আজ আমি দুটি মেয়েকে নিয়ে কথা বলবো। তাদের সংসার এবং কিছু কষ্টের কথা আলোচনা করবো। এই দুজনের সংসার টিকে আছে শুধু সমাজ রক্ষার্থে। শুধু এরা দু’জন নয়, এমন হাজারও সংসার শুধু সমাজ রক্ষার্থে টিকে আছে। এর দায় কার?
আমি এখন আর ওকে আগের মতো ভালবাসি না। যে মানুষটিকে পৃথিবীর সবথেকে ভালবাসতাম তাকে এখন ঘিন্না করতে হচ্ছে। ও আসলেই একটা অমানুষ। ভুলটা আমারই। ওকে চিনতে ভুল করেছি। নিজের স্বামীকে এ কথাগুলো বলছিল বিলকিস। আমার বান্ধু। ওকে প্রায় ৮ মাস ধরে চিনি আমি।
সামিয়া (ছদ্মনাম) অনার্স পাস করা একটি মেয়ে। ২০১৪ সালে রুমিন(ছদ্মনাম) নামের একটি অশিক্ষিত গার্মেন্টসে কাজ করা ছেলের সঙ্গে সামিয়ার বিয়ে দেয় তার বাবা মা। অনেকগুলো বছর তারা খুব ভালভাবেই সংসার করেছে। কিন্তু এখন নিত্যদিন তাদের সংসারে ঝগড়া লেগেই থাকে। সামিয়ার জামাইয়ের বিভিন্ন গোড়ামি আর অমূলক কাজকর্ম দেখে দেখে অতিষ্ঠ সামিয়া। স্বামীকে এখন সে মোটেই ভালবাসে না, এক চিলতে সম্মানও করে না।
কারণ হিসেবে সামিয়া বলল, ও এক রাতে আমার হাত ছেড়ে দেয়। সে রাতে আমাকে একা একা বাড়ি ফিরি। এর আগে সবসময় ও আমাকে বাড়ি এগিয়ে দিয়ে যেতো, রাস্তায় কখনও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলেনি যে, আমি তোমাকে এগিয়ে দিতে পারবো না। এখন থেকে ওকে আর আমার দরকার নেই। সামিয়া রুমিনের বাবার জন্য হাসপাতালে যেত। রুমিনের বাবা ধীর্ঘ এক মাস হাসপাতালে থাকে। টাকার জোগান দিতে রুমিনের দিনরাত কাজ করতে হতো। সে যেহেতু গার্মেন্টসে কাজ করে তার তাই তাকে ওভারটাইম করতে হতো। রুমিন সামিয়ার সঙ্গে রুঢ় আচারণ করে তার বাবার জন্যই। ভুলটা তাদের বাবা ছেলেরই ছিল। ধীর্ঘ একটা মাস ধরে সামিয়া শ্বশুরের সেবা করে সুস্থ করে তোলে। যেদিন সে পুরোপুরি সুস্থ হয় সেদিনই সামিয়াকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।
শুধু এ কারণে এমনটি হয়নি। সামিয়ার শ্বশুর খুব খারাপ লোক। খুব বাজে ভাষা ব্যবহার করে। ছেলের বউয়ের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়। সামিয়ার স্বামী সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে। এ ব্যাপারে সে কিছুই বলে না। তার বাবা হাজার অপরাধ করুক, হাজার খারাপ কাজ করুক, তাকে কিছুই বলা যাবে না। সে যেটা করছে সেটা খারাপ হলেও ভাল বলে গণ্য হবে।
এখন সামিয়ার সংসার টিকে আছে শুধু সমাজ রক্ষার্থে। স্বামী ছাড়া একটি মেয়ে থাকলে তাকে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়। ডিভোর্সি মেয়েকে দেখলে মানুষ বাঁকা চোখে তাকায়। ‘মাল’টাকে খেয়ে দেওয়ার চিন্তা করে সবাই। বাবা মাও বিষয়টিকে ভালভাবে নিতে পারে পারা লোকজন কি বলবে! পারা প্রতিবেশী সবাই ছিঁ ছিঁ করবে।
শিক্ষিত মেয়েকে অশিক্ষিত একটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে সামিয়ার জীবনটা ধ্বংস করেছে তার বাবা মা।
সামিয়া হাজার চেষ্টা করে স্বামীকে বোঝাতে পারেনি তারও ভুল হতে পারে। সামিয়ার স্বামীর একটাই কথা- তার কোনও ভুল নেই। তিনি নির্ভুল মানুষ। মনের ভুলেও তিনি কোনও ভুল করতে পারেন না। আর মেইন সমস্যাটা শুরু হয়েছে এখান থেকেই। সামিয়ার স্বামী কখনও কোনও ভুল করলে ‘সরি’ শব্দটা মুখ থেকে বের করতে পারেন না। হাজার অপরাধ করলেও সে কখনও ক্ষমা চায় না, চাইতে পারে না। সবকিছুর জন্য সামিয়াকে দোষ দেয়। সামিয়ার বাবা মা যদি শিক্ষিত পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিতেন তাহলে হয়ত এই সমস্যা না হতে পারতো। আজ হয়ত সামিয়ার জীবনটা ভাল থাকবো। প্রত্যেকটা মুহূর্তে সে সুইসাইড করার কথা ভাবতো না।
আমার আরেকটি বান্ধু ফারিয়া (ছদ্মনাম)। ওর জীবনেরও ঠিক একই অবস্থা। স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। সংসারটি টিকে আছে শুধু সমাজ রক্ষার্থে। সামিয়া এবং ফারিয়ার সংসারের একই পরিণতি হলেও ফারিয়ার স্বামী শিক্ষিত। এবং বাংলাদেশের এতো বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাশক, যে বিশ্ববিদ্যালয় দেশ বিদেশের সবাই চেনে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে এই জুটির ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। ভালবাসা থেকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল তারা। বৈবাহিক জীবনের প্রথম দু’তিনটি বছর সুখে ছিল ফারিয়া। এরপর কখনও সুখ দেখেনি সে। ফারিয়ার স্বামীর অবশ্য কোনও দুঃখ নেই। তিনি ক্লাস করাচ্ছেন, ঘুরছেন, ফিরছেন, ভালই কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলো।
আবার রাতে এসে নিজের মতো করেই ফারিয়াকে ‘‘ব্যবহার’’ করছেন। জীবনের কোনও অংশেই তার চাওয়া-পাওয়া, ভাল লাগা বা না লাগার কোনও পরোয়া করেন না তিনি। আরও বহু কারণ আছে। এই সংসার দু’টির মধ্যে এতো বেশি পরিমান সমস্যা যে, বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এতো এতো সমস্যা কেন সংসারগুলোতে। এই দু’টি সংসারের অবস্থা জানার পর আমি আরও কিছু সংসারের খোঁজ নিতে শুরু করি। নিজের চেনাজানার মধ্যে যেসব ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে তাদের খোঁজ-খবর নিই। খোঁজ নেওয়ার পর দেখতে পেলাম অধিকাংশের অবস্থা করুণ। বন্ধ-বান্ধবদের যারা বিয়ে করেছেন তাদের অনেকেরই সংসার ভেঙ্গে গেছে। আগে সংসারগুলো সমাজ রক্ষার্থে টিকে থাকলে বর্তমানে তা হয় না।
সংসারগুলো কেন টিকছে না? কেন বিয়ের কিছুদিন পরই সংসার ভাঙছে? এখানে গাফলতি কার আর কিইবা কারণ?
কারণগুলো আসলে বলে শেষ করা যাবে না। আগে বড় বড় কারণে সংসার ভাংলেও এখন ছোট ছোট কারণেই ভাংছে। এতো সাধারণ কারণে বিচ্ছেদ ঘটছে তা কল্পনা করা যায় না। স্বামী চুল বাঁধতে পারে না, ভাংছে সংসার। স্বামী ভাল অভিমান ভাঙাতে পারে না, ভাংছে সংসার। স্বামী কেন প্রতিদিন কেন ঘুরতে নিয়ে যায় না, ভাংছে সংসার। স্বামী অফিসে যাওয়ার সময় কপালে কিস করে না, ভাংছে সংসার। বিয়ে পরবর্তী মেয়ের জীবন বন্দি বন্দি লাগে, ভাংছে সংসার। স্বামী তার বান্ধবীর জামাইয়ের মতো মিষ্টি করে হাসতে পারে না, ভাংছে সংসার।
মিষ্টি করে হাসতে না পারার জন্য সংসার ভাঙ্গে। খুব হাস্যকরই বটে। কিন্তু এটাই সত্য। বউ স্বামীকে বলছে, মিতুর জামাইটা না খুব ভাল। ও খুব লাকি।
স্বামী- কেন?
স্ত্রী- ওর বরের হাসিটা খুব মিষ্টি। পরক্ষণে স্ত্রী বলছে, আচ্ছা তুমি একটু অমন করে হাসো না!
স্বামী- আচ্ছা আমি অন্যের মতো কীভাবে হাসবো? এতো পাগলামি করো কেন তুমি!
স্ত্রী তখন রাগে গাল ফোলা, আমার সবকিছুই তো তোমার কাছে পাগলমি। আমি পাগল তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন? এক কথা দুই কথা থেকে ঝগড়া। এরপর এটা বড় আকার ধারণ করে ডিভোর্সে পৌঁছে। এটা কোনো গল্প নয় বাস্তবতা। এক বন্ধুর জীবনে এমন হয়েছে। আরেক বন্ধুর সংসার ভেঙ্গেছে সে চুল বাঁধতে পারে না।
আবার কখনও এর উল্টোটা হয়। অনেক ছেলেই বিয়ের পর স্ত্রীকে তেমন ফ্রিডম দিতে চায়। ফ্রিডম দিতে চাইনা বলতে তারা চায়, স্ত্রীরা ঘরের ভেতর আবদ্ধ থাকুক। প্রয়োজন ছাড়া বেশি ঘরের বাইরে না যাক। চরম নারীবাদি পুরুষটিও কামনা করে তার স্ত্রী ঘরে আবদ্ধ থাকুক। বাইরে কম বের হোক। স্ত্রীর বাইরে বের হওয়া নিয়েও সংসার ভাঙ্গে। অনেক সময় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও পুরুষরা তাদের বাইরে যেতে দেয় না। বকাবকি করে। আবার অনেক মেয়েরই সারাদিন বাইরে ঘুরাঘুরি করার অভ্যাস আছে। তাদের ব্যাপাটার আলাদা।
স্ত্রীর সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি নিয়েও এক দম্পতির বিচ্ছেদ হয়েছে। লোকটি বলছিল, তার বউ সারাদিন মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়াই। শুধু তাই নয়, বান্ধবীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াই। একরকম বলতে গেলে জোর করেই দাওয়াত নেয়। যেমন নিকটতম কোনো বান্ধবীকে ফোন দিয়ে বলবে আমি আসছি। সে যদি অপাগতা প্রকাশ করে তাহলে সে জোর করে। এসময স্বামী যদি পাশ থেকে বলে ও জেতে চাচ্ছে না, সেদিন ওর ব্যস্ততা থাকবে, সেটা বলার পরও কেন তুমি জোর করছো। তখন স্ত্রী ঝাড়ি দিয়ে বলে, এটা আমার আর আমার বান্ধবীর বিষয় তুমি এর ভেতর কথা বলো না। সব জায়গা থেকে সে স্বামীকে সরিয়ে রাখতে চায়। কখনও এটা তার এবং তার ময়ের বিষয়, কখনও তার এবং তার বাবার বিষয়, কখনও তার এবং তার ভাইয়ের বিষয়। অর্থাৎ তার কোনো বিষয়ে স্বামী কেনো কথা বলতে পারবে না। অবশ্য তার পক্ষে কথা বললে সমস্যা নেই। বিপক্ষে কথা বললেই এই যুক্তি দেখায়।
দোষ যারই থাকুক, আমি পুরুষকে সর্বদা নমনীয় হতে বলবো।
এবিষয়ে বললে অনেক কথা বলা যাবে। কিন্তু সবশেষে আমাদের সচেতনতাই দায়ী। কখনও বাবা মায়ের সচেতনতার কারণে মেয়ের সংসার ভাঙছে। তারা যোগ্য পাত্রকে মেয়ে অর্পন করেনি। আমার কখনও ভুক্তভুগি নিজেই দায়ী। আবার কখনও দায়ী আমাদের বার্তি আবেগ। আবেগকে যথেষ্ট সাইডে সরিয়ে রাখা উচিত এক্ষেত্রে। সবাই ভাল থাকুক। সুখে থাকুক। কারও সাংসারিক জীবনেও যেন আগুন না জ্বলে। এআগুন একবার জ্বলছে আর শেষ হয় না। জ্বলতেই থাকে। ঈশ্বর সবাইকে হেফাজত করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১১:৪৭