১ম পর্ব : গেস্টাপো
গেস্টাপো নাকি চেকা?
“দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন” বলে একটা টার্ম আছে। এটা সাইকোলজিক্যাল কোন ব্যাপার না বরং ১৯২৯ সালের বিশ্বব্যাপী মহামন্দাকে বলা হয় “দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন”। এসময় কৃষকের উৎপাদিত শষ্যের দাম সর্বোচ্চ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল, বেকারত্ব সর্বোচ্চ ৩৩%, বিশ্ব বানিজ্য গিয়ে ঠেকেছিল সর্বনিন্ম পর্যায়ে, মূদ্রাস্ফিতী ছিল গত শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি [১]। এই রকম দূর্যোগের সময় বিশ্বব্যাপী একটা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। যাদের ভিতরে উগ্রজাতীয়তাবাদ আর ভিন্নমত দমনের অভিপ্রায় ছিল আশংকাজনক। জার্মানিতে হিটলারের “ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নাজি)” [২], ইতালিতে মুসোলিনির “ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি”[৩] শুধু স্ব স্ব দেশে নয় বরং বিশ্বের প্রতিটা দেশের রাজনীতি সচেতন জনগনের নজর কেড়েছিল।
কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তার মূল কারন কি ছিল?
প্রথমত, এরা ধনী এবং সুবিধাভোগী গোষ্টীর বিরুদ্ধে হিংসাত্বক কথাবার্তা বলে একটা টার্গেটেড গোষ্টীকে আকর্ষন করত। এই টার্গেটেড গোষ্টীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং ধনীরা থিওরিটিক্যালই সংখ্যায় কম ছিল। এই অল্প সংখ্যক ধনীরা ছিল পলিটিক্যালি খুবই কানেক্টেড। এখন আপনি যদি একটা গোষ্টীর বিরুদ্ধে হিংসা ছড়াতেই থাকেন তবে দুটো সম্ভাব্য ঘটনা ঘটতে পারে।
এক, আপনার উষ্কানিতে জনগন সেই ধনী ও ছোট গোষ্টিকে আক্রমন করতে পারে।
দুই, আপনি সেই ছোট কিন্তু ক্ষমতাশীল ধনী গোষ্ঠীর তোপের মুখে পড়তে পারেন।
কিন্তু প্রতিটা দেশেই সাধারন নাগরিকরা শান্তিপ্রিয় হয়; সেক্ষেত্রে জনগন নেতাদের কথায় ফুসে উঠলেও আক্রমন করা থেকে বিরত থাকে। সেক্ষেত্রে, নেতারা নিজেই স্যাবোটেজ করার জন্য তাদের নিজস্ব মাসল বাহিনী গড়ে তোলে। হিটলার [৪] এই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছিল।
দ্বিতীয়ত, তারা আজকের ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মত করে বলত, “ উই উইল মেক জার্মানি গ্রেট এগেইন”।
১৯২০ সালে নাজি পার্টির সৃষ্টির সাথে সাথেই এসএ (SA) [৫] নামের এক যুব বাহিনী (প্যারামিলিটারি) তৈরী করা হয়। যাদের ফোকাস ছিল রায়ট তৈরী, বিরোধী মতের সাথে সংঘর্ষ ও স্যাবোটেজ করা। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে ১ম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত একজন সেনা কর্মকর্তা রোমকে [৬] এই যুব বাহিনীর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। রোম এসএ র প্রধান হবার পর জার্মানির রাস্তায় “স্ট্রিট ফাইটিং” এর পরিমান ১০০০ গুন বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে হিটলার সাহেব এসএ এর কর্মকান্ডে নিজেও প্রচন্ড বিরক্ত ছিলেন। এর প্রধান কারন ছিল এসএ তার নিজের পার্টির মেম্বার ও নেতাদেরকেও অ্যাটাক করতে দ্বিধা করত না। হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসেন ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি, ঠিক তার পরপরই এসএ এর স্ট্রিট ফাইটিং এর মাত্রা আরো বাড়তে থাকে এবং হিটলার আশংকা করেছিলেন রোম এবং অন্যান্য নেতারা একাট্টা হয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে। এজন্য কিছুদিন পর হোমোসেক্সুয়ালিটি এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে রোমকে শর্ট ট্রায়ালের মাধ্যমে ১ জুলাই, ১৯৩৪ এ জেলখানার ভিতরেই ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের এক অবসরপ্রাপ্ত পাইলট গোয়ারিং [৭] যিনি স্বঘোষিত যুদ্ধফেরত নায়ক হিসাবে জার্মানিতে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন মূল পুলিশের থেকে ভিন্ন এবং পলিটিক্যাল গোয়েন্দাগিরিরিতে সক্ষম একটা বাহিনী তৈরী করতে। যাদের কাজ হবে, পক্ষ ও বিপক্ষ নেতাদের কর্মকান্ড গোপনে সারভাইল্যান্স, বিরোধীমত দমন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন, চার্চ, সিনেগগের উপর নজরদারি, পার্টির অভ্যন্তরীন কর্ম্পরিকল্পনা নির্ধারনে গোপনে সার্ভে করা, স্যাবোটেজ ও সর্বোপরি ভিন্ন কথার মানুষ গুলোকে গ্রেপ্তার, হত্যা ও গুম। আর এই গোপন পুলিশকেই আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত গোপন পুলিশ, গেস্টাপো [৮] বলে চিনি যেটা ১৯৩৩ সালের ২৬ এপ্রিল প্রতিষ্টা করা হয়।
কর্মকান্ডের উদাহরন (আভ্যন্তরীণ)
গেস্টাপো নাজি পার্টির টপ লেভেলের নেতাদের বিরুদ্ধে কেমন কার্যকরী হাতিয়ার ছিল সেটা একটা ঘটনা দিয়েই বোঝা যাবে। ড. গোয়েবলস [৯] ছিলেন নাজি সরকারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার [১০] (আমাদের দেশের তথ্য ও প্রচার মন্ত্রনালয়নের মত)। তৎকালীন জার্মানির সকল মিডিয়া, নিউজ এবং সিনেমা ইন্ডাস্টির বাদশাহ ছিলেন তিনি। সরকার যা চাইত তাইই প্রচারে বাধ্য ছিল সংবাদপত্র ও মিডিয়া গুলো। গোয়েবলস বিবাহিত হওয়া সত্বেও ১৯৩৬ সালে লিডা বভোরা নামের এক চেক অভিনেত্রীর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন [১১, ১২]। গোয়ারিং তার স্টেট অফ আর্ট বাগিং টেকনোলোজির মাধ্যমে গোয়াবলসের টেলিফোনে আড়ি পাতেন এবং সেই সব যৌন উত্তেজক রেকডিং তার স্ত্রী মাগদার [১৩] ও একই কপি হিটলারের কাছে পাঠান। যদিও আগে থেকেই মাগদা বুঝেছিলেন যে, তার স্বামী কিছু সংখ্যক মেয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করছে। মাগদা হিটলারের কাছে গিয়ে নালিশ করলেন, হিটলার সে সময় ছিলেন বার্লিন থেকে অনেক অনেক দূরে তার মাউন্টেন রিট্রিট- বারগফে [১৪]। একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, হিটলার স্বয়ং গোয়েবলস ও মাগদার বিয়ে দিয়েছিলেন। তাৎক্ষনিকভাবে তিনি গোয়েবলসকে ডেকে পাঠালেন তার কাছে এবং ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলেন। স্বাভাবিক ভাবে গোয়েবলস সমস্ত ঘটনা অস্বীকার করে। পরে হিটলার তার কাছে থাকা রেকর্ডিং গোয়েবলসকে শুনালে তিনি হতচকিত হয়ে পড়েন। হিটলার গোয়েবলসকে দুটো শর্ত দিয়েছিলেন “ হয় এখনই তার পারিবারিক সমস্যার সমাধান করতে হবে অথবা মন্ত্রী পদ থেকে রিজাইন করতে হবে”। ক্যারিয়ার সচেতন গোয়েবলস ১ম শর্তেই রাজি হন এবং সেই চেক অভিনেত্রীকে তার নিজের দেশে ফেরত পাঠান। একই সাথে গোয়েবলস বুঝতে পারেন, কোন এক অদৃশ্য শক্তি বা কিছু তার এবং দলের সকলের উপরেই গোপনে নজরদারি করছে এবং পান থেকে চুন খসলেই সেই শক্তি হিটলারকে এসে নালিশ করছে।
৪র্থ পর্বে সমাপ্ত
[১] দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশনঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Depression
[২] ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Nazi_Party
[৩] ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টিঃ Click This Link
[৪]এডলফ হিটলারঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Adolf_Hitler
[৫]এসএ (SA)ঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Sturmabteilung
[৬] রোমঃ Click This Link
[৭] হারমান গোয়ারিংঃ Click This Link
[৮] গেস্টাপোঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Gestapo
[৯] ড. জোসেফ গোয়েবলসঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Joseph_Goebbels
[১০] প্রোপাগান্ডা মিনিস্ট্রিঃ Click This Link
[১১] লিডা বভোরাঃ Click This Link
[১২] ঘনিষ্ঠতার প্রমানঃ Click This Link
[১৩] মাগদা গোয়েবলসঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Magda_Goebbels
[১৪] বারগফঃ Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:২৭