বারান্দা এবং শেষ ডিমলাইট
শিখাদের বারান্দার পূর্ব কোণে ছোট্ট একটা ডিমলাইট জ্বলে থাকতো সারা রাত। রাত সাড়ে ১২টা বা ১টার দিকে যখন বাড়ির সব লাইট বন্ধ হয়ে যেত, পরপরেই সাধারণত ডিমলাইট-টা জ্বালিয়ে দেয়া হত। একটা নিদিষ্ট রুটিন মাফিক ব্যাপারটা চলতো। কেন জানি ভাল লাগতো ব্যাপারটা। প্রায় প্রতিদিনেই অপেক্ষা করতাম কখন বাড়ির সব লাইট বন্ধ হয়ে যাবে, ডিম-লাইটটি জ্বলে উঠবে।
তবে এ ব্যাপারটি ছাড়িয়ে অন্য আরেকটি ব্যাপার আমাকে লক্ষ-কোটি গুন পুলকিত করতো। পূর্বদিকের বারান্দার ডিম-লাইটটি জ্বলে উঠার কিছুক্ষণ পরেই কে যেন বারান্দায় আসতো। হালকা ছায়া আবরণে খুব সহজেই বুঝা যেত এটা একটা মেয়ের আবরণ। প্রায় দেড়/২ ঘণ্টা পরে মেয়েটি ওখান থেকে উঠে বাড়ির ভিতরে চলে যেত। আমি জানতাম, এটা শিখা ছাড়া অন্য কেউ না। কারণ সে ছাড়া তাদের বাড়িতে তার বয়সী অন্য কেউ ছিল না।
আমি প্রায় নিশ্চিত জানতাম, প্রতিদিন যখন শিখা বারান্দায় আসে নিশ্চয় সে আমাকেও লক্ষ্য করে। কারণ তার বারান্দায় প্রতিদিনের মত ডিম-লাইটটি জ্বলে উঠার পরেই আমি নিয়ম করে আমার রুমের লাইটটি নিভিয়ে দিতাম এবং আমার পেছনের রুমের লাইটটি জ্বালিয়ে রাখতাম। এতে পেছনের রুমের সামান্য আলো আমার রুমে আসতো। হয়তো একটু আধটু আমাকে দেখা যেত তার বারান্দা থেকে।
সেই ছোট বেলায় শিখাকে আমি চিনতাম। খেলার ছলে বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতেও আমার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন দিন কথা হয়নি। স্কুলে যাওয়ার সময়ও তার সাথে দেখা হত। কেমন যেন একটু লাজুক হেঁসে চলে যেত। কিশোর বয়সের সে ভাল লাগাটা নেহাতই কম ছিল না। শিখারও হয়তো অনুভূতিটা তাই ছিল। তার পরে, বেশ কিছুদিন পরে শুনেছিলাম, তার বাবা অন্য কোথাও বদলি হয়ে গেছে, তারা তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার রেখে গেছে।
এ হল অনেক বছর আগের কথা। এখন নিশ্চয় আগের সে শিখা আগের মত নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। তার বয়স এখন ১৯ বছর তো হবেই।
সেদিন খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হলাম। ভাবলাম হোক আজ অনেক বছর, এত বছর পরে শিখা আমাকে নাই বা চিনুক। আজ একটু খোঁজ খবর নিতেই হবে। তাদের বাড়ির পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান ছিল। আমি চায়ের অর্ডার দিলাম। একটু সুযোগ বুঝে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বাড়ির মালিকরা কখন ফিরে এসেছে?
দোকানদার বলল, "কই না তো, তারা তো ফিরে আসেনি। "
আমি অবাক হলাম। বললাম, "আপনি হয়তো জানেন না। তারা ফিরে আসছে। "
দোকানদার হেসে বলল, "ভিতরে কেয়ারটেকার আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করেন।"
আমি তার কথা মত গেট দিয়ে ঢুকলাম। ঢুকেই কেয়ারটেকারকে পেলাম। কেয়ারটেকার যে তথ্য দিল আমি রীতিমত আঁতকে উঠলাম। কেয়ারটেকার জানালো, প্রায় ৮ বছর আগেই শিখা মারা গেছে। তার বাবা-মা আর কখনোই এখানে ফিরে আসেনি। মাঝে মাঝে কেয়ারটেকারকে ফোন করে বাড়ির খোঁজ খরব নেয়। এটাই।
আমি আরও জানতে চাইলাম এখানে অন্য কেউ থাকে কিনা।
কেয়ারটেকার জানালো, "অসম্ভব, মালিকের কোন অনুমতি নাই কেউ মূল বাড়িতে ঢুকার জন্য। কখনোই এখানে কেউ থাকে না। নীচে শুধু একটা রুমে আমি থাকি।"
আমি বোবার মত হয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে পারলাম। "সবাই জানতো হয়তো শিখা চলে গেছে। শুধু আমিই জানতাম না, শিখা আর কোন দিন ফিরে আসবে না"।
এটাও বুঝে গেলাম, 'শিখা টের পেয়ে গেছে শিখা জীবিত আছে ভেবে আমি শিখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম'।
শিখা আমার জন্য রাতের বেলা আসতো হয়তো এ জন্য যে, আমিই ছিলাম তার জন্য বাস্তবে শেষ অপেক্ষমাণ মানুষ। আর কেউ অপেক্ষা করবে না তার জন্য। কারণ অন্য সব মানুষগুলোই আগেই জানতো শিখা অনেকদিন আগে চলে গেছে। সে জন্যই হয়তো তাদের সাথে শিখা দেখা দিত না। আজ আমিও জানলাম শিখা নেই, অনেক আগে থেকে নেই। এবার আমিও নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আজ থেকে শিখা আমাকেও দেখা দিচ্ছে না হয়তো।
আমার ভিতরে অন্য রকম হতে থাকলো। আমি ভাবছিলাম, আমার মধ্যে এমন হবে কেন!! আমাদের মধ্যে তো কোন সম্পর্ক ছিল না।
আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, শিখা চলে গেল। কিন্তু শিখাদের রাজ্যটা কেমন হবে!
লাল, নাকি নীল!!
আলো আছে, নাকি সেই ডিম-লাইটের মত অন্ধকার!!!
সেই রাতেই একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম, "দেখলাম, রাতের বেলা আমি হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছি। উঠেই দেখলাম, হালকা আলো-ছায়ার মধ্যে আমার জানালা দিয়ে কে যেন উড়ে এসে ভিতরে ঢুকলো। খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করলাম, এটা ছোট্ট একটা পরী, যার ২টো ডানা আছে। একদম উড়ে এসে আমার হাতের উপর বসলো। তার ছোট ছোট দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি তার চেহারার দিকে খুব ভালভাবে লক্ষ্য করলাম।
কিন্তু হায়!!! এ যে শিখা নয়, অন্য কেউ। কিন্তু আমি কোন মতেই এ দৃষ্টিটাকে উপেক্ষা করতে পারলাম না। কোথায় যেন কি একটা মিল আছে, অনেক মায়া আছে।
হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, ছোট্ট পরীটা আমার হাতে কি যেন একটা আলতোভাবে রাখল, তারপর আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে শেষবারের মত তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে পাখা মেলে জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেল। আমি এক দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ না পরীটাকে শেষ দেখা যায়।
এবার আমি আমার হাতের মধ্যে জিনিসটার দিকে তাকালাম। তাকিয়েই প্রায় আঁতকে উঠলাম। দেখলাম, এ যে আমার সে লাল-ঘুড়িটা, যেটা শিখাদের বারান্দায় আটকা পড়েছিল সেই ছোট বেলায় কোন একদিন। সাহস করে সেটা আর কোন দিন আনা হয়নি। তবে আমি জানতাম শিখা সেটা রেখে দিয়েছে। আজ হয়তো ফেরত দিয়ে গেল তার কাছে রাখা আমার শেষ স্মৃতিটি।
স্বপ্নটি দেখার পরপরই আমি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। চোখ মেলে তাকাতেই শিখাদের পরিচিত সেই বারান্দাটি চোখে পড়লো। ঐদিকটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার, সুনসান নীরবতা।
আমি ভালোমতো লক্ষ্য করলাম বারান্দায় কেউ আছে কিনা। কিন্তু না, কোথাও কেউ নেই। সেদিনের পর থেকে রাতের কোন সময়ই তাদের বাসার লাইটগুলো আর জ্বলেনি, শিখার বারান্দার ডিম-লাইটটাও জ্বলেনি। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম শিখা আর কোন দিন বারান্দায় আসবে না। কারণ শিখা জেনে গেছে আমি তার জন্য আর অপেক্ষা করছি না। তাই সে কিছুক্ষণ আগে তার কাছে আমার রাখা শেষ স্মৃতি 'লাল ঘুড়িটি' আমাকেই আবার ফেরত দিয়ে চলে গেল।
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১১