somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।।--দ্যা ফুল মুন--।।

১৮ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ফোনটা বেজেই চলেছে।

এখন ধরতে ইচ্ছা করছে না। ঘুম ভেঙে গেছে যদিও। পাশ ফিরে কিছুক্ষন শুয়ে রইলাম। বিকেলের নরম আলো জানালা থেকে এসে রুমটাকে লাল আভায় ভরিয়ে ফেলেছে। বাইরে প্রচুর বাতাস। আমি উঠে বসলাম। ফোন বাজছে এখনো। বাজুক। আমি বারান্দায় চলে এলাম। এখান থেকে স্পষ্ট সমুদ্র দেখা যায়। আমার কাছে এই বারান্দাটা বড় প্রিয়। প্রায় প্রতি বিকেলই কাটে আমার এখানে, ইজি চেয়ারে। এখানে বুক ভরে শ্বাস নেই আমি। বিচ্ছিরি পৃথিবীটাকেও বড় বেশি মায়াবী মনে হয় তখন।

দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে পিছে ফিরে তাকালাম। ফোন বাজছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভার তুলে চুপ করে দাড়িয়ে থাকলাম।

সময় কেটে যাচ্ছে। মনে হল বহুকাল ধরেই আমি মূর্তির মতো এখানে দাড়িয়ে আছি। কোথাও যেন কিছু বাদ পড়ে গেছে। চিন্তাশূন্য আমি দাড়িয়েই আছি।

“হ্যালো কুশ।”
“হাই বব।”
“খবর কি তোমার? তোমার মনে হয় আজ আমাকে ফোন করার কথা ছিল।”
আমি চুপ করে রইলাম।

“সে যাই হোক”- বব বলতে শুরু করলো।“ কাল তোমার এসাইনমেণ্টটা সকালের মাঝেই সাবমিট করতে হবে। সেটার পরে ঠিক করা হবে তোমার স্কলারশিপটা আরও এক্সটেন্ট হচ্ছে কিনা।”

“বব, তুমি ভালো করেই জানো, কালকের মাঝে আমার রিপোর্টটা দেওয়া সম্ভব না।”

“সরি কুশ। তোমাকে এর আগেও কয়েকবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন আসলে আমার আর কিছুই করার নেই। তোমার ডিপার্টমেন্ট থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে কালই তোমাকে পেপারগুলো সাবমিট করতে হবে। নাহলে তোমার সামনে বড় ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করে আছে। তোমার এতো বড় অঙ্কের টিউশন ফি তুমি কিভাবে মিটাবে সেটা তোমার ব্যাপার। যদিও আমার মনে হয়না তোমার মতো কারো পক্ষে এতো বিশাল অঙ্কের টাকা যোগাড় করা সম্ভব।”

বব দুলে দুলে হাসতে থাকে। ফোনের এপাশ থেকে আমি তার কেপে কেপে উঠা হাসির শব্দ পাই। নিকষ কালো হাসি। দন্ত বিহীন অথচ ধারালো।

আমার অপমানিত বোধ হওয়া উচিৎ। তবুও আমার কিছুই মনে হচ্ছেনা। জীবন তার সকল স্বাভাবিক আকর্ষণ হারিয়েছে। আমার এখন ইউনিভার্সিটিতে যেতে ভালো লাগেনা, কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা। সারাদিন শুধু আমার বাসায় থাকতে ইচ্ছা করে। বিশাল দোতালা বাড়ি। চারপাশে গভীর জঙ্গল। সামনে, বহু দুরে সমুদ্র। আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। জঙ্গলের মাঝে কাঠের বাড়ি। বাবা খুব শখ করে কিনেছিলেন। বাবা খেয়ালী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। খেয়ালী মানুষটার জীবনের পরিসমাপ্তিটাও খেয়ালী। ৯ বছর আগের কোন এক দুপুরে বাংলাদেশ থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হন। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাবার কিছু বৈশিষ্ট্য আমার মাঝেও প্রবাহিত হয়েছে। আমিও মানুষজনের থেকে দুরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সমাজ ব্যাবস্থা আমার কাছে জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। আমি একজন অসামাজিক মানুষ। আমি গত ৬ বছর ধরে এখানেই পড়ে আছি, দেশে যাওয়া হয়নি। দেশে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছাও আমার নেই। আমার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই, নেই তেমন কোন ঘনিষ্ঠ আপনজন। শুধু শেষ বিকেলে দিনের আলো পড়ে গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, সেই সময়টা আমার খুব বিষণ্ণ যায়। কারন ওইসময় মা ফোন করেন।

আমি আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দুরে সমুদ্রের বুকে ছোট্ট একটা নৌকা ভাসছে। নৌকায় একজন তরুণ এবং তরুণী। নীল রঙের ছোট পাল। দেখতে ভালো লাগছে। একটা সময় আমিও এরকম ছোট্ট একটা নৌকার স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্ন কেটে গেছে। স্বপ্ন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। তবু দুর থেকে মানুষের স্বপ্নগুলো দেখতে ভালো লাগে।

আমি মাইক্রোবায়োলজির একজন ছাত্র।

বাবাও মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র ছিলেন। এখান থেকেই, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ডাকোটা থেকে পিএইচডি করেছেন। এই বাড়িটা তখনই কেনা। বাবা এখানে থাকতেন, আমিও এখানে থাকি। তিনিও এই জায়গাটা অনেক পছন্দ করতেন, আমিও এই জায়গাটা অনেক পছন্দ করি। বাবার সাথে আমার অনেক মিল।

অবশ্য এই জায়গাটিকে পছন্দ করার আরও অনেক কারন আছে। মনের ভেতরে থাকা গভীর নিশ্চুপতার সাথে এই বিস্তীর্ণ অরণ্যের অনেক মিল। বাড়িটা কেমন যেন এক অদ্ভুত মায়া মেশানো। সেই মায়া থেকে সহজে বের হওয়া যায় না।

বিকেলের আলো দ্রুত পড়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ পরেই সাপের মতো হিস হিসিয়ে নামবে গভীর অন্ধকার। চা খেতে ইচ্ছে করছে। চা বানানো দরকার।

সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামলাম। রান্নাঘরের কোনায় রাখা কেটলিটা কাল ধোয়া হয়নি। ওটাকে ধুয়ে পানি চাপিয়ে স্টোভে বসাতে যাবো এমন সময়-

জানালার পাশ থেকে খুট করে কেউ একজন সরে গেলো।
আমি মনে মনে হাসলাম। এই ঘটনা যে আজ প্রথম তা নয়। এটি আমার পূর্বপরিচিত, বহুকাল আগে থেকেই।

আমি একা থাকি শুনে মারিয়া একদিন বড় বড় চোখ করে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো-
“তুমি যে একা একা থাকো, তোমার ভয় লাগেনা?”
“আরে ধুর! ভয় লাগবে কেন?” আমি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলাম।

মারিয়া আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। রাশিয়ান এই মেয়েটি আমার প্রতি একটু বেশিই সদয়। খুব সম্ভবত মারিয়াই আমার একমাত্র সহপাঠী, যে প্রয়োজন ছাড়াও আমার খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করে।

মারিয়াকে আসলে আমি যেটা বলেছি, সেটা আংশিক সত্য। পুরোপুরি সত্যিটা বলা উচিৎ কিনা বুঝতে পারছি না।

ব্যাপারটা আসলে একটু অন্যরকম।

আমি আসলে পুরোপুরিভাবে একা থাকি না। আমার সাথে আরও কেউ একজন থাকে। ছায়ার মতো ঘুরঘুর করে আমার পিছে পিছে। কখনো সামনে আসেনা।

আমি তাকে কখনো কাছ থেকে দেখিনি। তবে তার উপস্থিতি আমি টের পাই সবসময়। গভীর জঙ্গলে তার বসবাস। তবু রাত হলে এ ঘর থেকে ও ঘর হেটে বেড়ায় সে। মসৃণ সাদা পাতলা পর্দার আড়াল থেকে আমি তার স্নিগ্ধতা দেখি। সে কোমল, সে লাস্যময়ী। সে আমার অনেক বড় আশ্রয়, বিশাল কোন এক বটবৃক্ষের মতো। কেন জানি আমার মনে হয়, খুব বড় দুঃসময়েও সে আমাকে ছেড়ে যাবেনা।

আমি যতই ছুটে যাই তার কাছে, সে ততোই দুরে সরে যায় প্রতিবার। যতই আমি তাকে দেখতে যাই, সে ততোই অস্পষ্ট হয়ে যায়। আমার সাথে তার কেন এতো ছলনা আমি বুঝিনা। আমি ব্যার্থ হই। সে হাসে, খিলখিল মধুর হাসি। সুন্দর অথচ অস্পষ্ট। আনন্দে সারা ঘরটা ভরে যায়। মনে হয়, পৃথিবীতে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মনে হয়, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই।
ভরা জোছনায় সমুদ্রের গর্জন শুনতে আমি যখন বারান্দায় হাজির হই, কেউ আমার সাথেই সমুদ্র দেখে। অরণ্যের শুকনো পাতার উপর আমি দীর্ঘ পদচারনার শব্দ পাই।

জগত সংসারে একমাত্র সেই আমাকে পুরোপুরি ভাবে বুঝতে পারে বলে আমার ধারনা। আমি যখন তার কথা মনে করি, সে তার উপস্থিতি আমাকে জানিয়ে যায়। আমি আনন্দ পেলে তারও আনন্দ হয়, আমার কষ্টে তারও কষ্ট। আমি যখন সংগীত শুনি, সে মৃদু ছন্দে নেচে যায় পর্দার ওপাশে। যখন রাতে মোমবাতি জ্বালাই কোনোদিন, আমার সাথে চলে তার দুষ্টুমি। হাওয়ায় হাওয়ায় দুষ্টুমি। কেন জানিনা, তবে আমি তার উপর বড় বেশি নির্ভরশীল।

আজও বাইরে পাতার খরখর শব্দ তার পরদচারনাকে জানিয়ে দিচ্ছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। উঁচু উঁচু গাছের ডাল পালার ফাঁক দিয়ে চাদের আলো এসে অন্ধকার আরও বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। ওই তো সে হেটে চলেছে মন্থর পায়ে। নীল রঙের লম্বা গাউনে তাকে বড় সুন্দর লাগছে।

আমি জানি সে মানুষ নয়। সে অন্যকিছু। সে কি, আমি জানিনা। আমার জানার দরকারও নেই। আমি শুধু তাকে চিরকাল আমার পাশে চাই। আমি জীবনটাকে গোছাতে চাইনি। জীবনটা অগোছালোই থাকুক। তবু সে চিরকাল আমার পাশে থাকুক। তার অস্তিত্ব ছাড়া কেমন যেন সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। আমি তার এক অদৃশ্য মায়ার বাধনে আটকা পড়ে গেছি। বোধহয় এটাকেই ভালোবাসা বলে।

আমি এগিয়ে গেলাম। তার পদচারনা বহু আগেই থেমে গেছে। দেবদারু গাছটার আড়ালে সে দাড়িয়ে আছে। আজ হয়তো সে আমাকে দেখা দিবে। আমি তাকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে চাই। অন্তত একটিবারের জন্য হলেও আমি তাকে দু চোখ ভরে দেখতে চাই।



চাদের আলো ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে অরণ্যের গহীনে।


২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×