২০১৭ সাল। অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম।
হঠাৎ একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ আমার হাত ধরে বললেন, বাবা আমারে দুইটা ভাত খাওয়াইতে পারো?
কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কন্ঠে নগ্ন দারিদ্রতা থাকে না, থাকে অসহায়ত্ব, লজ্জা আর বঞ্চনার শব্দ।
আমি কিছু বুঝার আগেই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো, হ্যাঁ বাবা চলেন, দুপুর তো ভাত খাবারই সময়।
সামনেই অদূরে একটা হোটেলে গেলাম। আজকের তরকারী হচ্ছে, আলু সিম আর ফুলকপি দিয়ে রুই মাছের ঝোল, লাল শাক, মুরগী, আর গরু ভুনা, ডিম আর ডাল।
জিজ্ঞেস করলাম, কি খাবেন?
তিনি কিছুটা ক্ষীন স্বরে বললেন, ভাত আর ডাল দিলেই হবে বাবা।
সানগ্লাস পড়লে আমাকে কিছুটা কঠোর মনে হয়। আমি সানগ্লাস খুলে বললাম, বাবা আপনি সংকোচ ছাড়া খান। যা দিয়ে ভালো লাগে, সেটা দিয়েই খান।
তিনি আমাকে একটা অভাবনীয় উত্তর দিলেন। বললেন, - না রে বাবা। অপচয় কত্তি নেই। এই অপচয় কইরে আজকে এই দশা। আমার ভাত, ডাল হলেই হয়ে যাবে। আজকে বেশি বেশি খালি পরে দুইদিন হয়ত না খাইয়ে থাকা লাগপে।
তিনি খেলেন, আমি দেখলাম। অল্প সামান্য যে কয়টা দাঁত আছে, তা দিয়ে আসলে ভাত চাবানো যায় না। ডালের সাথে ভাত হলে মোটামুটি গিলেই খাওয়া যায়। তাই তিনি হয়ত ডাল ভাতকেই বেছে নিয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলাম,কই থাকেন, কি করেন?
অনেক কিছুই বললেন, অনেক কিছুই শুনলাম। ঝিনাইদহ/ ঝিকরগাছা অঞ্চলে উনার বাড়ি। থাকেন, কাফরুলের দিকে, এক গ্যারেজে। গ্যারেজ মালিকই দুই বেলা খাওয়া দেয়।
জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেমেয়েরা কই?
তিনি বললেন, উনার স্ত্রী মারা যাবার পর ছেলেরা কেউ আর উনার দায়িত্ব নিতে রাজি হয় নি। প্রায় নাকি ছেলের বউ আর ছেলেদের সাথে ঝগড়া হতো। তাই একদিন বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন। কয়েকদিন রাস্তায় এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি পর এক গ্যারেজ মালিকের সাথে পরিচয় হয়। আর সেই থেকে সেখানে থাকা।
বললাম, তা কাফরুল থেকে এই দিকে কেন আসছেন?
তিনি কোন জবাব দিলেন না। চুপ করে আছেন দেখে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন কেন আসছেন এই দিকে?
দেখলাম, তার চোখে পানি। অল্প কিছু দাঁত সমৃদ্ধ মাড়ি কান্নার দাপটে আরো ভেতরে চলে গেছে। চোখ মুছে বললেন, বাবা ছেলেটারে খুব দেখতে মন চাচ্ছিলো। তাই তাদের বাসায় যাচ্ছিলাম শাহজাদপুরে। কিন্তু পরে হঠাৎ মনে হলো, এখন গেলে ভাববে আমি টাকার জন্য গেছি, আবার ঝগড়া। তাই ফেরত আসছি। এখন আর আগের মত শরীর কুলায় না। মাঝপথে কাহিল হয়ে পড়ছি।
কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠল। চোখের পানি আড়াল করার জন্য সানগ্লাস পড়লাম। অফিসে ফিরে বার বার সেই বৃদ্ধ মানুষটির কান্নামাখা মুখ আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিলো। একগাদা মানুষের চোখকে ফাকি দিয়ে কোন মতে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুছলাম। বিব্রতকর! মহা বিব্রতকর পরিস্থিতি।
আমি জানতাম তবে মনে মনে অস্বীকার করতাম যে আমি একজন দুর্বল মানুষ। কিন্তু পরিস্থিতি আজকে আমাকে বার বার চোখ মুছতে বাধ্য করে স্বীকার করালো - আমি একজন ভয়াবহ দুর্বল মানুষ।
হঠাৎ করে আব্বার কথা মনে পড়ল। সকালে সবাই উঠে গেলেও আমি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে পড়ে থাকি। মাঝে মাঝে আব্বা এসে কপালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, বাবা অফিসে যাবা না? উঠবা না বাবা?
আজ দুপুরে টের পেলাম সন্তানের প্রতি স্নেহ ভালোবাসা পূর্ন পৃথিবীর সকল বাবাদের দেখতে প্রায় একই লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৫ দুপুর ২:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




