somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক(গল্প)

০৬ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমি থেকে সাড়ে তেরশো ফুট বা ততোধিক উপর দিয়ে উড়ন্ত কোন গগনগামী চিল আচমকা ভূমি বরাবর চোখ নামিয়ে যেগুলোকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ভেবে ভুল করে আবারো গনগনে গগনেই দৃষ্টি ফিরিয়েছিল, সেই তথাকথিত গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের অনুভূমিকে হেটে চলা দশবছরের বাদামওয়ালা ছোকরাটির কাছে তা-ই হয়ে উঠল একটা মাঠের এখানে–ওখানে টায়ারের মত গোল হয়ে বসা বিভিন্ন মানুষের আড্ডা--- আড্ডাস্থল রাজধানী শহরের এক মিলনকেন্দ্র, যাকে সুধীসমাজ টিএসসি নামেই চিনে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। এর ভেতরে যে ছোট্ট অথচ সুবিস্তৃত মাঠটা আছে, বিকেল হলেই সেখানে বরযাত্রীর আমেজে মানুষের ভীড় জমে; এই যাত্রায় সবাই বর, সবাই-ই কনে, তাই আলাদাভাবে বরযাত্রী না বলে বর-কনে মেলাও বলা যেতে পারে, যদিও এখানে বর-কনের বয়সের বয়সের কোন বাছ-বিচার নেই, বরের সঙ্গে কনের বৈবাহিক সম্বন্ধও নেই কোনপ্রকার--- তবুও ‘বর-কনে’ তকমা দেয়ার কারণ, বিকালে ভীড় করা মুখগুলো বা মুখের আড়ালের ভাবনাগুলোর মধ্যে যে শিহরণ শনশন করে তার সঙ্গে ঐ বিশেষ সময়ের শিহরণেরই কেবল গ্রহণযোগ্য তুলনা চলে।


মাঠের মাঝখানটায় যে মানবটায়ার স্থির হয়ে আছে, সে দলের মানবসংখ্যা আপাতত সাত; কাগজে-কলমে হওয়া উচিৎ তেইশ--- বাকিদের কেউ কেউ হয়ত পথে আছে; তারা যোগ দিলে সংখ্যাটা টেনে-পিটিয়ে দশ-এগারোতে নিয়ে ঠেকানো যাবে, কিন্তু তেইশ কখনই হবেনা। তিনমাস আগে তেরোজন হয়েছিল-- আড্ডার ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ জমায়েত। প্রচলিত অর্থে একে আড্ডা বলা যাবেনা, আবার নিছক আড্ডা না বলেও উপায় নেই; ‘সংঘবদ্ধ সময় চালাচালি’ বললে হয়ত কিছুটা অর্থ প্রকাশ পাবে। আড্ডাটা প্রথম বসেছিল ১১বছর আগে, সেই আড্ডায় মানুষ ছিল মাত্র ৪জন- তারা এই সংঘের নাম রেখেছিল ‘অফট্র্যাক অথবা অফটপিক বিনোদন’। ১১বছর পর সেই নামটাই বহাল আছে, ৪জনের ২জন—শুভাশিস আর মাহমুদ, এখনো আড্ডায় প্রোপেলারের ভূমিকা পালন করে; অন্য দুজন জীবনের টানে কিংবা জীবিকার ঘ্রাণে আড্ডা থেকে অনেক দূরবর্তী কোন নগরে শোধ করছে বেঁচে থাকার নিমক। দুজনের সঙ্গে বিগত ৪বছরে কোন যোগাযোগ রাখা হয়নি--- ইচ্ছা ছিল-উপায়ও ছিল, ছিলনা শুধু আত্মিক তাগিদ। ২,০,১ এর সমঝোতামূলক বিন্যাসে পুষ্ট ক্যালেন্ডারটা জানাচ্ছে, সালটা ২০১০।

মাসে তিনবার দশদিনের ব্যবধানে সংঘের আড্ডাজীবীরা রাজধানীর কোন খোলা প্রাঙ্গনে সমবেত হয়। প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও সদস্যসংখ্যা অস্বাভাবিক কম হওয়ার নেপথ্য কারণটি খুবই যৌক্তিক, কিন্তু সংঘের গড়ে উঠার পেছনের গল্পটা কারো অযৌক্তিক লাগলে যুক্তির সম্ভ্রমই বরং তাতে বাড়বে!


৯৯সালের জুলাই মাসে শুভাশিসের জীবনে একটা বিদারক বিপর্যয় নেমে এসেছিল, যা সে এতবছর পরও কাউকে বলতে পারেনি। একইমাসে মাহমুদও কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতায় দুঃসময় পাড়ি দিচ্ছিল; তাই স্কুলজীবনের ৩বন্ধু, যারা সেসময় বিভিন্ন ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছিল, তাদের সঙ্গে লালবাগ কেল্লায় বেড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও মনের ফোস্কাগুলো সারছিলনা, কেল্লায় ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় ধপাস করে বসে পড়েছিল; সঙ্গের ৩বন্ধুও তাকে অনুসরণ করেছিল। তার মুখে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছিল-- কথা আসতে চেয়েও উত্তাপে নিঃশেষিত হচ্ছিল। তেমন একটা মুহূর্তে শুভাশিস গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘দোস্ত জীবনটা আসলে দুঃখের গল্প শুনে অপচয় করবার মত যথেষ্ট ফালতু জিনিশ না। তার চে এক কাজ কর- লাস্ট ১০দিনে টাকা-পয়সা আর সাংসারিক চিন্তা বাদে যেসব চিন্তা করেছিলি, এবং যেগুলোর একটাও বাস্তব হয়নি-- সেসব কথা বল্ আমাদের। দেখি, আমাদের ঝরে পড়া চিন্তাগুলো আমাদের কিছুই দিতে না পারলেও অন্তত এক পশলা সুখ দিতে পারে কিনা’।– চিন্তাশীল ছেলে হিসেবে শুভাশিসের কথার মূল্যমান নিতান্ত ফেলনা নয়--- উপস্থিত সবারই প্রস্তাবটা বিচিত্র লেগেছিল, আড্ডাটা চলেছিল টানা ৩ঘণ্টা। পরবর্তী কয়েকসপ্তাহেও এভাবে আড্ডা দেয়ার পর ৪বন্ধু উপলব্ধি করল আড্ডাটা একটা ব্যতিক্রমধর্মী সুখের মহাজন হয়ে উঠেছে, তাদের মনে হল আড্ডার জন্য ৪জন খুবই কম হয়ে যাচ্ছে-- আরও নতুন মানুষ অন্তর্ভুক্ত হলে ভিন্নধারার পতিত-চিন্তার সাথে চেনা-জানা হবে। কিন্তু চাইলেই তো আর এধরনের আড্ডায় মানুষ আসতে সম্মত হবেনা, এজন্য কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়--- প্রতিটি মানুষের অভ্যন্তরেই অদ্ভুত কিছু শূন্যস্থান থাকে; সেই শূন্যস্থান পূরণের প্রয়োজন নেই, অনুধাবন করে প্রাসঙ্গিক কথা-বার্তা বললে হয়ত সেই শূন্যস্থানগুলো বেরিয়ে এসে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে উৎসাহী হবে। অবশ্য পরবর্তীতে নতুন মানুষের ব্যাপারে কিছু পরিমার্জিত নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছিল, কারণ মানুষ বেশি হয়ে গেলে আড্ডাটা কারওয়ান বাজার হয়ে উঠবে। তাই সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেক আড্ডাজীবী সারাজীবনে মাত্র একজন নতুন মানুষ সংঘে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে, এবং এই নতুন সদস্যরা পরপর ২ আড্ডায় উপস্থিতও থাকতে পারবেনা।


‘অফট্র্যাক অথবা অফটপিক বিনোদন’ নামটা আজিজের মস্তিষ্কপ্রসূত, যে কিনা আড্ডা থেকে বিদায় নেয়া ২জনের একজন হয়েছিল কয়েক বছর পরে। তবে যাওয়ার আগে আজিজ তার ‘একজন নতুন সদস্য ভুক্তি’ কোটার কোটাটি পূরণ করতে পেরেছিল--- সুমন নামের এই আড্ডাজীবী এখনো বেশ সক্রিয়ভাবেই সংঘের সঙ্গে রয়ে গেছে, তার সূত্রেও একজন নতুন সদস্য সংঘে যুক্ত হয়েছিল, এবং বিরক্ত হয়ে প্রস্থানও নিয়েছে--- সুমন এজন্য কিছুটা হতাশ, কারণ মাত্র একবারই সে সদস্য ভুক্তির সযোগ পাবে, সেটা সে এভাবে বাজে খরচ করল!

আজিজের সূত্রে সংঘে এলেও তার সঙ্গে সেই অর্থে সুমনের কোন বন্ধুত্ব ছিলনা। আজিজদের এক স্কুলবন্ধু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তেজকুনিপাড়া একই মেসে থাকত সে। একবার ভার্সিটির গোলমালে আজিজ ২সপ্তাহের মত সেই মেসে গিয়ে উঠেছিল, তখনই দুজনের পরিচয়। দুজনের মধ্যে একটা অন্তমিলও ছিল : শব্দভান্ডার সীমিত হলেও শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারে, অর্থাৎ একটানা বকবক করতে কারোরই ক্লান্তি আসেনা, তাই আজিজের মেসে অবস্থানের দিনগুলোর নাম হতে পারে কথালিপি কথন। তবে ২-১দিন কথা বলেই আজিজ বুঝে নিয়েছিল সুমন মুখে যতকথা বলে তার থেকে অনেক বেশি কথা মনের ক্ষেতে চাষাবাদ করে--- তার ভেতরের মানুষটিতে শূন্যস্থানের বুদবুদ উঠে। আজিজও বুদবুদ ধরতে চাইছিল, এবং পেরেছিলও অনেকটাই। জেনেছিল, পাবনা শহরের উপর নিজেদের বাড়ি থাকার পরও সেই ক্লাশ এইট থেকে সুমনকেই সংসারের দেখভাল করতে হয়, যদিও তার মান্যবরেষু পিতা-পিতামহের উভয়েই প্যান্ট আর লুঙ্গির গিট জোরেশোরে বাধবার মত যথেষ্ট বলশালী ছিলেন তখন। তার বাবা ভবঘুরে ধরনের মানুষ--- নেহায়েত ঝোকের বশে বিয়ে করে অতিআবেগে পিতৃত্ব লাভ করেছেন, ২ঘণ্টা কোথাও স্থির বসে থাকা তার ধাতে নেই; আর দাদার সাফ কথা হল, ছেলেরটা ছেলেই বুঝে খাক! সুতরাং, সুমনের প্রতিটি দিনই চলছিল না চলতে চাওয়ার আকুতি নিয়ে, তখনো পর্যন্ত ২১বছরের জীবনটাকে তার স্রেফ একটা মহাসড়ক বলে মনে হত, যেখানে দূরপাল্লার বাস চলবে; রিক্সা-ভ্যানের মত নিরীহ যান চলতে চাইলে জানের ছদকা দিয়ে রাখতে হবে।

তবে আজিজকে সে তার স্বপ্নের কথা বলেছিল : সে ঢাকা শহরে থাকবেনা, পাবনা কোন অফিসে চাকরি নেবে, অনেক দামী একটা গাড়ি কিনবে, বাহারী রঙের অনেকগুলো স্যুট থাকবে তার, মাথার চুল স্পাইক করবে, মাঝে-সাঝে ঢাকা এসে বারে ঢু মারবে-- বিত্তশালীদের ড্রিংক করা দেখবে; বিপাশা হায়াতের মত সুন্দরী একটা বউ হবে তার, মাথায় ঝুটি বাধা একটা মেয়ে থাকবে--- সে অফিস থেকে ফিরলে মেয়েটা চকলেট চেয়ে কান্না-কাটি করবে। অথচ সেসময়টাতে সে তেজকুনিপাড়ার ঐ অস্বাস্থ্যকর মেসের ঘিঞ্জি একটা রুমে কোনরকমে সময়-ব্যবহার করছিল-- একটা কোচিংয়ে পড়াত, আর লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে তিতুমীর কলেজে একাউন্টিংয়ের ক্লাশ করতে যেত। আজিজ ভেবে-চিন্তে চূড়ান্ত করেছিল, একে দিয়েই তার সদস্যভুক্তির কোটাটি পূরণ করবে।

এর কয়েক বছর পর চাকরি পেয়ে স্বয়ং আজিজই বরিশালের লঞ্চে উঠলেও সুমনের আর পাবনা ফেরা হয়নি, সংঘের সঙ্গেও যায়নি দূরত্ব বাড়ানো। জীবনে অনেক বড়কিছু হয়ত হওয়া হয়নি, এমন কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষাও সত্যিকার অর্থে তার ছিলনা, তবে জীবনে একটা ঠিকানা সে চেয়েছিল, যা সে পেয়েও গেছে । কৃষিব্যাংকে একটা মাঝারি মানের চাকরি সে যোগাড় করতে পেরেছে। এখন প্রতিরাতে শরীর-মন বলে সারথি চাই, কিন্তু দায়িত্বের পর্বত বলে এখনই নয়, আর বর্ধিত বয়স বলে যা হচ্ছে হোক ; সুমন তাই ঝরে পড়া ভাবনাগুলো আড্ডায় না বললে, এ নিয়ে সূক্ষ-স্থূল রসিকতা না করলে দাঁতের ফাকে মাংস আটকানোর অস্বস্তিতে ভুগে।

সে নিজে যাকে দিয়ে তার সদস্যকোটা পূরণ করা হেতু হতাশাজনিত খচখচানিতে ভুগে, সেই রুস্তম তার সুজন-বন্ধু, কিছুই নয়। তবুও তাকে নির্বাচন করে সুমন কেন তার সদস্যভুক্তির ক্ষমতাটা বিসর্জন দিল, এর উত্তরে দুটো সম্ভাব্যতা আসে--- হয়, সুমন যে কোনভাবে দায় সারতে চাইছিল, অথবা তার মনে হয়েছিল আড্ডাজীবীদের অধিকাংশই ভাবুক ধরনের মানুষ, যারা মূলধারার জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করেনা, এদের ঝরে পড়া চিন্তাগুলো ফ্যান্টাসি-আক্রান্ত; কিন্তু লাইফবয় গোল্ড সাবান মেখে দীর্ঘ ১৭মিনিট ধরে গোসল করা রুস্তম, শান্তিনগরের বহুতল ভবনের উমেশ সরকার, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার নগেন্দ্র গোস্বামী, কিংবা দামী চুরুট খাওয়া আবু বকর সিদ্দিকী--- সবাই একই গণ্ডির জীবনকে বহন করছে, সেই জীবনের ঝরে পড়া চিন্তার সঙ্গে জানাশোনা হলেই বোঝা যাবে চিন্তার তারতম্যগুলো জ্যামিতিক-গাণিতিক, নাকি এক্সপোনেন্টশিয়াল আকারে উঠানামা করে।

চাকরি পাবার পর মিরপুর ১২নম্বরে সুমন ২রুমের যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত চেহারার বাসাটা ভাড়া নিয়েছে, সেই বাড়িওয়ালার অনিয়ন্ত্রিত বংশবৃদ্ধির ফলে জন্মানো ৫টি সোমত্ত-অপদার্থ ছেলের তৃতীয়জন এই রুস্তম। ঘরে বসে থাকলে শেলাই-ফোড়ের কাজ করতে হবে, আর বাইরে ঘোরাঘুরি করলে মদ-মেয়েমানুষের নেশা ধরতে পারে-- এই আশঙ্কায় বাবা তাকে মোড়ের একটা ভাতের হোটেল খুলে দিয়েছেন।

রুস্তম বয়সে সুমনের চেয়ে২-১বছরের বড় হবে। ঢাকা শহরে জীবাণু আর জ্যাম, দুটোই অফুরন্ত বলে সুমনকে সময়মত অফিস ধরতে এত সকালে বাসা থেকে বের হতে হয় যে রুস্তমের হোটেলেই নাস্তাটা সেরে নিতে হয়। প্রতিদিন খাওয়া শেষে সে যখন বিল দিতে যায়, রুস্তম কোন হলুদ অথবা খয়েরি রঙের গেঞ্জি গায়ে ক্যাশে বসে থাকে-- তার মাথার মাঝ বরাবর করা সিথিটা চুনকাম খসা দেয়ালের মত লাগে। সেসূত্রেই আলাপ, আর বন্ধের দিনগুলোতে বিকালে চা-নাস্তা খেতে খেতে হোটেলে আড্ডাও হয় ছোটখাট। তখনই রুস্তমকে নিজেদের সংঘের গল্প শুনিয়েছিল সে; রুস্তম তেমন আগ্রহই বোধ করেনি প্রথমদিন, কিন্তু দুদিন পর সে নিজে থেকেই সুমনকে ঠারেঠুরে সংঘের বিত্তান্ত জিজ্ঞেস করে, কারণ ক্যাশ গোনা,কর্মচারীদের সঙ্গে চেচামেচি, বউয়ের সঙ্গে রঙ্গরস, দিনের শেষে বাবার পানের পিক মাখা অপরিচ্ছন্ন মুখের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা‌, আর কোন কোনদিন কর-বেকরে তাপসের দোকানে ক্যারম খেলার প্রচণ্ডরকম গৎবাধা জীবনের কাঁচা-আমলকি স্বাদে বীতশ্রদ্ধ মন চাইছিল নতুন কোন স্বাদ; সেটা লেটুস পাতার স্বাদ হলেও সই! তাছাড়া, নতুন মানুষগুলোর কাছে নিজের হোটেলের বিজ্ঞাপনটাও তো মুফতে দিয়ে রাখা গেল!

কিন্তু দুটো আড্ডায় গিয়েই সে অনুধাবন করে সে ক্রিকেট খেলায় গোলের হিসাব কষতে বসেছে, এই আড্ডাজীবীদের সঙ্গে তার পোষাবেনা। নিজস্ব পতিত-চিন্তা প্রসঙ্গে সে প্রথম আড্ডায় খুব সমান্যই বলতে পেরেছিল : হোটেলটা ভেঙ্গে একটা বিরিয়ানী হাউজ দেবে, বাবা মারা গেলে সম্পত্তির বেশি অংশটা কিভাবে বাগাবে, এইসব। এখনও সুমনের সঙ্গে প্রতিসকালে দেখা-কথা হয়, আড্ডাও হয় কদাচিৎ, কিন্তু সংঘের ব্যাপারটা শাশুড়ির ডাকনাম হয়ে গেছে আলোচনায়।


রুস্তমের অন্তুর্ভুক্তিটা শুভাশিসের ভাল লাগেনি। অবশ্য তার ভাল লাগাটাও শুক্রবারে অফিস খোলা থাকার মতন ঘটনা, কারণ ১১বছরেও সে তার সদস্যভুক্তির কোটাটি পূরণ করেনি। মাহমুদ, সুমনসহ সংঘের পুরনো আড্ডাজীবীরা ধরেই নিয়েছে সে কাউকে নির্বাচিত করবেনা, অপশনটা সে রেখে দেবে, একটা পর্যায়ে আড্ডাবাজি থেকে চোখ সরে গেলে এই বলে সান্ত্বনা নেবে, আমি নিজে তো কাউকেই এখানে নিয়ে আসিনি।
শুভাশিসও মানে আড্ডা এবং সে, কেউ কাউকে ধরে থাকতে পারবেনা; ভাটার টান পড়বেই, কিন্তু পড়ি পড়ি করেও টানটা আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধু। ছাত্রজীবনে প্রবল ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার, কিন্তু চান্স না পেয়ে রেগেমেগে শেষে পালি’তে অনার্স পড়েছে। চাকরি করার ইচ্ছা অন্য সব মানুষের মত তারও ছিলনা, এবং যথারীতি সবার মত তাকেও অন্নের মোচড়ের সাথে সমঝোতায় আসতে হয়েছে। লোকে জানে সে একটা ট্রাভেলিং এজেন্সিতে চাকরি করে---তাদের জানাটা মিথ্যে নয়, তবে এর বাইরেও একটা ছোট্ট কার্যক্রম আছে: ৬মাস হল শেয়ার বাজারেও টুকিটাকি বিনিয়োগ চলছে। চিরচর্চিত প্রভাষণ বলে, বিয়ের সানাই ভাববিলাসের যমদূত, অথচ সংসারের অর্ধদশক এবং পিতৃত্বের ১বছর পার করে ফেললেও ‘অফট্র্যাক অথবা অফটপিক বিনোদন’ তাতে টালমাটাল হয়নি, যদিও ‘বাবা’ ডাকটা তার ভাবনাকে ভেঙ্গেচুরে দিতে চায়, ইচ্ছে হয ব্যস্ততার মাঝে পাওয়া অবসরটুকু আড্ডাকে না দিয়ে ছেলেকে দিতে। কিন্তু আড্ডায় এসে নতুন নতুন ঝরে পড়া চিন্তা আর চিন্তার বিবর্তন দেখে সে পিতৃসত্তার সঙ্গে মীমাংসা করতে চায়-- মাসের ২৭দিন যদি কর্তব্যে অবহেলা না করি, তাহলে এই তিনটে মোটে দিন একটু কষ্ট করে মেনে নাওনা বাবা!


শুভাশিসদের সবপাশেই অসংখ্য বৃত্ত-উপবৃত্ত মানুষের-- মাঠের খুব বেশিসংখ্যক সবুজ ঘাসের ভাগ্য হচ্ছেনা উপরের আকাশ দেখবার। একটা দল আবৃত্তি অনুশীলন করছে। শুভাশিস বারকয়েক তাকিয়েছিল সমস্বরে আবৃত্তি শুনে, বিরক্ত হয়ে চোখ ঘুরিয়ে এনেছে--- একগাদা ছেলে-মেয়ে শেয়ালের পালের মত একসাথে ‘আবার আসিব ফিরে’ বলে হুক্কাহুয়া করছে—এটা কেমন আবৃত্তিচর্চা!

কয়েকগজ দূরত্বে গিটার, ঢোলওয়ালা একটা দলও বসেছে, সংখ্যায় ৫জন। মানুষের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করেই তারা নিজেদের মত গেয়ে যাচ্ছে, গিটারবাদক গায়ক ছেলেটার ভরাট কণ্ঠ যে কয়েকজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হল শুভাশিসকেও তাদের মধ্যে রাখতে হবে। তার গান ফিরিয়ে আনছে সঞ্জীব চৌধুরীকে। ‘আমি তোমাকে বলে দেব— কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেটে গেছি বিরান পথে’। গানটা শুনে শুভাশিস থেমে থেমে ছেলেটার দিকে তাকায়—বসে আছে বলে উচ্চতা বোঝা না গেলেও শারীরীক কাঠামো বলছে মাঝারি উচ্চতা হবে, মাথায় ঝাউবন, মুখে খোচাখোচা দাঁড়ি, কঠিন-তরল-বায়বীয় সবরকমের নেশার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতার সাক্ষ্য দিচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু চেহারা।

সঞ্জীব চৌধুরীর গান খুবই পছন্দ শুভাশিসের, তার মৃত্যুর পর রীতিমত আপনজন বিয়োগের ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল। ১২বছর আগে তাদের কলেজের একটা অনুষ্ঠানে দলছুট ব্যান্ড গিয়েছিল গান শোনাতে, তার ইচ্ছা ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর একটা অটোগ্রাফ নেবে, কিন্তু ভীড়-ভাট্টায় আর নেয়া হযনি। ছেলেটার গান শুনে একঝলক সেইসব দিন উকি দিয়ে গেল।
সে আবারো আড্ডায় নিমগ্ন হয়। মাহমুদ ছাড়াও আরও ৫জন এসেছে- তপু, স্বপন, অভিজিত, জোবায়ের, জয়ন্ত। জয়ন্ত আজই প্রথম এল -- তপুর নির্বাচিত কোটায়। এ মুহূর্তে অভিজিত তার ঝরে যাওয়া চিন্তার কথা শোনাচ্ছে, বাকিরা সেই নিরিখে রসিকতা করছে; আনারসের মত এবড়ো-থেবড়ো চেহারা নিয়ে বসে নেই কেউ।

সব অচেনা মানুষের মধ্যে এসে জয়ন্ত শুরুতে কিছুটা নড়বড়ে ছিল, তাই তাকে স্বাভাবিক করতে সংঘের নিয়মানুযায়ী আড্ডাজীবীদের প্রত্যেকে তাকে ৩টি করে প্রশ্ন করছিল, সে উত্তর দিচ্ছিল, আর একটু একটু করে সঙ্কোচ মুছছিল। কিন্তু শুভাশিসের প্রশ্নের কোন তাৎক্ষণিক জবাব খুঁজে পাচ্ছিলনা। প্রশ্নটা এমন: ধরুন, আপনার বুদ্ধিবৃত্তি-পরিস্থিতিজ্ঞান-রুচি সবই স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আপনি একজন ব্যর্থমানুষ। অথবা, আপনি বলছেন আপনি খারাপ মানুষ, কিন্তু সঙ্গে এও জুড়ে দিচ্ছেন, আপনি জানেন আপনি ভাল মানুষ।– এ ধরনের প্যারাডক্সকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন’? সবাই যেখানে হালকা প্রশ্ন করছিল, সেখানে শুভাশিসের এমন হাইভোল্টেজ দার্শনিক প্রশ্নে জয়ন্ত একটা বড়সড় শকই খেয়েছিল, বুঝতেই পারছিলনা শুভাশিস তাকে অপমান করল, নাকি তার সঙ্গে রসিকতা করল। ইতস্তত করতে করতে সে জবাব দিয়েছিল, ‘ভাই, এত জটিল প্রশ্ন তো মাথার এন্টেনায় ধরেনা। ইয়ে, প্যারাডক্স কথাটার মানে কী’?

শুভাশিস মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে তর্জনী উচিয়ে দেখিয়ে বলেছিল, ‘ঐখানে লালড্রেস পরা যে মেয়েটা বসে আছেনা, ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন’।–কথাটা এত গম্ভীরভাবে বলেছিল যে জয়ন্ত সত্যিই উঠতে চাচ্ছিল। কিন্তু অন্যরা শুভাশিসের বাকভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত বলে তারা সশব্দে হেসেছিল।


শুভাশিসের উল্লিখিত দিকটাতে লালপোশাকের কোন মেয়ে নেই, উত্তরেও নেই, কিন্তু সঞ্জীব চৌধুরীর গান গাওয়া রকি নামের ছেলেটার থেকে কয়েকফুট দূরত্বে একটা মেয়ে সত্যিই বসে আছে। সামনে ঝুঁকে পড়ে সে খাতার পৃষ্ঠায় পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছে—পাড়ে থেমে থাকা ডিঙ্গি নৌকায় একটা মেয়ে শুয়ে আছে, তার দৃষ্টি উপরে আকাশের দিকে; সম্ভবত নিজেরই ছবি। ছবি আঁকছে আর আগ্রহভরে চারপাশে তাকাচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে মাঠের মানুষগুলো নিয়েই কোন দৃশ্যচিত্র ভাবছে, কিন্তু বিথীকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনে তারা জানে ছবি আঁকার সময সে এভাবেই আশপাশে তাকায়, কারণ যে ছবিটা সে আঁকতে চায় সেটিকেই বিভিন্নরূপে চারপাশে কল্পনা করে নেয়, ফলে আশপাশের বাস্তব দৃশ্যগুলো তখন কল্পনার দৃশ্যের নিচে লুকিয়ে পড়ে।

স্কুলজীবনে প্রচুর ছবি আঁকা হত, ইন্টারমিডিয়েটে তাতে স্থিতি এলেও অনার্স পড়তে ঢাকা চলে আসার পর আবারও একটু একটু করে পুরনো অভ্যাসের পরিচর্চা শুরু হয়েছে। এবং এক্ষেত্রে নিঃসঙ্গতা একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
কুয়েত-মৈত্রী হলের ৩২০ নম্বর রুমের দরজাঘেষা বিছানটায় উদাস শুয়ে থেকে সে বিমর্ষ হত, মনে পড়ত বাড়ির কথা; পরিবারের যে কোন সদস্যের চেয়েও বাড়িটা তাকে তীব্রভাবে টানত, ৩২০নম্বর রুমটাকে মনে হত বাড়ির বারান্দা। ইটের দেয়ালে টিনের চাল--- গ্রীষ্মে টিনের গরম, বৃষ্টিতে টিনের চালে চুড়ির মত বৃষ্টির শব্দ, আর চালের নিচে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়া, ছোটভাইয়ের সঙ্গে টিভি দেখা নিয়ে ঝগড়া বাধানো, ওর সাইকেলের পিছনে চড়বার বায়না ধরা--- সবকিছু স্মৃতির কাঠঠোকরা হয়ে তার মাথায় ঠোকর মারত। রাতে রুমের সবাই ঘুমিয়ে গেলে টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে ছোট ভাই-মা-বাবাকে চিঠি লিখত; লেখা শেষে ছিড়ে সেগুলো জানলা দিয়ে নিচে ফেলে দিত, মনে মনে ভাবত রাতের আঁধারের পিঠে সওয়ার হয়ে অনুভূতিগুলো ঠিকই তার আপনজনদের ভাষা-পরিভাষা খুঁজে নেবে। কিন্তু মোবাইলে কথা বলার সময় ছোট ভাইকে ধমকে, বা মা-বাবার সাথে কাটকাট কথা বলে বেদনার সাথে খেলত বরফ-পানি খেলা।

তাই নিজেকে বদলাতে-ব্যস্ত করতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে। তখন থেকেই বিবর্ণ বিকেলগুলোকে হলুদ-গোলাপির মিশেল দিতে সে এই মাঠটায় এসে বসে মাঝেমাঝে। কোন কোনদিন বান্ধবী লাবণ্য তার সঙ্গী হয়, দুজনে বসে চিনাবাদাম-ঝালমুড়ি খায়, আর লাবণ্যের নানাবাড়ি-দাদাবাড়ির গল্প শুনে, স্কুল-কলেজের গল্প শুনে। সারাদিনে হয়ত সে ১০টার বেশি কথা বলেনা, কিন্তু লাবণ্যের সঙ্গে থাকলে শুধু চুপচাপ শুনে গেলেও দেখা যায় কথার সংখ্যা ২০-৩০ হয়ে গেছে, সময়টাও কাটে মধুর ক্যান্টিনের সাদা মিষ্টির মতই দারুণ। কিন্তু লাবণ্য একটা পার্ট-টাইম চাকরি করে বলে তাকে সবদিন পাওয়া যায়না। এই একলা দিনগুলোতে বিথী মাঠে বসে নিজের মত করে ছবি আঁকে, আঁকা শেষে পৃষ্ঠাটা ছিড়ে নৌকা বানায়, এরপর মাঠেই ফেলে রেখে চলে যায়। বাদামওয়ালারা সেই নৌকাকে আবারো এক টুকরো কাগজে রূপ দেয়, অতঃপর কাগজ ঠোঙ্গা হয়ে যায়, যার বুকে জড়ানো থাকে বিথীর বিকেলের মুহূর্তগুলোর কফিন। ইদানীং বিথীর নতুন একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে--- সে মিনারেল ওয়াটারের বোতল সংগ্রহ করে, সেই বোতল কখনো গলিয়ে বা কখনো কাটি-কুটি করে নানান জিনিসপত্র বানায়— ফুল, ফুলের টব, হাতি, ঘোড়া, আরও কত কি।


বিথীর ঠিক ডানপাশে একটা জুটি বসেছে, সেদিকে হয়ত তাকানোই পড়তনা, কিন্তু তাদের ভঙ্গিটা তার চোখকে কয়েকসেকেন্ড খরচ করতে একপ্রকারে বাধ্য করল। মেয়েটা পা মেলে বসে আছে, ছেলেটা তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে; মেয়েটির চোখ নিচের দিকে আনত। মাঠের এত মানুষের মধ্যেও অনুভূতিকে স্বাধীন মানচিত্র দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি বলে বিথীর ওদেরকে ভাল লাগল বটে, কিন্তু আর্টের বিচারে ওদের বসাটাকে খুবই সাধাসিধে মনে হল। কল্পনায় ছেলে-মেয়ে দুটিকে সে নিজের পছন্দসই পজিশনে নিয়ে নিল : দুজনই ঘাসের উপর শুয়ে আছে—একজন দক্ষিণমুখী, অন্যজন উত্তরমুখী; পাশাপাশি বিপরীতমুখী শোয়াটা এমন যেখানে মেয়েটার মাথা আর ছেলেটার বুক একই সরলরেখায় রয়েছে; চাইলেই পরস্পরের মুখ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা না করে দুজনে আকাশ দেখছে, আকাশে খুঁজছে নিজেদের প্রতিবিম্ব!
জমাট হয়ে আসা সন্ধ্যায় জুটিটার ওভাবে বসে থাকাটা রকিও খেয়াল করেছিল, কিন্তু সে কোন কথা না বলে প্রকাশটা করল গানে- ‘কালো, ও সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালোহরিণ চোখ; কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’।

গান শুনে এমনকি মেয়েটাও লজ্জা পেল, ছেলেটা উঠে ঠিক হয়ে বসল, রকির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেও দিল, রকি প্রত্তুত্তরে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল- ক্যারি অন বস্ । বিথীও গানটা শুনে মেয়েটাকে আরও একবার দেখল : মেয়েটা শ্যামলা, চোখ দুটোও হরিণ না বলে মহিষচোখ বলা যায় সর্বোচ্চ।

বিথী ভাবল তার ছবির মেয়েটাও তো নৌকায় শুয়ে আকাশ দেখছে, তাহলে পাশে ছেলেটাকেও শুইয়ে দিক; পানিতে কিছুসংখ্যক কচুরিপানা ভাসুক, আর ছেলেটা কচুরিপানায় হাত রাখুক, অন্যহাতে সামান্য পানি নিয়ে কৃষ্ণকলির মুখে মেখে দিক। মনে মনে দুলাইনের একটা গানও বেধে ফেলল : ‘কৃষ্ণবর্ণের কোমল কলি, তারে দেখে ভুবন ভুলি’।
ছবি আঁকাটা প্রায় শেষপর্যায়ে--- পানিতে কচুরিপানা দেয়া হয়েছে, ছেলেটার শরীরও সম্পণ্ন, কিন্তু মুখ দেয়ার ক্ষেত্রে বিপত্তি বেধেছে; ছবির মেয়েটা যেহেতু সে স্বয়ং, তাই তার পাশে এভাবে নৌকায় শুয়ে থাকা ছেলেটিকে সে কোনভাবেই কল্পনায় আনতে পারছেনা। প্রেম-টেম তাকে টানেনা, পড়াশোনা শেষের আগে বিয়েরও সম্ভাবনা নেই বলে আগামী বছরকয়েকের মধ্যে অন্তত স্বামীনামক বস্তুটিকে অধিগ্রহণেরও অবকাশ নেই--- তাহলে কার মুখ কল্পনা করবে সে?

অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল মাথার আদলটা দিয়ে রাখবে, মুখটা পরে কোন একদিন একে নেবে, যেদিন সত্যিই বাস্তব মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়াবে, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলবে, ‘তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ গগনের তারা’। তাই, এই প্রথম সে একটা অসম্পূর্ণ ছবি আঁকল পরিপূর্ণ সম্পূর্ণতা পেতে, এবং এই প্রথমবার সে ছবির কাগজটা দিয়ে নৌকা বানালনা, যত্ন করে খাতায় রেখে দিল, যাতে ভাজ না পড়ে। এ সংক্রান্ত অনুভূতির আবেশে চটাচট সে কিছু পরিকল্পনাও করে ফেলল : এখন থেকে সময় পেলেই সে রঙ-বেরঙের রুমাল কিনবে, প্রচুর চুড়ি কিনবে, যতদিন না সেই মানুষটার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এরপর দেখা হলে সবচেয়ে সুন্দর রুমালটি তাকে উপহার দেবে, আর এত এত চুড়ি যোগাড় করে রাখবে যাতে মানুষটি প্রতিদিন তার হাতে নতুনন চুড়ি পরিয়ে দিতে পারে। ‘রুমাল দিলে ঝগড়া হয়’ কথাটা সে ভুল প্রমাণ করে ছাড়বেই।

তবে সে এও বুঝতে পারছে, সন্ধ্যাবেলা টিএসসির এই আলো-ঝলমলে আবহাওয়া, ৯নম্বর লোকাল বাসের মত হুক্কর-হুক্কর বওয়া বাতাস ভাববাদী চিন্তা প্রসবের জন্য অনুকূল; কিন্তু ভাববাদ তো আর ভাত দেবেনা, তাই খাতাটা বন্ধ করে সে পড়াশোনা-পরীক্ষার কথা মনে করতে থাকে, লাবণ্য-রাবেয়া-সানজিদাকে মনে করে। নীলক্ষেতে গরুর হাটের মত জ্যাম পেরিয়ে তাকে হলে ফিরতে হবে, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কোন মানবিক রিক্সাওয়ালা যেতে রাজী হবে তাও বলবার উপায় নেই। সুতরাং এক সুনিশ্চিত অনিশ্চিত প্রত্যাশা নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল; মাঠের ভীড় একটু কমেছে, তবুও আলো-আধারিতে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে কোন স্টিমার--- ঘাসের নদীতে তারা স্থির হয়ে আছে, কখনো কখনো ঢেউয়ের তোড়ে দুলছে সামান্য। রকি এখনো গান থামায়নি, ‘কৃষ্ণপক্ষ-কালোপক্ষ, কোন্ পক্ষেতে মধু আছে গো’। সেই জুটিটা চলে গেছে, ফেলে যাওয়া জায়গার কাছাকাছি দূরত্বে এখন এক প্রৌঢ় দম্পতি বসে আছে—তাদের মুখে কোন কথা নেই। শুভাশিসদের আড্ডাও চলছে, কিন্তু তাতে তো তার কিছুই আসে-যায়না, সে সামনে এগোয়, প্রতি পদক্ষেপের গতি বিভ্রম-বিক্রমে হারিয়ে দিতে থাকে পূর্ববর্তী পদক্ষেপকে।
বেরুনোর পথে টিএসসির গেটে সারবেধে ল্যাপটপ হাতে বসে থাকা মুখগুলোকে তার নদীতে ভেসাল জাল ফেলে অপেক্ষমান জেলে বলে মনে হল; ওয়াইম্যাক্স সুবিধা নিতে আসা এইসমস্ত মুখগুলোর একজনের ল্যাপটপের মুখাবয়বে সে চলতি অবস্থাতেই ২ সেকেন্ডের জন্য তাকায়--- দ্যাখে স্বল্পবসনা হাস্যোজ্জল ক্যাটরিনা কাইফকে।

সে টিএসসি মোড়ে এসে দাঁড়াল, কিন্ত কোন রিক্সাওয়ালাই মানবিক সাহায্য করতে সহায় হচ্ছেনা। একটা রিক্সা এসে তার সামান্য সামনে গিয়ে থামল; রিক্সার আরোহীর বয়স ত্রিশের আশপাশে, আরোহীকে নেমে ভাড়া মেটাতে দেখে সে একটা বিস্কুট দৌড় দিল যাতে অন্যকেউ সুযোগ না পায়। যতটা ভদ্র তারও বেশি ভদ্রভাবে রিক্সাওয়ালাটিকে একটা নির্দোষ প্রশ্ন করল- ‘মামা বিডিআর গেট যাবেন?’ রিক্সাওয়ালার মানবতাবোধ জেগে উঠল, আরোহীটি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে একবার শুধু তার মুখের দিকে তাকাল, এরপর হাটা ধরল-- গন্তব্য টিএসসি মাঠ।

গত কিছুদিনে সুমনের ঝরে পড়া চিন্তা আর টিকে থাকা চিন্তার অনুপাতটা প্রায় সমান সমান। চাকরি করতে ইচ্ছা হচ্ছেনা, ছোট ভাইটাও বেযাদবি করাটা শিষ্টাচারের মত করে রপ্ত করেছে, বাবার চোখে ছানি পড়েছে, মা কেমন যেন চুপসে গেছেন অনেকদিন--- সবমিলিয়ে নিজের চাওয়াগুলোই হারিয়ে যাচ্ছে, নিজেকে নিজের ফসিল মনে হচ্ছে। তাই খুব আস্থার সঙ্গেই সঙ্গোপনে নিজেকে এখন সুমনের চেয়ে ‘প্রাক্তন সুমন’ ভাবতে ভাল লাগে তার। তবুও সে আশা খুঁজে, অবলম্বন খুঁজে বলেই অফিস শেষে সেই মিরপুর থেকে ছুটে এসেছে সংঘের আড্ডায়। আজ যেসব ঝরে পড়া চিন্তার কথা বলবার কথা ছিল, কিছুক্ষণ আগে তার আরও একটি সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে: রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দেবার সময় যে মেয়েটা তারই ছেড়ে আসা রিক্সায় বিডিআর গেট গেল, সেই মেয়ের ছুটে আসাটা তার মাঝে কৌতূহল জাগিয়েছিল, ইচ্ছা হচ্ছিল আরেকটা রিক্সায় চড়ে পিছু নেবে, গিয়ে দেখবে বিডিআর গেটে যেতে এমন হন্তদন্ত হবার কী ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের না কামানো দাঁড়ি তার ব্রনযুক্ত মুখে কুটকুট করে জানাল, ‘বয়স নেইরে পাগলা’।


সাড়ে আটটা বেজে গেছে, ভীড়ও কমে এসেছে অনেকটাই; এর মধ্যে শুভাশিসদের খুঁজে পেতে বিশেষ সমস্যা হলনা। তার উপস্থিতিটা প্রথমে সেভাবে কেউ খেয়াল করেনি, পরে খেয়াল করলেও প্রতিক্রিয়ায় হেরফের হলনা; শুধু শুভাশিস টিপ্পনী কেটে বলল, ‘কি মিঞা, আড্ডা তো শেষ, সবাই উঠবে, আর তুমি মাত্র আসলা’! সুমন একথাকে আমল না দিয়ে হাতের নখ ফোটাল, কলগেট পেস্টে ব্রাশ করা দাঁতের একাংশ বের করা হাসিতে বলল, ‘ বিডিআর গেটে গেছিলাম’।
এ নিয়ে তুমুল হাসি-ঠাট্টা হল, নির্ধারিত সময় শেষে অনির্ধারিত আড্ডাও চলল আরও কিছুক্ষণ। এরপর বৃত্ত ভেঙ্গে জ্যা-বৃত্তচাপে বিভক্ত হল, যে যার বাড়ির পথ ধরল। তবে কিছু মানুষ তখনো রয়ে গেল--- নিরব হতে থাকা শহরে রাতপিয়াসী এইসব মানুষের কোন খেয়াল নেই পরিপাশে; যে যার মত করে জীবনপান করে কুলকুচা করছে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা।

ফিরবে বলেই সংঘের সবার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল শুভাশিস, কিন্তু রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে আবার ঘুরে দাঁড়াল সে-- রাস্তাটা পার হয়ে আইল্যান্ডে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ চেপে রাখা সিগারেটের নেশাটা চড়া হয়েছে এখন; আয়েশ করে সিগারেটে বেশ দীর্ঘ একটা টান দিয়ে রাতের অন্ধকারকে দিল কয়েক আউন্স ধোয়া উপহার। বাসা থেকে ঘনঘন স্ত্রীর ফোন আসছে, কিন্তু সে ধরছেনা; উপরন্তু, ফোনের স্ক্রিনে সুপ্তি, মানে তার স্ত্রীর নামটি দেখে সে স্ক্রিনে একটা চুমু খেয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল বুকপকেটে। এই অনন্তযৌবনা অন্ধকার ছেড়ে আপাতত বউয়ের আঁধারে হারাতে মন সায় দিচ্ছেনা তার। সে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সিগারেটটাকে ফুকতে থাকে, জন্ম দিতে থাকে ঝরে পড়া চিন্তার।

অথচ ঠিক সেই সময়টাতেই সুমন শ্যামলির সিগনালে আটকে আছে লোকাল বাসের পেছনের সিটে বসে, মাহমুদ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে জলহস্তি দেখছে, রুস্তম দিনান্তে ক্যাশের হিসাব কষছে--- তার মন খারাপ, কারণ কোন এক ধূর্ত কাস্টমার ৫০০টাকার একটা জালনোট দিয়ে গেছে, সে বুঝতে পারেনি; অভিজিত আর জয়ন্ত কিছুই করছেনা, বিথী হলে নিজের রুমে আলো নিভিয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে সেই অসম্পূর্ণ ছবিটা নেড়েচেড়ে দেখছে, কিশোরী প্রেমিকা যেভাবে দেখে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রখানি। তার রুমমেটরা ডাইনিংয়ে খেতে গেছে, মোমের সমুখে একটা রুমাল নামানো--- চলন্ত রিক্সায় বসেই নীলক্ষেতের মোড় থেকে কিনেছে সন্ধ্যায়। আর রকি গিটারটা পাশে নামিয়ে বাসার ছাদে বসে লিখছে নতুন একটা গান- আজ রাতভর চলবে গানে সুরোরোপের কাজ।

সবাই যখন এতকিছু করছে, তখন শুভাশিসের এমন সবার মধ্যে থেকেও একলা হতে চাওয়ার কারণটা বোধগম্য হলনা ভূমি থেকে সুদূরবর্তী তারকাটির কাছে। এসময়ই অদ্ভুত শূন্যতায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা বিমান; বিমান থেকে নিচে তাকাবার বিধান নেই, বা থাকলেও এতটা নিচে থাকা শুভাশিসকে বিমানের কোন যাত্রী দেখতে পেতনা। পেলে দেখত তার সিগারেটটা ফুরিয়ে এসেছে; ১১বছর আগে এমন একটা সময়েই তার জীবনের সেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল- সে মনে করতে চাচ্ছিলনা কিন্তু ঝরে পড়া চিন্তাগুলোই ক্ষয়ে যাওয়া সময়কে পুনর্জীবন দিল। সে আইল্যান্ড থেকে এক টুকরো পাথর তুলে অন্ধকারে নিক্ষেপ করল, সেটি রাজু ভাস্কর্য ডিঙ্গিয়ে অন্যপ্রান্তের আইল্যান্ডে গিয়ে পড়ল; সেপথে হেটে যাচ্ছিল দুজন মানুষ--- কোত্থেকে একটা উটকো পাথরটুকরা এসে তাদের একজনের মাথার পেছনে আঘাত করল তারা তা বুঝতে পারলনা; আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটি কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করল- ‘শালা’। এরপর কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে হেটে গেল।


শুভাশিস ৫টাকার ঝালমুড়ি কিনল; একটু একটু করে তার মধ্যে জীবন প্রবেশ করছে, মনে পড়ছে স্ত্রীর মুখ, ছেলের মুখ---সে ৩টাকা খরচ করে একটা আমড়া কিনল, আমড়ায় গেথে দেয়া কাঠিটা ধরে রাখল ভালমত; আমড়া সুপ্তির অনেক পছন্দ। রিক্সায় উঠে সে মোবাইলে নেট ব্রাউজ করতে শুরু করল, ঢুকল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে, যদিও সেই বিকেলেই শেষ হয়ে গেছে শেয়ারের লেনদেন!
হিমালয় ৬.৮.১০





সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১১:০১
১৩টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×