somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম আর নেই

১৬ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বরেন্য পদার্থবিদ ও গণিতবিদ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরন করেছেন। আমাদের বাঙালি জাতির বিজ্ঞান বিমুখতার কোনো তুলনা নেই। শিরোনাম পড়ার সাথে সাথেই নিশ্চয়ই অনেকে ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন এই লোকটা আবার কে? তাদের জন্য জামাল নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।

ড. জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহ জেলায়। তাঁর বাবা সে সময়ে ওখানকার মুন্সেফ ছিলেন (বর্তমানের সহকারী জজ সমতুল্য)। তাঁর বয়স যখন এক বছর, সে সময় তাঁর বাবার বদলির সুবাদে কলকাতায় চলে যান তাঁরা। জামাল নজরুল কলকাতার মডেল স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। সেখান থেকে যান শিশুবিদ্যাপীঠে। সেখানে চতুর্থশ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তির জন্য তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন। এই ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাকে “ডাবল প্রমোশন” দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে নেয়া হয়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার ভালবাসার সৃষ্টি হয়। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ (ও লেভেল)ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ (বর্তমান এ লেভেল) পাশ করেন। হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান। এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন। বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে ইসলাম কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। তারপর এখান থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জামাল নজরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি)কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নেএত হন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে কেমব্রিজের সোয়া লাখ টাকা বেতনের অধ্যাপনার চাকরীটি ছেড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র হাজার তিনেক টাকা বেতনে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। শুধু নিজে নয়, তাঁর প্রিয় সবাইকেই তিনি পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন।

১৯৬০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি সুরাইয়া ইসলামের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সাদাফ সাজ সিদ্দিকি আর ছোট মেয়ের নাম নার্গিস ইসলাম।তিনি বই পড়তে ভালবাসেন। তবে তিনি শখ হিসেবে গান শোনা ও ছবি আঁকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত সবচেয়ে প্রিয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এর প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিল। গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভাল লাগে না। অবশ্য তাঁর গবেষণাকাজে কম্পিউটার কখনো প্রয়োজন হয় নি।

তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে থাকে দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ইসলাম তৎক্ষণাৎ তাকে দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।

২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবী অচিরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- এ রকম একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। বাংলাদেশের মতো পশ্চাত্পদ দেশে এই আতঙ্ক মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়ার আগেই আমাদের সব উদ্বেগকে প্রশমিত করেছিল যাঁর অভয়বাণী তিনি জামাল নজরুল ইসলাম (আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যিনি জে.এন. ইসলাম নামে পরিচিত)। কোনো দৈবজ্ঞান নয়, তিনি রীতিমতো গণিতের হিসাব কষে জানান যে, আমাদের সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহ প্রাকৃতিক নিয়মে একই সরলরেখা বরাবর এলেও এর প্রভাবে এই গ্রহে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই।

উল্ল্যেখযোগ্য প্রকাশনা:
• Rotating Fields in General Relativity. Cambridge University Press. ISBN 0-521-26082-5.,1985. Translated in Japanese, French, Portuguese, Italian, Yugoslav
• Classical General Relativity: Proceedings of the Conference on Classical (Non-Quantum) General Relativity. Cambridge University Press. ISBN 0-521-26747-1., 1983.
• An Introduction to Mathematical Cosmology. Cambridge University Press. ISBN 0-521-37385-9., 1992.
• The Ultimate Fate of the Universe. Cambridge University Press. ISBN 0-521-24814-0.,1983.
• Sky and Telescope, Cambridge University Press. Translated in Spanish.
• The Far Future of the Universe, Cambridge University Press. Translated in German, Dutch, Italian.
• Introduction to Mathematical Economics and Social Choice, Cambridge University Press.
• সমাজ দর্শন বিজ্ঞান ও অন্যান্য প্রসংগ, বলাকা প্রকাশনী।
• কৃষ্ণ বিবর – বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত।
• মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা
• শিল্প সাহিত্য ও সমাজ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা

সদস্য
• বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি
• রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি
• কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি
• ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স
• বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী
• এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ

পুরষ্কার:
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। তিনি ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।

[লেখাটি নিন্মেক্ত আর্টিকেলগুলো সম্পাদনা করে তৈরি করা:
১. Click This Link
২. Click This Link
৩. Click This Link
বিডি নিউজে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। লিংক: http://arts.bdnews24.com/?p=346]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৪১
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×