somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা কবিতার দায়মুক্তি -১

২৪ শে নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবিতার ক্রমবিবর্তনকে আমি দেখি দায়মুক্তির পথে যাত্রা হিসাবে । অন্তত বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে । অন্য ভাষার কবিতা নিয়া আমার তেমন জানাশোনা নাই । ইংরেজি কবিতা পড়লেও, কবিতার ভিতরে ঢুকতে পারছি বলে এখনো মনে করতে পারি না ।

বাংলার প্রাচীন কবিদের পুঁথি বা পদ্য বা কাহিনীগাঁথাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুরু হয় রাজার বন্দনা তারপর পুরোহিত, সমাজপতি পাতিসমাজপতি শিক্ষাগুরু এই জাতীয় লোকদের বন্দনা দিয়া । মনে হয় কবিকে তখন এইসব লোকগুলাকে ম্যানেজ করে চলতে হত । এদের কোপাণলে পড়লে তার কবিতাতো দুরের কথা, নিজের জান বা ঘরের বউ নিয়াও টানাটানি পড়ে যেত ।

একসময় প্রকৃতি বা প্রকৃতির নিয়ামক বলে পরিচিত দেব-দেবীদের তুষ্ট করে চলার প্রথাও ছিল । রাজা-রাজড়ারা যদিও আমার মনে হয় প্রকৃতির ক্ষেমতাকে বিশ্বাস করত না তবে প্রকৃতির এজেন্ট হিসাবে , প্রকৃতির ভয় দেখিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাটা সুবিধাজনক বলে প্রকৃতির বন্দনায় তথা দেব-দেবীদের বন্দনায় তারা সমস্যা তো বোধ করত না বরং উৎসাহিতই করত কবিদের । সাথে সাথে তাদের বন্দনাটাও যুক্ত থাকত হত ।

এই দিক থেকে দেখলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বরং বাংলা কবিতার এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি ধনাত্নক নিয়ামক হিসাবেই কাজ করেছে । ব্রিটিশ শাসকরা ভিনদেশী , তাই বাংলা কবিতা বা বাংলার মানুষের চারুকলার জগতে তারা কিরুপে বন্দিত বা নিন্দিত এটা নিয়া তাদের জানার সুযোগ ছিল না । অথবা তদ্দিনে ইউরোপে রেঁনেসার ফলে শিল্পকলায় রাজনৈতিক প্রতিফলন অনেক কমে যাওয়াতে, ব্রিটিশদের হয়ত সে ব্যাপারে আগ্রহও ছিল না ।

এভাবে কবিতার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি ঘটে । কিন্তু কবিতা বাঁধা ছিল আরো অনেক দিক থেকে, অনেক বাল-ছালের কাছে । পৌরানিক দেব-দেবী বা ধর্মীয় লিজেন্ডদের নিয়া মাইল মাইল লম্বা চারণ-কাব্য লেখা অনেক কমে গেলেও, পুরাণের মূল কথা, তার মূল আনুগত্যের ধারা কিন্তু মেনে চলতেন তখনো কবিরা । অথবা মেনে চলতে হত ।

এই আনুগত্যের ধারা থেকে প্রথম বৈপ্লবিক বাহিরমুখী পদক্ষেপটি নেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । রাম ভালো রাবণ খারাপ, কৌরবরা খারাপ পান্ডবরা ভালো এইজাতীয় স্টেরিওটিপিকাল চেতনা অথবা বীরত্ব সততা দৃঢ়তা জাতীয় গুণগুলা কেবল রামের মধ্যেই আছে, রাবণের মধ্যে শুধু তার উল্টাগুলা, এই ধরণের ধারার বিপরীতে প্রথম সাহস করেন তিনি ।

মাইকেলের মেঘনাধবধ কাব্যে পৌরাণিক চরিত্রগুলার যুগযুগের স্টেরিওটিপিকাল বিচারের বদলে তিনি দেখান এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণের গল্প । যদিও তার প্রচেষ্টাকে পরবর্তিদের তুলনায় মনে হয় খুবই নরম-সরম ধরণের তবু যুগের অন্যান্য অবস্থা এবং সমকালিন সমাজ মানস বিচারে এটা বৈপ্লবিক ।

মাইকেলের কাব্যে রাবণও কল্যানকারী শাসক , বীর এবং দৃঢ়চেতা । বরং সূক্ষভাবে মনে হয় রামই ধূর্ত, দুর্বলচেতা এবং শোকে ন্যূজ হয়ে পড়া শাসক । সীতার অপহরণ নিয়া রাবণকে সরাসরি সমর্থন না করলেও, রাবণের ডিসেন্সিকে তিনি তুলে ধরেন এক ভিন্ন মাত্রায় যেখান থেকে মনে হয় হয়ত তালি কেবল এক হাতেই বাজে নাই ।

সামাজিক স্টেরিওটাইপ ভাঙার ক্ষেত্রে মাইকেলের আরেকটি বড় বৈপ্লবিক দিক হলো নর-নারীর প্রেম নিয়া পৌরাণিক ও ধর্মীয় জগতে যুগযুগের পুতুপুতু মনোভাবকে আক্রমণ । যদিও আমার মনে হয় বাংলা বা ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক জনমানুষ অনেক আগে থেকেই নর-নারীর স্বাভাবিক মেলামেশা নিয়া তেমন একটা গা করত না তবু পুরাণে বা বিধি-নিষেধের বইয়ে নর-নারীর স্বতঃস্ফূর্ত মেলামেশাকে তখনো , এমনকি এখনো একটি অপরাধ হিসাবেই দেখানো ছিল । নারী তার শরীর নিয়া বেশি মাতামাতি করবে না, পতি ভক্তা, রাজভক্তা সমাজপতিভক্তা হবে, শরীরের আগুনে পুড়ে মরে গেলেও টু-শব্দটি করবে না এটা ছিল আদর্শ(!) নারীর গুণ ।

মাইকেল তার বীরাঙণা কাব্যে এই স্টেরিওটাইপের উপর বৈপ্লবিক আঘার হানেন । এই কাব্যটি গঠিত এগারজন পৌরাণিক নারীর চিঠি নিয়া। এই চিঠিগুলা কোনো পৌরাণিক গ্রন্থে নাই । পৌরাণিক ঘটনাগুলা ঠিক রেখে মাইকেল তার দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেন এগারজন নারীর প্রেম, কামনা এবং জীবনের অন্যান্য দিক তার নিজস্ব মানস-বিশ্লেষণ । এই নারীরা বেহায়ার মত প্রেমিকের কাছে তার শারিরীক মানসিক কামের কথা প্রকাশ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ করে না থেকে তাদের প্রতিবাদ তুলে ধরে যা তখন পর্যন্ত বাংলার মেইনস্ট্রিম আদর্শনারীদের কাছ থেকে আশা করা যেত না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৩২
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×