ঘটনা প্রবাহ-১
সল্টলেক কলকাতা, ২০১৮ সাল
আমি রাস্তার এক টং দোকানে চা খাবো বলে দাঁড়ালাম, চা দিতে বললাম। দাদা আমাকে চা দিল, আমি চা শেষ করলাম। যখন টাকা দিতে যাব, দুঃখিত রুপি দিতে যাব; ঠিক সেই সময় আমার হাত থেকে ১০ রুপির একটা কয়েন মাটিতে পড়ে গেল। সাথে সাথে দোকানদার আঁতকে উঠল, দাদা, এ আপনি কি করলেন? আপনি টাকা মাটিতে ফেলে দিলেন? কলকাতায় এই দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক, আমার কেন যেন মনে হলো এরা টাকাকে ঈশ্বর-ভগবান এই জাতীয় কিছু একটা জ্ঞান করে থাকে। তারমানে অর্থনীতি শাস্ত্র এরা খুব ভালো করে জানে এবং আয়ত্ত করেছে। ফলাফল? দুই দুইটা নোবেল। অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ ব্যানার্জি, দুইজনই দাপুটে অর্থনীতিবিদ ও নোবেল লরিয়েট।
বাঙলাদেশেও চায়ের বিল দেয়ার সময় অনেকবার টাকা হাত থেকে পড়ে গেছে কিন্তু কখনো কোন দোকানদার টাকা পড়ে যাওয়ার কারণে আঁতকে ওঠে নাই। কারন বাঙলাদেশে টাকা পড়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক, সম্ভবত বাঙলাদেশের বাঙালিরা টাকা মূল্যায়ন করতে জানে না।
ডক্টর ইউনুস এর নোবেল
ডক্টর ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তি এক আজব ঘটনা, যিনি কিনা সারা জীবন ক্ষুদ্র ঋণের উপরে কাজ করলেন অথচ নোবেল পেলেন শান্তিতে। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় উনি অর্থনীতিতেও একটা নোবেলের দাবিদার, বাঙালি অর্থশাস্ত্রে খুবই পারদর্শী।
ঘটনাপ্রবাহ ২
সুশান্ত পাল বলে বাঙলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের একজন ব্যক্তি আছেন যিনি খুবই নাম করেছিলেন তার বিভিন্ন ভালো এবং বিতর্কিত কাজের জন্য। উনি যেবার সিভিল সার্ভিসে এডমিশন পান, সেবার উনি প্রথম হয়েছিলেন। খুবই ট্যালেন্টেড এবং মেরিটোরিয়াস। একটা জাতির মেধাকে কিভাবে একদিকে ডাইভার্ট করে রাখা যায় সুশান্ত পাল খুব ভালো করে জানতেন এবং তিনি তা করে দেখিয়েছিলেন। সিভিল সার্ভিসে এডমিশন পাওয়ার পর, উনি সারা বাঙলাদেব্যাপী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পেইন করে ছাত্রদেরকে সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। উনার এই উদ্ভুদ্ধকরণ ব্যাপার গুলো, খুবই কাজে দিয়েছিল সেই সময়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটার মাথায় সারাদিন গবেষণার প্রজেক্টগুলো ঘুরতো, সে ও সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য চাকরির পড়াশোনার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। এই ছাত্র গুলো এমন ভাবে পড়াশুনা করতো, যেন আগামীকাল বলে আর কিছু নাই। এবং তাদের কাছে মনে হল বেহেশতে যাওয়ার একমাত্র পদ্ধতি হলো এই সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য সরকারী চাকরি।
উক্ত ঘটনা প্রবাহে, একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। একটা জাতির সমস্ত মেধা, বুদ্ধিদীপ্ত মেধা; একটামাত্র ধারায় এবং একটামাত্র পথে ধাবিত হয়েছে। যাতে করে যিনি কিনা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন আর্কিটেক্ট, একজন ডাক্তার, একজন মেরিন বায়োলজিস্ট; তিনিও এই সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য সরকারি চাকরির পেছনে সময় দিতে দিতে তাদের নিজের জাত ভুলে গিয়েছিলেন।
যে ছাত্রটা, জাতে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সে নিজেকে একজন সরকারি প্রশাসনিক ক্যাডার হিসেবে কল্পনা করতে লাগলো। যে ছেলে বা মেয়েটার টেবিলে সব সময় ভবন কিংবা ব্রিজের নকশা থাকতো, সে এখন কল্পনা করতে শুরু করলো পররাষ্ট্র ক্যাডার হবে। যে ডাক্তারের টেবিলের পাশে থাকা মানুষের কঙ্কালটা প্রতিদিন নেড়েচেড়ে দেখতো সে এখন স্বপ্ন দেখে সে সরকারি প্রশাসনিক ক্যাডার হবে। পুরো একটা জাতির মেধাকে একদিকে ডাইভার্ট করে একটা জাতিকে ধ্বংস করার স্বপ্ন সুশান্ত পাল দেখেছিলেন।
এর ফলাফল?
প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছিল না মাঝে। মালিকরা যখন ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের তারতম্য টা বুঝে ফেললেন তখন বেতন বাড়ানো তো দূরে থাক উল্টো কম সেলারিতে একটা জব ম্যানেজ করাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। দেশটির অর্থনীতির চাকা, গতিশীল হওয়া তো দূরে থাক, শামুক গতি হয়ে গেছিল।
কল্পনা করুন প্রাগৈতিহাসিক একটা রাজ্যে ১০০০ পরিবার নিয়ে একটা রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সেখানে একজন রাজা ছিলেন, রাজার মন্ত্রীরা ছিলেন, অন্যান্য পর্ষদরাও ছিলেন। রাজা ঘোষণা দিলেন আমার রাজ্যে সকল পরিবার থেকে সমস্ত সদস্যরা রাজ্যের প্রশাসনিক কাজ করবে। এতে করে রাজ্যে কৃষক-ধোপা-নাপিত এদের সংখ্যা কমে গেল এবং একটা সময় পরে বাইরে থেকে নাপিত-ধোপা এদেরকে আনা লাগল রাজ্যের মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য।
এগজ্যাক্টলি। সেটাই হয়েছে বাঙলাদেশে। আমাদের সমস্ত মেধাকে ডাইভার্ট করে সিভিল সার্ভিস এবং সরকারি চাকরির পিছনে ছুটিয়ে দিয়ে বেসরকারি দামি দামি বেশি বেতনের হাই স্কিলড চাকরি গুলা বিদেশীদেরকে দেয়া হচ্ছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তান থেকে এক্সপার্ট আনা হচ্ছে। বিলিয়ন ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে, অথচ যে এক্সপার্টদের কে আনা হচ্ছে সে জাতীয় এক্সপার্ট বাঙলাদেশে তৈরি করা হয় এবং ভালো মানের এক্সপার্টই তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই এক্সপার্টদের কে আমরা ব্যবহার করতে পারছিনা। এক্সপার্টদের ব্রেইন চলে যাচ্ছে সরকারি চাকরিতে।
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
এমন একটা সময় ছিল যখন বেসরকারী চাকরীতে সেলারি সরকারি চাকরি থেকে বেশি ছিল। ইভেন আমি প্রথম যে চাকরিটা আমার প্রথম জীবনে শুরু করি, সেটার বেসিক সেলারি ছিল একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তার বেসিকের সমান। আমার মনে হয় সরকারি চাকরিতে জৌলুস থাকা ভালো কিন্তু এত সুবিধা দেয়ার কারণে আমাদের মেধা গুলো এই ধরনের বেসরকারী চাকরির পেছনে না ছুটে ডাইভার্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মেরিন সায়েন্টিস্ট, আইনজীবী তৈরি করেছিলাম তাদের সেবা থেকে দেশটির জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের মূলমন্ত্র হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা। ছাত্রদেরকে তার নিজ নিজ বিষয়ভিত্তিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোতে বেশি বেশি করে জোর দেয়া।
আমার মনে হয় একটা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক মানদন্ড, সেটার চর্চাতেই নিহিত। যে জাতি তার বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বিষয়ভিত্তিক বিষয় গুলা বেশি চর্চা করবে সে তত উন্নত হবে।
খুবই সিম্পল ফর্মুলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:০৮