***
সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মোটেই 'কুকুর-বিড়াল' বৃষ্টি না। 'ময়না-টিয়া' বৃষ্টি। কলকল-খলখল। ঘুমের জন্য উপাদেয় বলে একে 'ঘুম বৃষ্টি'ও বলা যায়। ঝুম-ঘুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি বসে আছি ছাদের উপর, চিলেকোঠার রুমটাতে। হাতে ধোঁয়াওঠা কফির মগ। কিন্তু চুমুক দেয়ার জন্য যতটুকু ইচ্ছার দরকার ততটুকু হাতে নেই বলে চুমুক দেয়া যাচ্ছে না। বাইরে উথাল-পাতাল বৃষ্টি। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবার প্রত্যয়ে ভীষন অভিশপ্ত যেন। সময়টা দ্বিপ্রহর হলেও চারিদিকে সন্ধ্যা সন্ধ্যা গন্ধ। বাইরের অস্বচ্ছ আলোয় কেমন যেন ঘোর জাগে। চারিদিকে তুলার মত ভাসে তরল অন্ধকার; ঘন কিন্তু জমাটবাধা না।
ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শে খানিকটা শীত শীত করছে। চিলেকোঠার এই ঘরটাতে হাওয়ার অবাধ যাতায়াত। দেয়ালজুড়ে বিশাল বিশাল দুটো জানালা। খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে থেমে থেমে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। জানালার ঠিক পাশে বসেছি বলে কিছু কিছু অতিউৎসাহী বৃষ্টির ফোঁটা কফিমগে আশ্রয় নিচ্ছে। কফির মগে চুমুক দিলাম। পানি মেশানো কফি খাওয়া কোন কাজের কথা না। মাথার উপরের টিনের চালে বিকট শব্দে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত-অবিরাম। বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। একটানা বৃষ্টির শব্দ বেশ একঘেয়ে।
অথচ চিলেকোঠার এই ছোট্ট কামরাটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল বৃষ্টির শব্দ শোনা। এককথায় বর্ষাযাপন। বর্ষা আমার খুব প্রিয় ছিল- তা বলা যাবে না। কিন্তু অহনার অসম্ভব পছন্দের। বিয়ের পর অহনার প্রচন্ড বৃষ্টিপ্রিয়তা আমার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের যৌথ বর্ষাপালনের উপলক্ষেই চিলেকোঠার এই অংশটুকু। এখানে অহনা আর আমার স্বেচ্ছাবৃষ্টিবন্দী হওয়া। ঘরের অর্ধেকটাজুড়ে জানালা। হাত বাড়ালেই যেন বৃষ্টির জলে হাত ভেজানো যায়। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন অলস দুপুরের রিকশার টুং টাং-এর মত বাজতে থাকে। একপাশে একটা বিছানা, একটা চেয়ার আর একটা টেবিল- ঘরের আসবাবপত্র বলতে এরাই। টেবিল রাখতে অবশ্য অহনা উশখুশ করেছিল। কখনো কখনো লিখতে বসব- বলে এককোনায় ফেলে রেখেছি। যদিও লেখা আর হয় না।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছেই। এভাবে বাড়তে থাকলে সন্ধ্যা নাগাদ অর্ধেক ঢাকা পানির নিচে চলে যাবে। আর আমার টিনের চাল ফুঁটো হয়ে যাবে বোধহয়। যেভাবে তীরের মত হামলে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, চাল ফুঁটো হয়ে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক না। আকাশ থেকে কেউ যেন মেশিনগান দিয়ে গুলি করছে একটানা। চারিদিকের অন্ধকারটা আরো চেপে এসেছে। আমাকে, আমার চিলেকোঠাকে, আমার পৃথিবীটাকে গিলে খাবে যেন।অনেকটা বিরক্ত হয়েই মগের সবটুকু কফি গলায় ঢেলে নিলাম। বারবার বিড়ালের মত চুকচুক করতে ইচ্ছা করছে না। বিরক্তিকর।
***
'বর্ষা তোমার খুব পছন্দের?'
'ভীষন'
'আমাদের চিলেকোঠায় একটা ঘর থাকবে। বৃষ্টি ছোঁয়ার জন্য।'
'বিশাল বিশাল জানালা?'
'আর উপরে টিলের চাল। বৃষ্টির শব্দ ঠিক ফোটে না টিনের চাল ছাড়া।' অহনা হেসে ওঠে। খিলখিল। হাসলে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মত লাগে। আমার খুব মায়া হয় তখন।
'দেয়ালের রঙটা নীল হোক।'
'আচ্ছা। আর দেয়ালটা আকাশ হোক।'
'আমাদের আকাশ।' অহনার কন্ঠে স্বপ্নের সযত্নস্পর্শ।
'আমরা কিছু ব্যাঙও পুষতে পারি। কি বল?'
'ব্যাঙ কেন?' অবাক কন্ঠে জানতে চায় অহনা। এর মধ্যে ব্যাঙ আসছে কোত্থেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ও।
'ব্যাঙের ডাক ছাড়া বৃষ্টির শব্দ কেমন খালি খালি লাগে। কিছু ব্যাঙ থাকল। মাঝে মাঝে ডাকল। ভাল্লাগবে।'
'হু। আর ঐ ব্যাঙ তোমাকে মুরগীর সাথে রান্না করে খাইয়ে দিব।'
'তুমিতো মুরগী রান্নাই পারনা। ব্যাঙ রাঁধবা কিভাবে?'
'অন্তত ব্যাঙের জন্য হলেও আমি মুরগী রান্না শিখে নিবো।'
কখন যে অজান্তেই ঠোঁটের কোনে একচিমটি হাসি এলিয়ে পড়ল টেরও পেলাম না। টের পাওয়ার পরও হাসিটা দমল না; আরো কয়েকফোঁটা বেড়ে গেল বরং। মুখে স্মিতহাসি ঝুলিয়েই বাতাসে একটুকরো দীর্ঘশ্বাস উগড়ে দিলাম। শামুকের খোলে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস জানালা গলে গলে যাত্রা করে অনন্তের দিকে।
***
ছোট পরিবার সুখী পরিবার। কথাটা সত্য না। আদর্শ সুখী পরিবারের বৈশিষ্ট্য হল- স্ত্রী বলবে, স্বামী শুনবে। স্বামীরা কিছুই বলতে পারবে না। তাদের মুখ থাকবে তালাবদ্ধ। সুখী পরিবারের এটাই নিয়ম। আমি নিয়ম ভাঙ্গলাম। ফলাফল যা হবার তাই হল। ঘরের ভেতর সাইক্লোন। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কথা বলাতো আগেই কমে গিয়েছিল। সেটা টুপ করে শূন্যের কোঠায় নেমে এল। দুই-একটা কথা হলেও তা হয় ব্যাকরনের ভাববাচ্যের নিয়ম মেনে।
'রিমোটটা পাচ্ছি না'
'টিভির উপরেই আছে'
'রাতে খাব না'
'রাতে রান্নাও হয় নাই'
এইটাইপ।
আমরা একই ছাদের নিচে থেকেও অচেনা হতে থাকি। আমাদের গ্রাস করে দুটি আলাদা অন্ধকার। আমরা কেউ কাউকে খুঁজে পাই না অনেকদিন। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোটাই সার হয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়েও যে তুলকালাম ঝগড়া করা যায় তা আমাদের না দেখলে ঠিক বোঝা যাওয়ার কথা না। কোথায় যেন শুনেছিলাম- প্রেম এবং বিয়ে অত্যন্ত আনন্দময় ব্যাপার, পরবর্তীতে একসাথে থাকতে গিয়েই যত ঝামেলা আর সমস্যা শুরু হয়। কথাটা মিথ্যা না। ছোটখাট পছন্দ-অপছন্দ। কথায় কথায় টুকটাক; অতঃপর আকাশ-পাতাল কালো করা ঝগড়া।
অহনা যখন আমাকে বলল, আমার সাথে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব না, আমি মোটেই বিচলিত হলাম না। কথাটা কানে কিছুমাত্র অস্বাভাবিকও ঠেকল না। বেশ সহজ কন্ঠেই বললাম, 'ও আচ্ছা'। যেন এটাই সহজ আর স্বাভাবিক। আমার 'ও আচ্ছা' শুনে অহনা অবাক চোখে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। অতঃপর বিনাবাক্যে গৃহত্যাগ। আমাদের আর কোন কথা হল না।
***
বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। চারিদিকের কালোত্ব কমেনি একটুও। দূরের নারিকেল গাছদু'টো ভীষন ভিজছে। আমার হঠাৎ নারকেল গাছ হওয়ার লোভ জাগে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য না। ইচ্ছে করলেই বৃষ্টিতে ভেজা যায়। কিন্তু ভিজতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু একটা নারিকেল গাছ হওয়ার লোভ। যার নারিকেল বৌগাছ তাকে ছেড়ে দূরে যায় না। বা চাইলেও যেতে পারে না।
এই অন্ধকার চিলেকোঠায় নিজেকে খুব অসহায় অসহায় লাগে। মনে হয় এক গাঢ় নিঃসীম অন্ধকার আমাকে গিলে নিচ্ছে। কোন নরখাদক অন্ধকার কূপে যেন তলিয়ে যাচ্ছি ক্রমশঃ। আমার মনে হতে থাকে অনন্তকাল ধরে এখানে বন্দী আমি। এখানেই একদিন মৃত্যু আসবে। এই বাড়ির চিলেকোঠায় কেউ একজন মরে আছে- হয়ত কেউ জানতেও পারবে না অনেকদিন।
বৃষ্টির একটা ঝাপটা এসে মুখ ভিজিয়ে সটকে পড়ে। ভাবনায় ছেদ পড়ে খানিক। মহাপুরুষরাতো বিয়েই করেন না। তাই বলে কি তারা মহাপুরুষ না? একলা জীবন শ্রেষ্ঠজীবন। মানুষ দুই প্রকারঃ জীবিত আর বিবাহিত- এমনসব ভাবনায় আমার মন আদ্র হয়ে উঠল। এখন থেকে চশমাটা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। এ আর কঠিন কি। চশমাটা একটু দেখেশুনে রাখলেই চলবে বেশ। কেউ এখন আর খেয়ে নেয়ার জন্য অযথা তাড়া দেবে না। অযথা কৈফিয়তও না। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠল। মুখ গোল করে ছোট্ট একটা শিসও দিলাম।
কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য। আমি আবার নিজেকে বেশ অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করলাম। কী যেন নেই, কী যেন ছিল, একটা খালি খালি ভাব এসে আমাকে গ্রাস করলো। এই খালিভাবটা গেল না। আরো যেন বুকের ওপর শিকড় মেলতে শুরু করল। আমি 'খালি খালি' বুকটা নিয়ে দূরের নারকেল গাছগুলোর মাথানাড়ানো দেখতে লাগলাম তপ্ত দৃষ্টি মেখে। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শো শো, আধো অন্ধকার - সব মিলিয়ে অপার্থিব এক জগতের চমৎকার আলপনা। আর অতৃপ্ত কোন আত্না হয়ত ঠাঁই নিয়েছে নারিকেল গাছে।
***
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। কোন এক বিচিত্র কারনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পরিচিত আর আপন একটা গন্ধ এসে নাকে টোকা দিচ্ছে। চোখ না খুলেই বুঝতে পারি কেউ একজন মাথার পাশে বসে আছে। হালকা নড়চড়ের গুঞ্জনও কানে আসে। কেমন যেন সুখ সুখ লাগে। একচিলতে হাসি ফোটে। প্রানপনে হাসিটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেও লাভ হয় না বিশেষ। বুঝি যে মুখটা ঠিকই হাসি হাসি হয়ে আছে। চোখ বন্ধ রেখেই মুখ খুললাম।
'বৌ সরি।'
কোন সাড়াশব্দ নেই। তবে কি হেলুসিনেশন নাকি? না। তা কেন? নিশ্চিত হওয়ার জন্য আস্তে করে একচোখ খুলি। আবছাভাব কেটে গেলে দেখি কেউ একজন আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। এইভাবে ধরা খেয়ে যাব ভাবিনি। এক চোখ খোলা রেখেই অহনার হাত ধরি। ঘরের অপার্থিব পরিবেশ যেন হঠাৎ করেই ভীষন স্নিগ্ধ লাগে।
'বৌ আমি খুব সরি। আর ঝগড়া করব না।'
'এখানে এসে শুয়ে আছ দিব্যি। ঘুমিয়েও গেছ।'
'তোমার কথাই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতেই ঘুম।'
'তাই নাকি?'
'হ্যাঁ' গলায় বেশ খানিকটা জোর এনে বলি।
'তোমাকে মিস করছিলাম খুব।'
'একটা ফোনওতো দাও নি'
কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। অন্যচোখটাও খুলে ফেললাম।
'তুমিওতো ফোন দাও নাই'
'আজব। আমি দিলাম না বলে কি তুমিও দিবা না নাকি? তুমি না মিস করছিলা? তো ফোনতো দিলানা কেন। শুধু শুধু মিথ্যা বল কেন- যে মিস করছিলা।' অহনা একনাগাড়ে দ্রুত অনেকগুলো কথা বলে। আবার বিরক্তি লাগছে। এই আপদ আবার আসল কেন। না আসলেইতো হত। এতক্ষন কত ভালো ছিলাম।
'আচ্ছা ঠিক আছে। মিস করি নাই।'
'এইত সত্যি কথা বের হয়ে এসেছে। প্রথমে মিথ্যা বললা কেন?'
'ভুল হয়ে গেছে আমার। আমি মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলসি। এখন জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এইবার খুশি?'
আমার ঠোঁটজোড়াও সচল হয়। এই বেচারা কতক্ষনইবা চুপ থাকতে পারে।
অহনা হাত ছাড়িয়ে নেয়। আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলি। ধুরো। প্রথমে সরি বলাটাই ভুল হয়ে গেছে। বিশাল ভুল। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। তবে বিশাল ভুল করেও কেমন একটা শান্তি শান্তি লাগছে। কেন কে জানে। আমি চোখ বন্ধ করে আবার হাতটা চেপে ধরলাম। এবার আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই।