somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অভিভাবক যখন অভিশাপ: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১১ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত কয়েক সপ্তাহে আমার বেশ কিছু মন খারাপ করা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে যিনি তার মেয়েকে নিয়ে সবসময়ই এক ধরনের আতঙ্কে থাকেন। আতঙ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তার কারণ মেয়েটি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। মেয়েটির বয়স বেশি নয়, জীবনের নানা ধরনের যে জটিলতা একজনকে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপারের দিকে ঠেলে দেয়, মেয়েটির সেই বয়স হয়নি। মেয়েটি মাত্র স্কুলে পড়ে, এই বয়সে ছেলেমানুষি কল্পনা করেই সময় কেটে যাওয়ার কথা। মেয়েটির বেলায় তা ঘটেনি। কারণ, সে কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে সেটি নিয়ে তার বাবা-মা তার ওপর এমন চাপ দিয়েছেন যে, তার পক্ষে সে চাপ সহ্য করা সম্ভব হয়নি, হঠাৎ করে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মা এখন মেয়েটিকে নিয়ে এক মানসিক ডাক্তার থেকে আরেক মানসিক ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে আবিষ্কার করছেন, একটা কম বয়সী কিশোরী মেয়ের নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য একটা দেয়াল তুলে রেখেছে, সেই দেয়াল ভেদ করে কেউ এখন ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।

আমি আরেকটি মেয়ের কথা জানি যে তার মায়ের প্রচণ্ড চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করল সে আর বাড়িতে থাকবে না, তাই একদিন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। এটি একটি ভয়ঙ্কর গল্প হতে পারত, শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ মেয়েটিকে বহুদূরের একটা এলাকা থেকে সময়মতো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন কেমন আছে আমি জানি না।

মাত্র কয়েকদিন আগে আমার অফিসে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবার পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে ছেলেটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তাই বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। ছেলেটি এখন আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছে, টাকা ধার করে ফরম ফিলাপ করে কোনোভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে, সে এখন কী করবে। আমি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, তাকে বাস্তব এবং কার্যকর কোনো উপদেশ দেওয়ার মতো আমি কিছু খুঁজে পাইনি!

এগুলো হচ্ছে মাত্র গত কয়েক সপ্তাহের উদাহরণ। আমি যদি আরও আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে করার চেষ্টা করি, তাহলে এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারব। বাবা-মায়ের নির্দয় ব্যবহারে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার উদাহরণ যে রকম আছে, ঠিক সে রকম বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের নাম পাল্টে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একেবারে নতুন করে একা একা নিজের জীবন শুরু করার উদাহরণও আছে।

কেউ যেন মনে না করে, আমি বলার চেষ্টা করছি আমাদের সব মা-বাবাই বুঝি এ রকম। আমি যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই কম। কিন্তু তারপরও এ রকম উদাহরণ যে কম হলেও আছে সেটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। দুশ্চিন্তাটুকু একটু বেশি, কারণ যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনে হচ্ছে এ রকম উদাহরণের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক বাবা-মা কেন জানি খুব সহজ একটা বিষয় বুঝতে পারেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা যত ছোটই হোক, তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাদের নিজেদের বিচার-বুদ্ধি আছে এবং তাদের ওপর নিজেদের কোনো একটা সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিলে তার ফল কখনও ভালো হতে পারে না।
কয়েক বছর আগে টেলিভিশনের একটা চ্যানেল আমাকে একটা নিয়মিত অনুষ্ঠানে কিছুদিনের জন্য উপস্থিত হতে রাজি করিয়েছিল। শুক্রবার সকালবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্য টেলিভিশনে 'লাইভ' বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতাম। বাচ্চারা আমার কাছে তাদের প্রশ্নগুলো পাঠাত, আমাকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হতো। সে সময় আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, এ দেশের শিশু-কিশোরের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সেখানে তাদের বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে কিনা!

আমাকে খুব সাবধানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আমি তাদেরকে বলতাম, তাদের বাবা-মায়ের বয়স যেহেতু বেশি, তাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও বেশি। সেই অভিজ্ঞতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় জানেন, যেগুলো শিশু-কিশোররা এখনও জানে না। তাই তাদের বাবা-মায়ের যুক্তিগুলো তারা শুনতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনটা কীভাবে গড়ে তুলবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ের বেলাতেও তারা কী নিয়ে লেখাপড়া করতে চায়, সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দিয়েছি। আমি মনে মনে আশা করি, সবারই জীবনে এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক।

বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়ের একটা সুন্দর জীবন দেখতে চান। কিন্তু সেই সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার জন্য তারা কতটুকু বাড়াবাড়ি করবেন, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

বাবা-মায়েদের বাড়াবাড়ি কী পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুল-কলেজে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয় (যখনই সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা হয়, তখন কেউ না কেউ বলে, 'কিন্তু আপনি কি জানেন, এখন সৃজনশীল প্রশ্নের গাইডবই বের হয়ে গেছে? আগে ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের পাঠ্যবই মুখস্থ করত, এখন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীল গাইডবইটাও মুখস্থ করতে হচ্ছে।' আমি তাদের মনে করিয়ে দিই, এই গাইডবই মুখস্থ করে তারা কখনোই কোনো সত্যিকারের পরীক্ষার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে না! সত্যিকারের পরীক্ষায় কখনও কোনো প্রশ্ন এই গাইডবই থেকে আসবে না। ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের পাঠ্যবই_ শুধু তাদের পাঠ্যবই আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ে, তাহলেই তারা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে)। যাই হোক যখন প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখন হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা এই পদ্ধতিটার গুরুত্বটুকু ধরতে পেরেছিলাম, তারাও সবাই মিলে এর পক্ষে কথা বলতে শুধু করলাম। তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করলাম, ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা যেভাবে হোক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। ঠিক কী কারণ জানি না, সেটা করার জন্য তারা সবাই মিলে আমাকে 'সাইজ' করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন। দিন নেই, রাত নেই তারা আমাকে ফোন করেন, আমার সঙ্গে কথা বলেন, দল বেঁধে এখানে-সেখানে দেখা করেন, আমাকে নানা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছুদিনের মধ্যে আমি আসল ব্যাপারটি আবিষ্কার করলাম, তাদের যুক্তিটি খুবই চমকপ্রদ। তারা আমাকে বলেন, 'আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, এই পদ্ধতিটি খুবই ভালো। কিন্তু এই বছর আমার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক_ তারপর যা খুশি করেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই!'

যেসব অভিভাবক আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন, তাদের মধ্যে একজনও নেই যার ছেলেমেয়ে সেই বছরের পরীক্ষার্থী নয়। দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, তাদের সব মাথাব্যথা শুধু নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমি তখন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সোচ্চার অভিভাবকরা আসলে খুব স্বার্থপর। তাদের নিজেদের সন্তানের ভালোমন্দের বাইরে তারা কখনও কিছু চিন্তা করেন না। স্বার্থপর মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেয়ে নিরানন্দ কাজ কিছু হতে পারে না। তাদের কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না।
২.

স্বার্থপর অভিভাবক থেকেও ভয়ঙ্কর এক ধরনের অভিভাবক আছেন। তাদের সঙ্গে সাধারণত আমার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর। এবারে একজন আমার অফিসে এসেছেন। তার সঙ্গে একজন কম বয়সী তরুণ, চেহারা দেখে অনুমান করতে পারলাম, সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় সে রকম একজন। বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং আমি তাদের সামনে বসার আমন্ত্রণ জানালাম। ভদ্রলোক আমাদের এলাকার মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। আমাকে জানালেন, তার সঙ্গের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি, তাকে ভর্তি করে দিতে হবে।

'অমুক' বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তখন তাকে আপনার বিভাগে ভর্তি করে দিতে হবে এ রকম অনুরোধ মাঝে মধ্যে শুনতে পাই; কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাতেই টিকতে পারেনি তাকে ভর্তি করে দিতে হবে_ এই অনুরোধটি নতুন। আমি এ ধরনের অন্যায় কাজ করতে পারি_ লোকজন সেটা বিশ্বাস করে জানতে পেরে অবশ্যই আমার খুব আশাভঙ্গ হলো, আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো; কিন্তু তারপরও আমাকে জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলতে হলো, এ রকম কিছু করা সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ যদি এটা করার চেষ্টাও করে, তারপরও সেটি করার উপায় নেই। মেধা তালিকায় যারা আছে তাদের একজন একজন করে ভর্তি করা ছাড়া আমাদের সিস্টেম আর কিছু করতে পারবে না।

ভদ্রলোক আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, হেসে হেসে বললেন, এ দেশে সবকিছু সম্ভব। আপনার দেশের একজন মানুষের জন্য আপনার এটা করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বেশ কিছুক্ষণ এ ধরনের আলাপ চলল, আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকা এই কম বয়সী তরুণ এবং তার অভিভাবকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক পর্যায়ে আমাকে কঠিন হতে হলো_ রূঢ় ভাষায় বলতে হলো যে এই ছেলেটি আপনার পাশে বসে বসে দেখছে তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা চলছে! আপনার সম্পর্কে এখন ছেলেটির কী ধারণা হচ্ছে? সে জানছে, তার অভিভাবক একজন ক্রিমিনাল_ এসেছে আরেকজন ক্রিমিনালের কাছে?

ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ন এবং বিরক্ত হয়ে বিদায় নিলেন। আমার ভেতরটা সারাদিনের জন্য তেতো হয়ে গেল। এ ধরনের অভিভাবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাদের ছেলেমেয়েদের সামনে তারা অন্যায় কাজ করে ফেলেন, ছেলেমেয়েদের বোঝান কোনো কিছু পাওয়ার জন্য অন্যায় করতে হয়। সৎ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেটা পাওয়ার কথা সেটা পেলেই হলো। এ ব্যাপারে খুব ছেলেমানুষি একটা ব্যাপার আমার ভেতরে বেশ দাগ কেটেছে। আমি বইমেলায় বসে আছি, শত শত ছেলেমেয়ে ভিড় করে আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। যখন দেখলাম এটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, তখন আমি তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলাম। কিছুটা হলেও একটু শৃঙ্খলা ফিরে এলো, তারপরও যে হুটোপুটি নেই তা নয়। তখন হঠাৎ করে একজন ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, 'এর বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিন।' আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তুমি কি সবার মতো লাইন ধরে এসেছ?' মা ছেলেটিকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না, বললেন, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ সে লাইন ধরে এসেছে।' আমি আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'সত্যি তুমি লাইনে ছিলে?' ছেলেটি কিছু বলতে পারল না, মা আবার বললেন, সে লাইনেই ছিল, লাইন ভেঙে ঢোকেনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে এই ছোট বিষয় নিয়ে নাটক করার চেষ্টা না করে ছেলেটির বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে তাকে বললাম, 'আমি দেখেছি, তুমি লাইন ভেঙে ঢুকেছ! কেন এটা করলে?'
ছেলেটির মুখ মুহূর্তে অপমানে ম্লান হয়ে গেল। তীব্র চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি করতে চাইনি। আমার মা আমাকে করিয়েছে।'

আমি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললাম, 'এরপর থেকে মা করাতে চাইলেও করবে না, ঠিক আছে?'

শিশুটি চোখের পানি আটকে রেখে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার ধারণা, যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তখন তারা অন্যায় করতে জানে না। অন্যায় করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যখন তাদের সন্তানের সামনে অন্যায় করেন, সন্তানকে অন্যায় কাজ করতে শেখান, তখন তারা সেটা করতে শেখে। সুন্দর একটা মন ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যায়।

আমাদের দেশের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার কিছু কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা অভিভাবক এবং তাদের সন্তানদের এক জায়গায় নিয়ে আসে। অভিভাবকদের খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা থাকে, যখন পরীক্ষার্থীরা রাত জেগে ফাঁস করে আনা মেডিকেলের প্রশ্ন মুখস্থ করতে থাকে। ছেলেমেয়েরা জানে তাদের বাবা-মায়েরা কয়েক লাখ টাকা দিয়ে তাদেরকে ফাঁস করে আনা প্রশ্ন মুখস্থ করার সুযোগ দিয়েছে। সেটা নিয়ে তাদের বিবেক কোনো যন্ত্রণা দেয় কিনা আমার জানা নেই। টাকা দিয়ে তারা অনেক বড় অন্যায় করছে কিন্তু সেই বাবা-মা কীভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের চোখের দিকে তাকান, আমি জানি না। আমার খুব জানার ইচ্ছে!

এ রকম একটা মন খারাপ করা কুৎসিত বিষয় লিখতে আমার খুব খারাপ লাগছে; কিন্তু আমি সেটা মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। কারণ প্রতিদিনই আমার খাঁটি অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা গভীর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সন্তানদের বড় করছেন। সন্তানের শখ পূরণ করার জন্য নিজের সময় দিচ্ছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার উৎসবে বাবা-মায়েরা কষ্ট করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। গণিত, বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান_ এ ধরনের অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য সন্তানদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ছবি আঁকার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছেন; ছেলেমেয়েদের দেশকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন, মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন। আমি হতদরিদ্র অশিক্ষিত বাবা-মায়েদের দেখেছি, যারা সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছেন। আমি জানি, আমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু যখন দেখি একটা তরুণ শুকনো মুখে আমাকে বলে, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি বলে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তখন আমার পরিচিত জগৎটি এলোমেলো হয়ে যায়। যখন শুনি বাবা-মায়ের প্রচণ্ড চাপে একটি মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে, আমি তখন আতঙ্কে শিউরে উঠি। আমার এই লেখাটি সে ধরনের কোনো অভিভাবকদের চোখে পড়বে কিনা জানি না। যদি পড়ে তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন আপনাদের সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। তাদেরকে তাদের নিজেদের স্বপ্ন দেখতে দিন। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। তাদেরকে জোর করে একটা প্রতিযোগিতা থেকে অন্য একটা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেবেন না। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে বাধ্য করবেন না। তারা যে কাজটুকু করতে আনন্দ পায় সেই কাজটুকু করতে দিন।

আমাদের একটি মাত্র জীবন, সেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশটুকু হচ্ছে শৈশব। তাদের শৈশবটিকে বিষাক্ত করে দেবেন না। তাদেরকে একটা আনন্দময় শৈশব নিয়ে বড় হতে দিন। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে হবে না, সবকিছুতে পুরস্কার পেতে হবে না, তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে হবে। তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে দিন।

যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের অন্যায় কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছেন তাদেরকে কী বলব আমি জানি না। তারা কীভাবে তাদের সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, 'তুমি এই গুরুতর অপরাধটি করো।' এ রকম কোনো একজন অভিভাবক কি আমাকে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবেন?

অভিভাবকরা সন্তানদের ভালোবাসা দেবেন, তাদের জীবনে তারা কেন অভিশাপ হয়ে যাবেন?
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×