ফ্যানটার এই এক সমস্যা: ঘুরতে ঘুরতে মাঝেমধ্যেই ঝাকি দিয়ে উঠে- ঘটঘট শব্দ হয় কিছুক্ষণ, এরপর বন্ধ হয়ে যায়। টানা কিছুদিন হয়ত এরপর আর চলেইনা, তারপর আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলতে থাকে ঠিকঠাক। আজও ফ্যানটাকে এই রোগে ধরেছে, যদিও দুজন মানুষ ফ্যানযুক্ত ড্রইংরুমের মফস্বলের এই বাড়িটিতে বসে আছে, অনেক্ষণই হল।মানুষ দুজন বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যানটার দিকে তাকায়, হয়তবা চোখের পলকও ফেলে কয়েক সেকেন্ড আগে-পরের ব্যবধানে, তারপর ফ্যানের মত তারাও স্থির বসে থাকে- অপেক্ষা করে একজনের আগমনের। সেই একজন আপাতত বাড়ির বাইরে আছেন; তবে তার সাথে মানুষ দুজনের দেখা হয়েছিল বাজারে- তিনি বলেছিলেন বাজারের কাজটা সেরে মিনিট বিশেকের মধ্যেই ফিরবেন, তারা যেন বাড়িতে বসে অপেক্ষা করে। তখন থেকেই ১৯ফুটি রুমটা মানষ দুজনের ওয়েটিং রুমে পরিণত হয়েছে।
ড্রইরুমের সাথেই মেইনগেট,গেট খুললেই মেঠোপথ। চুপচাপ বসে না থেকে দুজনের একজন গেটটা খুলে সেই পথে এসে দাঁড়ালো।ময়লা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রূপসী-সেনরগোল্ড বের করে সেটিকে ঠোটের ছোয়ায় ছোয়ায় নিঃশেষ করছে,শুষে নিচ্ছে সবটুকু উত্তাপ।আর, অন্যজন রুমেই রয়ে গেছে- বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। দাঁতে নখ কাটা মানুষটির ভাবনায় তার নিজের চেয়েও বেশিভাবে আছে তার সাথে আসা খুশখুশে কাশিওয়ালা মানুষটির সমস্যা। সমস্যার হোতা কাশিওয়ালার ছেলে : নিজেকে সে নায়ক শাকিব খান ভেবে টুপ করে ববিতার সাথে বিছানায় গেছে; এ নিয়ে গ্রামে কানাঘুষা-গুঞ্জন থেকে বিচার-সালিশ, শেষমেশ কোর্ট-কাছারি। আজকে এ বাড়িতে আসার উদ্দেশ্যও এই আদালত বিষয়ক হেম্তনেস্ত করা।
আবিদা আখতার একটা এনজিওতে চাকরি করছেন। গ্রাম্য সালিশ-আইনি সমস্যাগুলো তিনিই দেখে থাকেন। ফৌজদারী মামলায় তার সরাসরি কোন ভূমিকা নেই, তবুও মানুষ দুজন তার কাছে এসেছে, কারণ এনজিওতে কাজ করা হয় বলে আদালতপাড়ায় প্রায়ই তার যাওয়া-আসা পড়ে, সেইসূত্রে অনেক আইনজীবীর সঙ্গেই সুস্থ যোগাযোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে।এখন তার ৪৫চলছে, জীবনের ২৭টি বছর কাটিয়েছেন গ্রামে ; দাঁতে নখ কাটা মানুষটি ঐসময়ে তার শ্বশুরবাড়িতে রাখালের কাজ করত- পরিচয়টা তখন থেকেই।নখ কাটা মানুষটিও সে উদ্দেশ্যেই তার কাছে এসেছে- যদি তিনি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। অফিস শেষে তিনি যাচ্ছিলেন বাজারে- দুদিন হল ঢাকা থেকে ছোট ছেলেটা এসেছে, ছেলেটার আনারস খুব পছন্দ। তাই বাজার থেকে একজোড়া আনারস নেয়ার ইচ্ছা, সঙ্গে টুকিটাকি বাজার; বের হয়ে কয়েক কদম এগিয়েছেন কি- দাঁতে নখ কাটা, আর খুশখুশে কাশিওয়ালার সাথে দেখা।
দু-এক কথায় তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে বাজারে চলে যান, যাওয়ার আগে অবশ্য ছেলেকে ফোন করে বলে দেন তিনি ফেরার আগে যেন সে বাড়ি থেকে বের না হয়। কাজের মেয়েটা গ্রামের বাড়িতে গেছে - বাড়িতে মানুষ বলতে সে আর ছেলে। তাই, দুজন বাইরের লোকের জিম্মায় বাড়ি রেখে যাওয়া, আর বিড়ালের সামনে রসমালাই রেখে দেয়া, অনেকটা একই ব্যাপার। ছেলেটা এখন বেসিনে দাঁড়িয়ে শেভ করছে; আরেকটু বিলম্বিতবিকালে একজনকে সঙ্গে করে রিক্সাবিলাসের কথা আছে আজ। আজই প্রথম।
নখ খুটা শেষে মানুষটি এখন কানের ছিদ্রে তর্জনী চালান করে ভেতরের ময়লা খুঁড়ছে, খুশখুশে কাশিওয়ালাও ফিরে এসেছে সেনরগোল্ডের যৌবন শুষে। তার চেহারাটা অস্বস্তির : অপরিচিত একটা বাসায় এসে এভাবে অপেক্ষা করতেও ইচ্ছা হচ্ছেনা, আবার এখানে এসে সঙ্গীর সাথে ভিলেজ পলিটিক্স অথবা রহিমের শালীর জামাই আরব দেশে ভেড়া রাখে কিনা, এসব বলতেও ভাল লাগছেনা। সে চোখ-দোকানের শাটার নামিয়ে কষতে থাকে জীবনের বকেয়া হিসেব।
কানে আঙ্গুল ঢুকানো হাশেম তার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে বসা সঙ্গীটিকে সেভাবে খেয়ালই করছেনা- মাঝেমাঝে একটু-আধটু তাকিয়ে ইশারায় বোঝাতে চাইছে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’।তার বসার সোফার সাথে লাগোয়া দরজা থেকেই বারান্দার শুরু।দরজাটা খোলা। সে তাকাতুকি করছে- কাউকে দেখবার কৌতূহলে। মুহূর্তকাল পরে সেখান দিয়ে ২৪-২৫বছরের এক তরুণকে হেটে যেতে দেখল- তার হাতে শেভিং ফোম; বারান্দা থেকে আসা আফটার শেভ লোশনের সৌরভ হাশেমের সর্দিভর্তি নাকেও একটা স্বস্তিদায়ক অনুভূতি সরবরাহ করল। তরুণ না দেখার মত করে একবার হাশেমের দিকে তাকায়, এরপর আবারো সামনের দরজার দিকে এগোয়। হাশেম পিছু ডাকে।‘চাচাজি, একটু শুইনা যাউ। পরিচয় তো নাই, আসো দ্যাশের মাইনষের লগে পরিচিত হইয়া যাউ’।
অনুপ এই আহ্বানের জন্য প্রস্তুত ছিলনা- অল্পবিস্তর অস্বস্তি নিয়ে সে হাশেমের পাশের সোফায় বসল; খুশখুশে কাশিওয়ালা সোফার উপর পা তুলে বসেছিল- তাকে ঢুকতে দেখে তড়িঘড়ি করে পা নামাল, যদিও অনুপ তাকে খেয়ালই করলোনা সেভাবে। হাশেম উশখুশ করছিল, অনুপকে বসতে দেখে হঠাৎ ফুটো হয়ে যাওয়া বাধের পানির বেগে সে কথা বলতে শুরু করল।
-‘আমারে অবশ্যি তুমার চিনার কথা না। তয় আমি কিন্তু তুমারে ছোটকালে ম্যালাদিন কোলে কইরা রাখছি। তুমি তখন ক্যাবল হাটা শিখচো, আর তুমার বড়ভাই আরিকটু ঝরঝরা হইচে’।
অনুপ এবার কিছুটা আগ্রহ পায় কথা বলবার, চোখ দিয়ে লোকটাকে বা গল্পের হাশেম চরিত্রকে স্ক্যান করে যেন।‘অনেক ছোট ছিলাম তো, তাই হয়ত আপনার চেহারাটা মনে পড়ছেনা। তবে আপনি কয়েকটা ঘটনা বললে চিনে ফেলবো আশা করি’।
হাশেম কথা বলতেই চাচ্ছিল। অনুপের কথা শুনে তার কণ্ঠে জমে থাকা বায়বীয় মেদগুলো ঝরতে শুরু করল।
‘ঘটনার তো অভাব নাই চাচা। আমি তুমাগো দাদাবাড়ির রাখাল আচিলাম। তুমার দাদা তহন ট্যাপরা চাকরি করত, বিশহুত বার বাড়ি আসত। তুমার আব্বা আর আমি বছর দুইয়ের ছোটবড়। আর, তুমার চাচা-ফুপুগো তো হইতে দেখচি’।
অনুপ বুঝতে পারে মৌচাকে ঢিল ছুড়েছে; এখন মৌমাছির মত কথারা ছুটে আসতে শুরু করবে। নিজের হাতের কব্জি আর বাহুর সংযোগস্থলের কিছুটা নিচে ধ্যান করা ঘড়িটার দিকে তাকায় সে- ৫টা ২৩ বাজে; সাদিয়া নিশ্চয়ই রেডি হয়ে বসে আছে বাসায়, তার মিসকলের প্রতীক্ষা করছে- কিন্তু সাদিয়া তো জানেনা সে কেমন আচমকা এক গ্রাম্য মানুষের মুখোমুখি বসে পড়েছে, যে কিনা তার বাপ-দাদার বৃত্তান্ত বলতে শুরু করেছে। অনুপের এই ব্যাপারটা ভাল লেগে গেল। সাদিয়ার সাথে শেষপর্যন্ত যদি রিক্সায় ঘোরা নাও হয়, না হল- সেটা হয়ত অন্যদিন হতে পারে, কিন্তু এই লোককে সবদিন পাওয়া যাবেনা। সুতরাং সাদিয়ার ঠোটে ঠোট রাখার চেয়ে এই গ্রাম্য লোকটির ঠোটের নড়াচড়া দেখা বেশি জরুরী। আজ লিপস্টিক একাই সাদিয়ার ঠোটের অধিকার নিক।
‘শুনো চাচা, তুমার দাদী আমার মায়ের সঁই আছিল। সেইজন্যে তুমার দাদারে মামা ডাকত্যাম। আমাগো তখন দিনপাত চলতনা, তাই ১২বছর বয়স থিকাই তুমাগো বাড়ির রাখাল হইলাম। তুমার নানীবাড়ি থিকা একখান কালাগাই দিছিল- আমি একহাড়ি রস নিয়া গেছিলাম সেই গাই আনবার। তুমার নানীবাড়ির মানুষজন ভালা আছিল- আমার পাতে ইয়া বড় একখান কৈমাছ দিছিল খাওয়ার সুময়। ঐ কৈমাছ অহন আর পাইবানা- এহনকার কৈয়ের সাইজ তো পোলাপানের নুনুর সুমান’।
কথাটা বলে হাশেম জিহ্বায় কামড় দিল, ‘কিছু মনে কইরোনা চাচা। গ্রামের মানুষ তো- কথার ইস্টিশন-মিস্টিশন নাই’।
অনুপ মুচকি হাসল। সাদিয়ার সাথে কথা-বার্তায় সে অশালীন নয়, কিন্তু মাঝে-সাঝে গভীর রাতে ফোনে কথা বলতে গেলে তার কণ্ঠেও হাশেম কথা বলে উঠে; সাদিয়া শুরুর দিকে বিব্রত হলেও এখন বেশ মানিয়ে নিয়েছে। তবুও অনুপ অপরাধবোধে ভুগে- এগুলো ফোনসেক্স নয় তো? পরক্ষণেই সে নির্বিকার হয়ে যায়, কথাগুলোকে পরম স্বাভাবিক ধরে নেয়। সে তুলনায় হাশেমের কইমাছের চেহারায় বাচ্চাদের পুরুষাঙ্গ দেখাটাকে অরুচিকর কিছু লাগলনা তার।
-‘সমস্যা নেই চাচা, আপনি বলে যান; সব শব্দ আমি শুনবোনে না’।
-‘তুমার আব্বা তহন কন্ট্রাকটরি করে দৌলতপুরে- মোটরসাইকেল আছিল একখান। যাইত-আইত'। অনুপ অবাক হল, 'উনি কন্ট্রাকটারিও করেছেন’?
হাশেমের কথার ইঞ্জিন নতুন করে জ্বালানী পেল এতে।‘ আল্লাহর দুনিয়ায় খুব কমই আছে যেডা তুমার আব্বা করে নাই: কন্ট্রাকটারি, ওষুধের দুকান, কাচামালের ব্যবসা, মাছের ব্যবসা, রিক্সার গ্যারেজ- সব করচে। তুমাগো ২০-২৫খান রিক্সা আছিল।
( দীর্ঘশ্বাস) আসল কথা হইল, তুমার আব্বা একটা ভাদাইম্মা কিসিমের মানুষ- কুনোকিছুর উপরই মন বসাইবার পারলোনা '।
হাশেমের গলার স্বর নিচু হল- ‘তুমার আব্বা কি আসে তুমাগো এইখানে’?
অনুপ এ কথায় গুরুত্ব দিলনা। ‘উনি উনার বউ-সংসার নিয়ে সুখে আছে, থাকুক। মরবার জন্য তো জায়গার অভাব নেই; খুঁজে খুঁজে আমাদের এখানে এসেই কেন মরতে হবে’?
দ্রুত প্রসঙ্গ ঘুরালো অনুপ।‘চাচার ছেলেমেয়ে কয়জন’? অনুপ জানলোই না হাশেমের কতটা পছন্দের একটা প্রসঙ্গ সে তুলে এনেছে। হাশেমের কথা কি আর আটকায়।
‘২পুলা, ৩মাইয়া। আমার দিন ঘুইরা গ্যাছে চাচা: ২পুলা সৌদি থাকে, পুলা ছোট্টা ঢাকায় ট্যাম্পু চালায়। মাইয়া দুইডারও বিয়া দিছি। আল্লাহয় দিলে কিছু জমি-জিরাত করছি. চিন্তায় আছি এইবার মেম্বার ইলেকশন করুম’।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে অনুপ আগ্রহ হারাতে শুরু করলো। সাদিয়া এসএমএস দিয়েছে বাসা থেকে বের হবার তাগাদা দিয়ে।অনুপ ভাবছে রিক্সায় কিভাবে বসবে। রিক্সায় উঠলে পরস্পরের কাধের সাথে ছোঁয়া লাগে, এই ছোঁয়াতে সমস্ত শরীরে একটা শিহরণ হয়। সেক্ষেত্রে রিক্সায় উঠে তার করণীয়র ব্যাপারে সে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছেনা; মূলত সে কোন সিদ্ধান্তই খুঁজছেনা। তাই সে ফিরে আসে হাশেমের কথায়, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘চাচা, ইলেকশনের টপিকটা বাদ দেন। ভাল লাগেনা’।
হাশেম মনোঃক্ষুণ্ন হলেও পুরোপুরি দমেও যায়না।‘ তুমি শিক্ষিত্ ছাওয়াল হইয়া এই কথা কইলা। পলিটিক্স বাদ দিয়া চিন্তা করোন যায় নাকি’?
তার মনের ক্ষোভ মিটছেইনা, তীব্র অসন্তোষে সে মাথা ঝাকায়। ‘নাহ, তুমি তো ডুবাইছো চাচা। সমাজে থাকবার গ্যালে চোখ-কান বন্ধক রাখলে কি চলবো? সমাজ দেখতে-বুঝতে হইবোনা? তো সেইটা বুঝতে হইলে তুমার একটা রাজনীতির নলেজ দরকার আছে। নাইলে ভার্সিটি থিকা ডিগ্রি নিলা, একখান বিয়া কইরা এককাড়ি আন্ডা ফুটাইলা- এইডা তো জীবন না। বউয়ের লগে চোদাচুদির বাইরেও জীবন আছে রে বাজান’।
হাশেমের কথা শুনে খুশখুশে কাশিওয়ালা তাড়াহুড়ো করে গেটের বাইরে বেরোল; হাশেম তার উঠে যাওয়া দেখে অনুপের দিকে তাকিয়ে তড়াক হেসে দিল,’শরম পাইছে’। অনুপও মাথা নিচু করল বলে হাশেমের মুখের রঙ গোলাপী হয়ে গেল। ‘ আমার মুখটা ইট্টু বেশি খারাপ চাচা- কী যে কই। তয় আমার কিন্তু একখান যুক্তি আচে। যাগো উপরে উপরে সাদা, তাগো ভিতরে বিরাট বিরাট আন্ধার। আন্ধার কিন্তু সব্বারই আচে। এই আন্ধারগুলা হইল গুক্ষুই সাপের মতন- খালি ফোসফোস করব, হেরপর আতকা দংশন করব। কিন্তু ভিতরের আন্ধারগুলিরে যুদি ইকটু ইকটু কইরা বাইরে আনা যায়, তাইলে গুক্ষুই সাপটাও বিষ হারাইতে হারাইতে ধুরা সাপ হইয়া যায় – একসময় তো পুরা কুইচা-ই হইয়া যায়? কুইচা চিনো? দেখতে বাইম মাছের মতন, তয় লড়াচড়া দেখলে কইবা সাপ; হা হা হা’।
এইপ্রথম শব্দ করে হাসল হাশেম। অনুপ তার শেভ না করা খোচাখোচা দাঁড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে।‘বউয়ের লগে চোদাচুদির বাইরেও জীবন আছে’-কথাটা তার মগজে ঢুকে পড়েছে। সে এখন আর রুমের ভিতরে নেই; থুতনির মধ্যে শরীর ভরে মনটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাইরে কোথাও-এক বিশাল মাঠের মাঝখানে, যেখানে নেমেছে গভীর রাত, তার পরনে সাদামাটা পোশাক, তার হাত ধরে আছে সাদিয়া। অনুপ ভাবছে এখানেই তাদের বাসর হোক; ঘরের বদ্ধরুমে ফ্যানের ঘটঘট শব্দ আর নিঃসীম লোকাচারের মধ্যে শরীরে শরীর মিশলে সেখানে শুধুমাত্র দুটো শরীরের সহাবস্থান হতে পারেনা- আত্মীয়-অনাত্মীয়ের ভীড়, চাওয়া-পাওয়ার ঠাসাঠাসি, আর ভীষণমাত্রার দায়বদ্ধতা শরীরের ফাকে ফাকে ঢুকে পড়ে। এই মিলনটা শরীরের চাহিদা থেকে, আত্মার চাহিদাটা থাকে উপেক্ষিত। আঁধারে ঢাকা আকাশ, বিজন রাত-নির্জন মাঠ, সবুজ ঘাস, বহুদূরে দাঁড়ানো গাছের আড়াল ভেঙ্গে উঠে আসা ঝিঁঝিপোকার ডাক- এমন একটা পরিবেশে সাদিয়ার ভেতবে প্রবেশ করলে তবেই তো আত্মাকে স্পর্শ করা হবে; কিন্তু অনুপ বেশিদূর এগুতে পারেনা- খানিকবাদেই তার মনে পড়ে যায় এই ভাবনাটা গত সপ্তাহে পড়া ‘কালো বরফ’ উপন্যাসের একটি বিশেষ ঘটনা-প্রভাবিত। এরচেয়েও বড় সমস্যা হল, সমাজের চিরকালীন শৌখিন শালীনতায় বেড়ে উঠা সাদিয়া কখনই রাজী হবেনা এমন একটা পরিবেশে শরীরকে উন্মুক্ত করতে; অন্যদের মত তার কাছেও যে শরীর মানে আদিমতার কোষাগার; সুতরাং দশফুট বাই দশফুটের খাঁচা ছাড়া সেই শরীর প্রকাশিত হবার নয়।
হাশেম অনুপের এভাবে থুতনিতে হাত নাখাটা মানতে পারলনা। ‘এমুন কইরা থুতমায় হাত রাইখোনা চাচা। তুমার দাদা কইত, থুতমায় হাত রাখলে জীবনভর দুঃখ পাইতে হয়। একবার খাউয়ার সময় তুমার সাইজা ফুপু থুতমায় হাত রাখচিল- তুমার দাদা রাইগা বসার ফিড়ি চ্যাঙ্গা মারছিল, ঠোটে যাইয়া লাইগা বিদিকিচ্ছিরি অবস্থা। অহনও সেই দাগ মুছেনাই মনেহয়। তুমার ঐ ফুপু এহন নরসিংদী থাকেনা’?
খুশখুশে কাশিওয়ালা আবার রুমে ফিরে এল। হাশেম অনুপের সাথে তার আলাপ করিয়ে দিতে চাইল।‘ ভাইস্তার লগে কথা কইলানা কালাম ভাই’?
অনুপ প্রথমবারের মত কাশিওয়ালাকে খেয়ালের চোখে দেখে, কাশিওয়ালাও দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তার দিকে তাকায়। ‘হ যাতায়াত না থাকলে ভাই-ভাইস্তাগো সাথে কথা কইতেও শরম লাগে’।
অনুপ মোবাইল দেখে- সাদিয়ার ৯টা মিসকল জমা হয়েছে, সে ফোনটাকে সাইলেন্ট মোডে দিয়ে রাখল।
বাইরের গেটে শব্দ হল, অনুপ গিয়ে খুলে দিল- মা এসেছে। প্রাত্যহিকতার ছায়াপুস্ট চেহারায় আবিদা ভেতরে ঢুকলেন; অনুপের সাথে কথা হল দু-একটা, তাও সেগুলো ‘কিরে উনাদের বিস্কুট-টিস্কুট কিছু দেসনি’? ঘরানার। ঘরে ঢুকে হাশেমের সাথে দাঁড়ানো অবস্থায়ই কথা বললেন, ‘হাশেম ভাই, ২মিনিট বসেন। আমি চেঞ্জ করে আসি’।
আবিদা চলে গেলে অনুপ আবারো তাদের গল্পের চরিত্রদের সাথে পরিচিত হতে চাইল; হাশেম আর কালাম কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে বসে রইল। অনুপ হঠাৎই হাশেমের শরীর থেকে আতরের ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে; এতক্ষণ ঘ্রাণটা পায়নি কেন ভাবছে। সাদিয়ার শরীরেও একটা ঘ্রাণ পায় সে; তার ধারণা ঘ্রাণটা শ্যাম্পু অখবা বেলীফুলের, যদিও সাদিয়ার শরীর ঘেষে কখনই বসা হয়নি এবং বেলীফুলের ঘ্রাণটাও তার চেনা নেই। ঘ্রাণ একটা পেয়ে সে নিজের মত করে ভেবে বেলীফুল হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। সে উঠে দাঁড়ালো- সাদিয়ার সাথে রিক্সায় ঘুরার ইচ্ছাটা নষ্ট হয়ে গেছে, তবু বাইরে যেতে হবে এলাকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার জন্য হলেও। হাশেমের থেকে বিদায় নিল সে, ‘চাচা আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভাল লাগল, দেখি সময় পেলে একবার গ্রামে যাব । আজকে উঠি, মাঠে বন্ধুরা বসে আছে’। হাশেমের জবাব শোনা অথবা কালামকে কিছু বলবার প্রয়োজন বোধ না করে সে গেটের সামনে গেল, রুমে ঢুকলেন আবিদা আখতার।
আবিদাকে ঢুকতে দেখে হাশেম স্বস্তি পেল । ‘ভাবি, আমাগো ভাইস্তা মাশাল্লাহ ভালই হইচে, ম্যালা কথা শিখচে’।
আবিদা আধচিমটি লবণের সমান হাসি দিলেন।‘তা তো শিখেছেই, বংশের ধারা পেয়েছে’।
কালাম অনেকক্ষণ ধরেই কোনরকম আলোচনায় ছিলনা, তাই সে ভাবল তারও কিছু বলা দরকার।‘তয় ভাবি, ভাইস্তার বুদ্ধি-আক্কেল ইট্টু কম হইচে। হাশেম ভাই হাবিজাবি যা কইচে, সব বিশ্বাস গ্যাচে। শিক্ষিত্ পুলা, ইট্টু খিয়াল করলেই বুঝত উনার কথার ১২ আনাই ভুকাস’।
হাশেম কাচুমাচু করে, আবিদা অবাক হলেন কালামের কথায়।‘না না, হাশেম ভাই কাজটা আপনি ভাল করেননি’। হাশেম হেসে দিল, ‘রাইগেননা ভাবি, খারাপ কিছু কইনাই। দেখলাম আপনের দেরি হইতেচে, আর কালাম ভাই কতক্ষুণ পরপর বিড়ি খাইতে বাইরে যায়- তাইলে ভাইস্তার লগে গপশপ করি। আমি গ্রামের মানুষ, ভাইস্তা শহরে পড়ে- আমি না ডাকলে তো নিজে আইসা কথা কইবোনা, আর কইলেও দায়শোধ দিব। সেইজন্যে অরে হাচা-মিছা মিলায়া বাপ-দাদার কাহিনী কইলাম’।
আবিদা আশ্বস্ত হয়।‘ ঠিক আছে, আপনাদের কথা বলেন’।
কালাম-হাশেম মুখ চাওয়া-চাউয়ি করে। সংকোচ মেশানো কণ্ঠে হাশেমই মুখ খুলে শেষ পর্যন্ত। ‘সমস্যাডা হইল ভাবি, মানে, কালাম ভাইয়ের পোলার’। কিন্তু কালাম ঘিয়ে-আগুনে জ্বলে উঠে , ‘সব দোষ আমার পুলারই তাইলে হাশেম ভাই! আর, তুমার বউ মিশরের রানী, তাইন্যা’?
হাশেম লজ্জায় দুহাতে মুখে ঢেকে ফেলে, আবিদা কিছুই বুঝতে পারেননা। ‘কী হচ্ছে এসব। হাশেম ভাই, এমন করলে কী বুঝবো’?
হাশেম ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে মুখ বের করে আনে, চোখ মুছে লুঙ্গি দিয়ে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কথা বলতে থাকে। ‘কি আর কমু ভাবি, বুইড়া বয়সে দ্যাষ ছাড়নের যোগাড় হইচে। এই যে কালাম ভাই- উনার পুলাডা আমার বড় মাইয়ার সুমান বয়েসী; সেই পুলার লগে আমার বউ, ছিঃছিঃ’।
রুমের মানুষ তিনজন একসাথে বরফ হয়ে গেল, কয়েকমিনিটের জন্য। হাশেম পকেট থেকে ১প্যাকেট গোল্ডলিফ বের করে কালামকে বাড়িয়ে দিল, ‘কালাম ভাই, জুয়ান বয়সে তো ম্যালা বিড়ি টানবার পারতা। প্যাকেটে ৭খান গোল্ডলিফ আছে- যাউ বাইরে যাইয়া শ্যাষ কইরা আসো। ভাবির লগে আমার ইট্টু আলাপ আছে’।
কালাস প্রবল অনীহায় প্যাকেটটা নিল। এমনিতেই অনেক্ষণ ধরে কাশছে, তার উপর হাশেমের কথা শুনবারও একটা আগ্রহ কাজ করছে, কিন্তু আবিদাও যখন বললেন, ‘কালাম ভাই, আপনি তাহলে বাইরে গিয়েই বসেন; পরে আপনার কথাও শুনবো’, তখন তার আর ২য় কোন ভাবনা ভাবার সুযোগ রইলনা।
কালাম গেলে হাশেম চনমনে হয়ে উঠল, তার চেহারাটা একজন গুপ্তঘাতকের মত লাগতে শুরু হল। আবিদা অস্বস্তিতে পড়লেন বটে, কিন্তু হাশেম অবিচল। তার কথাগুলোকে মনে হচ্ছে স্ফূলিঙ্গ।
‘ভাবি, ভাইবা দেখলাম বুইড়া বয়সে মান-ইজ্জত নষ্ট করুমনা, শালীরে মাইরা ফালামু; নাইলে কবে জানি আমারেই শ্যাষ কইরা দিব’।
আবিদা আঁতকে উঠলেন, ‘কি বলেন এসব’।
হাশেম আগের মতই ফুঁসছে, ‘আমিও জানিনা কী কইতেছি; তয় কথা সত্য। আর, এমুনভাবে কামডা কামডা করুম যাতে আমারে কেউ কুনোভাবেই সন্দো না করে। একবার ভাবছিলাম ঘুমের বড়ি খাউয়াইয়া মুখ পলিথিনের মধ্যে ঢুকাইয়া রাখুম, দমবন্ধ হইয়া মরুক। তয় ভাইবা দেখলাম পোস্টমর্টেমে ধরা খাইয়া যামু’।
আবিদা এবার শক্ত কথা বললেন, ‘দেখুন হাশেম ভাই, আমার কাছে এসব বলতে আসবেননা, নিজেও এমন কিছু করবেননা। বেশি সমস্যা হলে ডিভোর্স দিয়ে দেন’।
হাশেমের কণ্ঠ ভারি হয়ে এল, ‘দুঃখটা তো এইখানেই ভাবি। শালী পোলাগো ক্ষেপাইয়া জোর কইরা বাড়ি আর ২খান ক্ষ্যাত নিজের নামে লেইখা নিচে। সেইডাউ কথা না; সামনে মেম্বার ইলেকশন করুম, এই কাম করলে মাইনষে কী কইবো’?
আবিদাকে নিরব দেখে সে পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেল, ‘আমি ভাবী ঐ শালীরে মারুমই, আর নিজেও বাঁচুম। ম্যালাদিন হইচে আমরা আলাদা শুঁই। অর খাটের ফ্যানডার স্ক্রু ঢিলা কইরা দিছি, রুমের কারেন্টের সুইচগুলাও লিক কইরা রাখছি- একদিন ফান্দে পড়বোই’।
আবিদা এবার সত্যিই ভয় পেলেন, ‘আরে আপনার বাড়িতে তো যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে। আপনার স্ত্রীর বদলে অন্যকেউও মারা যেতে পারে’।
হাশেম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘ভাগ্যে মরণ থাকলে থাকবো। তাউ, এউ ছিনাল মাগীরে সহ্য করুম না। আমি নিজের নিয়া ভাবতাম না, কিন্তু ঐ পুলাডার ৮–৯বছরের একখান ছাওয়াল আছে। চান্দের মতন মুখ। অর বউডাও সারাদিন কান্দে- এইগুলা দেইখা মনে কয় মাগীরে কুত্তা দিয়া চুদাই’।
আবিদা হাল ছেড়ে দিলেন, ‘তাহলে আর আমার কাছে এসেছেন কেন’?
হাশেম হাসল। ‘আমার জন্যে আসিনাই, কালাম ভাই লইয়া আইছে। গ্রামে সালিশ হইচে, পোলার শ্বশুরবাড়ি থিকা কোর্টে কেস দিছে। তাই আপনের কাছে ছুইটা আইছি। হাজার হইলেও, মাগী তো কাগজে-কলমে আমারই বউ’।
আবিদা খানিকক্ষণ চুপ রইলেন। ‘হুম বুঝলাম, কিন্তু আপনার প্ল্যানটাও ভালনা হাশেম ভাই- পুলিশ সবার আগে আপনাকেই সন্দেহ করবে। সর্বোপরি, খুন.... না, না এটা একদমই সাপর্টে করা যায়না’।
হঠাৎ হাশেম উঠে দাঁড়াল, আবিদা কিছু বুঝবার আগেই তার মুখ চেপে ধরল শক্ত করে। আবিদা বড়বড় চোখে তাকালেন, কিন্তু হাশেমের বলিষ্ঠ হাতের নিচে তার করবার কিছুই নেই। হাশেম হিংস্র এক প্রাণীর জিন সক্রিয় করল চেতনায়- এক ঝটকায় আবিদাকে রুমের শক্ত ফ্লোরে শুইয়ে দিল, আবিদা নড়তেও পারলেননা। এরপর আবিদার শরীরের অপ্রয়োজনীয় পোশাকগুলো টেনে খুলে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে হাশেম তার শরীরের নিম্নাংশে উঠানামা করল। মাত্র ৬মিনিট, এরপর হাশেম উঠে পড়ল ফ্লোর থেকে, আবিদা সেভাবেই পড়ে রইলেন- তার চোখে অবিশ্বাস, ক্রোধ।
হাশেম লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বলল, ‘ভাবি, এতক্ষণ তো ম্যালা কিছু কইলেন, কিন্তু এইডা কি মাইনা নিতে পারবেন বাড়ির রাখাল আপনেরে রেপ করল? কিন্তু এই ঘটনা কিন্তু আমি-আপনে ছাড়া কেউ জানেনা। তাউ নিজেরই ঘেন্না লাগবো। আর আমার অবস্থাডা দ্যাখেন: গ্রামের জুয়ান-বুইড়া সবাই এই কাহিনী জানে। আপনের যেমুন শহরে মান-সম্মান আছে, আমার কি গ্রামে সেইরকম নাই? এক্ষণ যুদি আপনের হাতের কাছে একখান অস্ত্র থাকে- পুলিশের মায়েরে বাপ, আপনে আমারে নগদে জবাই দিবেন। তাইলে’?
কালাম একবার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু আবিদাকে বিবস্ত্র দেখে কিশোরের গতিতে বাইরে চলে গেল; তার কাশিটা থামছেই না- খকখক খকখক চলতেই থাকে।
আবিদা বিধ্বস্ত চেহারায় উঠে দাঁড়ালেন, হাশেমের দিকে না তাকিয়ে কিংবা শাড়ির তোয়াক্কা না করেই বাথরুমে গেলেন শরীরের বর্জ্য পরিষ্কার করতে। অন্যদিকে, হাশেম মাথা নিচু করে বসেই রইল- উঠতে চাচ্ছে বারবার, কিন্তু পা সায় দিচ্ছেনা একটুও। তার চিন্তায় আবারো খুনের পরিকল্পনাটা আসন পেল- নতুভাবে, তীব্রভাবে; খুনটা সে করবেই।
পুনশ্চ: রশ্মি আর রেখার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। রশ্মির একপ্রান্ত বদ্ধ. অন্যপ্রান্ত মুক্ত- রেখার মুক্ত দুই প্রান্তই। তাই সূর্যের আলো একটা রশ্মি, কিন্তু জীবন? কখনো মনে হয় দুইপ্রান্তই খোলা, কখনোবা মনে হয় একপ্রান্ত। জীবন রশ্মি নাকি রেখা, সেই মীমাংসা হওয়ার আগেই সমস্যাটা তৈরি হয় মূলে : জীবনের আদৌ কি কোন প্রান্ত হয়?
হিমালয় ১৬.০৭.১০
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১০ সকাল ৮:৫৯