গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং, পেশা হিসাবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্মানজনক সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ায় অনেকেই এই পেশায় যুক্ত হয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এছাড়া বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে একজন মানুষকে যে মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়, সেই চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যও অনেকেই এই পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
তবে মানুষের এই ইতিবাচক মনোভাবকে পুঁজি করে এক ধরনের নতুন ব্যবসা সৃষ্টি হয়েছে যার নাম ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কোর্স। এই কোর্সগুলোর অধিকাংশই সঠিকভাবে ডিজাইন করা থাকে না, বাজারে বিভিন্ন কোর্স এদিক সেদিক করে কোন মতে কিছু একটা দাঁড় করিয়ে অনলাইনে বা অফলাইনে সেল করা হয়। এইগুলো সবই খন্ডকালিন ব্যবসা। ধরুন কেউ ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিলো মাত্র ৪৯৯ টাকায় ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কোর্স ( কোর্সেরা, ইউডিমি ইত্যাদি)। উনি দুই ধাপে বিজ্ঞাপনে খরচ করলেন ২০০০ টাকা। এই ২০০০ টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করে লিড পেলেন ৩০০/৪০০। এর মধ্যে আপনি কোর্স বিক্রি করতে সমর্থ হলেন ১০০/১২০ জনের কাছে। তাহলে দেখা গেল মাত্র ১৫/২০ দিনের ভেতর আপনি মোটামুটি খরচ বাদ দিয়ে ৪০/৪৫ হাজার টাকা কামিয়ে ফেলতে পারছেন। আর আপনি ৫০০ টাকার কোর্স করে লাখ টাকা কামাবার স্বপ্ন দেখে যখন বাস্তবতায় আসছেন তখন তা বিবর্ণ মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আপনি যে কাজ পারেন না, সেই কাজেও র্যান্ডম বিড করে অন্য সবাইকে বিপদে ফেলছেন। এই কারনে বাংলাদেশ পৃথিবীর ফ্রিল্যান্সারদের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাব হলেও কোয়ালিটি কাজ করার মত লোক এখানে নেই বলতেই চলে। সেরা ত্রিশের তালিকায় আমাদের অবস্থান ২৯ নাম্বারে। ফলে এই ধরনের ভুল বিডের কারনে সত্যিকার ফ্রিল্যান্সাররা বিপদে পড়েন। তাছাড়া বাংলাদেশে এত দীর্ঘ সময়েও কোন ভালো স্কিল ডেভলেপমেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নি যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ফ্রিল্যান্সিং পেশা হচ্ছে স্কিল ওরিয়েন্টেড একটা পেশা। বর্তমানে আপনি যদি ভাবেন সাধারন টুকটাক এডিট বা ডিজাইন করে আপনি কাজ পাবেন - এমনটা ভাবা বাল্যখিল এবং আত্মঘাতি। আপনি যদি আপনার স্কিলের মাস্টার না হন, তাহলে লাভ হবে না। একটা উদহারণ দিচ্ছি, আপনি একটা গ্রাফিক্সের কাজ সম্পর্কে জানলেন। ক্লায়েন্ট হিসাবে আমাকে প্রচুর মানুষ নক দিয়ে বলছে - স্যার, যথাযথ সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে, আমি অমুক। আমি রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং শিখেছি। আপনি যে কাজ দিবেন তা আমি করে দিতে পারব। প্লিজ স্যার আমাকে কাজটা দিন। ( হাস্যকর মনে হলেও, ঠিক এমন পিচ আমি অনেকবারই দেখেছি এবং প্রায় ৯০% এর ভাষাই এমন)। অন্য দিকে আপনি ক্লায়েন্ট বা আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বললেন, হ্যালো! আপনি ফাইল আউটপুট চাচ্ছেন জেপিজি তে। কিন্তু এটা তো লসি ফাইল ফরমেট, আপনি ২৫৬ শেডের সব শেড ব্যবহার করতে পারবেন না। ফাইল ফরমেট ঠিক করে নিলে আউটপুট ভালো আসত।
ক্লায়েন্ট আপনাকে কাজ দিক বা না দিক, কৌতুহল বসে আপনাকে নক দিবেই। কারণ এখানে যা উল্লেখ্য করা হয়েছে তা যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ আর স্কিল না হলে জানার কথা না। এই ধরনের স্কিল আপনি এক মাস ইলাস্ট্রেটর বা ফটোশপ শিখে পারবেন না। সময়, ধৈর্য্য আর প্র্যাকটিস করলে আপনি গভীর স্কিলগুলো জানবেন তখন আপনার কাজের অভাব হবে না।
আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারনা আছে যে ফ্রিল্যান্সিং মানেই বুঝি গ্রাফিক্স আর ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা সফটওয়ার রিলেটেড কাজ। বিষয়টা এমন নয়। ধরুন আপনি একাউন্টিং ভালো জানেন, আপনিও চাইলে ফিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং এর কাজ শুরু করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি এবং পড়াশোনা। এই সংক্রান্ত বিভিন্ন সফটওয়্যার যেমন ওয়েভ, কিবিও, কিউবি ডেস্কটপ, এক্সেল, এমএসওয়ার্ড, পেরোল ইত্যাদিতে অবশ্যই দক্ষতা থাকতে হবে, প্রয়োজনে বিভিন্ন সার্টিফিকেশন যুক্ত করতে হবে যাতে ক্লায়েন্ট আপনার প্রোফাইলে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়। পাশাপাশি, বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের ফাইনান্সিয়াল গাইড লাইন বা পলেসি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে। যেমন, আমেরিকার ক্ষেত্রে Generally Accepted Accounting Principles (GAAP)
ধরলাম আপনি একাউন্ট ফিল্ডে কাজ শুরু করবেন - আগামী দশ দিন আপনি প্লীজ বিভিন্ন জব পোস্টিং গুলো পড়ুন, গবেষণা করুন। কি কি কোয়ালিফিকেশনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেটা বের করুন। এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন ঐ কোয়ালিফিকেশনের মধ্যে কোনটা আপনার মধ্যে আছে। আর যা নেই, সেটা সম্পর্কে পড়াশোনা করুন। কতদিনের ভেতর তা রপ্ত করা সম্ভব সেটা বের করুন। তারপর একটা গাইডলাইন ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সেইভাবে এগিয়ে যান।
একাউন্টিং খাতের একজন অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার ঘণ্টায় ৩৩০ - ৪০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন অন্য দিকে একজন নতুন বা অল্প অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ঘণ্টায় ২০ -৩০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
আপনি নতুন হিসাবে ভাবলেন ৫০ ডলারের কাজ আপনি ২০ ডলার পিচ করবেন, এটা যদি করেন, তাহলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন। আপনাকে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে পিচ করতে হবে। কাজ পাবার জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির দিকে যাবেন না, আপনার সকল প্রজেক্ট ট্রান্সজেকশন আপনার ক্লায়েন্টরা দেখে আপনাকে বিচার করবে। মুক্ত পেশায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধৈর্য আর লেগে থাকার মনোভাব। আপনি পরিশ্রম করলে, লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। আপনাকেই বেছে নিতে হবে আপনি কোনটা শুরু করবেন।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং কে এক সাথে গুলিয়ে ফেলেন। দুটো বিষয় কাছাকাছি বিষয় হলেও আদতে তা এক নয়। ফ্রিল্যান্সিং মূলত ব্যক্তি নির্ভর আর আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান নির্ভর। অর্থাৎ ফ্রিল্যান্সিং মূলত ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কাজ করে। ফ্রিল্যান্সার মানে মুক্ত পেশাজীবী বা যারা স্বাধীনভাবে কাজ করে।
ধরুন আপনি একাউন্টিং এ দক্ষ, এই সংক্রান্ত বিভিন্ন আধুনিক সফটওয়্যার সম্পর্কে ধারনা আছে। একদিন আমি বললাম, ভাই আপনি কাইন্ডি কি আমার প্রতিষ্ঠানের একাউন্টসটা একটু দেখে দিতে পারবেন, বিনিময়ে আপনাকে আমি ঘণ্টা প্রতি ১০০ টাকা দিবো। আপনি রাজি হলেন, কাজ করলেন এবং টাকা পেলেন। মোটা দাগে এটাই ফ্রিল্যান্সিং। আপনি একই সাথে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে পারেন। আপনার সুনির্দিষ্ট অফিস প্রয়োজন নেই, সুনির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন নেই। (তবে ভালো ফ্রিল্যান্সাররা কিছু সুনির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করেন)।
এখন ধরুন আমার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক আকার বৃদ্ধি পেলো, প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হলো। আমি চাইলাম, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা একাউন্টিং বিভাগ হোক। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, আমার চাহিদা পূরণ করতে গেলে যে দক্ষ কর্মী প্রয়োজন তা আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশ ব্যয় বহুল। একজন আমাকে পরামর্শ দিলো, ভাই তুমি তোমার প্রতিষ্ঠানের একাউন্টিং এর কাজগুলো বাইরের একটা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করিয়ে নাও। আমি বিজ্ঞাপন দিলাম, আপনি যোগাযোগ করলেন, আমাকে জানালেন আপনার প্রতিষ্ঠান আমাকে কি কি সুবিধা দেবেন, আপনার দক্ষ কর্মীদের সম্পর্কে জানালেন। সব মিলিয়ে আমি সন্তুষ্ট হয়ে আপনার চার্জ জানতে চাইলাম। আপনি বললেন, ৫০০ টাকা। আমি রাজি হলাম। আপনি কাজ শুরু করলেন -সহজ ভাষায় এটাই মূলত আউটসোর্সিং। একটা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের অনেক আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান আছে যারা বছরে ২০০/৩০০ কোটি টাকার করে।
মনে রাখবেন ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং একটি প্রফেশনাল প্লে গ্রাউন্ড। আপনি নিজেকে ঠিক মত প্রস্তুত না করে আপনাকে কাজ প্রদানের দায়ভার সৃষ্টিকর্তার উপরে চাপিয়ে দিয়ে যদি এই ফিল্ডে আসেন - তাহলে আপনি নিজের তো বটেই অন্যেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবেন। এই সকল কারণে বাজারে আমাদের বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের রেপুটেশন ইদানীং বেশ প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানে চলে গেছে এবং আমরা এই উপমহাদেশের সবার পেছনে আছি। পাশাপাশি আরো একটি সমস্যা হচ্ছে কমিউনিকেশন সমস্যা! এটা সমাধান করতে না পারলে সমস্যা আরো বাড়বে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তো প্রাগৈতিহাসিক, আমাদের পড়াশোনার মান দেখলে উন্নত বিশ্বের মানুষজন বিশ্বাস করেন যে তাঁরা টাইম মেশিনে করে কয়েক শতাব্দী পেছনে চলে গিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক ড. বি এম মইনুল হোসেন আজকে প্রথম আলোতে এই সংক্রান্ত এই লেখা লিখেছেন। বিষয়টি গুরুত্বপুর্ন বিধায় আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। উদিত হওয়ার আগেই কি অস্তমিত হবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সূর্য
যেসব দেশের ফ্রিল্যান্সারদের চাহিদা বেশি, বাংলাদেশিরা কোন অবস্থানে?
ফ্রিল্যান্সিং জগতে রাতারাতি ইনকাম বলে কিছু নাই। সময় ধৈর্য্য, ডেডিকেশন দিলে আপনি এই সেক্টর থেকে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবেন। নইলে সামনে মহা বিপদ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২০