'কি রে ব্যাটা, পইড়া শেষ করছিস?' স্যার জিজ্ঞেস করেন।
ভয়ে কাঠ হয়ে শিশুটি দাঁড়িয়ে থাকে। পড়া শেষ হয়নি, এই তথ্য জানালে যদি স্যার পিট্টি দেন?
স্যার আদতে সেরকম কিছু করেন না। বই খুলে পড়াটা আরেকবার বুঝিয়ে দেন। নরম গলায় বলেন,'ভালো কইরা পড় ব্যাটা। একসময় বড় মানুষ হবি। না পড়লে চলবো?'
এরকম অজস্র শিক্ষক অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটিয়েও মানবশিশুকে 'মানুষ' করার কঠিন কাজটি করেন। অর্থের বিনিময়ে হয়তো কিছু শিক্ষক অন্যদের তুলনায় ঢের আয় করেন, কিন্তু সে সংখ্যাটা শিক্ষক সম্প্রদায়ের শতকরা কত ভাগ? বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথাই বলি। যতদূর জানি, তাদের বেতন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর সমপর্যায়ের। এ নিয়ে একটা গল্প আছে। ব্রিটিশ আমলে এক লাটসাহেব স্কুল দেখতে আসবেন। স্কুলে ক্লাস নেন একজন পন্ডিত, সাকুল্যে কয়েক টাকা বেতন। লাটসাহেব স্কুল ঘুরে গেলেন, সাথে এল তার প্রকান্ড দর্শন কুকুর। জানা গেল, ঐ কুকুরের পেছনে মাসে যা খরচ হয়, তা দিয়ে পণ্ডিত মশাইয়ের কয়েক মাসের বেতন হয়।
ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান জন্মেছে, পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মেছে আজকের বাংলাদেশ। এই স্বাধীন রাষ্ট্রের একজন সচিবের গাড়ির পেছনে মাসে যা খরচ হয়, তা একটি আস্ত প্রাইমারী স্কুলের মাসিক খরচের সমান।
অমন বৈষম্য জেনেও কেউ কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান, স্রেফ দুমুঠো খেয়েপড়ে দেশটাকে গড়ে দিতে চান নীরবে। আজন্ম ডানহাতে কিছু করতে না পারা রংপুরের মাহফুজার রহমান তাদেরই একজন। শারীরিক প্রতিবন্ধীত্বকে জয় করে এসএসসি ও এইচএসসি'তে প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। কালক্রমে স্নাতক স্নাতকোত্তর। বড় অফিসার নয়, হতে চেয়েছিলেন স্রেফ একজন প্রাথমিক শিক্ষক। অজস্র 'উন্নয়নের মাইলফলক' অর্জন করা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি, যার জন্ম হয়েছিল রক্তের সাগরে দাঁড়িয়ে, মাহফুজার রহমানকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও একটি শিক্ষকের চাকুরি দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
কষ্টে মাহফুজার রহমান গলায় দড়ি দিতে পারতেন, কিংবা অসহায় হিসেবে সমাজের কাছে হাত পাততে পারতেন। বলতে পারতেন, 'আজ যদি মোর জন্ম হত দুই রাজবংশের কোথাও, আমাকে নিয়ে ব্যানার ছাপাতে তোমরা, জয়ধ্বনি করে বসিয়ে দিতে কোন স্বর্ণখচিত চেয়ারে, শত কোটি টাকার মালিক হয়ে কি জীবনটাই না পেতাম! সুবিধাবঞ্চিত সমাজে জন্মেছি, তার উপর শারীরিক অক্ষমতার মতো কলঙ্ক নিয়ে, জন্মই তো আমার আজন্ম পাপ!'
আমাদের সভ্য সমাজকে এসব বলে বিব্রত করেননি তিনি। মাথা উঁচু করে রাষ্ট্রের দেয়া 'শিক্ষাগত যোগ্যতা'র সনদগুলো রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। 'মানুষ' মাহফুজার রহমান প্রতিবাদ করেছেন যথার্থ মানুষের মতো করেই। লাখো শহিদের রক্তে রাঙ্গা বাংলাদেশের একজন যোগ্য সন্তান হিসেবে তাঁর এ প্রতিবাদকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
ভাবতে চোখে জল এসে যায়।
রাষ্ট্রনায়কদের দোষ দিইনা। বয়েস হয়েছে তো। হয়তো একসময় চোখে জল জমতো তাদেরও, পুরনো নদীর মতো সে জলের ধারাও সম্ভবত শুকিয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৩৮