১.
চারদিকে ডানা ঝাপটানোর শব্দ ।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছিলাম কোন বিশাল ডানার বিস্তার , কোন আঁজলাভরা সোনাসকালের বুক ঘেঁষে , অজর কোন কালোপাখি ।
বাবা , হঠাৎই বলে বসলেন , কি দেখছিস অমন করে ?
পাখি , বাবা । ....... অদৃশ্য কোন পাখিকে খুঁজছিল আমার চোখজোড়া ।
কই ? নেই তো । ভুল দেখেছিস । সাইকেলে ওঠে পড় , এমনিতেও আজ দেরী হয়ে গেছে .......... ।
আমি জানতাম না , আমি কি দেখছিলাম ..... আমার সামনে স্কুলের খোলা বারান্দা , পরিচিত রেলিং এর সারি , সামনে একরাশ ইউনিফর্ম , মস্ত গোঁফওলা হারুন মাস্টার ।
মনে হল , ভুল শুনেছি ।
২.
কোন এক ঝড়ো বর্ষার সকালে , আমার কোলে ঠাঁই নিয়েছিলো বুনো ।
একবারেই দেশি নেড়িকুত্তা .... সাদাকালো শির্ণ দেহ আর ছোট্ট ঝোলা দুটো কানের কোল ঘেঁষে বড় বড় একজোড়া সজল চোখ । .... সেই চোখে কি অসীম ভালোবাসা আমার প্রতি , কি অপার্থিক প্রেম তার আমার সাথে ।
সে আমার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে গেল , যেখানেই যাচ্ছি , পেছনে আঠার মত সেঁটে থাকে , দরজায় ঝড়শেষে এলিয়ে পড়ে থাকা চেহারার সাথে কোন মিলই নেই আর ।
শরতের কাশফুলের সাথে সাথে বেড়ে উঠলাম আমরা । চোখের সামনে , ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যেতে লাগল শহরটা । শুকিয়ে যেতে লাগল পুরোন , নোংরা নদী ।
এভাবেই একদিন স্টোররুমের কোনায় , পুরনো রুমালের মত মরে পড়ে থাকলো বুনো ।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো , আমি দেখছিলাম , পড়ে আছে বুনো , যেন মরে পড়ে আছে আমার শৈশব ।
চারদিকে ভীষণ বাতাস , ক্রমাগত ডানা ঝাপটাবার শব্দ । পাখিরা আসছে , চারপাশ অন্ধকার করে , পাখি ।
আমি বাঁহাতে চোখ মুছলাম ।
কোথাও কেউ নেই ।
৩.
তুই আমার বউ হবি ?
আমার অবান্তর প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে ওঠে লাবনী । " বিয়ের শখ হয়েছে বুঝি ?" .... মাটিতে লুটোপুটি খায় একরাশ চুড়ি ।
চোখের সামনে বয়ে যেতে থাকে পুরনো নদীটি , আর সেই নদীর পাড়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসা কোন কিশোরীর গল্প ।
শেষ হত না কোনদিন কথা আমাদের , আমাদের আকাশটা ছিলো অনেক বড় ; শব্দগুলি ঘুড়ির মত ঘুরপাক খেত বাতাসে । কখনো লাবণীর চুলে বাতাস এস বসত , আমি তাকিয়ে দেখতাম ।
পরের বসন্তে লাবণীর সংক্ষিপ্ত চিঠি চলে আসল , গোটা গোটা অক্ষরে লেখা , "ক্ষমা করো ।" অনেক চেনা হাতের লেখা । তবুও ভীষণ অচেনা , ভীষণ ।
কোথাও যেন পাখিরা আসছে , আসছে আকাশ অন্ধকার করে ।
৪.
সে এক ভীষণ অস্থির সময় । মানুষ কত সহজে পশু , কখনো ঈশ্বর হয়ে যেতে পারি ।
চারদিকে ভীষণ ডামাডোল । মানুষ পালাচ্ছে দিগ্বিদিক ।
মায়ের হাত ধরে আমি চলেছি অজানার পানে । আমাদের চারপাশে বন্যার পানির মত মানুষ । সবাই চলেছে স্রোতের মত ......... কোথায় ? কারো জানা নেই ।
মা'কে অজানা এক স্টেশনে রেখে আসলাম , স্টেশন মাস্টার বলেছেন ..... দেখে রাখবেন । মা যেতে দিতে চায় না .....বারবার আটকে ফেলে চোখের জলে , আমি বেরিয়ে আসি ; সবকিছু পেছনে ফেলে । আমার শার্টে বাবার রক্তের দাগ কখনো স্পষ্ট ।
কাদার মাঝে শ্বাপদের মত পড়ে থাকি , চোখ জ্বলজ্বল করে নক্ষত্রের মত ।
হাসনাতের লাশ কুকুরে টেনে নিয়ে যায় ...... নিজের হাত অবলীলায় টেনে ছিঁড়ে ফেলে জামান ।
কখনো খাবার হয়ে আসে শুধু কষ্ট , কখনো বুকের আগুন । কখনো চোখের জল ছাড়া পানীয় জোটে না কিছুই ।
বাজারে চাদর মুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাই সন্তর্পনে ..... খাকি একদল অবয়ব বড় হতে থাকে চোখের সামনে ।
গ্রেনেডটা হাতের মুঠোয় ভীষন জীবন্ত লাগে , ছোট্ট বুনোর মত একদম ।
চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে । আমি জানি , সে আসছে ।
কোন বিশাল ডানার বিস্তার , কোন আঁজলাভরা সোনাসকালের বুক ঘেঁষে , অজর কোন পাখি উড়ে যায় ।
কালোপাখি ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




