somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।। গল্পঃ ত্রয়ী

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডক্টর ফ্লয়েড তার ধবধবে শাদা পাতলা ল্যাপটপ’টা ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন । কোটের পকেট থেকে চুরুট বের করে ইউ-এস-বি লাইটারের মাথায় চেপে ধরে ঠোঁটে গুজলেন । তারপর চুরুটের বিশাল ধোঁয়া বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে তিনতলার জানালা দিয়ে একবার ওপাশে তাকালেন । সকালের ট্রাভার্স শহর জুলাইয়ের গাঢ় রোদে ঝকঝক করছে । ভাল লাগছে দেখতে ।

তার সামনে বসে থাকা অল্পবয়েসী ইন্ডিয়ান মেয়েটি ইংরেজীতে বলে উঠলো, ‘স্যার, আমিই মৌরী রায় । বাংলায় লেখা ডায়েরী তিনটির ইংরেজী অনুবাদ আপনাকে মেইল করেছিলাম ।’

নিউরো-সাইকোলজিস্ট ডক্টর ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি পড়েছি । ডায়েরীগুলো কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিলেই হতো । আপনার কষ্ট করে আসবার দরকার ছিল না ।’
‘সত্যি কথা বলতে, আমি আসলে ডায়েরীর লেখকদের সাথে দেখা করতে এসেছি, স্যার । তিনজন আলাদা আলাদা পেশেন্ট । কিন্তু তারা ডায়েরী লিখেছে একই নামে । তিনজনই বাংলাদেশের । বাঙালি । তাদের চিন্তাভাবনাগুলি আলাদা, পেশা আলাদা, বয়স আলাদা । অথচ তাদের আত্মীয়-স্বজনের নামগুলি পর্যন্ত এক ! আমি আসলে ডায়েরীগুলো পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছি । বিভ্রান্তি কাটছে না । মাথায় চেপে বসে আছে । কৌতুহল মেটাতেই এখানে আসা ।’
‘আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন, ডায়েরীর লেখক একজন নয়, তিনজন আলাদা-আলাদা লোক ?’
‘আমি আসলে পুরোপুরি শিওর না । বললাম-ই তো, বিভ্রান্ত । তবে, তিনজন এক ব্যক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম । তিনজনের হ্যান্ডরাইটিং-এর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত ।’
‘আচ্ছা ? ভাল পয়েন্ট ! আমি বাংলা ভাষা জানি না । কঠিন ভাষারীতি, অনেক অক্ষর- এটুকু শুধু জানি । তাই পুরোপুরি ধরতে পারি নি । তবে বিষয়টা আমার মাথায় ছিল । আপনি কি একটু বসতে পারবেন, আমার রুটিন চেক-আপ গুলো সেরে আসাটা জরুরী ।’
‘অবশ্যই স্যার !’
‘কফি চলবে ?’
‘সিওর ।’

ডক্টর ফ্লয়েড ইন্টারকমে কফির কথা বলে বেড়িয়ে গেলেন । মৌরী তার পোর্টফোলিও থেকে ডায়েরীগুলো বের করে ডেস্কে রাখলো । কালো রঙের ছোট আকৃতির স্পাইরেলি বাইন্ডেড তিনটি ডায়েরী । প্রত্যেকটির উপরে রূপালী ইংরেজী হরফে লেখাঃ ‘ট্রাভার্স সিটি রিজিওনাল সাইকিয়াট্রিক হসপিটাল’ । এক একটি ডায়েরীতে আলাদা আলাদা নম্বর লেবেলিং করা ।

গত মাসের বাইশ তারিখ মৌরীর ই-মেইল অ্যাড্রেসে ওডেস্ক থেকে একটা অনুবাদের প্রস্তাব আসে । ট্রাভার্স শহরের মানসিক হাসপাতালের জনৈক ডক্টর ফ্লয়েড তাকে লিখেছেন, বাংলা ভাষায় লেখা তিনটি ডায়েরী সে অনুবাদ করতে আগ্রহী কি না ? সময় দু’সপ্তাহ । পঁচিশ ডলার পার আওয়ারের ভিত্তিতে তাকে পছন্দ করা হয়েছে । মৌরী সাগ্রহেই রাজি হল । ফ্রি-ল্যান্সিং এর এই কাজগুলি কখনো হাতছাড়া করতে নেই । তাছাড়া তখন তার হাতে কোন চাকরীও নেই । আগের জার্নালিস্ট হিসেবে যে চাকরীটি করতো- সেখান থেকে তাকে বের করে দিয়েছে দুমাস হল । কিছুই করার ছিল না, তার লেখা আর্টিকেল ফ্লপ ছিল । মহা দুশ্চিন্তার মধ্যে চলছিল তার জীবন-যাপন । সে থাকে ম্যাকিনাক-এ । ম্যাকিনাকের মতো জায়গায় হুট করে চাকরি চলে যাওয়ার মত বিড়ম্বনা আর হয় না । আরেকটি নতুন চাকরি না মেলা পর্যন্ত সময়টা আসলেই ভয়াবহ ।

দিনের বেলায় চাকরি খোঁজার পাশাপাশি দু’সপ্তাহ সারারাত বসে বসে সে অনুবাদের কাজ শেষ করলো । সে ভেবেছিল বিরাট ডায়েরী । বাস্তবে তেমন বড় কিছু না । দুটি ডায়েরীর অনুবাদ করতে করতে এক পর্যায়ে তার নিজেরই মাথা ঘুরে যায় । ডায়েরীর লেখাগুলো তাকে ভাবতে বাধ্য করে । ডায়েরীগুলোর কারনেই সে সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাভার্সে আসার । যে করেই হোক, মিজান নামের এই লোকগুলোর সঙ্গে তার দেখা করতে হবে । তিন ঘন্টার জার্নি করে ট্রাভার্সে আসার এই হল মূল উদ্দেশ্য ।

মৌরী তার পার্স খুলে ছোট্ট গোল একটা আয়না বের করলো । নিজেকে বারবার দেখার এই বদভ্যাস তার আছে । সময় কাটছে না । সে একে একে তিনটি ডায়েরী আবার শুরু থেকে পড়তে লাগলো ।

প্রথম ডায়েরী
লেবেল নং- AG-50033-TRX-432-553

১৬ নভেম্বর, ২০০৭
আমার নাম মঞ্জুরুল আহসান মিজান । মানসিকভাবে অসুস্থ্য একজন লোক । মাঝে মাঝে সুস্থ্য থাকি । যেমন এখন । সুস্থ্য থাকলে ডায়েরী লিখি, ছবি আঁকি । একসময় চমৎকার পেইন্টিং করতাম । এখন পারি না । হাত কাঁপে । আমার বিষয় ছিল ফিগারেটিভ ড্রয়িং । শুধু এই বিষয়ে চারকোল দিয়ে এতো দ্রুত আমি কাজ করতাম, যে মাঝেমধ্যে নিজের কাছে অবাক লাগতো । এখন দ্রুত আঁকতে পারি না । ধীরে ধীরে আঁকার চেষ্টা করি । কিন্তু তাও এলোমেলো হয়ে যায় । আমি পারি না ।

এখন কোথায় আছি তাও জানি না । আমার জানবার অধিকার নেই । একজন খুনীর কোন অধিকার থাকে না । মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আগে তার স্বাধীনভাবে মরবারও অধিকার থাকে না । আমি একজন খুনী । রাবেয়াকে আমি নিজ হাতে খুন করেছি । খুন করার পর আমি কি করেছিলাম আমার ঠিক মনে নেই । শুধু মনে আছে তার চোখের কনীনিকাটা আমি নেইলকাটারের ছুড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে আলাদা করেছিলাম । কনীনিকা ছাড়া রাবেয়াকে কেমন দেখায় জানতে ইচ্ছা করছিল । সবাইকেই প্রেতের মতন দেখাবার কথা । কিন্তু না, তখনও রাবেয়াকে এতো সুন্দর লাগছিল ! আমার একটা ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছিল, ওর মুখের । মনে আছে, আমি ঘোরলাগা গলায় ওর মৃত লাল চোখের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠেছিলাম,

No, no, babe, I got blood in my eyes for you,
No, no, babe, I got blood in my eyes for you.
Got blood in my eyes for you, babe,
I don't care what in the world you do.

এর পরের কোন স্মৃতিই আমার মাথায় নেই । রাবেয়াকে কেন খুন করেছিলাম তাও এখন মনে পড়ছে না । মাঝে মাঝে আমার জগৎ এলোমেলো হয়ে যায় । কিছুই মনে থাকে না । মনে হয়, আমার শরীর একটা ট্রেন । কেবল ছুটছে । কেবলই ছুটছে । ছুটে চলাই তার কাজ । ট্রেন আমার কথায় চলছে না, আমি ট্রেনের যাত্রী মাত্র; যে ট্রেন থামিয়ে দেয়ার জন্য কোন চেইনের ব্যবস্থাও নেই ।

প্রথম যখন আবার ঠিক হই তখন দেখি আমি হাসপাতালের একটি কেবিনে । পুরো ঘরের রং নীল । বেডশীট, পানির মগ, ম্যাট্রেস সব নীল । জানালার অ্যালুমিনিয়ামগুলো পর্যন্ত ! নীল আমার পছন্দের রং না । ছোটবেলা থেকেই আমার সবুজ রং ভালো লাগে । ছোটবেলায় আমি লুডু খেলার বেশ বড় রকমের ভক্ত ছিলাম । লুডু মেয়েদের খেলা । তবু ঐ খেলাটিই আমাকে বড্ড টানতো । লুডু খেলায় আমি সবসময় সবুজ ঘুঁটি নেবার জন্যে ব্যস্ত থাকতাম । একবার সবুজ ঘুঁটি না দেয়ায় আমি একটি মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে খাটের ওপর থেকে ফেলে দিয়েছিলাম । সিমেন্টের ওপর পড়ে ওর মাথা ফেটে গিয়েছিল । গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে আর সে চিৎকার করে কাঁদছে । ঐদিন রাতে মায়ের হাতে প্রচন্ড মার খেয়েছিলাম । মেয়েটির নাম ছিল সুবর্ণা । শৈশবে ওরা থাকতো আমাদের পাশের বাসাতেই ।

সুবর্ণার সাথে বহুদিন পর একবার এলিফ্যান্ট রোডে দেখা হলো । সে-ই আমাকে চিনতে পেরেছিল । আর্টিস্ট হিসেবে তখন ঢাকায় আমার বেশ নাম-ডাক । মাঝে মাঝে টেলিভিশনেও সাক্ষাৎকার দিতে হয় । প্রতি শুক্রবার বিটিভিতে ‘মনের কথা’ নামে একটা অনুষ্ঠানে আঁকাআঁকি শেখাই । অনুষ্ঠানটা জনপ্রিয় । হয়তো এজন্যই চিনতে পেরেছে ।

সুবর্ণার কোলে ফুটফুটে একটা মেয়ে । আট-ন’ বছর বয়স অথচ কি বিশাল চুল ! দুপাশে বেনী করে ঝুলিয়ে রেখেছে । এতো মায়া লাগলো দেখে... । আমি সাধারনত বাচ্চাদের কোলে নেই না । ঐদিন নিলাম । তাকে চকলেট কিনে দিলাম । আমি বললাম, ‘তোমার নাম কি মা ?’
‘সেমন্তী ।’
‘বাহ্‌, সুবর্ণা- সেমন্তী- । ‘স’ দিয়ে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে । তোমার বাবার নামও কি ‘স’ দিয়ে ?’
‘আমার বাবার নাম আলহাজ্ব অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান সুমন ।’

সেমন্তী এমন ভারিক্কী গলায় পদবীসহ নামটা বললো যে আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম । সুবর্ণা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, ‘এভাবে হাসছেন কেন ?’
আমি হাসি না থামিয়েই বললাম, ‘তুমি আবার আপনি-আপনি শুরু করলে কেন ? তুমি হচ্ছো আমার ‘নেংটা কালের’ ফ্রেন্ড । এমন ফ্রেন্ডকে আপনি ডাকা যায় নাকি ? তোমার মেয়েটা বড় পাকনা আছে ! হাহাহা । সেমন্তী, তোমার এই কঠিন নামের অর্থ কি ?’
‘শাদা গোলাপ ।’
‘তাই বুঝি ? তা শাদা গোলাপ, আপনাকে কে বেশী ভালবাসে বলেন তো ? আব্বু না আম্মু ?’
‘আব্বু যখন অনেক বেশি ভালবাসে, আম্মুও বাসে । যখন আব্বু রাগ করে, তখন আম্মুও রাগ করে ।’

সুবর্ণা প্রচন্ড বিব্রতমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে । তার বিব্রত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আরেক দফা হেসেছিলাম । আমার ‘হাসি-রোগ’ আছে । একবার হাসতে শুরু করলে হাসি থামে না । হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে, তবু হাসি থামবার নামগন্ধ নেই । এ এক অদ্ভুত রোগ !

সুবর্ণার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই বাড়লো । একদিন কিভাবে যেন বলে ফেললাম, ‘সুবর্ণা, একটা কবিতা শুনবে ?’
‘তুমি কবিতাও জানো নাকি ?’
‘জানি না । তবে, তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য আজকে চার লাইনের পদ্য মুখস্ত করে এসেছি ।’
‘কার পদ্য ?’
‘লিখেছে হেলাল হাফিজ, কিন্তু কথাগুলো আমার ।’
‘বাব্বাহ্‌ ! তা, হেলাল হাফিজ শুনিয়ে ইমপ্রেস করতে চাইবার কারনটা জানতে পারি ?’
‘না, পারো না । তাছাড়া ইম্প্রেসের বদলে, আন-ইমপোসিং ব্যাপারও হয়ে যেতে পারে । দেখা যাবে, আমি চার লাইনের কবিতা শেষ করার আগেই তুমি আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছো !’
‘এটা কখনোই হবে না ।’
আমি হঠাৎ করে সুবর্ণার হাত টেনে ধরলাম । তার চোখের দিকে তাকিয়ে গাঢ়স্বরে আবৃত্তি করলাম,

‘কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে ?’

কত বছর আগের কথা । চোখের সামনে থেকে দ্রুত চলা রেললাইন, চাঁদ । ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের ভেতর আমি আর সুবর্ণা । আমাদের ট্রেন ছুটছে; যে ট্রেন থামিয়ে দেয়ার জন্য কোন চেইনের ব্যবস্থা নেই ।

কোনদিন ভাবি নি সুবর্ণার স্বামী সুমন সাহেবের সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে । কিন্তু হয়েছিল । আমাকে সে হেস্তনেস্ত করে ছেড়েছিল । সব পত্রিকায় আমাকে-সুবর্ণাকে নিয়ে কুৎসিত সব লেখা ছাপা হতে লাগলো । আমাকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল । আমার অ্যাকলুও-ফোবিয়া আছে । অন্ধকারে বড় ভয় লাগে । আর জেলে আমি যে সেলে ঠাঁই পেয়েছিলাম, সেটিতে আলোর ব্যবস্থা নেই । বাতি ছিল বটে, হয়তো ফিউজ কেটে গিয়েছিল । আর সারাই হয়ে ওঠে নি । কী ভীষন ভীতিকর অবস্থা । একটু আলোর ব্যবস্থা যদি কেউ করে দিতো ! একটু আলো ! গুমোট অন্ধকারে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করলো । তখনো জানতে পারিনি ঐ রাতের অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে কেউ একজন সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করেছিল । সুবর্ণা !

এখানে এসে ডক্টর ফ্লয়েডের সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে । খুব ভালো লোক । আন্তরিক । সে বলেছে, আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবো । আমাকে নিয়ে সে মাঝে মাঝে মুভি দেখে । মুভি দেখা শেষ হলে, মুভি থেকে প্রশ্ন করা হয় । নায়কের চোখের রং কি ছিল ? সিনেমার কোন দৃশ্যটি আমার সবচে’ ভাল লেগেছে ? মুভির শিরোনাম, কোন রঙে লেখা ছিল,... এইসব । আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, সুসম্পর্কের কারনে তিনি আমাকে নিয়ে মুভি দেখেন । পড়ে বুঝলাম, ঘটনা তা না । এটা আমার চিকিৎসার অংশ ।

একবার তিনি ল্যাপটপ খুলে বললেন, ‘মিজান, আমি তোমাকে একটা ছবি দেখাবো । ছবিটা তুমি মাত্র ৫ সেকেন্ড দেখতে পাবে । তারপর কাগজে ছবি সম্পর্কে যা মনে আসে সব লিখে আমাকে দেবে, ঠিক আছে ?’

ডক্টরের ল্যাপটপটা দেখতে অনেক সুন্দর । ল্যাপটপের তুষারশুভ্র পিঠে একটা আঁচড় পর্যন্ত নেই ! আমি ভাবলাম তিনি ল্যাপটপে ছবিটা দেখাবেন । কিন্তু না । তিনি ল্যাপটপে খুটখাট করতে করতে নিজের কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটি শাদা কালো ছবি বের করলেন । কেমন অপ্রকৃতস্থ এলোমেলো একটা কামরা । আমি বেশ ভাল করে ছবিটা দেখলাম । খুব অল্প সময়, তাও । আমার অনেক বন্ধুরা বলতো আমার নাকি ফটোগ্রাফিক মেমরি । আমার নিজেরও তাই মনে হতো । কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম অনেক কিছুই মনে নেই । আমি যা যা লিখতে পেরেছিলাম তা হচ্ছেঃ
১। চেয়ার
২। বেহালার পেইন্টিং
৩। (হাতের লেখা স্পষ্ট নয়)
৪। ম্যাট
৫। টেবিল
৬। বুকশেলভ
৭। টেবিল-ফ্যান
৮। খুলি

ডাক্তার আমার লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে কি ভাবলেন কিছু বোঝা গেল না । যদিও তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না । আমি তাকে অনুরোধ করলাম ছবিটা আমাকে উপহার দিতে । আমি একশভাগ নিশ্চিত ছিলাম তিনি না করবেন । কি আশ্চর্য ! তিনি আমাকে দিয়ে গেলেন । ছবির খেলাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে । ডায়েরীতে লাগিয়ে রাখলাম । হয়তো কারো সাথে আমি ডক্টর সেজে খেলবো ।


(ডায়েরীর পৃষ্ঠায় স্ট্যাপল্‌ করা ছবি)

মাঝে মাঝে খুব ইনসমনিয়া হয় । সারা রাত এপাশ ওপাশ করি । রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না । কেবলই মনে হয়, কখনো কি সত্যিই আবার দেশে ফিরতে পারবো ? পারলে, কবে ???
(পরের বেশীরভাগ পৃষ্ঠাতে ডক্টর ফ্লয়েডের দেয়া ছবিটির স্কেচ আঁকা)

দ্বিতীয় ডায়েরী
লেবেল নং- AG-50089-TJW-432-609

৭ ডিসেম্বর ২০০৭
আজকে আমি ডায়েরীর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে অনেকগুলা নৌকা বানালাম । বেশি একটা ভালো হয় নাই । পঁচা হইছে । মনটাই খারাপ হয়ে গেছে আমার ।

লিখতেও ভাল্লাগেনা । ডাক্তার আঙ্কেল রাগ করবেন বলে লিখতে হচ্ছে । ডাক্তার আঙ্কেলকে আমি খুব ভালবাসি । আমি চাইনা আমার কোন কারনে সে কষ্ট পাক । সে আমার সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করে । আমি যদি বলি, ‘আঙ্কেল ফ্লয়েড, আমার আজকে বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে ...’ সে কখনও বলবে না, তার কাজ আছে- পরে । আমি দেখেছি, একবার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেছে । শুধু তাই না । আমাকে অনেকগুলা স্টিকারও কিনে দিয়েছে । আমি কিনে দিতে বলিনি । সে নিজে-নিজেই কিনে দিলো । সবগুলাই ক্যাসপারের । অনেক দামী-দামী স্টিকার । আমি যে ক্যাসপারের কার্টুন পছন্দ করি এটা সে মনে রেখেছে ।

আমি ঠিক করেছি ডাক্তার আঙ্কেলকে আমি কখনোই কষ্ট দেবো না । কক্ষনোই না । এক সত্যি । দুই সত্যি । তিন সত্যি । আঙ্কেল বলেছে, আমি ডায়েরী ভরে নিজের মনের কথাগুলি লিখে তাকে ফিরত দিলে সে আমাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেবে । গিফট’টা কি জানার অনেক চেষ্টা করেছি । আঙ্কেল বলেছে, ‘নো । নো । ইটস জাস্ট ফর সারপ্রাইজ ।’ আঙ্কেল ফ্লয়েডকে প্রথম দেখায় বুঝতেই পারি নি তিনি এতো ভালো একটা লোক ।
প্রথম যেদিন রাবেয়া আপা আমাকে এখানে নিয়ে এলেন, আমি ভাবলাম বুঝি ঘুরতে এসেছি । রাবেয়া আপা আমার খালাতো বোন । আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় । তার মেয়ে সুবর্ণার বয়সও আমার চেয়ে বেশি । সুবর্ণা গতবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে । আর আমি এইবার মাত্র ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিলাম । তবু আমি ওকে ‘সুবর্ণা’ই ডাকি । কারন সুবর্ণা আমাকে ‘খালামনি’ ডাকতে নিষেধ করে দিয়েছে । তার নাকি শুনতে খারাপ লাগে !

মা মারা যাবার পর রাবেয়া আপা আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে । আমায় ও এত্তো ভালবাসে ! এখানে আসার আগে সুবর্ণা আমাকে বলেছিল, আমরা ট্যুর করতে আমেরিকা যাচ্ছি । পরে শুনলাম সুবর্ণার টিকেট হয়নি । যাচ্ছি শুধু আমি আর রাবেয়া আপা । এখানে এসে আমি এক নিমেষেই বুঝে গেলাম আমার একটা কিছু অসুখ করেছে । তার চিকিৎসা করাতেই রাবেয়া আপা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে । আমি তো আর ছোট নই । আমার বয়স গত ডিসেম্বরের উনিশ তারিখ বারো হয়েছে । বারো বছরের একটা ছেলে অনেক কিছু বুঝতে পারে । কিন্তু আমার অসুখটা কি সেটাই বুঝতে পারি নি । ক্যান্সার হতে পারে । ক্যান্সার হচ্ছে এমন একটা রোগ যা চিকিৎসা করলেও ভালো হয় না । খুব কঠিন অসুখ । ছোট-খাটো অসুখের চিকিৎসা করতে কি কেউ এতোদূর বিদেশে আসে ? তাছাড়া রাবেয়া আপা যেভাবে কান্নাকাটি করেছে, তাতে সবাই বুঝবে ‘বিশাল কিছু’ । ক্যান্সার না হলে কি কেউ এমনি হাউমাউ করে কাঁদে ?

চলে যাবার দিন রাবেয়া আপা আমার রুমে এলো । আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো । আমি বললাম, ‘আপা, কাঁদছো কেন ?’
‘কাঁদছি কই ? চোখে কি জানি গেছে । এতো ধুলো ...’
অথচ কোথাও কোন ধুলোবালি নেই । কি চমৎকার পরিপাটি-পরিষ্কার একটা ঘর ! আমি যেমনটা ভেবেছিলাম, আমার একার একটা রুম থাকবে- পুরো নিজের, ঠিক তেমন । শুধু তেমন না, তারচেও ভালো । ঘরের রংটা হালকা বেগুনী । তার উপর ক্রেয়ন দিয়ে অনেক মেঘ আঁকা । আমার পছন্দের রং যদিও গোলাপী । তবু, এই রংটাতেই ঘরটাকে বেশি মানিয়েছে । আমি এখানে খুব ভালই থাকবো হয়তো । বাসার চেয়ে অন্তত । দুলাভাই লোকটা এতো খারাপ ! এতো দুষ্ট লোক পৃথিবীর আর কোথাও নেই । রাবেয়া আপা যতটা ভালো, এই লোকটা ততটাই খারাপ ।

আমার দুলাভাইয়ের নাম সুমন । হজ্ব করে আসার পর নামের আগে আলহাজ্ব লাগিয়েছে । সে ব্যবসা করে । কিসের ব্যবসা জানি না । তবে অনেক ধনী । তার অনেকগুলি গাড়ি । একেকটার রং একেক রকম । সে নিজে সবসময় নীল রঙের গাড়িটা চালায় । দুলাভাই একজন ‘রেক ড্রাইভার’ । অনেক স্পীডে গাড়ি চালায় । গত বছর সে চারবার একসিডেন্ট করেছে । দুলাভাই গাড়ি চালাতে গেলেই আমি একটা দুআ পড়তে থাকি । এটা আমি শিখেছি সুবর্ণার কাছ থেকে । গাড়ি ছাড়বার সাথে সাথে এই দুআ পড়লে নাকি কখনো একসিডেন্ট হয় না (আমি পরীক্ষা করে দেখেছি । আসলেই হয় না) । দুলাভাইর সাথে গাড়িতে উঠে আমি যে একদিন দুআ’টা পরিনি ঐদিনই একসিডেন্ট হল । আমার তেমন কিছু না হলেও দুলাভাইর পা ফ্রাকচার হয়ে গেল ।

আমি প্লেনে ওঠার আগে সুবর্ণা আমাকে দুটা পাজ্‌ল দিয়েছে । প্রথমটা হচ্ছে নয় ঘরের একটা স্কয়ারের প্রত্যেক ঘরে এমনভাবে সংখ্যা বসাতে হবে যেন যেদিক থেকেই যোগ করি, প্রত্যেক রো আর কলামের সংখ্যাগুলির সাম ১৫ হয় । কিন্তু শর্ত হল গিয়ে এক সংখ্যা দুবার ব্যবহার করতে পারবো না । প্রথমটা আমি পেরেছিঃ



কিন্তু দ্বিতীয়টা খুবই কঠিন । পারছি না । দ্বিতীয় স্কয়ারটায় ঘর হচ্ছে ১৬টা । বানাতে হবে ৩৪ । এটা কিছুতেই পারছি না । অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছি একা একা । ইচ্ছা করলেই ডক্টর ফ্লয়েডকে বলা যায় । কিন্তু ইচ্ছা করে না । একা একা মিলাতে ইচ্ছা করে ।

ও ! আমি তো একটা মুখোশও কিনেছি । মুখোশটা এতো সুন্দর যে কি বলবো ? আর কি লিখবো ? আর কিছুই মনে পড়ে না ।

(পরের পৃষ্ঠাগুলোতে অনেকগুলো ষোল ঘরের স্কয়ার আঁকা । প্রত্যেক ঘরে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা বসানো ।)

তৃতীয় ডায়েরী
লেবেল নং- AG-50089-TRY-432-584

২৩ ডিসেম্বর ২০০৭
বাইরে তুষারপাত শুরু হয়েছে । সুমন আমার পাশে বসে আছে । কিছুই বলছে না । তার কাঁধের ওপর ভায়োলিন ধরে রাখা । ভায়োলিনে করুন সুর বাজছে । আমি বলেছিলাম, ‘কফি খাবি ?’ সুমন জবাব দেয় নি । বাজাতে বাজাতে একবার চোখ তুলে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিয়েছে । এতো ভালো বাজায় ও ! ভায়োলিনের সুরে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে । এমন করুন বেহাগ বাজাতে ওকে কে বলেছে ? ওর কি কোন ধারনা নেই যে এটা একটা মানসিক হাসপাতাল । যেকোন সময় ডাক্তার বা নার্স এসে ওকে অপদস্ত করতে পারে । আমার দুশ্চিন্তা এই নিয়ে...

রাবেয়া যেদিন আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে এলো সেদিন এমন হলো । নার্স এসেছে ভর্তির ফরম জাস্টিফাই করতে । রাবেয়া আমার হাত ধরে পাশেই বসে ছিল । নার্স মেয়েটা বলল, ‘আপনি উঠে দাঁড়াচ্ছেন না কেন ?’

রাবেয়া একটুও ভড়কালো না । চোয়াল শক্ত করে বসে বসেই বলল, ‘আপনি কি ডাক্তার নাকি ?’
‘আপনি উঠে দাঁড়ান ।’

রাবেয়া নড়লো না । মুখচোখ শক্ত করে বসে রইলো । আমি অবাক হয়ে গেছিলাম । মেয়েটা এতো বদলে গেছে কেন ? আমার অসুস্থ্যতা কি ওর ওপর প্রভাব ফেলেছে ? ফেলাটাই স্বাভাবিক । আমরা তো ভালই ছিলাম । তারপর আমার একসিডেন্ট । সবকিছু কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেল । আমি অদ্ভুত আচরন করতে লাগলাম । মৃত মানুষজনকেও দেখতে পাই । যেমনঃ সুমনের কথাই ধরি ! আমি খুব ভাল করেই জানি সুমন মারা গেছে দুবছর হয়ে গেছে ! ওর বিয়ের মাত্র দুদিন আগে প্লেন ক্র্যাশে মারা গিয়েছিল । বডি পাওয়া যায় নি । অথচ এই তো আমি সুমনকে দেখতে পাচ্ছি । বেহালা হাতে । বেহালার সুর চড়ছে । প্রথম প্রথম ভয় লাগতো খুব । এখন আর লাগে না । বুঝতে পারি- এইগুলি হ্যালুসিনেশন । এতো প্রগাঢ় হ্যালুসিনেশনও মানুষের হয় ! আমার না হলে আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না । বুজরুকি ভাবতাম !

দীর্ঘ জীবন অধ্যাপনা করবার পর ‘পাগল’ তকমা লাগিয়ে ভার্সিটি থেকে বের হতে হল । যেদিন শেষবারের মত ভার্সিটির বারান্দায় বসে আছি কিছু ছেলেদের দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে । কালো করে একটি ছেলে বলেও উঠলো, ‘দ্যাখ ! দ্যাখ ! আসলেই পাগল হয়ে গেছে !’

আমি তাকে ডাকলাম । কঠিন স্বরে বললাম, ‘হাসছিলে কেন ?’
‘কিছু না স্যার । এমনি ।’
‘নাম কি তোমার ?’
‘শিপন ।’
‘শোন শিপন ! এই দীর্ঘ জীবনে আমি কখনো মিথ্যে কথা বলিনি । আজ সেই সত্যবাদীতা আমার কাল হল । আমি ইচ্ছে করলে মিথ্যে বলে আমার এই সমস্যা কেটে বের হয়ে আসতে পারতাম । আমি কিন্তু তা করিনি । জানি না তুমি কোন ডিপার্টমেন্টের । আমার ডিপার্টমেন্টের হলে অবশ্যই আমাকে চিনতে ।’
‘স্যার ! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ?’
আমি বললাম, ‘করো ?’
‘স্যার আকাশে যদি ইনফিনিট নক্ষত্ররাজি থেকে থাকে তাহলে রাতের বেলা আকাশ অন্ধকার দেখায় কেন ? ইয়ে মানে কিছু মনে করবেন না, আপনি তো ফিজিক্স পড়াতেন । এইজন্যে জিজ্ঞেস করলাম ।’

ছেলেটি আসলে পরীক্ষা করতে চাইছে, আমি আসলেই পাগল হয়েছি কিনা । আমি বলতে পারতাম ওলবার’স প্যারাডক্সের ওপর আমি তোমার পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নিতে পারবো । সেই সামর্থ্য আমার আছে । আমার বলতে ইচ্ছে হলো না । পরাজিত সৈনিকের মত হতাশ গলায় বললাম, ‘আমি কিছুই জানি না...’

বলার সাথে সাথেই মনে হল, ‘আরে ! এটা তো সক্রেটিস প্যারাডক্স হয়ে গেল ! আমি যে কিছুই জানি না- এই তথ্যটা তো আমি জানি । তার মানে দাঁড়ালো, আমি যে কিছুই জানি না- এটা সত্য না ...

ছোট্ট ডায়েরীটায় লিখতে কষ্ট হচ্ছে । পরেরবার ডক্টর ফ্লয়েডকে বলতে হবে, বড় সাইজের কোন ডায়েরী দিতে । এক্সট্রা লার্জ । যেখানে দ্রুত লিখতে গেলে সমস্যা হয় না । একটু লিখেই পাতা ওল্টানো বিরক্তিকর ব্যাপার ।

আমি ভেবে রেখেছি যেদিন আমাকে ওরা ছেড়ে দেবে (যদি সত্যিই কখনো সুস্থ্য হতে পারি) সেদিন এখানকার ডাক্তার সাহেবের কাছে গিয়ে আমি পা ধরে বলবো, ‘আমাকে দয়া করে এখানে থাকতে দিন, নয়তো ওপরতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবো ।’ রাবেয়াকে যেদিন আমি নিজের হাতে কবর দিয়ে এলাম- সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি । কোন একটা হাসপাতালে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব । একা একা ।

আচ্ছা ! রাবেয়ার সাথে যদি আমার বিয়ে না হতো, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো ? বহু বছর আগে রাবেয়াকে নিয়ে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে । আরও অনেকেই ছিল সঙ্গে । রোকেয়া, লাইজু, সুমন, পিনু । তখনো রাবেয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি । একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি, ভাল বন্ধুত্ব – এই যা ! নৌকায় করে ঘুরছি । চারপাশে গাঢ় করে কুয়াশা পড়েছে । পেঁয়াজী রঙের সিল্কের শাড়ির ওপর শাদা-শুভ্র একটা মিষ্টি শাল পেঁচিয়ে নৌকার একেবারে কিনারায় গিয়ে রাবেয়া গুটিসুটি মেরে বসে আছে । এই রঙে রাবেয়াকে ভারী মানায় । আমি ওকে একবার নীল রঙের একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম জন্মদিনের উপহার হিসেবে । এতো সুন্দর একটা শাড়ি অথচ পরবার পর ওকে একেবারেই ভাল লাগলো না । নীল রঙে রাবেয়াকে একেবারেই মানায় না । অথচ নীল, আসমানী এগুলি আমার সবচে প্রিয় রঙ । আমি রাবেয়ার পাশে গিয়ে বসতেই সে খপ করে আমার হাত ধরে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবি মিজান ?’

আমি টাল সামলাতে পারলাম না । ঘটনার আকস্মিকতায় এতোটায় অভিভূত হলাম যে দুম করে নৌকা থেকে পড়ে গেলাম । পাশের নৌকা থেকে পিনু, রোকেয়া সবাই চেঁচাচ্ছে, ‘কি হল ? কি হল ?’ আর আমি কাকভেজা হয়ে নৌকায় উঠেই রাবেয়াকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলাম । রাবেয়ার শাল ভিজে যাচ্ছিল ! কিন্তু ও আমাকে ছাড়লো না, জড়িয়েই ধরে রাখলো । একটু পরে পিনুদের নৌকা একটু এগিয়ে আসতেই ওরা সবাই মিলে চেঁচালো, ‘দেখেছি ! দেখেছি !’ রাবেয়া তড়িঘড়ি করে আমায় ধাক্কা দিয়ে সরে গেল । আমি আবার নৌকা থেকে পড়ে গেলাম ।

পুরোনো কথা মনে করেই আমার হাসি আসছে । আমি হো-হো করে হাসছি আর সুমন ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে । আমি হাসি থামালাম না । ব্যাটা বিরক্ত হলে হোক ! Pay no attention to the man behind the curtain । হাহাহা । আমি হাসছি তো হাসছিই । হাসতে হাসতে হাতের লেখা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । সুমন আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল । তার হাতে রজনের কৌটা । ফ্যাকাশে লাল চমৎকার একটা স্ফটিক । সে হয়ত বেহালায় রজন মাখবার কথা ভাবছে । আমি বললামঃ
‘সুমন, আজ যে আমার জন্মদিন এটা কি তোর মনে আছে ?’

সুমন ঘাড় ঘুরিয়ে পাগলাটে দৃষ্টিতে চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকালো । তাকে খুব পরিচিত কারো মতো লাগছে । কার মত লাগছে এটাই মনে করতে পারছি না । ইয়েস ! সালভাদর দালি ! খালি চিকন-চিকন দুটা মোচ থাকলেই পুরোপুরি মানিয়ে যেতো ...

এই পর্যন্ত পড়া হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে ড ফ্লয়েড ঘরে ঢুকলেন । ডেস্কের পড়ে থাকা কফির মগ সরিয়ে কয়েকটা ফাইল ব্যাগে ভরে সে মৌরীকে উঠতে ইঙ্গিত করলেন । দুজন লিফটে করে দ্রুত তেরো তলা পেরিয়ে নিচে নেমে এলো । হসপিটালের করিডোর ধরে হেঁটে বেড়িয়ে রাস্তা ধরে পার্কের দিকে হাঁটতে শুরু করলো তারা । মৌরী একটু কাশির ভঙ্গি করে বলল, ‘স্যার ! আমরা কোথায় যাচ্ছি ?’
‘To meet Rabeya ।’
‘হসপিটাল থেকে মিজান নামের পেশেন্টদের দেখে গেলে হতো না ?’
‘মিজান নামে আমাদের এখানে কোন পেশেন্ট নেই মিস রয় !’
‘তার মানে ?’
‘তিনটি ডায়েরীই রাবেয়ার লেখা । আমি আপনার অনুবাদ পড়ে তাই প্রথম দিকে বেশ খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম । স্যরি, আপনার ওপর ভরসা রাখতে পারি নি । তাই আমার পরিচিত ভাষাবিদ এক বন্ধুকে দিয়ে প্রথম ডায়েরীর কয়েক পাতা অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিলাম । কিন্তু দেখলাম বিষয়বস্তু একই ।’, ডক্টর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন ।

মৌরী খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো । কোথা থেকে জিজ্ঞেস করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না । তারা পার্কের মধ্যে ঢুকলো । মৌরী একটি বেঞ্চির ওপর বসেছে । পাশের বেঞ্চিতে দুটি বাচ্চা মেয়ে বেনী দুলিয়ে বসে বসে আইসক্রীম খাচ্ছে । দুজনকে একই রকম দেখতে, সম্ভবতঃ জমজ । কিছুটা দূরেই হুইলচেয়ারে করে এক অসম্ভব সুন্দরী মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলাকে (এই বয়সেও তাকে যথেষ্টই রূপবতী মনে হচ্ছে) ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বিশালদেহী এক নিগ্রো তরুনী । ড ফ্লয়েড তার নীল নীল চোখের ইশারায় বোঝালেন, ইনিই রাবেয়া !

‘ডিআইডি’ সম্পর্কে আপনার কোনরকম ধারনা আছে মিস রয় ?

ড ফ্লয়েড চুরুট ধরিয়েছেন । চুরুটের ধোঁয়ায় তার মুখ ঢেকে গেছে । তিনি আস্তে আস্তে নিজের টাই খুললেন । তারপর বললেন, ‘ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার । অনেকে MPD ও বলে । মাল্টিপাল পার্সোনালিটি ডিসর্ডার । অদ্ভুত ধরনের একটা রোগ । এই রোগে রোগী একটা অবাস্তব জগতে বসবাস করে । সে নিজেকে অনেক আলাদা আলাদা মানুষ হিসেবে ভেবে নেয় । মিথ্যে বলা, ব্ল্যাক আউট হওয়া এসব এই রোগের লক্ষণ ।’
‘কিন্তু,... মানে এইভাবে মিথ্যে লেখা- তাছাড়া হ্যান্ডরাইটিং এর আমূল পরিবর্তন- সবকিছু মিলিয়ে...’
‘এটা নিয়েও আমি ভেবেছি । আমি পুরোপুরি রাবেয়াকে MPD পেশেন্টের দলে ফেলে দিচ্ছি না । এটা স্পেশাল কেস । রিয়েলি রিয়েলি স্পেশাল কেস । আমার মনে হয়, এর জন্যে কনফেবিউলেশন দায়ী ।’
‘কনফেবিউলেশন মানে তো কঠিন মিথ্যে সত্যির মত করে বলা, তাই তো?’
‘স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলে ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয় । কনফেবিউলেটেড মেমরি হচ্ছে এক ধরনের বিহেভিওরাল সমস্যা যা মস্তিষ্কে মিথ্যে স্মৃতি তৈরী করে, কিন্তু আপনাকে তা বুঝতে দেয় না । আপনি নিজে যখন মিথ্যে কথা বলবেন, তখন আপনি সত্যি ভেবেই সেটা বলবেন । আর একারনে সাইকিয়াট্রিস্টদের জন্য ব্যাপারটা ধরা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে । এরা হেলুসিনেশন বা স্বপ্নকেও বাস্তব ধরে নেয় । আমি রাবেয়াকে ‘প্রফেসর’স অফিস’ টেস্টটা দিয়েছিলাম । প্রথম ডায়েরীতে সে এই নিয়ে লিখল । অথচ পুরো আবহ সে নিজের মত কল্পনা করে নিল । সেখানে আমি ছিলাম, আমার ল্যাপটপ ছিল, প্রফেসরের অফিসের ছবিটিও ছিল- অথচ সে নিজেই নিজেকে বদলে মিজান কল্পনা করে নিল । আমি ‘কল্পনা’ বলছি, কিন্তু তার কাছে ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরিই বাস্তব ! তখন সে নিজেকে আসলেই মিজান মনে করেছে যে তার স্ত্রী রাবেয়াকে খুন করার দায়ে অজানা কোন এক জায়গায় বন্দী হয়ে আছে । হ্যান্ডরাইটিং এর পরিবর্তনও সম্ভবতঃ এজন্যেই হয়েছে । MPD’র পেশেন্টদের অনেকের এমনও তো হয়েছে যে যখন সে নিজের ক্যারেক্টার বদল করেছে- তার চোখের দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত বদলে গেছে ! হয়তো সে এর আগে খালি চোখে দেখতে পেতো, চরিত্র বদলানোর পর সে খালি চোখে দেখতেই পাচ্ছে না !’
‘আমি যেটা জানি সেটা হচ্ছে কনফেব্যুলেশনে রোগী যে মিথ্যেগুলি একবার বলে, সে ব্যাপারে অনেক পরেও তার কাছে জানতে চাওয়া হলে সে একিউরেটলি তাই বলে । নতুন স্টেটমেন্ট আগের কথার থেকে এতোটুকুও বদলে যায় না...’
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই জানেন ।’
‘ডায়েরীগুলোতে দেখুন, প্রথম ডায়েরীতে সে লিখল, তার পছন্দের রঙ সবুজ, পরেরটায় লিখেছে বেগুনী, তার পরেরটায় নীল । আবার প্রথম ডায়েরীতে বেশ জোড় দিয়েই লিখল, নীল রং তার অপছন্দ । তাছাড়া দ্বিতীয় ডায়েরীতে তার জন্মদিন বলা আছে ১৯ তারিখ- পরেরটায় বলা আছে ২৩ ! এছাড়াও...’
‘বুঝতে পারছি । আসলে আমি নিজেও কনফিউজড... । আপাতত রাবেয়াকে EMDR দেয়া হচ্ছে, অনেক বেশী ভিটামিন বি এর ডোস দিয়েছি, হিপ্নোসিসও চলছে- লাভ তেমন কিছুই হচ্ছে না । যখন প্রথম ওকে ট্রাভার্সের এই হসপিটালে আনা হল, তখনকার MRI বা CT রিপোর্টেই ওর মস্তিষ্কের ডান দিককার ফ্রন্টাল লোবের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল । সম্ভবতঃ যখন ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন ড্যামেজটা হয় ।’
‘বলেন কি ?’, মৌরী আৎঁকে উঠলো, ‘কেন ?’
‘আমি তা জানতে পারি নি । তাকে এখানে নিয়ে আসে তার স্বামী মশিউর রহমান । তিনি প্রফেসর । কোন সাবজেক্টের এখন ঠিক মনে পড়ছে না । সে তেমন কিছুই বলতে রাজি হয় নি । আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, রাবেয়া দীর্ঘদিন ধরে শারিরীকভাবে নির্যাতিত হয়েছে । সেটা হতে পারে তার শৈশবে, অথবা প্রিয় কোন মানুষের দ্বারা রেপড্‌... Anything might happen... MPD’র বড় কারন যেটা ।’ একটু থেমে ডক্টর বললেন, ‘নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে রাবেয়া ফিজিক্সে পি এইচ ডি করছিল ।...’

নিগ্রো মেয়েটি হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে রাবেয়াকে ডক্টর ফ্লয়েডের সামনে নিয়ে এসেছে । রাবেয়া ঘোরলাগা দৃষ্টিতে আকাশ দেখছে । মৌরী হাত বাড়িয়ে তার কপাল স্পর্শ করল । কপাল হিম-ঠান্ডা হয়ে আছে । মৌরী হাসি হাসি মুখে বলল, ‘কেমন আছেন রাবেয়া ?’

রাবেয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে আকাশ থেকে চোখ নামাল । যদিও তার বিরক্তভঙ্গি বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না । সে মৌরীর দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসলো । তারপর চোখ টিপে পুরুষালী গলায় বীভৎস ভঙ্গি করে বলল, ‘How much for your ass, whore ?’

মৌরী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল । বাচ্চা মেয়ে দুটির আইসক্রীম খাওয়া শেষ । তারা পাশের বেঞ্চিতে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খুব হাসছে ।

________________________________________________
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×