somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোগেনভেলিয়া

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গলিটি সরু, ভেতরে রিকশা ঢোকে না । রিকশার ভাড়া মিটিয়ে প্রহর হাঁটতে শুরু করল । সে সাধারনতঃ শাড়ি পড়ে না । আজ পড়েছে । মায়ের পুরোনো যুগের শাড়ি । অনেকদিন যাবত আলমিরাতে পড়ে ছিল । এতো মিষ্টি রঙ, হালকা মেরুন । এতোদিন কেন চোখে পড়ে নি কে জানে ! আজই বের করে পরা হয়েছে । ভাঁজে-ভাঁজে ন্যাপথালিনের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে । শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ । নিজেকে চেনাই যাচ্ছে না, কি চমৎকার লাগছে তাকে দেখতে । নিজেকে বেশ বড়-বড় লাগছে, অপরিচিত’ও মনে হচ্ছে নিজের কাছে । অথচ আজ সে মাত্র উনিশ বছরে পড়েছে । শাড়ি পড়লে অবশ্যি কিশোরী মেয়েদেরকেও তরুণী বলে ভুল হয় ।

প্রহর গলির একটা গর্তে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো । হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে । শাড়ির এই এক সমস্যা । এটা পরে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লাগে । গলির শেষ মাথায় সে একটা শাদা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল । বাড়ির নামটা অদ্ভুত । টোনাটুনী । ঝকঝকে ফরসা শ্বেতপাথরের ওপর খোদাই করে লেখাঃ

টোনাটুনী
২৯/২, বড় মগবাজার, ঢাকা ।


প্রহরের বড়মামা আফসারউদ্দিন সাহেবের বাসা । তিনি হাইকোর্টের উকিল । বেশ ঘাঘু লোক, তবে ওকালতি খুব একটা বেশি জমাতে পারেন নি । মাঝখানে লোহার ব্যবসা করেছিলেন । ঐসময় বেশ টাকা-পয়সা জমিয়ে ফেলেন । একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড করোলা গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেললেন । পরে যদিও সেটা বিক্রি করে ফেলতে হয় । সেই লোহার ব্যবসাও উঠে গেছে । এখন জমির দালালী করেন । ‘দালালী’ শব্দটা শুনতে খারাপ শোনালেও অর্থ উপার্জনের দিক থেকে তুলনাহীন । নানাভাইয়ের কাঠের দোতলা পুরোনো বাড়ি ভেঙে তিনতলা পাকা দালান তোলা সহজ ব্যাপার না । বড়মামা শুধুমাত্র দালালীর পয়সা দিয়েই এই বাড়ি তুলে ফেলেছেন । নাম দিয়েছেন 'টোনাটুনী' । এই অদ্ভুত নামের পেছনকার ইতিহাস প্রহরের জানা নেই । প্রহর প্রতিবার এই বাড়িতে ঢুকবার আগে ভেবে রাখে আজ জিজ্ঞেস করবে, অথচ জিজ্ঞেস করবার কথা কখনোই মনে থাকে না ।

প্রহর বেল টিপল । অনেকক্ষণ পরে তিনতলা থেকে মঞ্জু নেমে এলো । বড় মামার তিন ছেলে । শফিক, রঞ্জু, মঞ্জু । শফিক ভাই এক বছর যাবত নিখোঁজ । তিনি বুয়েটে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলেন । থাকতেন আহসানুল্লাহ হলে । যেদিন তার রেজাল্ট বেরুলো তার দুদিনের মাথায় তিনি উধাও হয়ে গেলেন । বড়মামী কেঁদে কেটে একাকার হয়ে বললেন, ‘রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বললেই তো হতো । আমরা কি ওকে মেরে ফেলতাম নাকি ?’ । পরে অবশ্যি জানা গেল রেজাল্টের কারনে তিনি পালিয়ে যান নি । রেজাল্ট অবিশ্বাস্য রকমের ভাল । উপরন্তু, বুয়েট থেকে জব অফার পাওয়ার কথা, এমন অবস্থা ! এই সময়ে খোঁজাখুঁজির ধুম পড়ে গেল । পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে শুরু করে মাইকিং- কিছুই বাদ গেল না । রমনা থানায় একটা জিডি এন্ট্রি পর্যন্ত করা হল । পুলিশে জিডি করবার তিন-চারদিন পর শফিক ভাই’র হাতে-লেখা একটি চিঠি এলো । জানা গেল তিনি তার দুই বন্ধুর সঙ্গে খাগড়াছড়ি চলে গেছেন । নিজের সমস্ত সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে ফেলেছেন । গৎ-বাঁধা জীবন-যাপন তার লক্ষ্য নয় । জীবনের কোন এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি গৃহত্যাগ করেছেন, যে উদ্দেশ্য এখনো জানা যায় নি । শফিক ভাই’র প্রসঙ্গ এলেই বড়মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘অকালকুষ্মান্ড জন্ম দিয়েছি । গাধার গাধা !’

মঞ্জু হচ্ছে বড়মামার সবচেয়ে ছোটছেলে । সে ক্লাস সিক্সে পড়ে । বোকা টাইপের এবং খানিকটা তোতলা । সে তোতলাতে তোতলাতেই বলল, ‘আ-আ-আপা, বা-বা-বাসায় তো কেউ নেই ।’
‘রঞ্জু কোথায় ?’
‘র-র-রঞ্জু ভাই ঘুমাচ্ছে ।’
‘তুই গেট খুল্‌ । গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন গাধা ?’
‘আ-আ-আপা তোমাকে আজকে খু-খু-খুব সুন্দর লাগছে ।’
‘যে সুন্দর তাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে । তুই গেট খুল্‌ !’
‘চা-চা-চাবি আনতে ভুলে গেছি ।’
মঞ্জু চাবি আনতে ছুটে যাচ্ছে ওপরতলায় । প্রহর কাঁধের ব্যাগটা হাতে নিয়ে চেইন খুলল । চারপাশে একবার তাকিয়েই গোল আয়নাটা ব্যাগের ভেতরে রেখেই নিজেকে দেখতে লাগল । এই বদ-অভ্যাস তার আছে । বার বার নিজেকে অকারনেই আয়নার ভেতর দেখতে ইচ্ছে করে ।

**** **** ****

ঘুম ভেঙে রঞ্জু চমকে উঠল । তার খাটের পাশের কাঠের টেবিলের ওপর প্রহর পা ঝুলিয়ে বসে আছে । দরোজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল । সে কিভাবে ঢুকল কে জানে । এর আগেও দুবার প্রহর এই কাজ করেছে । সেবারের কথা খেয়াল নেই । তবে আজ সে একেবারেই নিশ্চিত রাতে ঘুমোনোর আগে সে ছিটকিনি তুলে দিয়েছিল । তার বিছানার সঙ্গে মশারি টাঙানো ছিল । এখন নেই । ঘরের জানালা বন্ধ ছিল । এখন দুটো জানালাই খোলা । অ্যাশ-ট্রে’টা খাটের ওপর বালিশের পাশে ছিল, সিগারেটের প্যাকেট ছিল । টেবিলের ওপর বই-পত্র এলোমেলো করে রাখা ছিল । এখন সেসব কিচ্ছু নেই । এই সবই প্রহরের কাজ । রঞ্জু মাথা গরম করতে করতেও নিজেকে সামলে নিল । মেয়েটাকে দেখে তার অসম্ভব ভাল লাগছে । পছন্দের মানুষদেরকে দেখে দিন শুরু করতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার । তাছাড়া ওকে পরীর মতন লাগছে । এতো সুন্দর লাগছে কেন আজ ওকে ? ঘটনাটা কি ? দীর্ঘ করে কাজল টেনেছে, চুলও বোধহয় অন্যরকম করে বেঁধেছে । শুধু এজন্যেই কি ? রঞ্জু উঠে বসলো ।

কাজের মেয়েটা ঘর ঝাড়ু দিতে এসেছে । প্রহর বলল, ‘শেফালি, ভাল আছো ?’

শেফালি গালভর্তি করে হাসল । তাকে এ বাড়ির সবাই তুই-তোকারি করে কথা বলে । অথচ এই আপা প্রথমদিন থেকেই মিষ্টি করে তুমি করে ডাকে । শুনতেই ভাল লাগে । এজন্যেই সে প্রহর আপাকে অত্যধিক পছন্দ করে ।

‘তোমার ভাইজানকে জিজ্ঞেস করো সে চা খাবে কিনা । যদি খায় তাহলে আমার জন্যও এক কাপ এনো ।’
শেফালি কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই রঞ্জু ঘুম ভাঙা কন্ঠে বলল, ‘চা খাবো না ।’
‘শেফালি তুমি তাহলে শুধু আমার জন্য এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো । চিনি কম দিও ।’
শেফালি চলে যেতেই রঞ্জু বলল, ‘কেউ কি আমাকে বলবে সে ঘরের ভেতর ঢুকল কি করে ?’

প্রহর কিছু বলল না । ঘরের ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া ছিল, একথা সত্য । তবে খোলাটা কঠিন কিছু না । বাড়ির বাইরে থেকে জানলার ছিটকিনি খুলবার একটা কৌশল আছে । সেটা একবার খুলতে পারলে দরোজা খোলাটা কঠিন কিছু না । এর আগেও কয়েকবার রঞ্জুকে এভাবে চমকে দিয়েছিল । তবে এটা সে শুধু তখনই করে যখন রঞ্জু ঘুমে থাকে । ম্যাজিক দেখাবার মজাই অন্যরকম । সে ম্যাজিকের কৌশল ভাঙতে চায় না ।

রঞ্জু রাগের ভঙ্গি করে বলল, ‘বিছানার ওপরে আমার সিগারেট রাখা ছিল ।’
প্রহর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেউ ড্রয়ারের ভেতর খুঁজলে হয়তো পেয়েও যেতে পারে ।’

রঞ্জু ড্রয়ার খুলে সিগারেট পেল । সে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘যে আমার ঘরে ঢুকে অনধিকার চর্চা করছে, তার কাছে কি আমি জানতে পারি সে কি চায় ?’
‘কেউ একজন আমার চিঠির জবাব দেয় নি ।’
‘যে দেয় নি, তার ইচ্ছা !’

সিগারেট বিস্বাদ লাগছে । রঞ্জু সিগারেট ফেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখা পেস্টের টিউব হাতে বাথরুমে ঢুকে গেল । দরোজা লাগাতেই ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ স্বর শুনতে পেল, ‘ঠিক আছে, দরকার নেই কারো । যার চিঠির জবাব দেয়ার ইচ্ছা নেই তাকে জানিয়ে রাখি, আজ আমার জন্মদিন । আর ইচ্ছাহীন মানুষটা সেটা ভুলে গেছে । তাকে নিয়ে জন্মদিন কাটানোর ইচ্ছে ছিল । তাই এসেছিলাম । চলে যাচ্ছি ।’

রঞ্জু দ্রুত দরোজা খুলে বের হল । টুথপেস্টের শাদা ফেনায় তার মুখ মেখে আছে । প্রহর দরোজা পর্যন্ত যেতেই তার হাত টেনে ধরল রঞ্জু, ‘পাঁচটা মিনিট ! মুখ ধুয়ে আসি । নাকি কেউ সেই সময়টাও দেবে না ?’
‘কেউ-কেউ করে কথা বললে কেউ দেবে না ।’
‘আচ্ছা ! প্রহর দেবে ?’

প্রহর এবার হেসে ফেলল । রঞ্জু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে । রঞ্জুর হঠাৎ করে মনে হলো, প্রহরের চেয়ে সুন্দর করে কি এ পৃথিবীতে অন্য কোন মেয়ে হাসতে পেরেছে ?

**** **** ****

সারাদিন রিকশায় করে দুজন ঘুরলো । কোন গন্তব্য নেই, তবু ঘুরতে ভালো লাগছিল । কখনো কোথাও থেমে অকারনেই কিছুদূর হাঁটা । নিউমার্কেট ওভার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে কারনে-অকারনে হাসাহাসি কিংবা রাগ-অভিমান । যান্ত্রিক শহরের মানুষগুলির থেকে একটু আলাদা হয়ে দুজনেই ফুটপাথের কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা জমানো । বেশিরভাগ মহিলারাই চোখ বড়-বড় করে দেখছিল ওদের । মনে মনে হয়তো গাল দিচ্ছিল, ‘আহা ! ন্যাকামি !’ বলে । বাঙালি ফুটপাথে ভিখিরিই দেখে এসেছে এতোকাল- প্রেম দেখে চোখে সইবে কেন ? তবু ওরা ওখানেই বসে গুনগুন করে গলা মিলিয়ে গান গাইলো । অকারনেই হয়তো শহীদ মিনারের চত্বরে পাশাপাশি বসে রইলো । দুপুর গড়ালে বেইলি রোডের ব্যস্ত দোকানগুলিতে ঘোরাঘুরি । তার এক ফাঁকে বুমার্সের খাবার গলিতে বসে অযথাই পয়সা নষ্ট করলো- খাওয়া হলো না কিছুই ! হয়তো অকারনেই । অথবা কোন কারন আছে । এখনো ঠিক জানে না ওরা ।

বিকেলে রিকশায় করে ফিরছে । ঠিক সে সময় পকেট থেকে একটা আংটি বের করল রঞ্জু । প্রহর ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘দেখি দেখি ! এতো অপূর্ব কেন এই পাথরটা ? সবুজের কি অদ্ভুত রঙ ! কি পাথর রে এটা ?’
‘এমেরাল্ড ।’
‘এটা আবার কি ?’
‘তোর টরাস, না ?’
‘হুম ।’
‘এটা পান্নাপাথরের আংটি । তোর জন্য অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি । তোর জন্মদিনের উপহার । টরাসের সৌভাগ্য বয়ে আনে এই পাথরটা ।’
‘আসলেই ?’
‘লোকে বলে...’
‘আচ্ছা, তুই কি আমাকে প্রোপোজ করার জন্য এটা নিয়ে এসেছিস ? সাহস নেই, এখন ভুজং-ভাজং মারছিস । তোর তো আমার জন্মদিনের কথাই মনে ছিল না । উপহার এলো কোত্থেকে ? সত্যি করে বল্‌ তো !’
‘কি আশ্চর্য ! তুই এমন আজিব কেন ?’
‘আমি আজিব ? নাকি তোর প্রপোজ করার সাহস নেই ? এতো ভয় পাচ্ছিস কেন ? আমি কি মারবো নাকি তোকে ?’, প্রহর চোখ টিপে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, ‘কর্‌ না প্রপোজ !’
রঞ্জু একটু ভেবে গাঢ়স্বরে বলল, ‘প্রহর, চল ! আজ আমরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি !’

প্রহর অবাক হয়ে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে আছে । বুঝতে সময় নিচ্ছে রঞ্জু মজা করছে কি না । এইতো রঞ্জু চোখ নিচু করে ফেলল । প্রহর বলল, ‘দূর ! এভাবে কেউ প্রপোজ করে নাকি ? তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না । কোন মেয়েকেই তুই পটাতে পারবি না ।’

রঞ্জু কোন কথা বলল না । মাথা নিচু করেই বসে রইল । প্রহর মাঝখানে একবার জিজ্ঞেস করল, ‘শফিক ভাই কি কোন চিঠিপত্র পাঠিয়েছে ? মানে যোগাযোগ হয়েছে তার সাথে ?’ । রঞ্জু ঘাড় নাড়ল একবার । সারা পথ রিকশা চলল । ওরা দুজন নীরব । যেন সব কথা বলা হয়ে গেছে । নতুন কোন কিছুই বলার নেই । নীরবতা আমাদের জীবনের হীরন্ময় মুহূর্তগুলোকে ঘিরে থাকে । অথচ আমরা তা বুঝতে পারি না । যখন বুঝতে পারি, তখন একই সঙ্গে এটাও আবিষ্কার করতে হয় যে, অনেক দেরী হয়ে গেছে ।

সূর্য ডুবছে । বাসাবোতে প্রহরদের বাসার কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ প্রহর নীরবতা ভেঙে বলল, ‘ওগুলি কি ফুল রে ?’
‘গেটফুল ।’, কিছু বলবে না ভেবেও মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল রঞ্জুর ।
‘এতো সুন্দর একটা ফুলের নাম গেটফুল ? কোন ভাল নাম নেই ?’
‘বোগেনভেলিয়া বোধহয় ! সিওর না ।’
‘আমায় এনে দিবি ?’
‘কি করবি ?’, একটু থেমে রঞ্জু বলল, ‘এইগুলি খোঁপায় পরার ফুল না ।’
‘দে না ! এমন করিস ক্যান ?’
‘পারবো না । কার না কার বাসা ।’, রঞ্জু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল ।

রিকশা থামতেই দুহাতে শাড়ি ধরে প্রহর এক ছুটে বাসার ভেতরে চলে গেল । চোখ ঘষতে ঘষতে সে দোতলায় নিজের ঘরে চলে এলো । চোখের পানিতে হয়তো কাজল লেপ্টে গেছে, কেউ দেখলে ভয়াবহ সমস্যা । আজকাল হুটহাট চোখে পানি চলে আসে । অথচ সে জানে, সে অকারনেই কাঁদছে । তবু তার কাঁদতে হবেই । কেন, কে বলবে ?

শাড়ি পাল্টাচ্ছে এমন সময় মতির মা এসে দরোজায় টোকা দিয়ে বলল, ‘আফামনি, ওষুধ !’
‘ওষুধ মানে কি ? কার ওষুধ ?’
‘আফনের । রঞ্জু ভাইজান দিয়া গেছে ।’
‘দরজার পাশে রেখে যাও । আমি নিয়ে নেবো ।’

শাড়ি বদলে একটা হালকা বেগুনী রঙের কামিজ পড়ে দরোজা খুলল প্রহর । দরোজার পাশে একটা কাশির সিরাপ রাখা । এটা কি ধরনের ফাজলামি ? রঞ্জু ফাজিলটার কান ছিঁড়ে দেয়া উচিত । সিরাপের বক্সটা খুলে প্রহরের বিকট চিৎকার দিতে ইচ্ছা করলো । বক্সভর্তি অনেকগুলি বোগেনভেলিয়া ! প্রহর গোলাপি রঙের বোগেনভেলিয়াগুলি বের করে গালের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলো । রঞ্জুটা এমন কেন ? কখনোই নিজেকে বুঝতে দেয় না ? ওর কি আসলেই মনে ছিল আজ প্রহরের জন্মদিন ?

**** **** ****

রঞ্জু সে রাতে কবিতার ডায়েরী খুলে বসে । বাইরে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে তখন । প্রহর কি করছে এখন ? ঘুমিয়ে পড়েছে কি ? কালকের সবুজ কালিতে লেখা কবিতাগুলোয় হাত বোলায় সে । গাঢ় করে অনুভব করতে চায় মেয়েটাকে । আহারে, মেয়েটা যদি জানতো তার জন্মদিনে সেকেন্ডের কাঁটা বারোটার ঘরে পৌঁছুতেই না পৌঁছুতেই একটি ছেলে আয়োজন করে মোম জ্বালিয়ে বসে গিয়েছিল । রাত্রিজোড়া ডায়েরীটিতে অসংখ্য কবিতা লিখেছিল । সবই প্রহরের জন্য, জন্মদিনের কবিতা । নৈঃশব্দের কবিতা । যা প্রহর জানবে না, হয়তো কখনোই ! কেন কিছু কথা কখনোই মুখে বলা হয়ে ওঠে না ?

দু-তিনদিন পরের কথা । ফাহমিদা রান্নাঘরে রুটি সেঁকছিলেন । মেয়ের চিৎকারে দৌড়ে দোতলায় গেলেন ।
‘কি হয়েছে ? কি হয়েছে ?’
‘মা আমার টেবিলের ওপরের নীল রঙের কৌটোটা কি তুমি ধরেছিলে ?’
‘কেন ? কি ব্যাপার ? কি হয়েছে ?’
‘আগে বলো তুমি ধরেছো কিনা ?’
‘হ্যাঁ । কি ব্যাপার ?’
‘ওর ভেতরে কিছু পাওনি ?’
‘কি বলিস ? কানের দুল-টুল কিছু ছিল ? আমি তো কিছুই পেলাম না রে মা । কিছু পঁচে যাওয়া ফুলের পাঁপড়ি ছিল কেবল । মতির মা’কে বললাম ওগুলি ফেলে কৌটোটা মুছে রাখতে ।’
‘মা, কেন এমন করো সবসময় তুমি ?’

প্রহর কাঁদতে বসলো । ফাহমিদা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন । মেয়ের কথার কিছুই তিনি বুঝলেন না । কি এমন ছিল ঐ কৌটাটিতে ? তার মেয়ে এমন উতলা হয়ে কাঁদছে কেন ? তিনি মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন । প্রহর সেই হাত সরিয়ে দিল ।


পরিশিষ্টঃ

এ গল্পের চরিত্রগুলি আমার পরিচিত । গল্পের প্রহর, রঞ্জু -এরা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে । প্রহরকে কেন্দ্র করে একটি আলাদা জগত গড়ে উঠেছে । রঞ্জুকে কেন্দ্র করে অন্য একটি জগত । এরা এখন অন্য প্রহর, অন্য রঞ্জু । সেই প্রহর ও রঞ্জুর জগতগুলি কখনো ইন্টারসেক্ট করে না । ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হলেও এখন এদের দুজনার দেখা হয় না আর, কথাও হয় না কখনো । তার অনেক রকম কারন হতে পারে ।

তবু প্রতিদিন একই রকম বোগেনভেলিয়াগুলি কাঠ-চুন-সুরকির বাড়িগুলির ফটকঘিরে জন্মাতে থাকে । কোন এক নতুন কবি মোম জ্বেলে ডায়েরীভর্তি করে লিখতে থাকে জন্মদিনের কবিতাগুচ্ছ । তারা বুঝতে চেষ্টাও করে না, এইসব বোগেনভেলিয়ার পাতা ঝড়ে যাবে- তারা জমিয়ে রাখতে পারবে না খুব বেশিদিন । ডায়েরীর ওপর কিছুটা হলেও ধুলো জমে যাবে, কারনে-অকারনে, কারন খুঁজে পাওয়া যাবে না কখনোই ।

মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয় । আমি খুব সাহস নিয়ে প্রায়ই একটি প্রশ্ন করবার কথা ভাবি । প্রতিবারই ভাবি বলবোঃ এখনো কি ওদের আগের মমতাগুলি হৃদয়ের কোন গভীরতম স্থানে জমা হয়ে আছে ? এখনো কি পুরোনো অদ্ভুত-অদ্ভুত স্মৃতিগুলো ওদের হঠাৎ-ই মনে পড়ে যায় ? অনুভূতিগুলো কতোটুকু প্রাঞ্জল আছে ? সেগুলো কি আগের মতোই উত্তাপ ছড়ায়, আগের মতোই কাঁদায়-হাসায় ? উত্তরগুলি জানা খুব প্রয়োজন । তবু প্রশ্ন করতে গিয়েও আমি থেমে যাই । বলে রাখা ভাল আমি খুব একটা সাহসী মানুষ নই ।
________________________________
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:১২
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×