somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ের চোখে জল

২৫ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আব্দুর রহিমদের বাড়ি অজপাড়াগায়ে। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান সে। আব্দুর রহিমের বয়স পনেরো। এই বয়সে সে ঢাকার একটা আভিজাত মাদরাসায় পড়ে। আগে পড়ত তাদের গ্রামের টিনসেটের তৈরি ছোট মাদরাসাটিতে। আব্দুর রহিমের অনেক স্বপ্ন এবং শখ ছিল বড় মাদরাসায় পড়বে। তার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। নাম বললেই সবাই তার মাদরাসা চিনে ফেলে। কারও সঙ্গে কথা বললে আব্দুর রহিম উতলা হয়ে থাকে কখন জিজ্ঞেস করবে তুমি কোন মাদরাসায় পড়ো। কেউ জিজ্ঞেস করলেই সে চট করে মাদরাসার নামটি বলে ফেলে।

ঈদে মাদরাসা ছুটি হয়। আব্দুর রহিম ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। আগামী কাল তার মাদরাসায় খুলবে। বাড়ির মায়া ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে মাদরাসায়। বাড়ির প্রতি তো সবারই মায়া। বাড়ির প্রতি আব্দুর রহিমের  মায়াটা একটু বেশি। বাড়ির প্রতি বলতে তার মা বাবার প্রতি। আবার বাবা মায়েরও মাত্র একটি সন্তান হওয়ার তার প্রতি মততাটা বড্ড বেশি তার মায়ের।

ছয় সাত দিনেই আব্দুর রহিমের বাড়ির প্রতি টান অনেক বেড়েছে। তার কেন জানি একবার মনে হয়, বাড়ি ছেড়ে যদি মাদরাসায় না যাওয়া লাগতো। পরক্ষণে আবার সে ভাবে, তাকে বড় আলেম হতে হবে, আর এ জন্য কষ্ট তো করতেই হবে। লক্ষ্যে পৌঁছতে এটুকু কষ্ট কিছুই না -মনকে বোঝায় আব্দুর রহিম।

আর মাত্র একটি রাত বাড়িতে থাকতে পারবে আব্দুর রহিম। সকাল হলেই মাদরাসার উদ্দেশ্যে রওনা করতে হবে তার। রাতে জানালার কাছে শুয়ে কিছুটা বিষণ্ন মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হালকা জোসনা আছে। কিন্তু জোনাকি নেই। অন্যদিন অনেক জোনাকি ওড়াউড়ি করে। ঘরের ভেতরও চলে আসে কয়েকটা।

আব্দুর রহিম দুপুরেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে। আগে আগে ব্যাগ না গোছালে প্রতিবার কোনো একটা জিনিস ভুল করে রেখে যায়। ঘরে একটা কুপি জ্বলছে। তাদের এ অজোপাড়াগায়ে এখনও কারেন্ট আসেনি। আব্দুর রহিমের মা এসে হাতে এক ক্লাস দুধ নিয়ে এসে খেয়ে নিতে বললেন। ঢক ঢক করে দুধ পান করার পর আব্দুর রহিম তার মাকে বলল, মা তোমাকে না কতোবার বলেছি, আমাকে রহিম বলবা না। আজ দিনেও তুমি আমাকে অনেক বার রহিম বলে ডেকেছো। রহিম হলো, আল্লাহর নাম। আব্দ শব্দের অর্থ হল, গোলাম বা বান্দা। আমি হল, আব্দুর রহিম অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা। আর তুমি আমাকেই রহিম বলো। আব্দুর রহিমের মা বললেন, হ বাবা মনে থাকে না। আচ্ছা সবকিছু দেখেশুনে নিছিস তো। প্রত্যেক বার তো মাদরাসা গিয়ে ফোন করে বলিস, এটা রেখে গেছি ওটা রেখে গেছি। গতবার যে বই রাইখে গিয়েছিলি, নিছিস তো? আব্দুর রহিম বলল, হ এবার সবকিছু আগে আগেই দেখেশুনে নিছি। এবার সমস্যা হবে না।

আব্দুর রহিমের বাবা মা অশিক্ষিত। বাবা ক্ষেতে কাজ করে আর তার মা গ্রামের আর আট দশটা বউ ঝির মতো তার বাড়ির কাজকাম করেন। তার বাবা মা আগে নামাজ রোজা তেমন করত না। ছেলেটিকে মাদরাসায় দেওয়ার পর থেকে তারা নামাজ রোজা শুরু করেছেন। মাদরাসা ছুটি হলে বাড়ি গিয়ে আব্দুর রহিম তার বাবা মাকে সুরা কেরাত এবং শরীয়তের বিধান শিখিয়ে দেয়। এখন শরীয়তের অনেক কিছুই জানেন আব্দুর রহিমের বাবা মা। দু’জন দশটা করে সুরাও মুখস্ত করেছেন। আব্দুর রহিম বাড়িতে না থাকলে নামাজে একটু গাফলতি হলেও ছেলে বাড়িতে এলে ওয়াক্তমতো নামাজ পড়া হয় তাদের। ওয়াক্ত হলেই আব্দুর রহিমের নামাজের তাগিদ দেয়।

বাড়িতে গেলে আব্দুর রহিম বসে থাকে না, বাবার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করে। আজান দিলেই ক্ষেতের আলে বাবাকে নিয়ে জামাত করে নেয়। কোনোদিন আবার কাজ শেষ করে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে তারা। মসজিদে গেলে ইমাম সাহেব আব্দুর রহিমকে সামনে ঠেলে দেন। সে নামাজ পড়ায়। এতে গর্বে বুক ভরে যায় আব্দুর রহিমের বাবার। তিনি গর্ব করে স্ত্রীকেও বলেন, জানো আমার ছেলে মসজিদে নামাজ পড়াইছে আইজ। আব্দুর রহিমের মা ঈষৎ ঠোঁট বাকিয়ে বলেন, ইশ ছেলে বুঝি তোমার একার। ছেলে তো আমারও।

ফজরের আজান হয়েছে। রাতে করে ঘুমাবার কারণে আব্দুর রহিমের ঘুম ভাঙেনি। তার মা এসে ডেকে তুলল –বাবা আজান হয়েছে, সলক হয়ে আসছে, নামাজ পড়বি না? আব্দুর রহিম চোখ কোচলাতে কোচলাতে উঠে বসল। দ্রুত অজু করে নামাজ পড়ে নিল। ফজরের নামাজের পর আব্দুর রহিম বারান্দায় বসে শব্দ করে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করে। তার বাবা ঘরে বসেই ছেলের কুরআন তেলাওয়াত শোনে। আব্দুর রহিমের মা খাবার তৈরি করে আর তেলাওয়াত শোনে।

আজ আব্দুর রহিমের মায়ের অনেক কাজ। ছেলে চলে যাওয়ার আগে তার পছন্দের খাবারগুলো শেষ বারের মতো রান্না করে খাইয়ে দেন তিনি। সঙ্গে করে কিছু খাবার দিয়েও দেন। পথে ক্ষিদে লাগলে খাবে। ছেলে চলে যাবে সেই উপলক্ষে আব্দুর রহিমের বাবা আজ কাজে যাবেন না। বাড়িতে কোনও কাজ না থাকলেও এ দিন তিনি বাড়িতেই থাকেন। ছেলে যাওয়ার আগে একগাদা উপদেশ দেন। কারও সঙ্গে মারামারি করবে, কারও জিনিস না বলে ধরবে না, ভাল করে পড়বে, আরও নানান উপদেশ। আব্দুর রহিমের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। বাবা তার সঙ্গে কাউন্টার পর্যন্ত যাবেন। পোশাক পড়ে ফেলেছে আব্দুর রহিম। আব্দুর রহিমের মা বিদায় জানালেও বড় রাস্তা পর্যন্ত যান প্রতিবার। এবারও তার বিপরিত হল না। আব্দুর রহিমের মা ঘোমটা দিয়ে পেছন পেছন যাচ্ছেন। বড় রাস্তায় গিয়ে আব্দুর রহিম আর তার বাবা একটা ভ্যানে চেপে বসল। ছেলে চোখের আড়ালে যেতেই আব্দুর রহিমের মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। দেখা যাবে না তবু রাস্তার ওপাড়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করলেন ছেলেকে দেখার।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ৯:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×