somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিন যায়, আমার প্রেম যায় বেড়ে...

১২ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমাদের স্কুলের মেয়েগুলো বড় 'মাথা নষ্ট' টাইপের ছিলো (এটা অবশ্য আমাকে দেখেই বেশ বোঝা যায়)। সাধারণতঃ স্কুলজীবনের শেষে অর্থাৎ ক্লাস টেনের সমাপ্তির দিকে এসে ক্লাস পার্টি জাতীয় কিছু একটা হয়। আমাদেরও সেটার ব্যতিক্রম ছিলো না--- ক্লাস পার্টি, শাড়ি পরে মাঞ্জা মেরে ভাব নেয়া, দল বেঁধে ছবি তোলা, বিরিয়ানি খাওয়া, টিচারদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া এসব তো হতোই, মাঝখানে ফাউ একদিন হতো শুধু পানি মারামারি। মেয়েরা আবার শুধু পানি মেরেই ক্ষান্ত হতো না, সাথে রঙও মারতো। আমাদের ('৯৯ ব্যাচ) যেবার ক্লাস পার্টি হলো সেবার রঙের ভাগটা একটু কম ছিলো, পানিই মারা হয়েছিলো বেশি। অত্যধিক পানি ছোঁড়াছুঁড়ির কারণে কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলো সবাই এমনভাবে ভিজে গেছে যে প্রত্যেককেই সামান্য স্কুল ইউনিফর্মেই ব্যাপক সেক্সি লাগছে! সমস্যা হলো বয়সটাই এমন ছিলো যে, যখনই এই ব্যাপারটা মেয়েদের মাথায় ঢুকে গেলো তখন তারা খুবই লজ্জায় পড়ে গেলো (হায় হায় আমার এ কি হলো! টাইপের)। =p~ এটা একটা গার্লস স্কুল, এখানে কোনও ছেলে নেই সুতরাং সেক্সি দেখালেই বা কি আর না দেখালেই বা কি--- এই সহজ কথাটা জানার পরেও দেখা গেলো যে সবাই একেবারে লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

স্মৃতি জিনিসটা আসলেই বেদানা।

খুবই প্রবলেম হতো যখন বৃষ্টি নামতো। চিৎকার- চেঁচামেচি- গান গাওয়া- হৈ হুল্লোড় করা, মানে মাথা নষ্টের আরেক প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কি! এমনও হয়েছে যে ম্যাডাম ক্লাসে পড়াচ্ছেন, খুবই গুরুগম্ভীর অবস্থা, এর মধ্যে হঠাৎ শুরু হলো আকাশ কালো করে দমকা বাতাস আর বৃষ্টি... আর যায় কই! একটু পরপর একবার করে তীব্র বাতাসের ঝাপ্টা আসে আর অমনি মেয়েগুলো আনন্দের আতিশয্যে এমন শেয়ালের মত হুক্কাহুয়া করতে থাকে যে বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ম্যাডাম ঘোষণা দিলেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, এতই যদি তোমাদের পাগলামি তাহলে থাকো ঐ নিয়ে, আমি আর পড়াতে পারবো না, এই আমি মুখে কুলুপ দিলাম, এখন তোমরা যা খুশি করোগে!" X((

কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো ক্লাসের মেয়েগুলো বৃষ্টির আনন্দে আহা-উহু করেই যাচ্ছে আর ম্যাডাম চুপচাপ গালে হাত দিয়ে ভ্যাবলার মত বসে আছেন!

তবে এটা হয়তো একটা স্পেশাল কেস, সবসময় সবক্ষেত্রে এটা সম্ভব ছিলো না। আরেকদিনের ঘটনা বলি। ক্লাস নাইন থেকেই যথারীতি ফোর্থ পেপারে একটা ভাগাভাগি হয়ে যেতো, কেউ নিতো হায়ার ম্যাথমেটিকস আর কেউ নিতো গার্হস্থ্য বিজ্ঞান। কমার্স টিচারের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার কারণে ব্যবসায়িক উদ্যোগ জাতীয় সাবজেক্টগুলো পড়ানোর কেউ ছিলো না কাজেই আর্টসের মত কমার্সের ছাত্রীদেরকেও ঐ গার্হস্থ্য বিজ্ঞানই নিতে হতো। অর্থাৎ, তুমি যদি সায়েন্স গ্রুপের হয়ে থাকো তাহলে তোমার দু'টো অপশন (হয় হায়ার ম্যাথস নয়তো গার্হস্থ্য), কিন্তু তুমি যদি আর্টস বা কমার্স গ্রুপের হয়ে থাকো তাহলে আর কোনও অপশন নেই, ঐ গার্হস্থ্য বিজ্ঞানই নিতে হবে। কাজেই ক্লাস রুটিনে যখন ফোর্থ পেপারের ক্লাস উল্লেখ থাকতো তখন মেয়েরা দুই ভাগ হয়ে যেতো, এক ভাগ যেতো হায়ার ম্যাথ ক্লাসে আরেক ভাগ যেতো গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ক্লাসে।

ঘটনার দিন যথারীতি তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। যে স্যার আমাদের হায়ার ম্যাথস ক্লাসটা নিতেন তিনি খুবই হাল্কা মেজাজের মানুষ ছিলেন, অঙ্ক নিয়ে কখনও কোনও চাপ দিতেন না, বকা/মার দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সবচেয়ে বড় মজা হলো ঐদিন তিনি ক্লাসেই আসেননি! !:#P আমাদের তো যাকে বলে একেবারে 'আসমানে পাখা মেলোওওওওওও' (মোজো'র বিজ্ঞাপন) টাইপ অবস্থা। একদিকে বৃষ্টির পানি নিয়ে মাখামাখি করি আরেকদিকে হেঁড়ে গলায় গান গাই। কেউ ক্লাসরুমে, কেউ বারান্দায়, কেউ স্যারের টেবিলে... পুরাই যাচ্ছেতাই কারবার। একজন চেঁচিয়ে ধরলো 'ও ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে/ বুকে নদী বইয়া চলে'... একজন আবার শুরু করলো তার প্রেম কাহিনী, কোন ভাইয়াটা তাকে নাকি পাত্তা দিচ্ছে না, তার মন নিয়ে খেলছে সেই নিয়ে তার মরোমরো অবস্থা! এইসব করতে করতেই হঠাৎ চোখ গেলো পাশের গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ক্লাসের দিকে, ভাবলাম একটু দেখি কি করছে ওরা।

ওরে... তাকিয়ে দেখি, প্রচণ্ড কড়া এক ম্যাডাম ওদের পড়া ধরছে, ওরা পাগলের মত পড়া মুখস্থ করছে (গার্হস্থ্যতে তো অঙ্কের মত বোঝার মত কিছু নাই জাস্ট চোখ-কান বন্ধ করে মুখস্থ করে যাওয়া)। যারা ঠিকমত মুখস্থ বলতে পারছে তাদের অবস্থা ভালোই কিন্তু যারা পারছে না তাদের অবস্থা খুবই করুণ, প্রত্যেককে ম্যাডাম কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখছে। :|

অত সুন্দর বৃষ্টিটা ওদের বৃথাই যাচ্ছিলো সেদিন।

আসলে ঐ স্কুলটায় একটা লেভেলে আসার পর বেশ ডানা গজিয়ে যেতো আমাদের। এটা শুধুমাত্র বয়সজনিত কারণ নয়, এখানে আরও একটা ব্যাপার ছিলো। আমি যতদূর জানি, বয়েজ স্কুলগুলোতে বকাবকি বা মারধোরের পরিমাণ অনেক বেশি, গার্লস স্কুলে কিন্তু তা নয়, ফলতঃ এমনিতেই আমরা টিচারদের মার বা বকা খুব একটা খেতাম না (অবশ্য একেবারেই ছিলো না তা না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই ছিলো)। মোটামুটি ক্লাস টেনের কাছাকাছি এসে গেলেই দেখা যেতো টিচাররা কেউ শাস্তি দেন না, মার তো দূরস্থান। ঠিক বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগে মেয়েরা বাপের বাড়িতে যেমন খাতির পায় অনেকটা সেরকম। মনে হতো যেন আমরা কিছুদিন পর স্কুল ছেড়ে চলে যাবো বলে টিচারদের মমতা অনেক বেড়ে গেছে আমাদের প্রতি, খুব ক্ষ্যাপা স্বভাবের টিচাররাও হাসি হাসি মুখ করে কথা বলতেন। খুব ভালো লাগতো, আবার একটু খারাপও লাগতো। এত সাধের স্কুল লাইফ ছেড়ে যেতে কারই বা ভালো লাগার কথা?

রোজ সকালে অ্যাসেম্বলির সময় দু'রকম ড্রিলের নিয়ম ছিলো। একটা ছিলো গানের তালে তালে (রণ সঙ্গীত i.e. চল চল চল) আরেকটা ছিলো শুধুই ড্রামের সাথে কিন্তু খুবই রিদমিক, ওটার নাম ছিলো রুমাল নৃত্য। রণ সঙ্গীতের সাথে ড্রিলটা খুব সোজা প্লাস ছোটখাট ছিলো কিন্তু অতটা ভালো লাগতো না... কিন্তু রুমাল নৃত্যটা অনেক লম্বা এবং মুভমেন্টগুলো তুলনামূলক কঠিন ছিলো কিন্তু ওটাই বেশি ভালো লাগতো। আমরা এমনই ফাজিল ছিলাম, যখনই মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেয়া হতো "মেয়েরাআআআআ......... রুমাল নৃত্যের জন্য প্রস্তুউউউউত হও!" এমন ভাব দেখাতাম যেন কত বিরক্ত হয়েছি, 'ধুত্তুরি ছাই' টাইপের একটা ভাব নিতাম আবার দাঁত কেলিয়ে একটা হাসিও দিতাম, বেশ বোঝা যেতো যে মহাখুশি হয়েছি!

আবার খুশি হয়েছি বলে যে ধুত্তুরি ছাই বলা থেকে বিরত থাকতাম তাও না, ঐটাও ঠিকই চলতো! ;)

ফুলটাইম টিচাররা মোটামুটি বাঁদরামি কম করার জন্যই বোঝানোর চেষ্টা করতেন কিন্তু পার্টটাইম টিচারদের (বি এড ট্রেনিং) কেউ কেউ এসে সবকিছু এমন ভণ্ডুল করে দিতেন যে একেবারে মাথা খারাপ হয়ে যেতো... কক্সবাজারের কৃষ্ণাদি একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন "এই, তোমাদের স্কুলে যে এত আম গাছ, তোমরা আম চুরি করো না?" হতবুদ্ধি হয়ে আমরা ওনার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলাম... বুঝতে পেরে উনি বলেছিলেন "আরে গেছো হওয়ার এই তো বয়স, এখন চুরি না করলে আর কখন করবা, পরে তো আফসোস হতে থাকবে কিন্তু তখন তো আর চান্স পাবা না!"

আমরা আসলে বুঝতে পারিনি যে উনি বয়সে যতই সিনিয়র বা পেশায় শিক্ষক হোন না কেন, আসলে ওনার ভেতরটা এখনও আমাদের মতই বালিকা রয়ে গেছে। দুষ্টু এবং মিষ্টি এক বালিকা। এরকম সত্যিই খুব কম দেখা যায়।

আজকাল স্কুলটার অনেক বদনাম শুনি। লেখাপড়ার মান নষ্ট হয়ে গেছে, ছাত্রীভর্তি প্রসেসের মধ্যে অনেক পলিটিক্স ঢুকে গেছে, ক্লাসরুমে বসার জায়গা হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্যা হলো, যত খারাপ কথাই শুনি না কেন সেই মাথা নষ্ট করা দিনগুলোর কথা কোনওভাবেই ভুলতে পারি না। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা কোয়েশ্চেন পোল দেখলাম—কোন জীবনটি আপনার বেশি ভালো লাগে- স্কুল, কলেজ না ভার্সিটি? স্কুলজীবন ছাড়া যে আর কোনও জীবন এত বেশি ভালো লাগতে পারে সেটা আমার মাথায়ই আসেনি... যতবার স্কুলের সামনে দিয়ে যাই ততবারই নস্টালজিক হই, যতই স্কুলটার কথা ভাবি ততই চোখ দু'টো স্বপ্নালু হয়ে আসে।

দিন যায়, আমার প্রেম যায় বেড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪৩
৭৬টি মন্তব্য ৭৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×