somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: ঢাকা মেট্টো জ-১৪-০৯০৬ অথবা একটি ফেলে যাওয়া হৃদয়ের গল্প

২৫ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গরীব হলে যা যা সমস্যা হবার কথা আমার তার চেয়ে বেশী হয়। রোজ এই বাসষ্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাতে পায়ে শেকড় গজিয়ে যাচ্ছে। তারপর যাও দুয়েকটা বাস পাওয়া যায়, অফিস টাইমে পাবলিকের জোয়ারে তাও ধরা যায় না। কিছু করার নেই। ভাগ্য বলে একটা জিনিস আছে। যার প্রতি ব্যাপক বিশ্বাস আমার। তারপরও মাঝে মাঝে বিরক্তি এসে যায়। স্বপ্ন হয়ে দুঃস্বপ্ন আসে, কবে যে নিজের গাড়ী হবে?
আচ্ছা, নিজের গাড়ী থাকলে কেমন লাগে?
২.
আকাশের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। অন্ধকার চারদিকে। এ সময়টা ভীষণ ভালো লাগে। সেই ছোটবেলা থেকেই। কিছুক্ষণ পর যে ঠান্ডা বাতাস শুরু হবে সেই বিষয়টাতো আরো ভয়াবহ। এই ভালোলাগা বোঝানো যায়না।
৩.
আশেপাশে মানুষ কমে গেছে। এখন অবশ্য বাস আসছে প্রচুর। আমার কেন জানি আর বাসে ওঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। এর অবশ্য দুটো কারন আছে, এক আবহাওয়াটা খুব প্রিয়। আরেকটা হচ্ছে আমার ঠিক ডান পাশে এক পরী দাঁড়িয়ে আছে। সে কতটা সুন্দর তা অবশ্য দেখতে পারছি না। সামনাসামনি মেয়েদের দিকে ভালোভাবে তাকানোর মত অত সাহস আমার নেই। তার উপর আমি সবসময় নিজের যোগ্যতাটাও বিচার করি। এ পর্যন্ত এমন মেয়ে পাইনি যাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আমি এই মেয়ের যোগ্য। আমার বুকটা কাঁপছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, পরীটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে এক ঝলকে দেখে নেব কিনা সেই সাহস পাচ্ছি না। তবে একটু আড়চোখে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে সে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা, মুখে কালিটালি লেগে আছে নাকি? আশেপাশে তা দেখারও সুযোগ নেই।
৪.
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে। হুংকার দিয়ে একটা বাস সামনে এসে দাঁড়ালো। পরীটা চলে যাচেছ। বাসটা কোথায় যাবে, তা দেখার চেয়ে পরীর চলে যাওয়ার দেখছি। উঠে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে চলে যাই পরীটার সাথে। পরীর দেশে। আনমনেই পা বাড়ালাম।
৫.
বাসে কেউ নেই। ড্রাইভার একমনে সতর্কভাবে গাড়ী চালাচ্ছে। কন্ডাক্টর, ড্রাইভারের পাশে বসে শার্ট খুলে বৃষ্টিতে ভেজা মাথা মুছছে। আর আমি পাশাপাশি বসে আছি পরীর সাথে। ইচ্ছে হচ্ছে, কথা বলি। কিন্তু কি কথা বলব? আর কিভাবেই কথা বলব? বুঝতে পারছি না। মেয়েদের সাথে কথা বলার কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। একটা সময়তো মনেই হতো আমি কোনদিন কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবো না। এই বিষয়টাই ছিল অসম্ভব। হয়তো এক জীবনে সম্ভবও হবে না।
৬.
গাড়ী থেমে গেছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে গেছে। আমি নামছি না। আজ আমরা নামবো না। সবাই যার যার জায়গাতেই বসে আছি। ড্রাইভার তার সীটে। কন্ডাক্টার একমনে চুল শুকাবার চেষ্টা চালাচ্ছে ড্রাইভারের পাশে বসে। আর আগের মতই আমি আর সেই পরীটা বসে আছি পাশাপাশি। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। নামার কোন সুযোগ নেই।
নামবেন না?
চমকে ওঠালাম কে যেন কথা বললো। তাকালাম, একি পরীটা কি কথা বলল? বিশ্বাস হচ্ছে না। তার দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম,
আমাকে বললেন?
অদ্ভুত তো। এই গাড়ীতে আর কে আছে যে তাকে বলবো। কথা শেষ করেই পরীটা ফিক হেসে দিল। আমার দম বন্ধ হবার যোগাড়। কারো হাসি এতো সুন্দর হয়? আর সে হাসি আমার জন্য। ভাগ্য ভালো সে হাসি থামালো। আরেকটু হাসলে বোধ হয় মরেই যেতাম। এ হাসিতে কয়েকশবার মারা যাওয়া যায় অনায়াসে। সত্যি পরীদের হাসিও এতো সুন্দর হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে।
কি ব্যাপার কথা বলছেন না কেন?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। তার দিকে ভালোভাবে তাকাতেও পারছিনা। তাকিয়ে আছি ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের দিকে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, তারা কিছুটা হিংসা করছে আমাকে। তাদের হিংসার মাত্রা আরেকটু বাড়াতে বুকে হাতটা চেপে বললাম, বৃষ্টিতো।
তাতো দেখছি। যাবেন কোথায়?
ভূলে গেছি।
মানে?
স্যরি, কমলাপুরের দিকে।
দিকে মানে কি? আপনার বাসা কোথায়?
জানিনা।
কি বলছেন? বলেই আবারো আগের মতো হাসি শুরু করে দিল সে। দীর্ঘ হাসি। আবারো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এবার বোধ হয় আমাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। কি করে বোঝাই, হে পরি হাসি থামাও আমি মারা যাচ্ছি।
অনেক কষ্টে বললাম, সরি। ওদিকেই বাসা।
ও ! আচ্ছা।
এর উত্তরে কি বলা যায় ভেবে পাচ্ছি না। আমি বাসের ভেতরকার শিামূলক লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। অনেক ধরনের জ্ঞানের কথা, ব্যাবহারে বংশের পরিচয়, চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলবেন না অথবা একশ ও পাঁচশ টাকার ভাংতি নাই। আচ্ছা, এটাও কি জ্ঞানের কথা? কি জানি হবে হয়তো। হতেও পারে। কে জানে?
কি ব্যাপার কথা বলেন না কেন?
কি বলবো ?
কিছু একটা বলেন। বাসের ভেতর এইভাবে তো আর মূর্তির মত বসে থাকা যায় না।
কি বলবো ভেবে পেলাম না। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ প্রশ্নটাই করলাম, আপনার নাম কি?
পরী। মেয়েটা জবাব দিল।
জ্বি? মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ঝিম মেরে গেল পুরো মাথা।
স্যরি, আমার নাম হলো নীলা। মা, পরী ডাকে তো তাই মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো।
পরীকে পরি বলবেনা তো কি বলবে? কথাটা এক দমে বেশ সাহস করে বলে ফেললাম।
মেয়েটা হেসে দিল। এবারের হাসিতে যেন বুকের বিশাল পাথর নেমে গেল। এবার কোন ভয় ছাড়াই বললাম। হাসছেন ক্যান?
না এমনিই। প্রথমেতো মনে হয়েছে কথাই জানেন না। এখন তো হলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। ভালো।
ভালো মানে? বেশ সংশয় জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম।
ভালো মানে, ভালো। বুদ্ধিমান মানব।
আমি আবারো আগের অবস্থায় ফিরে গেলাম। ভয় আবারো আঁকড়ে ধরল। বিষয়টা বুঝলাম না। পরীটা আমাকে আবারো দেখলো। তার মুখে অন্যরকম হাসি। বিজয়ীর হাসি। কাউকে সম্মুখ যুদ্ধে হারিয়ে দেবার হাসি।
৭.
দৈনিকবাংলা মোড়ে থেমে থাকা বাস আবার ষ্টার্ট নিচ্ছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে গেছে। কন্ডাক্টার বলল, আফনেরা নাইম্যা যান। গাড়ী ঘুরামু। গুলিস্তানের দিকে যামু।
পরীটা বলল, যান আমি ওদিকেই নামবো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে তো তাহলে এখানেই নামতে হবে। আমার হাত পা যেন স্থির হয়ে যাচ্ছে। নামতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু নামতে হবে। না নামলে পরীটা অন্য কিছু মনে করবে। কিন্তু কি করে নামি? এখন কি করে বলি গুলিস্তানেই যাবো। আমার গুলিস্তানেই যেতে হবে। গন্তব্যতো উল্টো। কি করব বুঝতে পারছি না। পরীটা তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে কি হাসছে নাকি। চোখে ঘোলা ঘোলা দেখছি। ঘোলা চোখেও তার হাসি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বুক, হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ আমি নামবো না। আমি আমার পরীর সাথেই থাকবো। আমি আমার পরীর পাশেই থাকবো।
কন্ডাক্টরকে এবার পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন মানুষ মনে হলো। সে হুংকার দিলো, স্যার নামেন। জলদি করেন।
বুঝলাম, শালা প্রতিশোধ নিচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালাম। পরীর দিকে এবারই প্রথমবারের মতো ভালোভাবে তাকালাম। মানুষ কি আসলেই এতো সুন্দর হয়? আমার ভেতরে যেন কি হচ্ছে। কিছু যেন ভেঙ্গে চুড়ে যাচ্ছে।
বাসে দরজার সামনে এসে ঠিক করলাম শেষবারের মতো দেখে নিই। এবার তাকাতে পারছি না। তবুও সুন্দরকে অবহেলা করার শক্তি নেই। এক ঝলকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বাসের দরজার উপরের দিকে তাকালাম। একটা সুন্দর লাইন লিখে রেখেছে। কিছু ফেলে গেলেন কি?
ভেতরটায় প্রচন্ড ধাক্কা লাগল। কেন জানি মনে হচ্ছে আমি সত্যিই কিছু ফেলে যাচ্ছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জিনিস ফেলে যাচ্ছি। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন জিনিস ফেলে যাচ্ছি। আমার হৃৎপিন্ডটাই ফেলে যাচ্ছি।
তাই বোধহয় এতো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ভেতরটা।
৮.
রাস্তায় নেমে দাঁড়ালাম। বাস চলে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্টো জ-১৪-০৯০৬। প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে অন্ধকার প্রিয় বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি। ভালো লাগা না লাগার ফিলিংস বুঝতে পারছি না। বোঝার কথাও না । কারন বুঝতে হলে হৃদয় লাগে। হৃৎপিন্ড লাগে। সেটা তো আমার নেই। বাসে ফেলে এসেছি। একটা পরির কাছে। আমার পরির কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:২৩
২৮টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×