অবশেষে টাউট সিদ্দেকের খুঁজ পাওয়া গেলো। সিদ্দিকেরা সাত ভাই। তারা সাত ভাই মিলেই বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী ভারতে পাচারের কাজ করছে। শুনেছি তারা খুবই প্রভাবশালী। অনেকেই তাদের ভয় পায়। সে প্রমাণ অবশ্য আমরা পরে পেয়েছি। আমাদের সাথে থাকা পুরুষেরা সিদ্দিকের সাথে আলোচনা করলেন। এবং জনপ্রতি ১০০ টাকা হারে নির্ধারিত হলো আমাদের ভারত যাত্রা। আমরা ভারতের লাতু শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা মোট ছিলাম ৫১ জন। এই ৫১ জন আমরা রাতের আঁধারে বড়লেখার উদ্দেশ্যে প্রথমে যাত্রা শুরু করি। কিছু হেঁটে কিছু নৌকায় পারি দিয়ে আমরা প্রায় দুই রাতে বড়লেখা পৌঁছাই। বড়লেখায় এক পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে দিনের বেলা লুকিয়ে বসে থাকার জন্য আমাদেরকে রেখে, অন্য একটি কাজে চলে যায় সিদ্দিক। অবশ্য আমাদের পুরুষদের জানিয়ে যায় যে, সমস্যা হলে তাকে কোনদিকে খুঁজলে পাওয়া যাবে। তবে সমস্যায় পরলে আগে যেন বলি “আমরা সিদ্দিকের লোক”। আমরা নীরব বসে থাকি ঘরের ভেতর।
পাশের আরেকটি ঘরে আরেক টাউটারের আরও কিছু শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ আমরা চিৎকার শুনি, পাশের ওই পরিত্যক্ত ঘরে। আমাদের পুরুষেরা দরজা খুলে বেড় হলে, আমাদের কাছে ধেয়ে আসে কিছু লোক। এদের মধ্যে যুবক থেকে বেশ বয়স্ক লোকও ছিল। এদের ধেয়ে আসা বুঝতে বাকী রইলোনা আমাদের। আমার স্বামী ছিলেন খুবই সাহসী। তিনি সাহস নিয়ে বলেন “আমরা সিদ্দিকের লোক”। তখন লোকগুলো আমাদের দরজা থেকে চলে যায়। আমরা তখন সাহস ফিরে পাই। এবং বারান্দায় কেউ কেউ চলে আসি। আমি সব সময়ই ছিলাম একটু কৌতূহলী। পাশের ঘরে কি হচ্ছে দেখার জন্য, আমিও বারান্দায় চলে আসি। দেখলাম, তারা লুটপাট চালিয়েছে। এবং তা ভয়ংকর ভাবে। মানুষগুলো তাদের শেষ সম্বল টাকা, গয়না না দেয়াতে এলোপাতারী দা’ দিয়ে কোপাচ্ছে! দেখলাম, একটি ছোট ছেলেকে বয়স আনুমানিক ১২/১৩ বছর হবে, তার গলায় দা’ দিয়ে কোপ মেরে প্রায় অর্ধেকটা কেটে দেয়। বাচ্চাটা মাটিতে লুটিয়ে পরে কাতরাতে থাকলো। তার মা-বাবা আহাজারি করছে। ভয়ে অন্য লোকগুলো নড়তেই পারছেনা। রক্তে উঠোন ভেসে যাচ্ছে! তখন ভয়ে আমরা আমাদের ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেই। কিছুক্ষণ পর, ওরা চলে যাওয়ার পরে, দরজা খুলে এসে দেখতে পাই, কিছু লোকের মারাত্মক জখম হয়েছে। আর লাশ হয়ে ওই ছেলেটির নিথর দেহ পরে আছে। তার মা-বাবা অজ্ঞ্যান হয়ে তার কাছে পরে আছে। সবাই কাঁদছে। আমরাও কাঁদছি। আমরা আবারও দরজা লাগিয়ে ঘরের ভেতর বসে থাকলাম।
............................................. চলবে......