আমাদের যাদের জন্ম হেমন্তের শিশির বৃষ্টির কালে, দুঃখী মায়েদের বিস্ময়কর মমতার দেশে… সেকালে তখনও মটরশুঁটির ক্ষেতগুলো সবুজ বাতাস ঠেলে বিকেল নিয়ে আসতো, তখনও সূর্যালোক কেবলই বন্ধু আমাদের.. গলা জড়িয়ে সবুজ মাঠ খচতে খচতে শিশু-জংলার পথ মাড়িয়ে সেই নদীর পাড়ে হাট বসতো আমাদের.. যেখানে শালিক মাছরাঙার পায়ের জলছাপে বাড়ছে বালুচর ক্যানভাস, আর কচুরিপানার অন্ধকারে পানকৌড়ির সাধের ডুবসাঁতার..
অদ্ভুত ব্যাপার! একজন আইয়ুর বাচ্চুকে খুঁজতে গিয়ে আমাদের যৌথ শৈশব হড়হড় করে বেরিয়ে আসছে.. উঠে দাঁড়াচ্ছে কৈশোর.. আরেকটু পরেই স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে যেতে যেতে ভাট্টিদের বাড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে আমরা আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনে নেবো.. অন্তত আরও ২৪ ঘন্টা গুনগুনের খোরাক হবে আমাদের…
রক-ফোকের নিকেশ মেনে গান শোনা হয়নি কোনদিন.. আকাশ বাতাস প্রতিবেশ থেকে যত বিস্ময়কর মেলোডি আমাদের চুবিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিল, সেগুলোই শুষে পুষ্ট হয়েছি আমরা..
স্কুল-কলেজে যখন একাকার হচ্ছিলাম, তখন আইয়ুব বাচ্চুর স্বর্ণযুগ.. স্রোত-কোলাহল বিচ্ছিন্ন আমরা কতিপয় ‘বেসামাজিক’ বন্ধু চুরি করা রাতে সন্ধ্যায় আঁতেলায়িত আড্ডার সুযোগ পেলে বাচ্চুর গানগুলোর কয়েক দফা রিভাইজ হয়ে যেতো.. কলেজের অদ্ভুত অনুভূতির কালে এই সব রিভাইজ, কদাচ মৌসুমি কনসার্ট হয়ে গানগুলো ততদিনে আমাদের কান হয়ে রক্তে-মাংসে লোহিত কনিকায় প্রবলভাবে ছড়িয়ে গেছে.. তারপর এক দিন আমরা টের পাই.. গিটারের প্রথম ঝংকারেই রক্ত জ্বলে উঠতে শুরু করেছে.. অদ্ভুত!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরগুলোতে যখন হাঁটার অনুমোদন মিলেছে, তখন সন্ধান মিললো আরেক বাচ্চুর… হাসান তখন সবে প্রশ্ন তুলছে এত কষ্ট কেন ভালবাসায়… আইয়ুব বাচ্চু তখন বনেদি.. বুয়েটের কনসার্টে তীব্র বিস্ময়কর গিটারে বিদ্ধ হচ্ছে পুরো একটি প্রজন্ম.. অথবা টিএসসির মোড়ে বর্ষবরণের মঞ্চ থেকে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে গিটার.. কণ্ঠ, কোলাহল ছাড়িয়ে প্রবল একটি গিটার কাঁদতে কাঁদতে ভাসতে ভাসতে বনেদি বট ঝাউ ছুয়ে নীলক্ষেতের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে..
নিঃসঙ্গতাপ্রিয় আমি টিএসএসির কনসার্ট জনসভার খানিক দূরে দাঁড়িয়ে নিজের উন্মাদনার হিসেব কষি.. পুরো টিএসএসি চত্বরের দৃষ্টিসীমা জুড়ে মেক্সিকান ওয়েভে ভেসে ভেসে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাচ্চুর গিটার... এত বিপুল উন্মাদনা সত্বেও এই মহাসাগরে আমিই যেন সবচেয়ে স্বল্প মাদকাসক্ত.. কী বিস্ময়কর!
কী বিস্ময়কর! আইয়ুব বাচ্চু কি ভাববার অবকাশ পেয়েছিলেন.. কিভাবে এই দুঃখী বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলে.. একে একে কয়েকটি প্রজন্মের কৈশোর তারুণ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:১৭