আমাদের একজন সহকর্মী বড়ভাই মোঃ মাহবুব হোসেন খান ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ১১/০৪/২০১২ তারিখে এই পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। মাহবুব ভাই কে নিয়ে তাঁর একজন অতি কাছের বন্ধু এবং সহকর্মী স্মৃতিচারণ করেছেন। লেখকের অনুমতি নিয়ে লেখাটি এখানে পোষ্ট দিলামঃ
“ভালো ছাত্র দেশে প্রচুর আছে , হাজার হাজার জিপিএ ৫ , প্রথম শ্রেণী কিন্তু ভালো মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল ভালো মানুষ হওয়া । কেউ হয়ত ডাক্তার , কেউবা ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু হতে চেয়েছিলে । আবার অনেকে পছন্দ করেই বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছ। তোমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো মানুষ হওয়া , ভালো ছাত্র বা সহজে আমরা ভালো রেজাল্টধারী যা বুঝি তা দেখবে এমনি এমনি হয়ে যাবে। হাজারো ভালো রেজাল্টধারীতে দেশে ভরে যাচ্ছে কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কোথায়? যেদিন স্কুল ,কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ভালো মানুষ বের হবে, সেদিন ঠিকই পরিবর্তনটা আসবে।" প্রত্যেক বছর নবীণবরন অনুষ্ঠানে এই কথাগুলোই বলতেন মোঃ মাহবুব হোসেন খান । মাহবুব স্যার ছিলেন আমার বহু দিনের বন্ধু , কত বছর হবে ২০ বা ২১ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে একই ব্যাচের ছাত্র , একই হলে ছিলাম , একই বিশ্ববিদালয়ের( ইসলামী বিশ্ববিদালয়, কুষ্টিয়া) একই বিভাগে শিক্ষকতা করেছি এমনকি কুষ্টিয়াতে একই বাসায় ভাড়া ও থেকেছি প্রায় ২ বছর।
প্রায় দেড় বছর মাহবুবের সাথে দেখা নেই , উচ্চ শিক্ষার্থে হং কং এসেছি। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত। মাহবুব ও ব্যস্ত ছিল ওর পি এইচ ডি গবেষণায় ।৬ মাস আগে হঠাত একদিন সহকর্মী আজাদের কাছ থেকে শুনলাম ওর নাকি ব্লাড ক্যানসার ধরা পরেছে । কথা গুলো শুনে বিশ্বাস করিনি, মাহবুবকে ফোন দিলাম।
- হুম ডাক্তার তো তাই বলেছে। অনেকটা নির্লিপ্ত ছিল , বরং আমাকেই ও সান্তনা দিল ; এগুলো কিছুই না সবই পরীক্ষা । দোয়া কর আমার জন্য ,যাতে পথভ্রষ্ট না হই শেষ দিন পর্যন্ত।
ওর অসুখের কথা শুনে এতটাই খারাপ লেগেছিল , সারা সপ্তাহ আমি প্রায় নির্বাক ছিলাম। এতটা কষ্ট শুধু আমি পাইনি , বিভাগের সব ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীরাই পেয়েছে আমি নিশ্চিত । মাহবুব ছিল সবারই প্রানপ্রিয় একজন মানুষ।
মাহবুব নেই আর আমাদের মাঝে । গত ১১ই এপ্রিল চিকিৎসারত অবস্থায় ভারতে মারা গেছে ( ইন্না লিল্লাহে............রাজেউন) । ভারতে অবস্থানরত মাহবুব এর ভাইয়ের কাছ থেকে ফোনে মারা যাওয়ার কথা গুলো শোনার পর ও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কত যে কষ্ট পেয়েছি এই সংবাদটা শুনে । সহকর্মী আজাদ তো ফোনে কথাই বলতে পারেনি কান্নার চোটে । বন্ধু মিল্লাত ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে অবাক । কেউই বিশ্বাস করছে না আমাদের এত প্রিয় মানুষটা আর নেই । ফেসবুকে দেখলাম আমাদের এক ছাত্র লিখেছে ,
-“মাহবুব স্যার এর মৃত্যুতে এমন কষ্ট পেয়েছে যেমনটা পেয়েছিলাম আমার বাবার মৃত্যুতে । “
শিক্ষক তো বাবার মতনই , না হয় বয়সটা একটু কম । সদা হাস্যউজ্জল ওর চেহারা ভেসে উঠছে । বন্ধুরা আমরা চেষ্টা করেছি । ওর বিভাগের বন্ধুরা একটা ওয়েবসাইট খুলেছিল , ব্যপক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল । বিভিন্ন পত্রিকায় ওর সাহায্যার্থে সংবাদ বের হয়ে ছিল। যে যেভাবে পেরেছে চেষ্টা করেছে । আমরা পেরেছি কিন্ত পারিনি। প্রায় ১ কোটি টাকা বন্ধুরা সংগ্রহ করেছে বন্ধু - বান্ধব , সহকর্মী , শিক্ষক , পরিচিত – অপরিচিত দানশীল লোকদের কাছ থেকে । প্রথমে সিঙ্গাপুর চিকিৎসাধীন ছিল পরে ভারতে গিয়েছে। ধন্যবাদ দিতে চাই সেইসব হৃদয়বান মানুষকে যারা মাহবুবের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছিলেন।
ভীষণ ধার্মিক ছিল মাহবুব , আমাদের ও বলত । কিন্তু কোন গোঁড়ামি ছিলনা । আমরা পিকনিকে যেতাম , ও যেত না কিন্তু বলত ঘুরে আসো ছাত্রদের নিয়ে , ওদের ভালো লাগবে । শিক্ষা সফরের সঙ্গী হত কিন্তু বলত বিনোদন ভ্রমন অংশে তোমরা যেয়ো । কিন্তু ফোন করে ঠিকই খোঁজ নিত সবাই সুস্থ আছে কিনা । তবে ছাত্র ছাত্রীদের ফ্রী মিক্সিং ওর পছন্দ হত না। বলে দিত শিক্ষা সফরে ছাত্র ছাত্রীরা যেন এক সিটে না বসে , বিশেষত রাতে । বার বার বলত এই সব ছাত্র ছাত্রীদের বাবা মা শুধু মাত্র আমাদের উপর ভরষা করে পাঠাচ্ছেন।
একবার কক্সবাজারে এক ছাত্রের মানিব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের ভাড়া করা গাড়িতে। ৩ দিন পর গাড়ির হেল্পার খুঁজে পেয়ে ফেরত দেয়ার কথা (হেল্পারের সততা) বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলার সময় ওর প্রতিক্রিয়া দেখে তো অবাক ।
- “মানুষ সৎ হবে ,এটাই তো স্বাভাবিক । ওই হেল্পার মানুষ , অধিকাংশ লোক মানুষের মুখোশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। “
ওর জীবন দর্শনই ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। সবসময় খুশী থাকতো তা যত খারাপ অবস্থাই হোক না ক্যান। বাচ্চার ১০৩ বা ১০৪ জ্বর , কোন টেনশন নেই । বলত প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়েছি , ইনশাল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে। বিপদে সবুর করাটা পরীক্ষা। রাগতে দেখিনি কখন , কিছু বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করত । আর বলত আমরা পাল্টালে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার ওর সুখী ভাবটাকে ঈর্ষা করে বলেছিলাম টিপস দাও। সহজ উত্তর
- “চাহিদা কমাও , ভালো থাকবে। “
খুবই কম ছিল ওর চাহিদা। বাসায় অতান্ত প্রয়োজনীয় ছাড়া কোন বিলাস দ্রব ছিল না। খাবার মেনু ও ছিল খুব সাদামাঠা । কিন্তু আপ্যায়নের আন্তরিকতা ছিল ঈরষনিয়। বলত খাওয়া দরকার তো বেঁচে থাকার জন্য , মনের শান্তির জন্য কিছু খরচ করা দরকার , আর পরকালের জন্য কিছু।
সাধারনত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির শেষের দিকের সিটে বসত ও। এত পিছনে বসার কারন জিজ্ঞাস করলে বলত একজন প্রফেসর এর সামনে কিভাবে বসি , হইত সে গাড়ি ছাড়ার আগে আসল। পুরটা পথ দাড়িয়ে গিয়েছে এমন অনেক দিন গেছে যখন ওর সিট অন্য কোন বয়োজৌষ্ট কাউকে বসতে দিয়েছে।
ভীষণ উদ্যোগী মানুষ ছিল মাহবুব । শুরুর দিকে বিভাগে কিভাবে ভালো সিলেবাস করা যায় তার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিল , ইন্টারনেট ঘেটে নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সিলেবাস থেকে প্রয়োজনীয় অংশ সাথে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সিলেবাস সংযুক্ত করে নতুন সিলেবাস উপস্থাপন করেছিল বিশেষজ্ঞ কমিটিতে । বিপত্তি বাধলো সংশ্লিষ্ট কোর্সের বই সংগ্রহ নিয়ে। ঢাকা গিয়ে খুঁজে খুঁজে যখন পাওয়া গেল না তখন ইন্টারনেট থেকে বই ডাউনলোড করে পড়ানো শুরু করল। বিভাগের লাইব্রেরির জন্য ওই বইগুলো প্রিন্ট করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম , এতে পাপ হচ্ছে না ? সহজ উত্তর
- দেশে যেহেতু বই পাওয়া যাচ্ছে না এবং আমরা অলাভজনক ভাবে প্রিন্ট করেছি, তাই ইন্টারনেট থেকে বই ডাউনলোড করে না পড়িয়ে , ফাঁকিবাজি করলে বরং বেশি পাপ হবে।
মাহবুব , তোমার প্রিন্ট করা বইগুলো ঠিকই বিভাগে ছাত্রদের সুবিধার জন্য আছে , কিন্তু তুমি নাই।
ব্যক্তিগত ভাবে ও ছিল দারুন উদ্যোগী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রান রসায়ন ও অনুপ্রান বিভাগ থেকে পাস করার পর ডায়াগনস্টিক সেন্টার করার চেষ্টা করে ছিল । ও বলত কিছু কিছু টেস্টে এত কম খরচ হয় , সেখানে ডাকাতের মত চার্জ নেয় সেন্টারগুলো । ব্যবসা ও হল সাথে মানুষের সেবা। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর সাথে ওর উদ্যোগ এর কথা আলাপ করার পর তারা এমন ভয় দেখাল , ওর উদ্যোগ ভেস্তে গেল। কুষ্টিয়াতে একটা টিস্যু কালচার ফার্ম খুলেছিল , আলু দিয়ে শুরু। শেষে বিভিন্ন কারনে তাও সফল হল না।
শান্ত স্বভাবের মাহবুব ঠিকই অন্যায়ের প্রতিবাদ করত ওর মত করে। একবার বিভাগের ছাত্ররা শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে বিভাগের গেটে তালা দিয়ে দেয়। মাহবুব তাতে সমর্থন দিয়েছিল। সমালোচনা করার লোক তো কম না আমাদের দেশে । ওর স্পষ্ট জবাব
- “অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না শিখলে ছাত্ররা তো ভ্যাড়া হয়ে যাবে, মানুষ হওয়ার জন্য প্রতিবাদ করতেও জানতে হয়। “
তবে অহিংস হয় যেন ছাত্রদের প্রতিবাদ তার জন্য ও সাবধান করে দিয়ে ছিল ।এখানে উল্লেখ্য তখন বিভাগে শিক্ষক ছিল মাত্র ৩-৪ জন , সৌরজগতে এত কম শিক্ষক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগে নেই। আমরা সাবেক ভিসি মহোদয়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে ছিলাম । ওর নির্ভীক স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ ছিলাম সবাই। লেজুড়বৃত্তিপনা ওর মধ্যে একেবারেই ছিল না , শিক্ষক ফোরামের নেতাদের বলতে গেলে এড়িয়ে চলত। সবসময় বলত পরিবর্তনটা আগে আনতে হবে নিজের মধ্যে ।
ছাত্রদের ভালো মন্দের দিকে খুব সচেতন ছিল। একবার পরীক্ষায় কোন এক কারনে সব ছাত্ররা হাজির হতে পারলেও এক ছাত্র না আসলে , ছাত্রদের খোঁজ নিতে বলেছিল কতখন লাগবে ওর আসতে। তার পর সব ছাত্রদের অনুরোধ করেছিল তোমরা রাজি থাকলে আমরা কিছুক্ষণ পরে পরীক্ষা শুরু করতে পারি কিনা? তবে পরীক্ষা পিছানোর ভীষণ বিরোধী ছিল ।তারপর মানবিক দৃষ্টি ছিল খুবই প্রখর। এক ফাইনাল পরীক্ষায় আগের রাতে এক ছাত্রীর বাবা ফোন করে জানায় , ছাত্রীর মা মারা গেছে এবং ও পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। মাহবুব ছিল ওই পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান বা সদস্য । বাকি সদস্যদের সাথে ফোন যোগাযোগ করে ওর ইচ্ছা প্রকাশ করল । তারপর সরবসম্মতিক্রমে পরীক্ষা ১ সপ্তাহ পিছিয়ে দিল এবং ছাত্রীর বাবাকে জানিয়ে দিল । সেই দিন ওর প্রতি শ্রধা আরও বেড়ে গেল । মানুষ হওয়ার স্লোগানের মানুষটা প্রকৃত মানুষ ছিল। দুষ্টামি করে ওকে ডাকতাম স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বলে। হারিয়ে গেলে ফেরিওয়ালা । ক্যানসার পড়াতে পড়াতে কোন ফাঁকে ক্যানসারই তোমাকে পড়ে ফেলেছে বুঝতে পারনি ।
মাহবুব আমাকে বলেছিল , সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায় মারা যাওয়ার পর , শুধু খোলা থাকে একটা - মানুষের দোয়া আর ভালো কাজের প্রতিদান। বন্ধু , তোমার খোলা থাকা ওই অ্যাকাউন্ট নিশ্চয় ভরে যাবে মানুষের ভালবাসা আর দোয়ায়। তুমি শান্তিতে ঘুমাও । তোমার স্বপ্নের ভালো মানুষে ভরে যাবে দেশ একসময় নিশ্চয় ।