somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সরকারি শিশু পরিবারে এতিম শিশুদের বলাৎকার ও নির্যাতনের ঘটনায় আড়াই বছর পর মামলা

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবার বা এতিমাখানায় বলাৎকার, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা গ্রামের এক এতিম শিশুর মা বাদি হয়ে গত বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা সদর থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার আসামিরা হলেন, সাতক্ষীরা সরকারি এতিমখানা বা শিশু পরিবারের এমএলএসএস গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার সিংগা গ্রামের বিমল বৈরাগীর ছেলে বিমান বৈরাগী, ওই প্রতিষ্ঠানের বাবুর্চি কৌশিক ফরহান, কর্মচারি নওগাঁ জেলা সদরের উকিলপাড়ার মোজাফফর হোসেনের ছেলে আব্দুলাহ আল মাহমুদ বিন (বড় ভাইয়া), সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে তানভির হোসেন ও একই উপজেলার মাড়িয়ালা গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে মোস্তফা মো. নুরুজ্জামান।

এদিকে ২০১৭ সালের ২ জুলাই বলাৎকার, নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনার দু’বছর তিন মাস আঠারো দিন পরে মামলা হয়েছে। শিশুদের যারা অমানবিক পরিবেশে রেখেছেন এবং মারাত্মক যৌন নিপীড়ন করেছেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী করার জন্য নাগরিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সাতক্ষীরার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও সাতক্ষীরা সরকারি শিশু পরিবারের তৎকালীন সভাপতি আবুল কাশেম মহিউদ্দীন(বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব) প্রকারন্তরে ওই কর্মচারীদের অপরাধকে লঘু করে দেখে তাদেরকে আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা হতে বাঁচিয়েছিলেন। এখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আমরা ধন্যবাদ জানাতেই হয় দেরিতে হলেও বিষয়টি আইনের আওতায় এনে অভিযুক্তদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য। একই সাথে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২ জুলাই রাত সাড়ে সাতটার দিকে সাতক্ষীরা সরকারি এতিমখানা বা শিশু পরিবারের শিশু এক শিশুকে কর্মচারী আব্দুলাহ আল মাহমুদ বিন (বড় ভাইয়া) তার নিজের কক্ষে ডেকে বলাৎকারের চেষ্টা করেন। বাঁধা দেওয়ায় তাকে মারপিট করে জখম করা হয়। একপর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক বলাৎকার করা হয়। বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য এতিমখানার অন্য কর্মচারীরা তাকে জীবননাশের হুমকি দেয়। একইভাবে কর্মচারী তানভীর হোসেন ওই শিশুকে বলাৎকার করে। এ ছাড়া ওই এতিমাখানায় তেল মশলাবিহীন রান্না, শিশুদের পঁচা ও বাসী খাবার খাওয়ানো হয়। আপত্তি করলে ওই খাবার জোর করে খাওয়ানো হতো। তাদেরকে পুরাতন জামা কাপড় পরতে বাধ্য করা হতো। এ সব ঘটনার প্রতিবাদে গত ২০১৭ সালের ২ জুলাই রাতে এতিমাখানার শিশুরা ফুঁসে ওঠে। একপর্যায়ে কর্মচারি ও এতিমদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।
সরকারি এতিমখানাটির পাশেই এ করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আমার আমার শ্রদ্ধাস্পদ বড় বোন নাসরিন খান লিপি(সাতক্ষীরার তালা-কলারোয়া সংসদীয় আসনের সাংসদ অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ'র স্ত্রী)। তিনি সম্ভবত তার কোন ছাত্রীর কাছ থেকে এতিমখানার শিশুদের বিক্ষোভের ঘটনা জানতে পেরে আমাকে ফোন করেন বিষয়টির বিস্তারিত খোঁজ নিতে। আমি তখন আমার পত্রিকা অফিসে সংবাদ সম্পাদনা করছিলঅম। খবর পেয়ে আমি তৎক্ষণাৎ আমাদের বার্তা সম্পাদক এম বেলাল হোসাইন ও অপর সাংবাদিক আমির হোসেন খান চৌধুরীকে ঘটনাস্থলে পাঠাই। ততক্ষণে সেখানে সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন পরিদর্শক(তদন্ত) মো. আবুল হাশেম(বর্তমানে মেহেরপুরের মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) তার ফোর্স নিয়ে উপস্থিত হন। তারা সেখানে শিশুদের মুখে যে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা শোনেন তা অবর্ণনীয়। শিশুদের যৌন নিপীড়ন ছাড়াও তাদের অনেককে ব্যক্তিগত সেবাদাসের মত ব্যবহার করতেন সরকারি শিশু পরিবারের কর্মচারীরা। শিশুদের জন্য সরকারি বরাদ্দের বড় অংশটাই লুটপাট করতো কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি নিয়ে সাতক্ষীরা সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে শহরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসুচি পালিত হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু, সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক হাফিজুর রহমান মাসুম প্রমুখ। এমনকি এঘটনার পর সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম শিশু পরিবারের শিশুদের সার্বিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিতে সেখানে যান।

বিষয়টি নিয়ে ২০১৭ সালের পহেলা আগস্ট দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় “সাতক্ষীরায় শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ” শীর্ষক এক প্রতিবেদন দেখে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে ছয় শিশুকে বলাৎকারের কথা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ করলেই সেই সব শিশুদের মারপিট করা হতো বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বিমান বৈরাগীর বিরুদ্ধে শিশুদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ও আব্দুলাহ আল মাহমুদ বিন, তানভির হোসেন মোস্তফা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ও কৌশিক ফাহাদ আলীর বিরুদ্ধে শিশুদের নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। প্রতিবেদনে বিমান বৈরাগীর বিরুদ্ধে বদলীসহ শাস্তিমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা অপর দোষীদের বিরুদ্ধে জেলার বাইরে বদলীর সুপারিশ করা হয়। কিন্তু, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের আদেশনামায় উল্লেখ করেছেন যে, এঘটনা নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ (২০০০ সালের ৮ নম্বর আইন) ১০ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া কৃত অপরাধটি ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৭০ ধারা অনুসারেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কমিশন তাদের আদেশে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইনে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন।

অভিযোগ, প্রতিবেদন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় অভিযুক্ত বিমান বৈরাগীর বিরুদ্ধে শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নের ও শিশুর প্রতি বর্বরতার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় কমিশন কর্তৃক জেলায় নিয়োজিত প্যানেল আইনজীবীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অথবা জেলা শিশু আদালতে মামলা দায়েরের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।সে অনুযায়ি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিযুক্ত প্যানেল আইনজীবী শেখ মোস্তাফিজুর রহমান শাহনেওয়াজ বলাৎকার হওয়া শিশুর পক্ষে বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা সদর থানায় এ মামলা করান। মামলা নং ৬১ তারিখ ২১.১০.১৯ জিআর ৬৮১/১৯ (সদর)।

এঘটনায় মানবাধিকার কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×