somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লোকটাকে হয়তো চিনবেন; আজ তার জন্মদিন, শুভেচ্ছা জানাবেন?

১৪ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাষ্টার্স অর্থনীতিতে অধ্যয়ণরত এক দুর্দান্ত রাগী যুবক। ১লা বৈশাখের এক কাকভোরে জন্ম নিয়েই দেখে এই বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতী।
তখনও যুদ্ধ বোঝেনি-
তবে যুদ্ধর আগুনে বুক পুড়িয়েছে ৯০-এর গণ আন্দোলনে। পুলিশি নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলার ফেরারী আসামী।
আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে হাত পাকিয়েছে কবিতায়। পরবর্তীতে মাধ্যম হিসেবে এসেছে ব্যান্ড সঙ্গীত।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ডের গানে প্রথম সার্থক সৃষ্টি 'জেল থেকে বলছি' এবং 'মাকে বলিস'।
'কমপ্লিট ম্যান' খ্যাত সেঞ্চুরী ফেব্রীক্সের মডেল।
শৈশব আর তারুণ্যের শহর-নাটোর। যৌবণের শহর-ঢাকা।
নেশা- যুদ্ধ। পেশা- যুদ্ধ। ভালোবাসে- যুদ্ধ।

- একটা বই থেকে নেয়া এই কথাগুলো। বইটির নাম, 'ইচ্ছে হলে ছুতে পারি তোমার অভিমান'। বইটির প্রকাশকাল ১৯৯৫। লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী। এক সময়ের সেরা গীতিকারদের একজন। পল্টনের পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে অনেক আকাঙ্খিত এই বইটি যখন পাই, তখন বইটির ব্যাক কভারে এই তথ্যগুলোই ছিল।
ভবিষ্যৎ বলা যায়না বলে এই মানুষটার পরবর্তী সমৃদ্ধ ইতিহাস সেখানে স্থান পায়নি। কারন এরপরের ইতিহাস তার শুধু সামনে এগিয়ে যাবার ইতিহাস।

লতিফুল ইসলাম শিবলীর কবিতা: যেখানে নির্দ্ধিধায় খারিজ করে দেয়া যায় অনেক হামবরা কবির কবিস্বত্ত্বার দাবীকে

লতিফুল ইসলাম শিবলীর কবিতা নিয়ে কী বলা যায়? প্রাণ জাগানোর অস্ত্র 'কবিতা'য় যদি প্রাণময় বিষয়টাই না দিতে পারে তবে সে কবিকে নিদ্ধিধায় ব্যর্থ বলে দেয়া যায়। সে বিবেচনায় শিবলীর পরিচায় তার কবিতার বর্ণে বর্ণে উজ্জ্বল। 'তোমাকে দেখি' শিরোনামের শিবলী যখন লিখেন,
আমি ডানে তাকালে
অদেখা থেকে যায়
বাম দিক
সামনে তাকালে
সম্পূর্ণ পেছন আমার
অদৃশ্যমাণ
অথচ চোখ বুজলেই
আমার দশদিক জুড়ে
তোমাকে দেখা হয়ে যায়।

অথবা পিতা এবং আমি কবিতায় যখন উঠে আসে এমন পঙতি,
রনাঙ্গন থেকে রনাঙ্গনে
সঙ্গিন হাতে দুরন্ত ছুটে বেড়াতেন
আমার পিতা
তিনি ছিলেন প্রকৃতই-পুরুষ,
এবং আমি সংসারি প্রাণীর মত লিখছি
পিতার বীরত্বগাথা
প্রকৃতই- কাপুরুষ।

কিংবা 'অভিসার' কবিতায় লিখেন,
গতকালে অভিসারে
অগ্নিকান্ডের পর
তোমার ডাইরীতে তুমি লিখেছ-
'একটা আকাশ নীল বিলিয়ে
আপনাকে রিক্ত করে
একটা ভূমি বৃষ্টি যাকে
মুষলধারে সিক্ত করে
বুকের উনুন লোহার কড়াই
পাথর ভাজে রুমু ঝুমু
প্রমিজ প্রমিজ আর দেবোনা
সাপের ঠোঁটে অমন চুমু।'
- তখন শিবলী কবি হিসেবেও যে কতটা উৎরে যান সচেতন পাঠক তা অনায়াসে বুঝতে পারেন।
শিবলীর কবিতা রোমান্টিকতায়ও অস্বাভাবিক সমৃদ্ধ। বইতে অনেকগুলো কবিতা পড়েই সে বিষয়ে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকেনা। 'ভয়' নামের একটি দীর্ঘ কবিতার উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্বৃত করি,
ভয় করে-
এখন আমার বড় ভয় করে প্রিয়তমা,
শীত সন্ধ্যার কুয়াশার মত রহস্যময় এক ভয়
আমার আনন্দ কে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ।
এর আগে এমন ভয় আমি কোনোদিন পাইনি
আমার সেই অনেক না পাওয়ার শৈশবে
কত নিকষ কালো শেষ রাতে একা আমি
ট্যাটা হাতে ছোট্ট ডিংগি নৌকায় করে
ঝাড় জঙ্গল পেরিয়ে মাছ ধরতে চলে যেতাম ধুধু মধ্য বিলে
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
বাইন ভেবে গর্তে হাত ঢুকিয়ে কুবার ভুল করে চেপে ধরেছি
বিষাক্ত সাপের মাথা
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
রাতের আধারে ভয়াল কালী মূর্তির সামনে থেকে
চুরি করে খেয়েছি ভোগের মিষ্টি এবং কলা
কালী মা চেয়ে চেয়ে দেখেছে আমার সাহস
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
যে বয়সে শেয়ালের কান্না শুনে ভয় পাওয়ার কথা
সে বয়সে আমি বাঙ্গী ক্ষেতের পাশে
শেয়াল ধরার জন্য ফাঁদ পেতে রাখতাম
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
প্রতিবাদী তারুণ্যের বিপদজনক ছাত্র রাজনীতির
দিনগুলোতে
আগুনঝড়া দিনগুলোতে
এক নায়কের বন্দুকের নলের মুখেও আমি ছিলাম- মিছিলের সামনের মানুষ
কত রক্তপাত দেখেছি
কত প্রতিহিংসার মুখোমুখি হয়েছি
নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছি
প্রিয় সহযোদ্ধাকে
পুলিশের রিমান্ডে উল্টো করে ঝুলন্ত যে আমি
পেন্ডুলামের মত ঢুলতে ঢুলতে
মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখেছি
সেই আমি এখন ভয় পাই
আলোকিত দেয়ালের অন্যপাশের ছায়ার মত ভয়
আমাকে অস্থির করে রাখে
আমার শৈশব কৈশর তারুণ্যে সঞ্চিত সমস্ত সাহস
ম্লান হয়ে যায় এই ভয়ের কাছে।
প্রিয়তমা, আমার এই বিশাল ভয়টা অন্য কিছুর নয়
এখন শুধু তোমাকে হারাবার ভয়।

আবার তার কোনো কোনো কবিতা ফিরিয়ে নিয়ে যায় অন্য কোনো জগতে। করে দেয় নষ্টালজিক। 'কষ্ট' কবিতায় যখন শৈশবকে পাওয়া যায় এভাবে,
আর কারো জন্য নয়
শুধু আমার শৈশবের সবুজ শার্টটার জন্য
খুব কষ্ট হয়।
আহারে আমার শার্টটা যে এখন কোথায় আছে
আমার সমস্ত শৈশবের বাগান ঝোপঝাড়
আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে
সেই শার্টটার পুরো দশটি বোতাম।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
কাচা পোকা, ব্যাঙ্গাচি, ছেকে ধরা মাছ, বড়শি, সুতো
খুচরো পয়সা, আধখাওয়া বিস্কুট, বিস্কুটের গুড়া
আমার ছোট্ট পৃথিবীর অমূল্য এই সব কিছু
এক সাথে নির্দ্ধিধায় জায়গা করে নিত
শার্টটার পকেটে।

লতিফুল ইসলাম শিবলীর গান: আগামীর গীতিকারদের অনেকটা বছর কেটে যাবে শিবলীর গানের সংখ্যাকেই ছাড়াতে, মানকে ছাড়াতে কত বছর? তা কেবল সময়ই বলতে পারবে...

শিবলীর একটা একক এলাবাম বেরিয়েছিল ১৯৯৯ সালের ১লা বৈশাখ। নাম, নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম।

ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে যারা
মিছিলের সামনে থাকে যারা
অভিমান অভিযোগ কান্না লুকাতে শিখেছে যারা
আর
নিয়ম করে নিয়ম ভাঙ্গার সাহস রাখে যারা
- তাদের উৎসর্গ করা এই এলাবামের ভূমিকাতেই চোখ আটকে থাকে অনেকক্ষণ। যেখানে লেখা-
বাবা, আমার অসম্ভব মন খারাপ করা এক সন্ধ্যায় তুমি তোমার কাপা কাপা হাতে যখন আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলে, মূলত তখনই জন্ম নিয়েছিল এই এলবাম...তুমি জানোনা বাবা তোমার কাছ থেকে পাওয়া শিল্পী স্বত্ত্বার সেই স্বীকৃতির আনন্দে আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
অবলা বৃক্ষের মতো চেয়ে চেয়ে আমার অনেক কথার জন্ম এবং পরিশেষে নির্মম মৃত্যু দেখতে দেখতে আমার আত্মা কখন যে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছে আমি টের পাইনি... যখন টের পেলাম ততদিনে আমিও বুঝে গেলাম আমারও জমে আছে কিছু... প্রতিধ্বনী যদি সত্য হয় তবে প্রশ্ন তোমাকে- বল, আমার কথা আমার চেয়ে সুন্দর করে আর কে বলতে পারে?
যে কথা পরবর্তী জীবনগুলোতে সত্যিও হয়েছিল। তার কথা তাকেই সুন্দর করে বলতে হয়েছে যে সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হয়েছিল বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত। যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল, জেল থেকে বলছি, তুমি আমার প্রথম সকাল, আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, কেউ সুখী নয়, হাসতে দেখো, কত কষ্টে আছি, একজন বিবাগী, কার কাছে যাবো, প্রিয় আকাশী, মধ্যরাতের ডাক পিয়ন, মান্নান মিয়ার তিতাস মলম, ছয়টি তারে, ঘুমাও তুমি, পলাশরি প্রান্তর, হ্যালো ঢাকা, বড় বাবু মাষ্টার, হাজার বর্ষারাত-এর মতো তারুন্য জয় করা গান।
শেষ কথা
সৃজনশীলতার এক জীবনে লতিফুল ইসলাম শিবলী করেনী এমন কিছুই নেই। কবিতা গানের পাশাপাশি মডেলিং, নাটক লেখা, নাটকে অভিনয় সহ সব। স্মৃতী যদি খুব বেশি প্রতারণা না করে তবে, কারোরই ভুলে যাবার কথা নয় প্যাকেজ নাটকের প্রথম দিকের 'রাজকুমারী' নাটকের কথা। শিবলীর রচনায় সেই নাটকে শমী কায়সারের বিপরীতে 'মির্জা গালিব' চরিত্রের সেই অসাধারণ অভিনেতাও এই শিবলী-ই।
তবে এতো কিছুর নায়ক শিবলী সত্যিকার নায়ক হয়ে গেছেন তখনই যখন তিনি এই খ্যাতির মধ্য গগনে থাকা অবস্থায় নির্দ্ধিধায় সব অস্বীকার করে ছেড়ে দিয়ে আড়াল হয়ে যান। খ্যাতির মোহ ত্যাগ করার মতো বিশাল ক্ষমতা সকলের থাকেনা। শিবলী তা পেরেছেন। এই মুহুর্তে, এমন কি গত চার পাচ সাত বছরে শিবলী আসলে এসব ছেড়ে কি করছেন তা আমার জানা নাই।
তারপরও এক অচেনা গুনমুগ্ধ হিসেবে শিবলীর জন্মদিনের এই সময়ে অভিবাদন জানানোর জন্যই এই লেখা।
কারন ভুলে যাওয়াটা সহজ।
যেভাবে নিসংকোচে শিবলীকে ভুলে গেছে আমাদের মিডিয়া।

আজ শিবলীর জন্মদিন। অভিবাদন কমরেড।










২৬টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×