নি। আবার যুদ্ধ হবে।

- “তারপর?” আমি মুক্তি আর জয়ীকে কাছে এনে জড়িয়ে রাখি। কী সুন্দর যে লাগছে তাদেরকে!

- এই যুদ্ধে আমরা জিতে যাবো, মা। আর তারপর কোন যুদ্ধ হবে না। নতুন বাংলাদেশে শুধু ভাল মানুষগুলো থাকবে। আমরা ওদের এদেশে থাকতেই দিবো না যারা নানার মতো মানুষদের মেরে ফেলেছে। মা প্লিজ কেঁদো না এভাবে... এবার দেশ স্বাধীন হবেই হবে!... আসো তো মা সেই গানটা গাই...

... ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি...
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×