ছোট বলো থেকেই স্কাউট এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। প্রাইমারী পড়াকালীন কাব স্কাউট করতাম। আর হাইস্কুলে ওঠার পর স্কাউট দল করতাম। দু’টো থেকেই জাতীয় কাব ক্যাম্পুরী এবং জাতীয় স্কাউট জাম্বুরীতে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। স্কাউটের সঙ্গে জড়িত থাকবার কারণে ভাষার মাস, স্বাধীনতার মাস এবং বিজয় দিবসের মাস গুলোকে ভালোভাবেই বুঝতে পারতাম। কারণ এই মাসগুলো আসলেই, স্যার প্যারেড প্রাকটিস করাতেন। কাঁধে ঝুলে থাকত ইয়া বড় বড় ড্রাম! যেগুলো গলায় ঝুলিয়ে বাজাতে বাজাতে গলাতেই দাগ পড়ে যেত। ঠিক এ কারণেই ভাষার মাস ছাড়া বাকি মাসগুলোর উপস্থিতি বুঝতে পারতাম। তারপর সেই দিনটি আসলে আল্লাহর ফজরে স্কুলে যেতে হতো। তারপর সেখানে তিন থেকে চারবার প্রাকটিস করে কলেজ মাঠে যেতে হতো। সেখানে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা প্যারেড পরিদর্শন করবেন। রোদে পুড়ে প্যারেড করা এবং এক দুপুর শেষ করে বাড়ি ফেরার মাঝেই আমাদের বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস সীমাবদ্ধ ছিল। আর উপলবদ্ধির জায়গাটা পুরোটাই ফাঁকা(!) আর ফাঁকা থাকবে নাই বা কেন, পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়! প্রাইমারীতে থাকাকালীন পড়েছি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। হাইস্কুলে ওঠার পর এই ব্যক্তিটির আর নামগন্ধও পাই নি। বইয়ে পেয়েছি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময়ের ছোট মস্তিষ্কে এতো প্যাচের রাজনীতি সহজে ঢুকতে পারেনি। তাই মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় কি জিনিস এস,এস,সি দেয়ার আগ পর্যন্ত সেভাবে জানার সুযোগ হয়নি।
ছোট বেলা থেকেই গল্পের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। পরিবারের বাদ বাকি সদস্যরাও একই পথের পথিক হবার কারণে বাসায় যথেষ্ঠ গল্পের বই ছিল। এস,এস,সি আগেই হুমায়ূন আহমেদ এর হিমু সিরিজ শেষ! এস,এস,সি পরীক্ষার পর মাঝখানের গ্যাপটাতে ইতিহাস নিয়ে পড়ার আগ্রহ জন্মাল। ব্রাক গণকেন্দ্র পাঠাগারের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের উপর কিছু বইও পড়ে নিলাম। আর সেই ইতহাসকে জানার প্রচেষ্ঠা আজও চলমান আছে। কিন্তু কোনটা যে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস তা ঠাওর করতে পুরো জাতিটাই বিভরি খেল আর আমি তো আদার ব্যাপারি! আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ করতে চাচ্ছি! তবুও নিজের দেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীকারের আন্দোলনের পটভূমি জানতে হবেই। তা না হলে আগামী প্রজন্মকে কি শিক্ষা দিব???
অনেকদিন আগে একটা গান শুনেছিলাম,
“স্বাধীনতা চাই নি আমি এই স্বাধীনতা
স্বাধীনতা পাই নি আমি সেই স্বাধীনতা
যাহা পেয়েছি আমি চাই নি তাহা
পেয়েছি যাহা চাই নি”।
প্রথমেই বলে রাখি আমি স্বাধীনতার বিরোধী করার জন্য লিখতে বসিনি। শুধুমাত্র উপলবদ্ধির জায়গাটুকুকে জাগ্রত করবার জন্য এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠা। কয়েকদিন আগে ডেইলি ষ্টারে একটা কলামে পড়লাম, অখন্ড পাকিস্তান থাকাকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রেলওয়েতে চাকুরীজীবির সংখ্যা ছিল ৫৩ হাজার। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে রেলওয়েতে চাকুরীজীবির সংখ্যা ২৩ হাজার(!) দেশ স্বাধীন হবার পরই আরও অতিরিক্ত ৩০ হাজার মানুষ বেকারত্ব বরণ করেছে! এটা কি আমরা চেয়েছিলাম??
আর বাংলাদেশের যেকোন রেলষ্টেশনে গেলেই এর চাক্ষুশ প্রমাণ মিলে যাবে। একবার লালমনিরহাট ষ্টেশন থেকে “লালমনি এক্সপ্রেসে” করে ঢাকা আসতেছিলাম। ট্রেনের দেরি থেকে লালমনিরহাট ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টারের রুমে গেলাম! রুমে ঢুকতেই উচ্চবাচ্যের আওয়াজ। ষ্টেশনে লোকবল নেই তার উপর যারা আছে তারাও ঠিকমত অফিস করে না। ষ্টেশন মাষ্টার বলতেছে, আমার রিটায়ার্ড হয়ে গেছে! তারপরও জোর করে ধরে রেখেছে! দুই বছরের এক্সটেনশন করে দিয়েছে। এই বয়সে কি আর এতো কিছু সামাল দেয়া সম্ভব! কেন যে এরা নিয়োগ দেয় না?
আমাদের সুরঞ্জিত বাবু রেলমন্ত্রী হবার পর নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তার গাড়ি থেকেই টাকার বস্তা উদ্ধার হবার পর নিয়োগ গেল স্থগিত হয়ে আর তিনিও হয়ে গেলেন দ্প্তরবিহীন। আর বর্তমান রেলমন্ত্রী বুড়ো বয়সে বিয়ে করে এখন বউ সামলাবেন নাকি নিজেকে সামলাবেন আর নাকি মন্ত্রনালয় সামলাবেন সেই চিন্তায় সত্যিই অুসস্থই হয়ে গেলেন। কিন্তু জাতির বেকার তরুনদের চাকরীর ব্যবস্থা হচ্ছে না।
স্বাধীনতা মানে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা! কিন্তু আমরা কি এই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? এক সময় দেশে ছিল উর্দু সংস্কৃতির জয়জয়কার। আমাদের রুনা লায়লা ম্যাডাম এখনও ও লাল মেরি রাখিও ভেলা নামক উর্দু গান গেয়ে মঞ্জ মাতিয়ে রাখেন।
তারই দেখাদেখি নাকি নিজেরাই স্বপ্রনোদিত হয়ে আজকের তরুনরা হিন্দির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। এফএম চ্যানেলগুলোর দিকে কান দিলে মনে হবে আমরা যেন ইন্ডিয়ার কোন একটি শহরে বসে আছি। অনুষ্ঠানের নাম হিন্দি বিট! আর আমাদের দেশের ঘরগুলোতো আজ ভারতীয় সিরিয়াল দখল করে রেখেছে! হিন্দি সিরায়ালের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কত জনকে দেখলাম প্ল্যাকাড হাতে নিয়ে টিএসসির মোড়ে দাড়িয়ে আছে, ষ্টার জলসা বন্ধ কর, ঘর সংসার রক্ষা কর।
আমার মেজ মামা সরকারী মেডিকেলের ডাক্তার। যার কারণে তিনি খুব একটা ছুটি পান না। তার দুই ছেলে অনেক দিন পর আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। বড় জনের বয়স ১০ বছর আর ছোট জনের বয়স চার বছর। তারা দু’জন খেলেতেছিল। তাদের খেলার বিষয় বস্তু ছিল রাক্ষস এবং রাক্ষসি। বড় জন বলতেছে আমি রাক্ষসি কটকটি আর তুমি কিরণ মালা! ভাবতে পারেন আমাদের সংস্কৃতির নমূনা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে!
কথাগুলো অনেকটা এলামেলো লাগতেছে মনে হয়! আসলে সাজিয়ে লেখার মানষিকতা নষ্ট হয়ে গেছে! সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বাসার পাশে মাইকে উচ্চশব্দে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছে! অথচ এই মাইকেই সারারাত হিন্দি গান বেজেছে! বিজয়ের উৎসব মতিঝিলের আলোক সজ্জা কিংবা প্যারেড গ্রাউন্ডে সেনাবাহিনী এবং তিনবাহিনীর লেফটরাইট এর মধ্যে বন্দি না রেখে আমাদের স্বত্ত্বার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার অর্জন আমাদের সংস্কৃতির ভিতরে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদটা আমাদের অর্জন করতে হবে। তা না হলে আজম খানের সেই আক্ষেপময় বাণী আমাদের প্রজন্মকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তিনি বলেছিলেন,“মাত্র নয় মাসে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বলেই আমরা স্বাধীনতার মর্ম উপলবদ্ধি করতে পারছি না। কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করে আমরা যদি এই স্বাধীনতা পেতাম তা হলে হয়তো এর মর্ম সঠিক ভাবে উপলবদ্ধি করতে পারতাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৪০