প্লট-১
সকাল সকাল কুয়ালালুমপুর থেকে তেরেনগানু যাচ্ছি। প্রফেসর গাড়ি চালাচ্ছেন, আমি তার পাশের সিটে বসা। নড়াচড়া করতেছি না, আর্মি স্টাইল। মনে হচ্ছে, গাড়িতে ফিল্ড মার্শাল রোমেল বসা। নড়লেই গুলির নির্দেশ (মজা করলাম)। কিছুদুর যাবার পর প্রফেসর মিউজিক অন করলেন। সম্ভবত উর্দু গান, হিন্দিও হতে পারে। আমি পরে ইউটিউবে খুজেও গান গুলা পাই নাই। গানের ডিটেইলস প্রফেসরের কাছে চাইতে লজ্জা করে।
তো, আমি সাধারানত ধুম ধাড়াক্কা মিউজিক পছন্দ করতাম মাঝে মাঝে রবিন্দ্র সংগীত, কিন্তু গাড়ির ভিতরে বাজতেছিল, তার প্রতিটা শব্দ (হিন্দি উর্দু কাছাকাছি ভাষা যার দুইটাই আমি বুঝি সম্ভবত) রক্তে একধরনের শীতলতা এনে দিচ্ছিল। আগের রাতের ফ্লাইটের ধকল টের পেলাম না। মজার ব্যাপার হলো, ৬-৮ ঘন্টার ড্রাইভের পথ মনে হলো ১-২ ঘন্টা। বুঝলাম আমার বয়স হচ্ছে, হেভি মিউজিকের দিন শেষ। ভাগ্যিস প্রফেসরের কালেকশনে গান গুলা ছিলো।
ভারতীয় উপমহাদেশে, অনেক গায়ক এসেছেন যারা দুই দিন লাফ দিয়ে হারিয়ে গেছে, কিন্তু টিকে গেছেন, মোহাম্মদ রফি, অনুপ জালোটা, নচিকেতা, লতা মোংগেশকর, নুসরাত ফাতেহ আলী খান। সম্ভবত তাদের এই গান গুলার আবেদন ১০০ বছর পরেও থাকবে (অন্তঃত আমি বিশ্বাস করি)।
প্লট -২
ছোট বেলা থেকে, বাঙলা সাহিত্যের প্রচুর আউট বই পড়তাম। আউট বলতে, কারিকুলামের বাইরের কারিকুলাম। গল্প, উপন্যাস, কবিতা; এককথায় যা পেতাম তাই পড়তাম। একটা নির্দিষ্ট বয়সে এসে, বিদেশি ভাষার বাঙলা অনুবাদ পড়তাম। সেসময় অনেক বইয়ের অনুবাদ বাঙলায় ছিলোনা (এখন আছে কিনা জানি না), সেক্ষেত্রে, ইংরেজি বই কিনে পড়া শুরু করেছিলাম।
মজার ব্যাপার হলো, আমার মতে বাঙলা সাহিত্যের সবচেয়ে হ্যাংলা লেখক হলো "হুমায়ূন আহমেদ" ("দেয়াল" বাদে, দেয়াল মূলত রাজনৈতিক চরিত্রধারার উপন্যাস; যার হয়ত ঐতিহাসিক মূল্য আছে)। হুমায়ূন আহমেদের অবদান অন্য জায়গায়, তিনি আসলে একটা পাঠক গোষ্ঠী তৈরী করে গেছেন। কিন্তু তার লেখা একবার পড়ার পর দ্বিতীয়বার পড়তে গেলে বিরক্ত লাগে। হেবি ওয়েট লেখকদের মধ্যে প্রথমে থাকবেন, "ডঃ হুমায়ুন আজাদ", "মানিক বাবু", "শরৎ বাবু", "আহমদ ছফা", "রবীন্দ্র বাবু", "কাজী নজরুল ইসলাম" ইত্যাদি। আপনি এদের লেখা আজ থেকে ১০০ বছর পরে পড়লেও মনে হবে নতুন। একই লেখা বার বার পড়লেও বিরক্ত হবেন না।
এদের ভিতরে ডঃ হুমায়ুন আজাদের লেখা গুলা এতো ক্লাসিক যে, সেগুলো আপনি রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। কেউ কেউ হুমায়ুন আজাদকে চোর নকলকারী, অনুবাদকারী বলে গালাগাল করেন। আরে ভাই, সে যদি নকল করেই থাকে তবে সমস্যা কোথায়, বাঙলা ভাষা অন্য ভাষার সাহিত্য দিয়ে সমৃদ্ধ হলো।
আরেকজনের কথা না বললেই নয়, সেটা বাঙলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল। যার লেখা বুঝতে গেলে, শুধু বাঙলা ভাষা জানলে কাজ হবে না, পুরো একটা ভাষা গোষ্ঠী সম্পর্কে আপনার ভালো ধারনা থাকতে হবে। নজরুলের প্রত্যেকটা লেখাই ক্লাসিক, সময় নিয়ে পড়লে বুঝবেন। আপনি বোঝেন না বলে নজরুল পড়েন না হয়তো, নজরুল কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের চেয়ে বেশি মাত্রার ক্লাসিক।
কালের বিবর্তনে ১০০-২০০ বছর পর হয়তো হুমায়ূন আহমদরা হারিয়ে যাবেন কিন্তু ক্লাসিক, হুমায়ুন আজাদ, রবিন্দ্র, নজরুল, ইভেন লালন টিকে যাবেন।
প্লট-৩
যেহেতু আমি রিসার্চ করি, কিছু ক্লাসিকাল রিসার্চের কথা না বললেই নয়। ১৯৫১ সালে ডঃ লাউরি ও তার কলিগস প্রোটিন অ্যাসেইর (Lowry protein assay) উপর কাজ প্রকাশ করেন [১]। তিনি সেজন্য বিখ্যাত না হতে পারেন, তবে তথ্য উপাত্ত বলছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার পেপারটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বার সাইট করা হয়েছে। আজকের দিনে সেটা তিনলক্ষেরও বেশি বার [২]। আপনাকে সারাজীবন ধরে অনেক অনেক কাজ করার দরকার নাই, জীবনে একটা কাজের মত কাজ করলেই, সারা জীবনের জন্য মানুষ আপনাকে ক্লাসিকের সম্মান দিয়ে দিবে। প্রোটিন আপনি যেভাবেই নির্নয় করতে যান না কেন, আপনাকে লাউরি ইট অ্যাল এর সাহায্য নিতেই হবে। নতুবা নতুন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। আর এজন্যই লাউরির এই পেপারটাকে আমার কাছে সবচেয়ে ক্লাসিক মনে হয়েছে।
আবার ধরেন, প্রফেসর অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কারের প্রকাশনাটা "On the antibacterial action of cultures of a penicillium, with special reference to their use in the isolation of B. influenzae" [৩]। এই পেপারের গুরুত্ব যে কত, যারা এই সম্পর্কিত কাজ করেছে তারাই কেবল জানে। তিনি এই রিসার্চের মাধ্যমে পৃথিবীকে গোটা এক নতুন দুনিয়াতে নিয়ে গেছিলেন। আজও এর গুরুত্ব কোন অংশে কম না।
শেষ করি আমার একটা পছন্দের উক্তি দিয়ে, বিলাসী গল্পে শরৎ বাবু বলেছিলেন, "অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে"। যদি পৃথিবীতে মজুদ সকল পারমানবিক বোমার বিস্ফোরনের পর জীবনের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে, আমার ধারনা সেক্ষেত্রে বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী, ক্লাসিক তেলাপোকা টিকে যাবে।
বিঃদ্রঃ উক্ত লেখা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত, সাহিত্যিকদের র্যাংকিং এর ব্যাপারে, কারো অনুভূতিতে আঘাত করলে, আপনার জানা বোঝাতে ঘাটতি আছে মনে করে আবার বাঙলা সাহিত্যের ১-৫০০ র্যাংকিং উপন্যাস পড়তে বসে যান। বাকিটা পরে বুঝবেন।
সূত্রসমূহঃ
১
২
৩
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২১ রাত ১১:৫৫