১.
ইদানিং কলিমদ্দিনের ঘুম হয় না রাতে। মাঝ রাতে হুটহাট ঘুম ভেঙ্গে যায়, শত চেষ্টায় আর ঘুম আসে না। জেগে জেগে দূরে শিয়ালের ডাক শোনে, মনে পরে সদূর অতীতের কিছু স্মৃতি। নতুন বিয়ে করেছে কলিমউদ্দিন তখন, তার বাড়ি ছিল গ্রামের শেষপ্রান্তে। মাঝরাতে তার জানালার পাশে আচমকা হুক্কা হুয়া বলে ডেকে উঠত শিয়ালের পাল। তার বউ সালেহা চমকে উঠে জড়িয়ে ধরে তাকে, “মাগো আমার ডর করছে, আপনে আমারে শক্ত করে ধরে থাকেন”
কপট বিরক্তির স্বরে কলিমদ্দিন বলে, “ ধুর পাগলি, শিয়াল তো বাইরে। এইহানে ডরের কিছু নাই” তবু অবুঝ বউকে শক্ত করে ধরে থাকে কলিমদ্দিন।
সেই পুরনো স্মৃতি মনে আসায় এক চিলতে হাসির রেখা ঠোঁট ছুঁয়ে গেল কলিমের। স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল তার দিনগুলি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসে সে, আজ রাতে আর ঘুম হবে না। দূরে ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেল সে, কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। ভোর হতে বেশি দেরি নেই আর।
পোড়াদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে গত সতের বছর ধরে ঘুমায় সে, দিনের বেলায় বাজারে ভিক্ষা করে।
দেখতে দেখতে অন্ধকার সরে গিয়ে আলো ফুটতে লাগল। দিনের শুরু আর শেষ সময় খুব দ্রুত চলে যায়, এর মাঝের সময় দীর্ঘ হয়। প্রকৃতির এই আচরণের সাথে কলিমদ্দিনের জীবনের কোনই মিল নেই। তার জীবনের শেষ সময় যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তিরিশ বছর আগেই তার জীবনে নেমেছিল সন্ধ্যা।
ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় কলিমদ্দিন, রেললাইনের পাশে টিউবওয়েলের দিকে পা বাড়ায়। হাত-মুখ ধুতেই সকাল হয়ে এল, সালেকের চায়ের দোকান এতক্ষণ খোলার কথা। ছেলেটাকে খুব স্নেহ করে সে।
২.
“এখনো দুধ দিয়ে যায়নি, চাচা। লাল চা খান”, হাসি
মুখে বলে সালেক।
বাঁশের বেঞ্চের উপর বসে কলিমদ্দিন, কথা বলে না।
“কি চাচা, আইজ কি আপনের মনডা ভাল নেই?” জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সালেক।
“সইলডা ভাল না”, গম্ভীর মুখে বলে কলিম।
চায়ের কেতলি রেখে উদ্বিগ্ন হয়ে কলিমদ্দিনের কপালে হাত রাখে সালেক, “সইলডা গরম আছে। শীত আইস্যা পড়ছে,চাচা। কমিশনার সাবকে বইল্যা আপনেরে একটা কম্বল দেওনের ব্যবস্থা করুমনি”
চোখ ছলছল করে ওঠে কলিমদ্দিনের, আপন মানুষের কাছ থেকে ভালবাসা পায়নি সে। তার দুই ছেলের সংসারে জায়গা হয়নি তার, অভাবের সংসারে ছেলেদের বউ খোঁড়া অথর্ব একজনকে বসে বসে খাওয়াতে রাজি ছিল না। ছেলেরা শেষে বলেছিল, আপনে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করেন, আমরা খাবার ব্যবস্থা করব। রাজি হয়নি কলিমদ্দিন। প্রবল বেদনায় জীর্ণ শরীর নিয়ে পথে নেমেছিল।
অথচ এই স্টেশনের সবচেয়ে শক্তিশালী কুলি ছিল সে একসময়। আয় রোজগার ভালই করত সে, কলিম কুলি নামে এক নামে চিনত সবাই।
সেই কাল দিনের কথা মনে পড়ে যায় কলিমদ্দিনের। প্রতিদিনের মত মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি সময় মত স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। চালের বস্তা নামানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কলিমুদ্দিন। বস্তাগুলি নামিয়ে প্লাটফর্মে সারি করে রাখে, গুনে দেখা গেল ভুল করে একটি বস্তা বেশি নামিয়েছে সে। ট্রেন তখনো ছাড়েনি, বস্তাটা উঠিয়ে দিতে গেল সে। এই সময় ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল দিল, ভাবল খোলা দরজা দিয়ে সে বস্তাটা উঠিয়ে দিতে পারবে। বস্তাটা দরজায় রাখার সাথে সাথে ট্রেনের চাকা সচল হল। বস্তাটা ঠিক মতই তুলে দিল সে, নামার সময় প্লাটফর্মের কানায় পা পিছলে গেল। সাথে সাথে তার ডান পা চলে গেল চাকার নিচে।
এর পর তিরিশ বছরের জোয়ান কলিম কুলির জীবনে নেমে এল বিভীষিকা।
“এই লন বিস্কুট”, সালেকের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে কলিমদ্দিনের। এই ছেলেটা প্রতিদিন সকালে তাকে একটি বিস্কিট আর এক কাপ চা খাওয়ায়। এভাবে খেতে তার আত্মসন্মানে বাঁধলেও না বলতে পারে না, ভালবেসে খেতে দেয়।
চা খেয়ে উঠে পড়ে কলিমদ্দিন। পিছন থেকে সালেক বলে ওঠে, “আইজ দুপুরে আমার লগে খাইবেন, চাচা”
কিছু বলে না কলিমদ্দিন, ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে।
বাজারের মাঝামাঝি এসে নটীবাড়ির দিকে চোখ যায় তার। আবারও স্মৃতি নাড়া দিয়ে যায় তার মনে। পা হারানোর দুই বছরের মাথায় সালেহা এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। লজ্জা, ক্ষোভ, অপমান, অক্ষমতায় বিধ্বস্ত হয়েছিল কলিমদ্দিন। এরপর দশ আর বারো বছরের ছেলে দুটিকে একাই বড় করেছে সে।
এখন তার মনে হয়, সালেহা খুব সম্ভবত ভুল কাজ করেনি। কলিমদ্দিন তাকে তিনবেলা খেতে দিতে পারত না। খেয়ে না খেয়ে পঙ্গু একজনের ঘর করার ধৈর্য্য তার ছিল না। এখানে তবু তিন বেলা খেতে পারত সে। এখন সালেহা কোথায় আছে, কলিমদ্দিন কিছু জানে না। নটীবাড়ি ওঠার বছর দুইয়েক পর উত্তরের এক পৌড় চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে চলে গিয়েছিল।
সে অনেক দিন আগের কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও হাঁটতে থাকে কলিমদ্দিন। আজকাল তার পা চলতে চায় না, শরীর ভেঙ্গে আসে। কিন্তু তাকে চলতে হয়, রাত না নামা পর্যন্ত তাকে চলতে হবে।
৩.
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেক আগেই, নতুন পাওয়া কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে কলিমদ্দিন। শক্ত করে কম্বল ধরে থাকে, এর আগেরটা ঘুমের মাঝেই চুড়ি হয়ে গিয়েছিল।
রাত বাড়তে থাকে, কম্বলের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। অনেক দিন পর ভাল ঘুম হয় তার। ঘুমের মাঝে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখে কলিমদ্দিন। স্বপ্নে দেখছে তার মা দীঘির জলে তাকে সাঁতার শিখাচ্ছে। সে পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে ভীত, হাত পা নাড়িয়ে পানি থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কলিম লক্ষ্য করে যে সাঁতার কাটছে, সে আসলে বালক কলিম নয়; বৃদ্ধ কলিমদ্দিন। অবাক হয়ে কলিমদ্দিন তার মায়ের দিকে তাকায়, অপরূপ সুন্দরী এক কিশোরী বলছে, “ভয় পায় না আমার কলিম বাবা, আমি আছি তো”
তার কিশোরী মায়ের খিলখিল হাসির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় কলিমের। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় তার মা, তাই মায়ের কোন স্মৃতি নেই তার।
অনেক দিন পর স্বপ্নে মা’কে দেখে আনন্দে মন ভরে যায় কলিমের।
দূরে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসের হুইসেল শোনা যাচ্ছে, হঠাৎ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে সে।
দ্রুত পা চালিয়ে স্টেশন থেকে একটু দূরে রেললাইনের উপর গিয়ে বসে পড়ল কলিমদ্দিন, অপেক্ষা। তার মন অজানা কোন এক আনন্দে পূর্ণ। খুব তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে।
মিনিট পাঁচেক পর হুইসেল বাজিয়ে স্টেশন অতিক্রম করে চলে গেল ট্রেন।তখন আলো ফুটতে শুরু করেছে।
ঠিক ভোরবেলাতে রাত নেমে এল কলিমদ্দিনের জীবনে, দীর্ঘ প্রতিক্ষার সেই রাত্রি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:৫০