প্রযত্নে-হন্তা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। লেখালিখি করে জীবিকা নির্বাহের কোনরকম আকাঙ্ক্ষা নেই বলে বই প্রকাশের ঘটনাকে বাড়তি উচ্ছ্বাসের অনুষঙ্গ ভাবা উচিত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, তবে মানুষের মন সবসময় পরিচ্ছন্ন যুক্তিবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়না বলে উচিত-অনুচিতের প্রসঙ্গটাও জোরালো কিছু নয়। আমার মনে হয় উচ্ছ্বাসের প্রকাশটা ঠিকই আছে। তাই উচ্ছ্বসিত হবার পেছনের গল্পগুলোও বরাবরের মত দৃশ্যপটে নিয়ে আসবার তাড়না বোধ করছি।
আমার বইয়ের প্রকৃত প্রকাশনা তারিখ ৩১ শে অক্টোবর। আমার অনুভূতির শুরু তারও আগে থেকে, সুস্পষ্টভাবে বললে সেটা ২৫ শে অক্টোবর, রাত সাড়ে নয়টার পরে। আমি এবং উদ্ভাসের ব্র্যান্ডিং ম্যানেজার লেবু ভাই যখন নটর ডেম কলেজ গলির অভীষ্ট প্রেসটাতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর সোহাগ ভাইও আমাদের সাথে যোগ দেন। সকলের উপস্থিতিতে বইয়ের প্রিন্টেড একটা কাঠামো নিয়ে আসা হয় প্রেসের কারখানা থেকে; তখনো মলাট ছাপানো হয়নি, বই বাইন্ডিং করা হয়নি, শুধুমাত্র লেখাগুলো ছাপানো হয়েছে। সেই ভ্রুণবই হাতে নিয়েই ৩ বছরের যাবতীয় বঞ্চনার গ্লানি ভুলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল ফুসফুসে বাড়তি অক্সিজেন প্রবেশ করছে, যা এতদিনের জীবনে আমি একদমই পাইনি।সোহাগ ভাইকে আমি আগেই জানিয়েছিলাম বইটা তাকে উৎসর্গ করেছি, কিন্তু আমার জানানোটা প্রত্যাশামাফিক বেমালুম ভুলে গিয়ে তিনি জানান বই উৎসর্গ করায় তিনি বিব্রত---- মানুষ প্রথম বই সাধারণত মা-বাবাকে উৎসর্গ করে, তা বাদ দিয়ে উনি কেন? এটা অবশ্যই স্বীকার করবো, আমার জীবনে আম্মু এবং বড় আপার যত অবদান, তা সমস্ত জীবন ধরেও শোধ করা সম্ভব হবেনা। বিশেষ করে, আমার জন্য বড় আপা যত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, তেমনটা বিরলেরও বিরল দৃষ্টান্ত। তাই তাদের কারো একজনকেই উৎসর্গ করা যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু লেখালিখি বিষয়ে কখনো ন্যূনতম উৎসাহটুকুও তাদের কাছে পাইনি, তাই সোহাগ ভাইয়ের চেয়ে উপযুক্ত মানুষ একজনও ছিলনা। যাহোক, তার প্রতিক্রিয়াটাও আমার জন্য প্রাপ্তি ছিল। ঋণ ব্যাপারটা ভাল লাগেনা, আমার মতে ঋণ দুই ধরনের- আর্থিক এবং মানসিক। আমি যদি কারো কাছে কোনভাবে ঋণী হই, তবে সবসময় চেষ্টা থাকে সেই ঋণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পরিশোধ করবার। গত ১৪ মাসে সোহাগ ভাই আমার জন্য যত কিছু করেছেন তাতে আর্থিক এবং মানসিক দুই ঋণের পাল্লাই ভারি হতে হতে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। আর্থিক ঋণ অবশ্যই একদিন শোধ করে দেব, কিন্তু মানসিক ঋণ কখনোই শোধ হবার নয়। তবু ন্যূনতম চেষ্টা অন্তত করা যায়। সোহাগ ভাইয়ের স্বল্পস্থায়ী অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়াটি প্রকাশনা পরবর্তী আমার দ্বিতীয় সুখানুভূতি।
৩১ শে অক্টোবরে আগেভাগেই পাইল্যাবস থেকে মতিঝিল উদ্ভাসে গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা শেষে চলে যাই প্রেস কারখানায়। জীবনে এটাই প্রথমবারের মত কোন প্রেস কারখানা পরিদর্শন। বইয়ের পর বই সেখানে সাজানো। সেগুলোকে সিগারেটের কাটুনে ভরে আমার হলে নিয়ে আসতে হবে। সিগারেটের কাটুনে বই ঢুকানোর কৌশলটা আমাকে দারুণ আকর্ষণ করেছিল, কাজটা করছিল ৩টি শিশু যাদের বয়স ৮-১২ এর মধ্যে। ওইটুকু বাচ্চারা এত নিপুণভাবে একটা কাজ করছে, অথচ ২৫ বছর বয়সেও ব্যক্তিগত দক্ষতা বলতে কিছুই নেই আমার, এটা ভেবে হীনমন্যতা তৈরি হচ্ছিল নিজের ভেতর। ভাল লাগাটাকে সম্মান জানাতে ওদেরকে ৫০ টাকা বকশিস দিই, এবং বাচ্চাগুলোর একজন যখন কাটুনগুলো বয়ে নিয়ে রিকশা অবধি দিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে যন ওর প্রতি প্রচণ্ড মায়া জন্ম নেয়। রাস্তা সংলগ্ন দোকান থেকে ১ হালি কলাও কিনে দিই ওকে। এতে ঐ বাচ্চাটি যে হাসি দিয়েছিল, তা ভুলতে বেশ কয়েটা বসন্ত পার করতে হবে আমায়। বই প্রকাশ পরবর্তী সময়ে অসংখ্য সুন্দর অনুভূতি হয়েছে, কিন্তু এটা পুরোপুরিই আলাদা।
৩ কাটুনে মোট ১৮০টা বই নিয়ে রিকশায় চড়ে হলের উদ্দেশে রওয়ানা হই। বুয়েট গেটের কাছাকাছি আসবার পর আমার সম্ভাব্য বাগদত্তার ফোন পাই। বই প্রকাশিত হওয়ায় সে যতটা পবিত্রতায় আলহামদুলিল্লাহ শব্দটা উচ্চারণ করেছিল, ততটা পবিত্রতা আমি খুব বেশি সংখ্যক মানুষের আচরণে পাইনা চেনা পরিমণ্ডলে।
তবে, রিকশায় আসবার পুরো সময়টাতেই আমি অস্থিতিশীল একটা আতংকে ভুগছিলাম। দুই-দুইবার আমার বই একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে প্রকাশিত হয়নি, তৃতীয় বারে এসে স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, এই ব্যাপারটা একদমই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। তাই বারে বারে মনে হচ্ছিল পথে কোন অঘটন ঘটবে, প্রচণ্ড মৃত্যুভয় ভর করেছিল নিজের মধ্যে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম পেছন থেকে কোন বেপরোয়া বাস আমার রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে পিষে ফেলবে। একটা সময় পর্যন্ত, আমি মাত্র ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে চাইতাম, এবং এই সময়ে যে কাজগুলো করবো বলে মনস্থির করেছিলাম, ৭টা ভাষা শেখা এবং ভাষা ও সংখ্যার মধ্যে একটা রিলেশন স্থাপন বিষয়ক গবেষণা- এই দুটো ছাড়া সবগুলোই পূরণ হয়ে গেছে। সুতরাং মৃত্যু এখন আসতেই পারে। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হয়েছে মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। কিন্তু সকল রাস্তা পেরিয়ে যখন দোয়েল চত্বরে পৌঁছাই, তখন নিশ্চিত হই ওইদিন রাস্তায় মৃত্যু হচ্ছেনা, অর্থাৎ বইটা মানুষের হাতে পৌঁছুবে। রিকশায় কোণঠাসা হয়ে বসে থাকবার ঐ সময়ের কোন একটা সময়েই আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ বহ্নি আপু একটা এসএমএস দিয়েছিলনে যা আমি দেখতে পাই রিকশা থেকে নামবার পর। এই অদৃশ্য যোগাযোগটা খুবই উপভোগ করি সে মুহূর্তে, যদিও এর আগেও তার সাথে এধরনের যোগাযোগ হয়েছে কয়েকবার। তাই কাটুনগুলো নামিয়ে প্রথমেই তার এসএমএস এর উত্তর দিই, বই প্রকাশের সুসংবাদটা জানাই এবং পরমুহূর্তেই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বড় আপাকে ফোন করি। সে সম্ভবত আমার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, যা আমি এত বছরেও বুঝতে পারিনি। মজার ব্যাপার হল, তার সাথে কথা বলা অবস্থাতেই বহ্নি আপুর ফোন পাই। উনি প্রচণ্ড মিশুক ধরনের মানুষ, যতটা সময় জেগে থাকেন হাসিখুশি থাকেন, অন্যদেরও রাখতে চেষ্টা করেন। তাই তার প্রতিক্রিয়াটাও অনন্যতার দাবিদার। এরপর ফোন করি আম্মুকে। আম্মু বেশ কয়েকদিন ধরেই বইয়ের নাম জানতে চাচ্ছিলেন, এবং আমি বারবারই এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিনও জানতে চান, এবং আমি বলি বইয়ের নাম খুবই উদ্ভট, মুখে বলা যাবেনা। আমার সাথে আম্মুর কথা-বার্তা শুনলে কেউই বুঝতে পারবেনা মায়ের সাথে কথা হচ্ছে, ভাববে ক্লাশমেট কারো সাথে দুষ্টুমি করছি। ফলে আম্মুকে বেশ ভাল রকম একটা কৌতূহলের মধ্যে আটকে রাখতে পারি, এতে বেশ আনন্দও লাগছিল। আম্মুর সাথে কথা বলবার পরই সিদ্ধান্ত নিই পরদিন পাই ল্যাবসের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো; সে উদ্দেশ্যে প্রথমেই সোহাগ ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এসএমএস দিই, পরদিনের অনুষ্ঠানে থাকতে বলি। এরপর একে একে লিটন ভাই, জুবায়ের ভাই, উদ্ভাসের লেবু ভাই, বন্ধু আরমানকে এসএমএস দিই। সোহাগ ভাই, লিটন ভাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বহ্নি আপুকে আগে থেকেই নিমন্ত্রণ দেয়া ছিল, আর এমন একটা আয়োজনে আমার সম্ভাব্য বাগদত্তা থাকবেনা, তা তো হতেই পারেনা।
ইলেকট্রিকাল পড়ুয়া ব্যাচমেট ব্রতীর সা্থে বাস্তবজীবনে খুব বেশি কথা কখনোই সেভাবে হয়নি। আনকমনলাইফবিডি এর জন্য ৫৫ মিনিটের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ওর; সে-ই আমাদের দীর্ঘতম বাস্তব আলাপন। তবে বিভিন্ন প্রয়োজনে আন্তর্জালে মাঝে মাঝেই দু-এক শব্দের বাক্য বিনিময় হত। তারই পরম্পরায় সে জানিয়ে রেখেছিল বই প্রকাশিত হলে তাকে যেন জানানো হয়, কেননা আমিই তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম বুয়েট ছাত্রী হলে সে্ আমার বইয়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে কিনা। সে নির্দ্বিধায় 'হ্যাঁ' বলে দিয়েছিল। তাই বই হলে নিয়ে আসবার পর তাকে এসএমএস দিয়ে বলি, বই চলে এসেছে; সে তার সুবিধামত সময়ে নিতে পারবে। আমাকে একটু আগে থেকে জানিয়ে রাখলেই হবে। আমি তার জবাব পেয়ে কী পরিমাণ অবাক হয়েছিলাম লিখে প্রকাশ করতে পারবোনা। তাৎক্ষণিক একটা ফিরতি এসএমএস পাই, যাতে সে লিখেছে, সে তক্ষুনি বই নিবে, যদি আমার সমস্যা না থাকে! রাত্রি তখন ৯টা ৫১, এবং বুয়েট ছাত্রী হল ১০টার সময় বন্ধ হয়ে যায়! এই উচ্ছ্বাসটা আমাকে অদ্ভুত আনন্দ দিয়েছিল, তার মত এত চুপচাপ একজন মানুষ এতটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র হবে, আমি কেন, সে নিজে বাদে কেউই বোধহয় তা জানতোনা। ঐটুকু সমযের মধ্যেই আমি তাকে ৩টা বই হস্তান্তর করি, যার একটাতে্ আমার অটোগ্রাফ ছিল। প্রযত্নে-হন্তা এর সর্বপ্রথম অটোগ্রাফটা তাকেই দেয়া। এই ইতিহাসটা কখনোই বদল হবেনা।
ব্যাপারটার চমৎকারিত্বে বেশ কিছুক্ষণ নিমগ্ন থাকি। নিজেই নিজের গল্পের পাঠক হয়ে যাই, এর মধ্যে কেটে যায় ঘন্টা দেড়েক। আমার ফোনে একটা ডিসটেন্ট কল আসে। আমি নিশ্চিত ছিলাম সেটা সাজী আপুর কল; কারণ তিনি ব্যতীত কোন প্রবাসী আমাকে কল দেননা। কিন্তু প্রকৃতি সিন্ডিকেট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল ঐদিন কোনকিছুই আমার অনুমানমাফিক হতে দেবেনা। তাই ফোন রিসিভ করেই বুঝতে পারি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ জনাব চমক ভাই ফোন করেছে। চমক ভাই কখনো আমাকে ফোন করবে ইউএসএ থেকে, এই প্রত্যাশাটা আমার জন্য নেপাল রাশিয়ার রাজধানী হওয়ার সম্ভাবনার মতন ব্যাপার ছিল। চমক ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে গেলে আমার মধ্যে একধরনের উদ্ভটতা ভর করে, সেদিন সেটাও হাপিস। এতটা সিরিয়াস ভংগিতে তার সাথে আমি প্রথম পরিচয়ের দিন ব্যতীত কখনো বলিনি, এটা ১কোটি ৩ লাখ ৩৭টাকা বাজি ধরার শর্তেও বলতে পারি। সে বলল, আমার একটা বই ইউএসএ তে পাঠানো সম্ভব কিনা। আমি নিশ্চিত সম্ভব, তবু বললাম ওটা অনেক ঝামেলার ব্যাপার, আমি তাকে পিডিএফ ফাইল পাঠাবো, সে তাতেই কনভিন্সড। কিন্তু আমি যে সত্যিই তাকে বইটা পাঠানোর পরিকল্পনা করছি, এই লেখাটা পড়বার আগে তা তার জানবার কোনই সম্ভাবনা নেই, যদি না বহ্নি আপু জুলিয়ান এসেঞ্জ এর ভূমিকা নেয়।
পরদিন আমার সম্ভাব্য বাগদত্তাকে নিয়ে পাই ল্যাবসে সময়মতই পৌঁছে যাই--- লিটন ভাই চলে এসেছিলেন, বহ্নি আপু জ্যামে আটকা- সেখান থেকে প্রথমে বুয়েট যাবে, জুবায়ের ভাই পুরান ঢাকায়, লেবু ভাই তখনো রওয়ানা হয়নি, এবং সোহাগ ভাই কাকরাইলে জ্যামবন্দী। তাকে ফোন করে জানা গেল তিনি বেশিক্ষণ থাকতে পারবেননা। আমি যখন বললাম ২ মিনিট থাকলেই চলবে, তিনি প্রত্তুত্তরে জানালেন ২ মিনিটের অনেক বেশি সময়ই থাকবেন। আমার বিশেষ কোন পরিকল্পনাই ছিলনা--- সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো, এবং সোহাগ ভাই-লিটন ভাইকে ২টি বই উপহার দেব, ব্যস। কিন্তু সোহাগ ভাই এই সামান্য আয়োজনটিকেই অসামান্য পর্যায়ে নিয়ে যান। প্রায় ৩০ মিনিটের মত বক্তব্য দেন। তার সাথে আমার পরিচয়ের গল্প, আমার পাই ল্যাবসে যাওয়ার গল্প, এবং তার নিজস্ব কিছু দর্শন। বইয়ের নাম প্রযত্নে-হন্তা কেন তা তাকে মেইল করেছিলাম; সেই মেইলটি তিনি সবাইকে পড়ে শোনান। আমার ধারণা, হতাশার বাদশাহ ও তার কথা-বার্তা শুনে কয়েকমিনিটের জন্য আশার সাম্রাজ্য ভ্রমণ করতে চাইবে। সেখানে আমি তো জ্বলজ্যান্ত মানুষ--- আশার সাম্রাজ্য না থাকলেও কুড়েঘর একটা আছেই। তাই আমিও অনুপ্রেরণা বোধ করি বহুগুণ। লিটন ভাই সাধারণত কথা বলেন গুণে গুণে; তবু এদিন তিনি কথার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে আমি সফলভাবে ব্যর্থ একজন মানুষ। তবু আমাকে বক্তব্য দিতে হয়েছে। বহ্নি আপু, আমার সম্ভাব্য বাগদত্তা সবাই-ই ২-৪ কথায় নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে; পরিবেশটা ছিল দারুণ।
নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হলেই মানুষ সৌজন্য সংখ্যা চায়। এই নিচুমানের মানসিকতার ব্যাখ্যা কী হতে পারে আমার জানা নেই।এই মানসিকতার মানুষদের আচরণে মনে হয় বই প্রকাশ করা একটা মহাপাপ, এবং বই প্রকাশ করতে কোন টাকা-পয়সা খরচ হয়না; প্র্রেসের লোকেরা চেহারা দেখেই বই ছাপিয়ে দেয়। যে মানুষ নিজে বই কিনেনা, সে কীভাবে আরেকজনকে বই কেনার কথা বলবে? তাছাড়া, একটা লেখা লিখতে লেখককে যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়, তার কি কোনই সম্মান নেই? পুরো লেখাটাই কি পণ্ডশ্রম? তা যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই তার লেখার একটা মূল্য থাকবে। এটা তার পরিশ্রমের প্রতি, প্রতিভার প্রতি সম্মান। সৌজন্য সংখ্যা দেয়া মানে সে ধরেই নিয়েছে বই প্রকাশ করে এতগুলো বই রাখার জায়গা পাচ্ছিনা, তাই দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণের মত করে যাকে-তাকে বই দিয়ে বেড়াবো, এবং তার আচরণও হবে তেমনই--- বইটা আবর্জনার সাথে শোভাবর্ধক হিসেবে থাকবে, কখনো কোন কারণ টয়লেট ট্যিসুর সংকট দেখা দিলে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো সেই ঘাটতি পূলন করবে। কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই আমার লেখা পছন্দ করে, তাহলে দাম যতই হোক, সে বই কিনবেই। এরাই প্রকৃত পাঠক। সুতরাং কোনরকম সৌজন্য সংখ্যা দেবনা, সে ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। প্রয়োজনে উইপোকাতে বই খাবে,তবু সৌজন্য সংখ্যা নীতিতে কোন আপোষ করবোনা।
অনুষ্ঠান শেষে, সোহাগ ভাইয়ের বক্তব্যের মোহমুগ্ধতাতেই হয়তবা মুহূর্তের মধ্যে ২০-২৫ কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
তবে, এই আনন্দের শধ্যেও আছে একটা অপ্রাপ্তিজনিত খচখচানি। বই প্রকাশের কাজে লেবু ভাই প্রচুর পরিশ্রম করেছিল, কিন্তু মতিঝিল থেকে আসতে দেরি করায় তাকে মিষ্টি খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। আমি এবং আমার সম্ভাব্য বাগদত্তা উভয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি একদিনি মতিঝিল গিয়ে তাকে মিষ্টি খাইয়ে আসব।
সুখানুভূতিতে কিছু খাঁদও মিশ্র্রিত আছে। বই প্রেস থেকে নিয়ে আসামাত্র স্কুলবন্ধু সুমনকে ফোন করেছিলাম। সে এখন এন.বি.এল এর ব্যাংকার। অফিসে এত খাটুনির পরও সে রাত এগারোটায় আরেক স্কুল সহপাঠী সাবেক রোস্তমকে নিয়ে আমার হলে চলে এসেছিল বই নিতে। বইয়ের শুরুতে 'গল্প শেষের পরে' শিরোনামে একটা কৃতজ্ঞতা লিস্ট আছে। সুমন খুব বেশি মাত্রায় প্রত্যাশা করেছিল সেখানে তার নাম থাকবে, কিন্তু নাম খুঁজে না পেয়ে সে যদি দুঃখ পেয়ে থাকে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবেনা। সেই ২০০২ সাল থেকে সে আমার লেখালিখির মানসিক পৃষ্ঠপোষক। প্রতিদিন ডায়েরিতে নতুন একটা লেখা লিখে মাঠে নিয়ে যেতাম, সেসবের একমাত্র পাঠক ছিল সে। এছাড়া ২০০৭ এ আমার দেশ পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য আমার বিশ্রী রকমের ছুটোছুটিতেও সুমন, সাবেক রোস্তম, নিরীহ ছেলে লিমন আমার সঙ্গী ছিল। তাই তাদের নাম উল্লেখ না করে আমি অবশ্যই মহা অন্যায় করেছি।
আমার জীবনে বড় আপার ভূমিকা আকাশের মত। বই প্রকাশিত হওয়াতে সে এতটা উচ্ছ্বসিত হবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। সে বারবার বলছিল তাকে যেন একটা বই দিয়ে আসি। একদিন পর আমি বই দিতে গিয়ে যখন তাকে আগের দিনের অনুষ্ঠানের গল্প শোনালাম, ছবি দেখালাম সে খুবই মন খারাপ করল। এত সুন্দর একটা অনুষ্ঠান হল, অথচ সে ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে জানাইনি, সে নাকি যেভাবেই হোক অনুষ্ঠানে যোগ দিত।আমি বললাম তুমি তো অসুস্থ, তার জবাব ছিল 'আমি মরে তো যাইনি, গেলে নাহয় আরেকটু অসুস্থই হতাম'। তার এই কথা শুনে আমার পক্ষে আবেগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল, নিজেকে আবারো পঞ্চম প্রজাতির গর্দভ মনে হচ্ছিল। আগামী ১৮ই নভেম্বর বুয়েটে যে চা-পার্টির আয়োজন করতে যাচ্ছি, তা প্রকৃতপক্ষে বড় আপাকে সম্মাননা জানাতেই, অন্য উদ্দেশ্যগুলো আসবে আরও পরে।
আমার পরিকল্পনা ছিল ৩ ভাই-বোন, আম্মু এবং সম্ভাব্য বাগদত্তাকে যে বইগুলো দেব সেটার ভর্তুকি আমি নিজের পকেট থেকে দিয়ে দেব, বড় আপার তা জানবার কোন কারণই ছিলনা। কিন্তু সে নিজে থেকেই আমাকে ২ টি বইয়ের টাকা দিয়ে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, তোমাকে আমি গিফট করতে চাই, সে জবাব দেয়, 'আমি যদি না কিনি, তাহলে মানুষ কিনবে কেন'? এরপর সে আমার অটোগ্রাফ নেয়। আমি প্রত্যেককেই আলাদা কথা লিখি। কোন পরিকল্পনা থাকেনা কাকে কী লিখবো, কিন্তু বড় আপাকে কী লিখবো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। এবং লিখবার পর আমার অনির্বচনীয় একটা অনুভূতি হয়েছিল। আমি বড় আপাকে 'নানু পিচু' সম্বোধন করি। তার লেখাটা ছিল এমন:
নানু পিচু,
একটা কথা তোমাকে কখনো জানানো হয়নি; আজ বলেই দিই; তুমি কেবলমাত্র আমার বড় বোন নও, তুমি আসলে আমার দ্বিতীয় মা
---অপদার্থ ছোট ভাই
এবার কিছু অন্যরকম অনুভূতির অভিজ্ঞতা বলি। আমার পিঠাপিঠি বোনটা, যাকে আমি প্রচণ্ড মারধর করেছি শৈশব-কৈশোরে এবং এখনো মাঝে মাঝে ছোটবেলা ফিরে আসে, সে ডাচ বাংলা ব্যাংক মানিকগঞ্জ শাখায় কর্মরত। অত্যধিক মিশুক প্রকৃতির বলে মানিকগঞ্জ শহরেও তার বিশাল বন্ধুমহল আছে। সে তার ব্যাংক এবং বন্ধু-বান্ধব মিলিয়ে আমাকে ৪০টার বেশি বই বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে মাত্র ৩য় দিন শেষেই বইয়ের বিক্রি সংখ্যা ১০০ পেরিয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল, ওর প্রতি আমার কোন প্রত্যাশাই ছিলনা। মানুষ কখন যে কে কার কাজে আসে বলা মুশকিল।
শেষ করবো আরেকটা মজার অনুভূতি দিয়ে। আমার 'হতেও পারত প্রেমিকা' এখন আমারই আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ঘরনী হবার প্রতীক্ষায়। কৈশোরে তাকে দেখে ব্যাপক লজ্জা পেলেও বন্ধপত্নী হবার বদৌলতে এখন দুষ্টুমি করা হয় প্রচুর। গতকাল দুপুরে তার কাছে একটা বই বিক্রি করেছি। রাতে ১টা এসএমএস পাই তার। সে লিখেছে, জীবনে সে যেখানেই থাকুক, আমার কোন বই প্রকাশিত হলে সে কিনবেই। বইটা হাতে নিয়ে তার আমার ক্লাশ সিক্সে পড়ার সময়কার মুখটা মনে পড়েছিল, সেই আমার বই সে পড়ছে, এই অনুভূতিটা নাকি তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। এই কমপ্লিমেন্ট টা আমার জন্যও অনেক বড় কিছু। জীবনভর আমি শুধু অন্যরকম ব্যাপারগুলোর সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। গতানুগতিক কোনকিছুতেই কেন যেন আকর্ষণ বোধ করা হয়না।
বই প্রকাশ হয়েছে ৫দিন হল। আরও অসংখ্য সুখানুভূতি আগামীতে হবে এটা নিশ্চিত। তবু মনে হল, শুরুর অনুভূতির তীব্রতা অন্যমাত্রার, সময়ের সাথে সাথে অনুভূতির পারদও নিচে নামতে থাকবে, ঘনত্বও হবে হালকা থেকে হালকাতর। তাই তীব্রতাকেই তাতিয়ে রাখলাম।
প্রযত্নে-হন্তা প্রকাশনা পরবর্তী অনুভূতিসমূহ...
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া
১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।