somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাসপোর্ট অফিস

২৭ শে নভেম্বর, ২০০৬ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগারগাঁও পাসপোর্ট ভবনের সামনে জটলা যেন কখনো শেষ হতে চায় না। ওখানে দালাল ও প্রতারকদের হাতছানি। ওদের যাদুকরী হাতছানিতে ধরা দিয়ে সর্বস্বন্ত হয়ে পড়ে গ্রামের সহজ-সরল খেটে খাওয়া মানুষ।

পাসপোর্ট ভবনের রাসত্দার মোড় থেকেই শুরু হয় বিড়ম্বনা। একটি মক্কেলের আশায় তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে দালাল ও প্রতারক। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ পাসপোর্ট করতে এসে বুঝতে পারে বিদেশে যাওয়া সহজ নয়। এখানে এসে তার স্বপ্ন যেন ভেঙ্গে যায়। বহু কষ্ট, হয়রানি, মানসিক চাপ, দালালদের উৎপাত আর কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতার পর কাঙিৰত পাসপোর্ট হাতে পেয়ে মনে হয় এ যেন স্বগর্ীয় কোন বস্তু। যার জন্য প্রতিটি ধাপে ঘুষ আর বকশিস না দিলেই নয়।

এক সকালে পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দু'-তিন দালাল 25/26 বছরের এক যুবককে ঘিরে ধরেছে। যুবকটি কিছু বোঝার আগেই এক দালাল বলল ঃ 'কি ভাই, পাসপোর্ট করতে এসেছেন? দেখেন না, কত ভিড়! এই ভিড় ঠেলে আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না। ভিতরে দালালে ভরা। গেলেই দালালের খপ্পড়ে পড়বেন। সাবধান, পাসপোর্ট করতে কাউকে টাকা দিবেন না। তাহলে টাকা মাইর, পাসপোর্ট নাই।' সবগুলো কথা সে এক নিঃশ্বাসে এমনভাবে বলল যে, যুবকটি কোন কথা বলার সুযোগই পেল না।

গেটের সামনে এগিয়ে দেখা গেল, দু'জন লোক হাতে কিছু পাসপোর্ট আবেদন ফরম নিয়ে দশ টাকা করে দাম হাঁকছে। যেখানে বিনামূল্যে ফরম দেয়ার কথা সেখানে দশ টাকা করেই লোকজন ফরম কিনছে বাধ্য হয়ে। আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখা যায়, লোকজন প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে ভিতরে প্রবেশ করছে। ভিতরে বিশাল লম্বা লাইন। দু'-একটি নয়, কয়েকটি লাইন একেবারে পাসপোর্ট ভবন প্রাঙ্গণে কয়েকটি চক্কর খেয়েছে। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শত শত মানুষ। ফরম বিতরণের কৰের সামনেও বিশাল লম্বা লাইন। সেখানেও বিনামূল্যে ফরম দিচ্ছে না। দায়িত্বরত কর্মচারী ফরম বিতরণ করে পাঁচ টাকার বিনিময়ে। মধ্যবয়সী এক লোক এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে তাকে হেনসত্দা হতে হয়। ঐ কর্মচারী আশেপাশের কয়েকজনকে ডেকে বলল ঃ 'এই লোকটাকে ধর। কিভাবে পাসপোর্ট করতে হয় একটু শিখিয়ে দে। কয়েকজন দালাল তাকে ঘিরে ধরে বলল ঃ 'আপনার ছবি আছে? থাকলে ছবি দেন।' লোকটি কিছু না বুঝেই মানিব্যাগ থেকে তিন কপি ছবি বের করে দিল। ছবি দেয়ার পরই দালালরা একটু ভারীকণ্ঠে বললো ঃ 'এবার চার হাজার টাকা দেন, দুই মাস পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না।' লোকটি তার ছবিগুলো ফেরত চাইলে লোকগুলো তাকে হুমকি, ধমক, ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। আর ভয় দেখালো 'স্বরাষ্ট্র সেলিমের'। যে সেলিম 'স্বরাষ্ট্র সেলিম' হিসেবে পাসপোর্ট ভবন এলাকায় বেশ পরিচিত। সে নিজেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেয়। সাধারণ লোকজন কেন পুলিশরাও নাকি তাকে ভয় পায়। লোকটি উপায়নত্দর না দেখে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি।

ভিড়ের একটু আড়ালে এক দালালকে এক মহিলার কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা নিতে দেখা যায়। টাকা হাতে দেয়ার পর মহিলা বলছে ঃ 'দেহেন ভাই আমি গরীব মানুষ। ছাগল বেইচা পাসপুট করতে আইছি। দেড় মাসের মাঝেই দিয়া দিবেন। ভিসা আইসা পড়ছে। পাসপুট হইলেই সৌদি যামু।' লোকটি উত্তরে বলে ঃ কোন চিনত্দা করবেন না, পুলিশের রিপোর্ট পাইলেই আপনার পাসপোর্ট পাইয়া যাইবেন। এর মধ্যেই এক লোক এসে অভিযোগ করে ঃ তিন মাস আগে পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। এখনো পাসপোর্ট পাচ্ছি না। অফিস থেকে বলছে, আরো পনের দিন লাগবে। এ পর্যনত্দ পুলিশ, দালাল আর অফিসে দিয়েছি চার হাজার টাকার মতো।

গত রবিবার সকালে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে এসব চিত্র দেখা যায়। এমনিভাবে পাসপোর্ট ফরম নেয়া থেকে শুরম্ন করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যনত্দ প্রতিটি লোককে পদে পদে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। পাসপোর্ট করতে এসে দালালদের চাপাচাপি আর হয়রানিতে লোকজন ভীতসন্ত্রসত্দ হয়ে পড়ে। পুলিশের সাহায্য পাবে না জেনে নীরবে সহ্য করে যায় দালালদের যন্ত্রণা।

এমন শত শত অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের। পাসপোর্ট অফিস পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়েছে দালালদের কাছে। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা সবকিছু জেনেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না সাধারণ মানুষের প্রতি। উল্টো চোখ রাঙ্গিয়ে বলে, এখানে এই নিয়ম। টাকা দিলে তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট পাবেন আর না দিলে পাবেন না। পাসপোর্ট কর্তৃপৰ জানায় ঃ আইন-শৃঙ্খলা রৰাবাহিনী ও জনবলের অভাবে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জনবলের অভাবে চুক্তিভিত্তিকভাবে কয়েকজনকে দিয়ে অফিসিয়াল কাজ করানো হচ্ছে।

ভুক্তভোগী আলী হায়দার দালাল ছাড়া পাসপোর্ট বাবদ কোথায় কত টাকা দিয়েছেন এবং কোথায় বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন তার বিবরণ দিলেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম কিনতে হয়েছে পাঁচ টাকা দিয়ে। ফরম নেয়ার পরই তাকে কয়েকজন দালাল ঘিরে ধরেছে তাদের দিয়ে পাসপোর্ট করানোর জন্য। কিন্তু সে তাদের ফরম না দিয়ে পরেরদিন ফরম জমা দেয়ার জন্য ব্যাংকে আসেন। তাকে ব্যাংকে দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে হয়। যারা দালালকে বিশ টাকা দিয়েছে তারা বিশেষ লাইনে টাকা জমা দেয় দশ মিনিটে। এখানে মহিলা দালালের সংখ্যা বেশি। ঐদিন সময় না পেয়ে ফিরে যান বাড়িতে। পরেরদিন সাধারণ পাসপোর্ট লাইনে দাঁড়ান। দীর্ঘ চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে চলে যান কাঙিৰত কাউন্টারে। কিন্তু কাউন্টারে থাকা কর্মচারী জানান, 'আপনার ফরম ঠিক নেই। ঠিক করে নিয়ে আসেন।' কি ঠিক নেই জানতে চাইলে তিনি দালালদের দেখিয়ে দেন। পনের-ষোল বছরের এক ছেলে বলে ঃ 'আপনার ব্যাংকের রশিদটি আঠা দিয়ে লাগাতে হবে। আমার কাছে আঠা আছে। বিশ টাকা লাগবে।' বাধ্য হয়েই তার কাছে ফরমটি বাড়িয়ে দিলেন। তারপর পাসপোর্ট (সাধারণ) পেতে পুলিশ প্রতিবেদন 21 দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি তিনমাস পর পাসপোর্ট হাতে পান। এর মধ্যে পুলিশকে দিতে হয়েছে একশ' টাকা, এসবি অফিসে দু'শো টাকা। পাসপোর্ট করতে এভাবেই হাজারো সমস্যার মুখোমুখি মানুষ।

সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নেয়ার কথা ঘোষণা করা হলে গ্রাম-গঞ্জের হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছে পাসপোর্ট অফিসে। এ সুযোগে পাসপোর্ট দালালদের যেন পোয়াবারো। অতি জরম্নরি পাসপোর্ট 72 ঘন্টার মধ্যে পাওয়ার কথা থাকলেও সাধারণ মানুষ তা পাচ্ছে একমাস পর। অফিস থেকে ডেলিভারি তারিখের সিল দেয়া হয় পনের দিন পরের। কিন্তু তারপরেও সময়মতো কেউ পাসপোর্ট পান না। এভাবে তিন ক্যাটাগরিতে পাসপোর্ট পেতে বহু সময় পার হয়ে যায়। বেশি সমস্যায় পড়ে ছাত্র, মহিলা ও রোগী। দ্রম্নত পাসপোর্ট পাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। দালালদের 10 হাজার টাকা দিয়েও জরম্নরি পাসপোর্ট নিতে হচ্ছে পনেরদিন পর।

এ ব্যাপারে পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মোঃ সিরাজউদ্দিন জানান, এসবি অফিস এবং থানা পুলিশের গাফিলতির কারণে পাসপোর্ট সময়মতো দেয়া যায় না। এছাড়া আগে প্রতিদিন এক থেকে দুই হাজার পাসপোর্ট আবেদন জমা পড়তো। এখন দৈনিক 10 থেকে 12 হাজার ফরম জমা পড়ে। রাজধানীতে চারটি বিভাগে পাসপোর্ট অফিস থাকলে এতো চাপ পড়তো না এবং সমস্যা লাঘব হতো। শিৰাথর্ীদের দাবি ঃ তাদের এবং মহিলাদের জন্য ফরম আলাদাভাবে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দালালদের বিরম্নদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এভাবে দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না স্বাধীন দেশের নাগরিকরা।

ঃঃ দৈনিক ইত্তেফাক ঃ 28.11.2006
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহূর্ত কথাঃ সময়

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



সামুতে সবসময় দেখেছি, কেমন জানি ভালো ব্লগাররা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়! যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচণ্ড নেগেটিভ স্বভাবের মানুষ। অন্যকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে, গারবেজ গারবেজ বলে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×