বাসায় থাক্তে থাক্তে ক্রমশঃ হাঁফিয়ে উঠছি। ক্লান্তি লাগছে, অসহ্য লাগছে, একঘেঁয়ে লাগছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, টিভি দেখা, বইপড়া, নেট ব্রাউজিং আর প্রার্থনা, এছাড়া করার কিছুই নেই। নিজেকে ভীষণ আলসে আর অকর্মণ্য মনে হৈতেছে। একবার মনে হৈলো এই অবসরে রান্নাটা শিখে ফেলি। শেখার কুনু বয়স নাই। কিন্তু কিচেনের দরজায় আমাকে দেখেই বউ চেঁচিয়ে উঠে, কি ব্যাপার তুমি এখানে কেন?
না মানে শুয়ে বসে সময় কাঁটছে না, ভাবলাম তোমাকে একটু সাহায্য করি।
বউ যেন একটু প্রসণ্ন হলো। 'আমাকে সাহায্য করতে চাও। ঠিক আছে এঁটো বাসন আর ডিসগুলো চটপট ধুয়ে ফেলো।
কি বলো এসব? আমি আসছি তোমাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে আর তুমি কিনা...।
রান্নার কাজে সাহায্য করবা? ঠিক আছে ঝটপট শসা গুলো ছিলে ফেলো, তারপর পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ গুলো...।
হায় হায় শেষ পর্যন্ত এই ছিলো কপালে ! ডিসি (ডিস ক্লিনার) হওয়াটা পাশ কাটাতে পারলেও যখন আমার ওসি (ওনিয়ন কাটার) হওয়া প্রায় নিশ্চিত। তখনই মেয়ে ডাক দিলো, 'বাবা এদিকে আসতো টিভির রিমোটটা কাজ করছে না।'
গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়ে কিচেন থেকে দ্রুত অন্তর্ধান হই।
দিনে অন্তত পাঁচ ছয়বার চা খাওয়ার অভ্যেস। এখন দুইবার চা খেয়েই সন্তষ্ট থাকতে হচ্ছে। রাস্তায় বের হতে পারছি না। অসহ্য লাগছে। রাত এগারটায় স্ত্রীকে মোলায়েম কন্ঠে বললাম, 'এককাপ চা দাও না।' তিনি ততোধিক মোলায়েম কণ্ঠে জবাব দিলেন, 'এতোরাতে চা বানাতে পারবো না, প্রয়োজনে নিজে বানায়া খাও।
কথাটা শুনেই মেজাজটা তেতে উঠেছিলো। কিন্তু নিমিষেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলাম, এই দুঃসময়ে তার সঙ্গে কথা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বাইরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ।
চা বানানোটাকে বরং 'চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। রান্না ঘরে গিয়ে একটি পাতিলে কিছু পানি চড়িয়ে তার মধ্যে দুচামচ পাত্তি ঢেলে দিয়ে চলে এলাম। পোলাপান টিভিতে স্টার ওয়ারস মুভি সিরিজের 'দ্য রাইজ অব স্কাই ওয়াকার' দেখছিলো। ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিলাম।
একটু পর রান্না ঘরের দিক থেকে স্ত্রীর কণ্ঠের চিৎকার আর চেঁচামেচি ভেসে এলো। গিয়ে দেখি আমার চায়ের বারোটা বেজে গেছে, পাতিল পুড়ে ছাই...। সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রবাদ বাক্যটি মনে পড়ে গেলো, 'যার কাজ তারই সাজে....'।
অতঃপর স্ত্রী চা বানাতে বানাতে আমাকে 'অকর্মণ্য' অপদার্থ' 'আমড়া কাঠের ঢেঁকি' ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করলেন। আমি গায়ে মাখলাম না।
ত্রী'দের কথা পুরুষদের গায়ে মাখতে নেই, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হয়, অথবা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়, যারা সেটা পারেন, এমন উদাস এবং সুবোধ স্বামী গণই ভালো থাকেন। এই করোনা দুর্যোগে আমিও ভালো থাকতে চাই।
'ভালো' স্বামী হয়ে থাকলেই বরং লাভ (Love)। না চাইতেই ডাইনিং টেবিলে পছন্দের মেনুগুলো পাওয়া যায়। মাত্রাতিরক্ত টেক-কেয়ার এবং ভালোবাসা পাওয়া যায়। 'ভালো' না হলেই বরং বিপদ। এই দুর্যোগে যাবো কোথায়?
ছোট ছোট পান-সিগারেটের দোকানদার, আয়-রোজগার বন্ধ হওয়ায় তাদের ভারি কষ্ট। তাদের চেয়ে বেশী 'কষ্টে' আছেন, যারা সিগারেট খেতে পারছেন না। অন্যান্য জিনিসপাতি যথেষ্ট মজুদ করলেও তারা 'বুদ্ধি করে' ধূমপানের শলাকা স্টক করে রাখেননি।
আমার এমন কিছু ধূমপায়ী বন্ধুর কষ্টের কথা ভেবে আমারও খুব 'কষ্ট' হচ্ছে। তারা পুলিশের 'মৃদু লাঠিচার্জ' (এই 'মৃদু লাঠিচার্জ' যে কতোটুকু 'মৃদু', যার পিঠে কিংবা পশ্চাদ্দেশে পড়ে, সেই শুধু জানে) এবং মান-ইজ্জতের ঝুঁকি নিয়ে দোকানে গিয়ে বেশী দামে সিগারেট কিনে আঞ্ছেন আর লক ডাউনের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছেন।
লকডাউনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে এক ভদ্রলোক জনবিরল রাস্তায় উদাস ভঙ্গিতে হাঁটছেন। পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি ওভাবে রাস্তায় হাঁটছেন কেন ! তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, 'কেন, অসুবিধা কী'। পুলিশটি তাকে ভদ্রভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, 'করোনা প্রাদুর্ভাবে এভাবে ঘরের বাইরে থাকা বিপজ্জনক।' ভদ্রলোক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, 'আর ঘরে যিনি আছেন, তিনিতো করোনার চেয়ে বেশী বিপজ্জনক।'
এমতাবস্থায় আমার স্ত্রী বরং বেশ 'করুনাময়ী'। তিনি আমার সার্বক্ষণিক গৃহ উপস্থিতি এবং উপদ্রব হাসিমুখে না হলেও স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করেছেন। বাসায় সহায়ক এবং অনুকূল পরিবেশ বজায় রেখেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। মানুষ কতো ক্রিয়েটিভ। এই বাধ্যতামূলক গৃহবাসে থাক্তে থাক্তে কতো জিনিস আবিস্কার করে ফেলছে, কতো অজানা রহস্য উন্মোচন করে ফেলছে। মশারি টানাতে কয়টা পেরেক বা রশি লাগে জানেনতো?, হয়তো বলবেন, 'কেন চারটি!' কিন্তু মশারি ভালোভাবে টাঙ্গাতে চারকোনায় চারটি ছাড়াও মাঝামাঝি আরো দুটি অর্থাৎ ছয়টি রশি বাঁধার ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বাস না করলে মশারীটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখুন।
সেদিন সামু'রই এক ব্লগে পড়লাম, লকডাউনে বাসায় থেকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করে এক ভদ্রলোক জেনে গেছেন, সিলিং ফ্যানের সুইচ অফ করার পর ফ্যানটি নাকি ছত্তিশ বার ঘুরে তবে বন্ধ হয়। ফুল স্পিডে থাকলে ৪৮ বার। আবার ম্যাচের ভিতর নাকি মাত্র ৩৯ টি শলাকা, তার মধ্যে দশবারটি ভাঙা। যদিও ৪৯টি শলাকা থাকার কথা। কতো অজানারে...।
ঘরে থাকছি। স্ত্রীকে যতোটা সম্ভব সাহায্য করতেছি কিংবা করার চেষ্টা করছি। কারণ আমাদের ছুটি চললেও তারতো সংসার থেকে কোন 'ছুটি' নেই। গৃহ সহায়ক বাড়ি চলে গেছে। যাবতীয় কাজ তাকে সামাল দিতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় তাঁর 'অশান্তি' কিংবা 'প্রেম' করার সময় কোথায়!
#ফানপোস্ট//
(পোস্ট ব্যবহৃত ছবিটি নেট থেকে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১২:২২