আজ জন্মদিন আমার। এখনো জন্মাইনি। তবে পৃথিবীতে যাকে পরিবার বলে - আমার সৌভাগ্য আমি একটি পরিবার পাব। তাদের মাঝে কথা-বার্তা চলছে যে আজ আমি জন্ম নেব। এদের আচার আচরনে বেশ হাসি পায় আমার! এদের কথা বার্তা বা আচরন এমন যে তারা যেন আমার মালিক। এরা ভুলেই যায় যে এরা উপকরন মাত্র। শ্রষ্ঠা আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবে। এরা ব্যবহার হয়েছে মাত্র। হ্যাঁ, অধিকার কিঞ্চিৎ যদি কারো থেকে থাকে সে হচ্ছে ঐ "মা" নামক বাহনটির যার শরীর-মন-মগজ সব ভাজা ভাজা করে আমি আজ জন্মাচ্ছি।
সেই প্রায় অন্ধকার থাকা ভোরে আমার বাহনটিকে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আনা হয়েছে যাকে এই বোকার দল "হসপিটাল" বলে। আমার বাহনটিকে বিছানায় নেয়ার আগেই তার মূল্য দিয়ে দিতে হয় বা নিশ্চিত করতে হয় এই মূল্য দেয়ার সমার্থ আছে কি না।
আমি নিজেও বাহন ছেড়ে বের হওয়ার জন্য আকুপাকু করছি। একটুও ভাবছি না যে আমার সামান্যতম নড়াচড়া এই 'মা' নামক বাহনটি কলজে-চেরা ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠছে। আমি ভাগ্যবানদের একজন মনে হচ্ছে। আমার বাহনটি যার তত্বাবধানে আছে যাকে পৃথিবীতে 'বাবা' নামে সবাই চেনে ঐ মানুষটাও সংবেদনশীল। কারন আমার 'মা'টা যখন ব্যাথার যন্ত্রনায় হাটতে পারছে না তখন এই লোকটা তাকে প্রায় কোলে করে এনে মাইক্রো নামে আরেকটা বাহনে উঠিয়েছে।
সেই সকালে আমাকে বার করার জন্য আনা হয়েছে। আমি সেই রাত আড়াই-তিনটা'র সময় থেকে বের হতে চাইলাম, পুরো পরিবারটিকে তটস্থ রাখলাম, পরিবারের বয়স্ক থেকে জোয়ান যারা একেকজন একেক পরিচয়ে পরিচিত - দাদা, দাদী, চাচা কারো চোখেই ঘুম নেই। সারা রাত চারিদিকে কত কথা!! সেই কতদুর থাকে ফুপু, নানা, নানি, খালা সবাই আমাকে নিয়ে কথা বলছে, "কখন আমি আসব"। অথচ আমি ঘুমাই আর ঘুম ঘোরেই ব্যাথা দেই মা টাকে। কেউ আমাকে কিচ্ছু বলছে না বা আমার উপর রাগ করছে না। কত্ত বড় লাট বাহাদুর আমি !!!!
দুপুর হয়ে গেছে এখনো আমার বার হওয়ার নাম নাই। মাঝে মাঝে মা'টা ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠছে। একে তো আমি ব্যাথা দিচ্ছি ভেতর থেকে, তারউপর আরো ব্যাথার জন্য "ডিপ" নামক কিছু দেয়া হচ্ছে যে মা'টা আরো ব্যাথাতুর হয়। অসহায় মা'টাকে ডিপের পর আরো গরম কি কি যে খাওয়ানো হচ্ছে, সাথে সাথে এই ভারী শরীর নিয়ে ক্রমাগত হাটানো হচ্ছে। কামরার এই স্বল্প পরিসরে সে অন্তত কয়েক কিলো হেটেছে আমাকে বহন করে।
ঐদিকে বাপটাও দৌড়াদুড়ি করছে হসপিটালের "সেবা-মূল্য" কত কম করা যায়। গত তিন মাস আগে তার চাকরী চলে গেছে। কোন রোজগার নাই। তিন-চার জনের কাছে হাত পেতেও রেখেছে। ঐ টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বেচারার চোখ-মুখ এত করুন হয়েছে যে মায়া লাগে। বিকাল পাঁচটার দিকে আবার আমি নড়ে-চড়ে উঠলাম। বের হব হব... কিন্তু বের হচ্ছি না। আমার কাছে খেলা খেলা লাগছে... আর এদিকে মা টা ব্যাথায় নীল হয়ে গেছে। সেই করুন সময়ে একটু ভালও লাগছে যে মা'টা একটা ভাল শাশুড়ী পেয়েছে। এই পৃথিবীতে এটা একটা আজব কথা - ভাল শাশুড়ী পাওয়া। মা'টা যখন ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে তখন তার শাশুড়ী তার দু'হাত মায়ের দু'হাতে ভরে রেখেছে আর নিজের গালটা আমার মায়ের গালে লেপ্টে দিয়ে অনেক্ষণ ধরে নামাজের রুকু স্টাইলে উবু হয়ে আছে।
রাত সাড়ে দশটা। সিদ্ধান্ত হয়েছে আমি এমনিতে বের হব না। মা টাকে কাটা-ছেড়া করতে হবে। তাকে একটা চলন্ত বিছানায় শুইয়ে কাটা-ছেড়া কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল। ঢোকার আগে দেখে এলাম দরজার বাহিরে দাদী-ফুপু-চাচা-বাপ সবাই অধীর আগ্রহে দাড়িয়ে আছে আমার আগমনের জন্য।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমি সজোরে পুরো হাসপাতাল কাঁপিয়ে মায়ের পেট চিরে ডাকাতের মত সর্বোচ্চ শক্তিতে চিৎকার করে আমার জন্ম-ঘোষণা করলাম। সবাই শুনল আমি আ............................................ করে চিৎকার করলাম। আসলে আমি ডাকলাম মা.... আ...............।
এই লেখার প্রথম অংশ: "পৃথিবীতে ল্যান্ডিং" পড়ুন
এই লেখার ২য় অংশ: "মানব জন্মের ২য় ধাপ" পড়ুন