somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিরো টলারেনস

২১ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার জন্ম নিবাস বন্দর নগরী চট্টগ্রাম হলেও ব্যবসা ঢাকা কেন্দ্রিক।মাস খানেক হোল চট্টগ্রামে কেন্দ্র করার চেষ্টা করছি। যারা গার্মেন্টস সেক্টরে চাকরী বা ব্যবসা করেন তারা জানবেন, এই সেক্টরে ফ্রি টাইম বা কাজের নির্দিস্ট সময় এবং সামাজিক জীবন, বলতে কিছু নেই। তার ওপর আবার করি স্টক লট বা লেফট ওভার গুডস এর ব্যবসা। ঈদ চট্টগ্রামেই পালন করলাম। যথারীতি ইদের একদিন পরই বের হলাম মার্কেটের কিছু পার্টি থেকে পেমেন্ট আনতে। রিয়াজ উদ্দিন বাজার, পুরান ষ্টেশনের সামনে। পেমেন্ট নিয়ে যাবো সিটি কলেজ। সাথে এক বন্ধু কাম আমার চট্টগ্রামের ব্যবসাহিক পার্টনার। পেমেন্ট নিয়ে চিন্তা করলাম একটু সর্ট কার্টে যাই। পুরান ষ্টেশনের ভেতর দিয়ে যাত্রী চলা চলের ব্রিজের ওপর দিয়ে, স্টেশন কলনির ভেতর হয়ে সোজা আইস ফ্যাক্টরি রোডের ওপর। পুরান ষ্টেশনের যাত্রী চলা চলের ব্রিজটা সাধারণ মানুষ জনের যাতায়াতের সুবিধার জন্যই স্টেশন কলোনি পর্যন্ত টেনে আনা হয়েছে। যথা রীতি ব্রিজ দিয়ে নামার সময়ই দূর থেকে হালকা চোখে পড়েছিল, হেটে হেটে কলোনির রাস্তা ধরে আসছে একজন পুলিশ।আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিলাম। সামনা সামনি হতেই জিজ্ঞাসা,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
নেইম প্লেট চোখে পড়লো, “আবু মুসা”। কাধে দুই ফুল অর্থাৎ এস,আই। বেটে খাটো পেট মোটা, শ্যমলা বর্নের সাধারন পুলিশ। গাল ভর্তি মেহেদি রাঙ্গানো সুন্নতি দাড়ি।
বললাম, “সিটি কলেজ যাবো।”
“সিটি কলেজ এখান দিয়ে কেন?”
“জ্বি সর্ট কার্ট তাই।”
“আপনারা আসেন আমার সাথে। আপনাদের সাথে কথা বলতে হবে।”
উনার পেছন পেছন হেটে কলোনির বাইরে এলাম।
কলোনির বাইরে দেখলাম পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানো। পাশে তিন জন কনস্টেবল। আমাদের দেখিয়ে,“এদের চেক করো।” বলেই রাস্তা পেরিয়ে আরেক জনকে থামালেন।
আমার কাধে ল্যাপটপের ব্যগ। ব্যগের চেনটা একটু খানি খুলতেই কনস্টেবল বললেন, “লাগবে না।” পকেট টকেট চেক করলো না।
এস আই রাস্তার ওপার থেকে বলে উঠলো, “ওদের গাড়িতে উঠা”।
এবার আমরা একটু নড়ে চড়ে উঠলাম।
“গাড়িতে কেন উঠবো? উনি তো বললেন চেক করবেন। চেক করে দেখেন কিছু পান কিনা।”
কনস্টেবল এর মাঝে থেকে একজন বলল,
“ভাই, মাদক বিরোধী অভিযান চলতেসে। এখন স্যরকে কিছু বললে মেজাজ খারাপ করবে।উঠেন যা বলার পরে বইলেন।”
উঠলাম গাড়িতে। ভেতরে আরও দুই জন অল্প বয়স্ক ছেলে বসা। একজন কালো করে, চোখে চশমা, অপর জন শ্যামলা বর্ন। কাপড় জামা দেখে বোঝাই যায় ভালো পরিবারের ছেলে। তারা দুই জনই বন্ধু। তাদের কাছেও কিছু পায়নি। রাস্তার লোকজন সব গাড়ীর ভেতরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি। একটু পরেই এস আই গাড়ীর সামনের সিটে উঠে বসেই ড্রাইভারকে বললেন, “টান দে”।
গাড়ি চলতে শুরু করলো।গাড়ি ঢিমে তালে ঘুরে ফিরে সদরঘাটে পোঁছাল। বন্দরের একটা মসজিদের সামনে থামলো। এস আই মুসা সাহেব নেমে মসজিদে ঢুকলেন। নামায পড়বেন। ড্রাইভার নেমে পেছনে এসে কনস্টেবলদের উদ্দেশ্য করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, “এদের জিগ্যেস কর কি করবে না করবে। স্যর আসলে কিন্তু থানায় নিয়ে যাবে।”
কতটা নির্লজ্জ আর ভন্ড হলে একজন মুসলমান ঘুষের ইঙ্গিত দিয়ে মসজিদে ঢুকতে পারে নামায পড়তে!!! সিজদায় যখন পড়ে একটা বারের জন্যও কি মনে ভয় আসে না?!!

আমি পার্টনারের দিকে তাকালাম। পার্টনার কনেস্টেবল এর দিকে তাকিয়ে বললো,“ভাই আমার খালু ডি আই জি, ঢাকা। আপনারা রেফারেন্স চাইলে ফোন দিতে পারি।”
কনেস্টেবল জিগ্যেস করলো, “আপনার বাড়ি কোথায়?।”
“গোপাল গঞ্জ।”
পার্টনার “গোপালী”।
চট্টগ্রামের এডীশনাল ডি আই জি আমার আত্বিয়। উপ পুলিশ কমিশনার কাজল ভাইয়ের সাথেও সম্পর্ক ভালো। চাইলে তাকেও ফোন করতে পারি।
কিন্তু কনেস্টেবল অভয় দিয়ে বলল এখন ফোন কইরেন না আগে দেখেন স্যর কি বলে।
পার্টনার অভয় অনুভব করলো, কিন্তু আমি করলাম না। কারন আমি পুলিশের নিরীহ মুখের অভয় দাণের অতীত ভুক্ত ভুগি। ২০১০ সালে এদেরই এক জাত ভাই আমাকে কিছু হবে না কিছু হবে না বলে অভয় দিয়ে, চুপ থাকতে বলে, থানার লক আপে বন্দী রেখে পর দিন পেন্ডিং কেসে কোর্টে চালান করে দেয়। পাক্কা এক বছর কাস্টডী খেটে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে জামিনে বের হই। সেদিন ঘর থেকে বের হবার সময় মাকে বলেছিলাম এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছি ।সেই এক ঘণ্টা এক বছর পর শেষ হয়। তাই আমি কোণ রিস্কে যেতে রাজি নই। আমি মোবাইলের নাম্বার লিস্ট ঘাটতে লাগলাম। কনেস্টেবল আবার বলল ফোন করা লাগবে না। আমি তাও ঘাটতে লাগলাম। এবার কনেস্টেবল যার নেইম প্লেটে নাম লিখা “নাসির” আমার হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় কেড়ে নিয়ে নিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “ভাই এটার মানে কি? আপনাদের কি লাগবে বলবেন তো? এস আই এর সাথে কথা বলেন, উনি তো কথা বলতেই চাচ্ছিলেন। বলেন। আমাদের কাছে তো অবৈধ কিছুই পান নি। এভাবে শুধু শুধু আমাদেরকে অপরাধীর মত গাড়িতে ওঠানোর মানে টা কি?”
কনেস্টেবল চুপ। তার পাশে “সুশান্ত” নামের আরেক কনেস্টেবল তার হাতের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ হাতের মোবাইলের রিং বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা সে বন্ধ করে দেয়। সাথে সাথে গাড়িতে বসা কালো ছেলেটা বলে ওঠে, “ভাই আমার বাসা থেকে ফোন করতেসে, আপনি ফোন টা বন্ধ করে দিলেন, বাসার মানুষ জন তো চিন্তা করবে।”
কনেস্টেবল নিরব।
বুঝলাম আমার মত তার মোবাইলও আগেই বাজেয়াপ্ত।
ততক্ষণে মুসা সাহেব নামায শেষ করে মেহেদি দেয়া দাড়ি গুলো ছোট চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে গাড়ির কাছা কাছি এলেন। সুশান্ত নামের কনেস্টেবল লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে তার কাছে গেলো। সাথে গাড়ীর ড্রাইভার। তিন জনে কি বলা বলি করলো শুনলাম না, দুই এক মিনিট পর কনেস্টেবল আমার পাশে এসে উঠলো, মুসা সাহেব সামনে। গাড়ি চলা শুরু করলো।
কিছু টা রাগ নিয়েই কনেস্টেবল এর দিকে ফিরে বলে উঠলাম, “কি ব্যপার ভাই? কথা বলেন না ক্যান?”
কনেস্টেবল নিরব।
কোণ মানে হয়???!!!
গাড়ি সদর ঘাট থানায় ঢুকলো।মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কপালে না জানি এবার কি আছে!
গাড়ি থেকে মুসা সাহেব নামলেন, সাথে আমাদেরও নামানো হল।সিভিলে কিছু অফিসার দাঁড়ানো। তাদের মাঝের একজন আমাদের সাথের কালো ছেলেটিকে দেখে বলে উঠলো, “তুই আবার? আবার খাইতে গেসোস??!!!”
ছেলেটি রীতি মত আর্ত নাদ করে উঠলো, “ভাই আমার বাসাই তো অইখানে।”
কে শোনে কার কথা।
অন্যান্য অনেক অফিসারও চিনতে পারলো। তাকে আগেও থানায় আনা হয়েছিল। অবশ্য চিনতে পারলো নাকি চেনার ভান করলো বোঝা মুশকিল।
“এই শালার পুত তো বাবা খোর, এই দুইটা?!!”(মানে আমরা)
কনেস্টেবল জবাব দিলো, “এরা ফেন্সি খোর। ফেন্সি খাইতে আইসিল।”
চমকে উঠলাম। মানে কি?
সব এস আই খিক খিক করে হাসতে হাসতে আমাদের টিট কারী মারতে লাগলো।
মুসা সাহেব বীরদর্পে আমাদের নিয়ে থানার এন্ট্রি রুমে ঢুকলেন। সেখানে দুই টা টেবিল। একটায় রেডিও অপারেটর অন্য টায় এন্ট্রি লিখার জন্য কনেস্টেবল বসা। সেই কনেস্টেবলকে উদ্দেশ্য করে মুসা সাহেব বললেন, “সবার নাম ঠিকানা লিখেন। এই দুইটারে (অন্য দুই জন ) লক আপে ঢোকান আর এই দুই জনকে (আমাদেরকে) এখানে টুলে বসান। ইনাদের স্পট থেকে ধরা হয়েছে। ওসি সাহেব আসলে কথা বলবেন তার পর উনাদের ব্যপারে সিদ্ধান্ত দিবেন।”
আমরা বসলাম আর কনেস্টেবল সেই দুই ছোকরাকে নিয়ে পড়লেন।
নাম? বাপের নাম? মায়ের নাম? ঠিকানা?
তারা দুই জনই তাদেরকে যে এলাকা থেকে ধরা হয়েছে সেই এলাকার স্থানীয় ছেলে। বি বি এ পড়ছে, এক প্রাইভেট বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে।
এর পর পার্টনারের পালা।
এর পর গেলাম আমি।
ব্যপারটা পার্টনারের সময়ও খেয়াল করেছিলাম, আমার সময়ে ও দেখলাম, কনেস্টেবল কিছুক্ষন পর পর নাক কুচকে উঠছে। ভোদড়ের মত মুখ করে এক সময় বলেই উঠলো, “উফম। আপনাগো মুহের থে ফেন্সিডিলের গন্ধ বারইতাসে।।”
আমি পুরাই বলদ বনে গেলাম।
ফেন্সিডিলের ভয়াবহতার স্বীকার সবচেয়ে বেশি হয় আমার প্রজন্ম।আমাদের ব্যচের ৩০% এক্সট্রিম পর্যায়ের এডীক্ট হয়ে জীবন নষ্ট করে ফেলেছে, ৫০% মাদকাসক্ত অবস্থা থেকে ফিরে আসতে পেরেছে,৫% এখনো সেবন করে যাচ্ছে, ৫% অকেশনালি খাচ্ছে, ৭% একবার হলেও খেয়েছে আর বাকি ৩% কক্ষনো না খেলেও, খেতে কেমন বা খেলে কি কি হয় তা সম্পর্কে ভালো রকম ধারনা রাখে। সুতরাং ফেন্সি ডিলের ব্যপারে আসক্ত ব্যক্তি ছাড়া, আমাদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানবে বলে আমার মনে হয় না। এই আমরাই কখনও জানলাম না ফেন্সিডিলের গন্ধ খাবার পর মুখ দিয়ে বের হয়।
ফেন্সিডিলের মুল সমস্যাগুলর একটি হচ্ছে এর সেবনকারীকে দেখে বা রক্ত পরীক্ষা করে বোঝার কোণ উপায় নেই। সে জায়গায় কনেস্টেবল রীতি মত গন্ধের কারনে আমাদের সাথে কথাই বলতে পারছে না!!!
যাক একটু দূরে গিয়ে টুলে বসলাম।
এর মধ্যে এস আই মুসা কনেস্টেবলকে বললেন,“আমি ডিউটি তে যাচ্ছি। ঐ দুজনের অবিভাবক আসলে মুচলেকায় সাইন করিয়ে ছেড়ে দিও(সেই ছেলে গুলো যারা তখন লকআপে) আর উনাদের (আমাদের) ব্যপারে অসি স্যর সিদ্ধান্ত দিবেন।”
মনে মনে কিছুটা হাফ ছাড়লাম। যাক এ যাত্রা বোদহয় উলটা পাল্টা কিছু হবে না।
কিছুক্ষন পর সেই কালো ছেলেটার বাবা এলেন।
কনেস্টেবলকে জিগ্যেস করলেন। কনেস্টেবল দাত কেলিয়ে উত্তর দিলো, “আপনার ছেলে? আপনার ছেলে তো ইয়াবা খায়। ইয়াবা খাইতে যাইয়া ধরা খাইসে। আর অরা(আমাদের দেখিয়ে) ফেন্সি পার্টি।”
কি কিম্ভূত মুসিবত রে বাবা!!!!
আমারা কাচু মুচু মুখে বসে আছি।
ভদ্র লোক আবার শুধালেন, “আচ্ছা এখন কি করতে হবে?”
“কি আর করবেন। কেস দিয়া দিবে। কালকে চালান হবে কোর্টে।”
“ভাই কিসূ কি করা যায় না?”
“ডিমান্ড হাই।”
“কত?”
কনেস্টেবল খাতায় একটা এমাউন্ট লিখলেন, “এত”
ভদ্রলোক বললেন, “ভাই আমার কাছে এখন পনেরো হাজার টাকা আছে। এটা দিলে হয় না?একটু কথা বলেন না ভাই।”
কনেস্টেবল ফোন দিলেন। এস আই মুসা কে। কারন উনি ই ধরেছেন।
“ও স্যর উনি তো পনের কয়।”
স্যরের কথা কিছুক্ষন শুনে ফোন রেখেই বললেন, “হবে না। স্যর কেস লিখতে বলসেন।সব গুলা চালান হবে। ওরা সহ।যান যান।”
বলেই উঠে কেস লিখার জন্য সাদা পাতা খুজতে লাগলেন।
আবার ভদ্র লোকের অনুরধ, “ভাই ইদের পরের দিন। মানুষের হাতে ক্যশ কি থাকে? আমি ভাই আরও পাচ মেনেজ করে আনছি। টোটাল বিশ হাজার দিচ্ছি, ছেড়ে দেন।”
কিছুক্ষন গাঁই গুই করে কনেস্টেবল বললো, “আধা ঘন্টার মধ্যে আনতে হবে না হলে এর পর ওসি স্যর চলে আসবেন। ওসি আসলে আর পারবো না।”
ভদ্র লোক তারা তারি রওনা দিলেন।
পুলিশকে এর আগেও আমি টাকা ডাকাতের মত ছিনিয়ে নিতে দেখেছি, ভিখারির মত মেঙ্গে নিতে দেখেছি কিন্তু সবই থানার বাইরে। এই প্রথম সাথে কিছু না পেয়েও, সন্দেহ বশত ধরে নিয়ে আসার মত ছোট খাটো আসামির কাছ থেকে, থানায় বসে, রীতি মত দর দাম করে টাকা নিতে দেখছি।

আমাদেরকে ধরা হয়েছে দুপুর তিনটায়, এখন মাগ্রিবের আজান দিচ্ছে। ওসি সাহেব কখন আসবেন তার ঠিক নাই। এর আগে যদি কিছু দিয়েও তাড়া তাড়ি মুক্তি পাওয়া যায় সে আশায় কনেস্টেবল এর সামনে গিয়ে আহ্লাদি সুরে বললাম, “ভাই আমাদের ব্যপারেও মুসা সাহেব কে একটু জিজ্ঞাসা করেন না! যদি কিছু বলে, তাহলে একটা ব্যবস্থা করলাম।”
কনস্টেবল ভোঁদড়ের মত মুখে আবার বললো, “দূর ভাই। যান তো।”
আমার পার্টনারও বার কয়েক চেষ্টা করে ভোঁদড় মুখো ঝাড়ি খেয়ে ফিরে এলো।
আমি এবার ওয়্যারলেস অপারেটর সাহেবের দিকে নজর দিলাম, “ও ভাই।”
অপারেটর সাহেব এ টুকুতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “আপনাদের ভাই বিবেক বলতে কিসু নাই। দেখতেসেন কাজ করতাসি। সম্মান দিয়া টুলে বসাইসি তো, ভাল লাগতাসে না। অগর মত লক আপে ঢুকাইলে ভালো লাগতো।”
এবার কনেস্টেবল সাহেবও হুঙ্কার দিলেন, “আরেক বার কথা কইলে দুডারেই লক আপে দেমু। তহন বুজতে পারবেয়ানে।”
আমি আর কথা বাড়ানো নিরাপদ মনে করলাম না। বাংলা ভাষায় সম্মানের “গিয়ার” সর্বচ্চ থেকে সর্বনিম্ন যথাক্রমে, আপনি>তুমি>তুই। চোখের পলকে সর্বচ্চ গিয়ার থেকে সর্বনিম্ন গিয়ারে নেমে যাওয়ার নির্লজ্জ ক্ষমতা কেবল বাংলাদেশের পুলিশেরই আছে। তাই ধৈর্য্য ধারন করে প্রাপ্ত "বিরল" সম্মান (টুলে বসার অধিকার) বজায় রেখে বসে থাকাটাই শ্রেও মনে করলাম।
কিন্তু আমার পার্টনারের অত ধৈর্য্য নেই। সে মোবাইল বের করে এক ফাকে ডি আই জি খালুর ছেলেকে ফোন করে দিল। ছেলে অভয় দিল সে আসছে।
এর মধ্যে সেই ভদ্রলোক টাকা নিয়ে এলেন। কনেস্টেবল এর সামনে বসে পকেটে হাত দিতেই কনেস্টেবল হা হা করে উঠলো, “এহানে না। বাইরে চলেন।”
এই প্রথম খেয়াল করলাম কোনায় একটা সি সি ক্যমেরা নজর রাখছে। বাইরে লেন দেন সেরে কনেস্টেবল ভদ্রলোক কে নিয়ে হাস্য মুখে ফিরে এলো।
“বো ঝলেন, এহন তো অভিযান চলতে য়াসে, সপ খানে করা করি। তা ও আপনের ডা আমি রিক য়েস্ট ক ইরা কম করা ইসি। এই অগো রে লইয়ে এ আয়।”
সেখানে আরেক জন চাকমা কনেস্টেবল আছেন যিনি আসামি লক আপে আনা নেয়া করছেন সাথে অন্যদের ফুট ফরমায়েশ পালন করছেন। নামটা পড়তে পারি নি। চাকমা কনেস্টেবল গিয়ে পরক্ষনেই কিঞ্চিৎ উত্তেজনা নিয়ে আবার ফিরে এলেন।
“স্যর। চেলে গুলা বেদ্দপ। আমি আনতে গেসি নি, আমারে বলতেসে, কি একন সারতেসেন কেনো, কত টাকা কাইসেন?? এরকম বলতে সে যে স্যর!!”
স্যর অর্থাৎ কনেস্টেবল চুপ। চাকমা কনেস্টেবল আবার শুধালেন,
“স্যর, সুন সেন নি কি ব ল তেসে?!”
স্যর অর্থাৎ কনেস্টেবল এবার কাগজে কি লিখতে লিখতে বললেন, “আরে লইয়ে আয়।”
চাকমা কনেস্টেবল আবার ছুটে গেলো। সে বোধহয় নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল ছেলে গুলোর পেমেন্ট হয়ে গেছে কিনা।ছেলে গুলোকে নিয়ে আসা হোল। বাবা ভদ্রলোক এবার মৃদু তিরস্কার করলেন ছেলেকে। ছেলে নির্লিপ্ত মুখে তার জিনিস পাতি বুঝে নিচ্ছে। বেল্ট, মানি ব্যগ, আংটি, ব্রেস্লেইট, খারু, একটা মোবাইল। পর ক্ষনেই বলে উঠলো, “আমার মোবাইল আরেকটা কই?”
কনেস্টেবল, “আর সে লো?”
“আরে আই ফোন টা। গাড়ীর কনেস্টেবল নিসিলো প্রথমেই, ওইটা কই?”
বাবা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কনেস্টেবল এর দিকে তাকালেন। কনেস্টেবল ফোন করলেন। যা সম্ভব এস আই মুসাকে। কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে বললেন, “কালকে সকালে আপনি থানায় এসে আমার কাচ থেকে মোবাইল টা নিয়ে যাইয়েন।”
ভদ্রলোক সম্মত হয়ে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
যেখানে মুচলেকা দিয়ে ছেলে কে ছাড়িয়ে নেয়ার কথা সেখানে নগদ বিশ হাজার টাকা নগদ আর এন্ট্রি ছাড়া “আই ফোন” রেখে গেলেন।
আমরা বসে রইলাম।
ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে। চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
এমন সময় হাতে হ্যন্ড কাফ লাগানো শুকনো টিং টিঙে যুবক বয়সী আসামি নিয়ে সিভিলে এক অফিসার প্রবেশ করলেন। আসামিটিকে আমাদের পাশে বসিয়ে চাকমা কনেস্টেবলকে আদেশ করলেন হ্যন্ড কাফ খুলে দিতে। চাকমা কনেস্টেবল হ্যন্ড কাফ খুলতেই যুবকটি ইতস্তত স্বরে বলল, “ভাই একটু পানি খাওয়াবেন?”
কনেস্টেবল পানি আনতে গেলো। পার্টনার খাটো গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাই কি হইসিল? ধর সে ক্যন?”
“আর কইয়েন না ভাই। ঘর তে বাইর হয়ে ফোন দিলাম কাউন্টারে(মাদকের স্পট), কইল মাল আসে আসেন। গেলাম। ঢুকার মুখেই ধরল সিভিলে। আপনারা মাল পাইসিলেন ভাই?”
আমি পার্টনারকে কনুইর গুতা দিয়ে একটু সরে বসলাম। পার্টনারও শুন্য দৃষ্টিতে কড়ি কাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। যুবক আবার শুধাল,
“ভাই আপনারে তো প্রায়ই দেখি। আপনার একটা গাড়ি আসে না ভাই?!”
এবার পার্টনারও আমার দিকে সরে এলো।
যাহ বাবা। এবার পুলিশের সাথে সাথে মাদকাসক্ত ব্যক্তি রাও আমাদেরকে মাদক সেবী হিসাবেই ঠাউরেছে। বুঝতে পারলাম যুবকের মাথার তার একটাও আর অবশিষ্ট নাই। যা সম্ভব ইয়াবা সেবী।
কিছুক্ষন পর কনেস্টেবল তাকে সর্বনিম্ন গিয়ারে ডাক দিলো, “ওই এদিকে আয়, নাম ঠিকানা বল। কি খাস? দেহি জিহ্বা দেহি, এইতো ...নকির পোলা বাবা খাইতে খাইতে সব শেষ করসস।”
যুবকটি নাম ঠিকানা বলল। অদিকে চাকমা কনেস্টেবল তার পকেট থেকে সব কিছু বের করে টেবিলে রাখতে লাগলো। আচমকা যুবকের বেল্ট ধরে টান দিলে, যুবক মৃদু প্রতিবাদ করলো, “স্যর পেন্ট ঢিলা, বেল্ট খুললে পইড়া যাবে।”
চাকমা “স্যর” সম্বোধন শুনে আরও উত্তেজিত।
“দুর ব্যডা কোল বেলত কোল”
যুবক বেল্ট খুলে দুই হাতে প্যান্টটা ধরে রাখলো। প্যন্টটা আসলেই অনেক বড়। খুলে পড়ে যাচ্ছে। দুই হাতে প্যন্ট ধরা অবস্থায় নাম ঠিকানা বলা শেষ করলো। তার পর করুন মুখে কনেস্টেবলকে অনুরধ করলো, “স্যর একটা দড়ি হইলেও দেন, প্যান্টটা বান্ধি।”
কনেস্টেবল কিছুক্ষন তাকিয়ে হুঙ্কার দিলো, “দড়ি নাই। বর পেন্ট প ড় সো কেন। ওই যা ল ঈয়ে যা।”
চাকমা কনেস্টেবল টানা টানি শুরু করলো। যুবক দুই হাতে প্যন্ট টা ধরে হাঁটা শুরু করলো। লক আপ।
কনেস্টেবল আমাদের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বললো, “দেক সো নি অবস্তা ডা? হালার বাবা খোর।”
আমরাও কনেস্টেবল এর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার আশায় দাত বের করে সায় দিলাম।
কনেস্টেবল এর মাথার ঠিক পেছনেই একটা স্টিকার লাগানো। তাতে লিখা “মাদকাসক্তরা অপরাধী নয়, তারা অসুস্থ। তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন।”
আবার বসে থাকা।
আট টার দিকে ডি আই জি পুত্রের আগমন। বয়স ২৫/২৬ হবে। লম্বা চওড়া দেহের গড়ন, গায়ের রঙ্গ কিছুটা বেশি ই কালো। স্কুল বা কলেজে প্রতি টি ক্লাসেই একটা মোটা ছেলে, একটা শুকানা ছেলে আর একটা বয়সের তুলনায় যুবক টাইপের অকাল পক্ক শরিলের, যাকে বলা যায় “দামড়া” টাইপের ছাত্র থাকবেই থাকবে। আমি নিশ্চিত সে তার ব্যচের সেই “দামড়া”। গট গটিয়ে থানায় ঢুকলো। কনেস্টেবল এর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “ওদের কে যিনি ধরেছেন তার নাম্বার টা দিন।”
কনেস্টেবল নাম্বার দিলে কানে ফোন লাগিয়ে ডি আই জি পুত্র বাইরে গেলো কথা বলতে। এদিকে আমার মাথায় তখন ঘুরছে, “টলারেন্স” তো “জিরো”। এমনি তে সাথে কিছু পায় নি। ওসি আসলে কনভেন্স করার একটা চান্স আছে। কিন্তু “জিরো” “টলারেন্স” এ ডি আই জি র রেফারেন্স যদি হিতে বিপরীত হয়?!
মুখের ওপর হয়ত মুসা সাহেব বলে দিলেন, “জিরো টলারেন্স। ডি আই জি .োদা র সময় নাই। চাকমু লকআপে ঢুকা।”
ধুর। আর চিন্তা করতে ইচ্ছা করছে না। যা হবে হোক।
কিছুক্ষণ পর ডি আই জি পুত্র হাসি মুখে ঢুকে, একটা চেয়ার টেনে আমাদের সামনে বসলো,
“সমস্যা নাই ভাই। এস আই মাই ডিয়ার মানুষ। শুনেই বললেন,
“বাবা তুমি বসো আমার ডিউটি ৮টায় শেষ করেই আমি এসে ব্যবস্থা নিচ্ছি।” তাছাড়া আমার বাবার আন্ডারে চাকরী করে নাই এমন অফিসার আমি খুব কমই পাইসি।”
শেষের বাক্যটি কনস্টেবল এর দিকে তাকিয়ে বলা।কনস্টেবল বাবার নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। জবাব শুনে খুব একটা বিকার দেখা গেলো না। কনস্টেবলের দোষ দেব না, তার ভাব সাব দেখে আমারি হাসি পাচ্ছিল।
যা হোক এস আই মুসা সাহেবের জন্য আমরা বসে রইলাম।
ডি আই জি পুত্র পার্টনারের সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠলো।
নয়টা বাজে। ওসি চলে এসেছে। এস আই মুসার কোণ খবর নাই। আস্তে আস্তে ধৈর্যের বাধ ভাঙছে সবারই। এর মাঝে অয়ার্লেস অপারেটর দুই একবার আপত্তি করে উঠলো ডি আইজি পুত্রের কথার আওয়াজে। ছেলেটার গলার ভয়েজটা আসলেই বিকট। তার ওপর ননস্টপ কথা বলেই যাচ্ছে। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি মুসা সাহেব ইচ্ছা করেই দেরি করছেন। পার্ট নার একসময় অধৈর্য হয়েই বলে উঠলো,“ভাই তোমার কথা মনে হয় মুসা সাহেব পাত্তা দিচ্ছে না।”
ডি আই জি পুত্র গম গম করে উঠলো, “কি যে বলনা তুমি।পাত্তা দিবি না মানে। থানায় আগুন লাগায় দেবো না!!!”
আবার ফোন কানে নিয়ে কথা। এক পর্যায়ে একটু জোরে জরেই কথা বলা শুরু করলো। ওয়্যারলেস অপারেটর এবার চিৎকার করে উঠলো, “এই মিয়াঁ আপনার সমস্যা কি? বসতে পারেন না আপনি?”
ব্যস। আতে ঘা লাগলো পুত্রের।
“আপনার ব্যবহার এরকম ক্যান? মানুষের সাথে ব্যবহার ভালো করেন।”
এক কথা দুই কথার পর তুমুল ঝগড়া। দুইজনেই রুমের বাইরে তাই দেখতে পাচ্ছিলাম না, শুধু গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
আওয়াজ শুনে ওসির পি এ ছুটে এলো।
ডি আই জি পুত্র, পিতার পরিচয় দিয়ে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলো। পরক্ষনেই পি এ ধমক দিয়ে উঠলো, “চো ও প।”
সব চুপ। অপারেটর রুমে ঢুকল, সাথে পুত্র ধন পেছনে ওসির পি এ।
পি এ, “আপনি (পুত্র ধন) বসেন। এই উনার নামে জিডী করো। থানার পরিবেশ নষ্ট করতেসে।”
পুত্র ধন চেয়ারে বসেই মোবাইল কানে। অপাশ থেকে ধরতেই নাকি সুরে বলে বলে উঠলো, “আম্মু। @#@## ভাইয়া রে পুলিশে সন্দেহ বশত ধইরে নিইয়ে আইসে সদর ঘাট থানায়, বুজসো। ভাইয়া রিকয়েস্ট করায় আমি আইসিলাম, আব্বার পরিচয় দিসি, তারপরেও ইরা খারাপ ব্যব হার করতিসে। এখন আমার নামে বলে কি জি ডি করবে। আমারে ও বলে আটকাবে……...।”
পি এ একটু নড়ে চড়ে বলে উঠলো, “ এই আপনি মিথ্যা কথা ক্যান বলছেন?”
পুত্র ধন,”আমি আপনাদের নামে কম প্লেইন করবো। লেখেন কি লিখ বেন।”
এবার অপারেটর, “ছার, ছেলেটা আসলেই বেয়াদপ। দেখেন সে ইনাদের জন্য আসছে। ইনারা কি সুন্দর ভদ্র ভাবে বসে আসে। আর সে লাফাইতাসে। ইনাদের জিজ্ঞেস করেন আমরা কোণ খারাপ ব্যব হার করসি কিনা?!! ভাই আপনারাই বলেন আপনাদের আমরা এই খানে সম্মানের সাথে বসাই সি না?!! কোণ খারাপ ব্যবহার করসি?”
আমরা সম্মতি দিয়ে পুত্র ধনের দিকে হাল ছেড়ে দেয়ার মত একটা ভঙ্গী করে তাকালাম। “উফ কি যে হবে এই ছেলেটার” এমন একটা ভাব।
পিএ এবার আমাদের বললেন, “আপনারা আমার সাথে আসেন। আর অর নামে জি ডি কর”।
আমরা পি এ র পেছন পেছন ওসির রুমে ঢুকলাম। ওসির বয়স খুব একটা বেশি না। ফরসা দো হারা গড়ন। আমরা ঢুকে সামনে দাড়াতেই বললেন, “দেখি, জিহ্বা দেখি।”
দুজনেই কালী মা র মত এক হাত জিহ্বা বের করলাম।
দেখে কি বুঝলেন বুঝলাম না, সামনের সোফা দেখিয়ে বসতে বললেন। পি এর দিকে ফিরে বললেন, “ওইটা কই? ডাকেন।” অর্থাৎ পুত্র ধন।
একটু পরে পুত্র ধনের প্রবেশ। তাকে বসতে বলেই শুরু করলেন, “আপনার বাবা ডি আই জি, আপনি থানায় এসে প্রথমে দেখা করবেন আমার সাথে অথবা সেকেন্ড ইনচার্জ এর সাথে। সেটা না করে সাধারণ কনস্টবলদের সাথে কথা বললে, তারা তো আপনার রেফারেন্স এর মুল্য দিবে না বা তারা বুঝবে না।”
যুক্তি সঙ্গত, মলম সুলভ কথা।
এবার ফিরলেন আমাদের দিকে।
“আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“জ্বি সিটি কলেজ।”
“অখান দিয়ে ক্যান?”
“আমরা আসলে রিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে আসছিলাম তো, ওদিক দিয়ে সর্ট কার্ট হয় তাই।”
“রিয়াজ উদ্দিন বাজার ক্যান?”
“একটা পেমেন্ট আনতে।”
“আজকে তো সব বন্ধ।”
“জ্বি পেমেন্ট টা ইদের আগের দিন হওয়ার কথা ছিল। সেদিন ঝামেলা থাকায় এক দিন পর অফিশিয়ালি নিচ্ছিলাম।”
“আপনারা যেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন সেটা চট্টগ্রাম শহরের সব চেয়ে প্রাচীন এবং স্ট্রং মাদকের স্পট। আমরা অনেক কষ্টে এবার এটা বন্ধ করতে সমর্থ হয়েছি। তাই ওই জায়গায় বাইরের কাউকে দেখলে চার্জ করবে। এসব জায়গা দিয়ে যাওয়া আসা করাটা আপাতত বন্ধ রাখবেন। আর তাছাড়া সব পুলিশ এক রকম না। সব পুলিশের আই কিউ এক না। আমি আপনাদের পেলে হয়ত চেক করে ছেড়ে দিতাম, থানায় আনতাম না। কিন্তু আপনাদের যে ধরেছে তার আই কিউ তে সেটা হয়ত কাজ করে নি বা করবে না। তেমনি সবার ব্যবহার ও এক রকম হবে না।”
এ পর্যায়ে পি এ সাহেব বলে উঠলেন, “স্যর, উনাদের সাথে কিন্তু ভালো ব্যবহার ই করা হইসে। লক আপেও ঢোকাই নাই। অফিসে বসাইসি।উনিই খালি খালি রাগা রাগি করতেসে।”
“এই তো দেখেন আপনাদের কিন্তু লক আপে ও ঢুকায় নাই।”
আমরাও বিগলিত হয়ে সম্মতি জানালাম। মনে মনে বললাম, “ভাই জান, আপনারা যে টাকে আপনাদের দয়া বলছেন, সেটা আমাদের সংবিধানিক অধিকার।”

পুত্র ধনও কিছু বলতে চাচ্ছিল পার্টনারের ইশারায় চুপ মেরে গেলো। ওসি সাহেব পি এ কে বললেন, “উনাদের নাম ঠিকানা লিখে, নিচে লিখবা সুস্থ দেহে ইনার(পুত্র ধন) জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নিচে সবার সিগনেচার নিবা। যাও। আপনারা চলে যান।”
ধন্য বাদ দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
বেরতেই দেখি মুসা সাহেব। হাসি মুখে হাত মিলালেন।
“চলে যাচ্ছেন ! যান ভাই খোদা হাফেজ।”
পুত্র ধন মুসা সাহেব কে আঙ্কেল আঙ্কেল করে যাবতিয় ইতিহাস বর্ননা করছে। আঙ্কেল ও অর্থাত মুসা আঙ্কেল হাসি মুখে তার আব্দার শুনছে। এক পর্যায়ে জিম্মা নামায় দস্ত খত করতে ভেতরে ঢুকলো। আমরা বেরিয়ে এলাম। ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে দশটা। বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরিয়ে পুত্র ধনের জন্য অপেক্ষা করছি। পুত্র ধন তার মডিফাইড করলা কার নিয়ে বেরোল। কারের ফ্রন্ট গ্লাসে কাগজ সাঁটানো “পুলিশ”। লিফট অফার করতেই উঠে বসলাম।
পুত্রধন অকথ্য ভাষায় ওসি সহ পুরা থানার পুলিশের মা বাপ উদ্ধার করছে। সাথে তার সাথে কবে কোণ পুলিশ অফিসার বেয়াদবি করেছে এবং তার চৌদ্দ গুষ্টির কি হাল সে করেছে তার ফিরিস্তি।
কিছু দূর গিয়ে বলে উঠলো, “ভাইয়া তেল ভরতি হবে। টাহা আসে?”
পার্টনার হাসি মুখে বলল, “আরে ব্যাপার না। পাম্পে ঢোকাও।”
বাসায় নামলাম। পুত্র ধনকে ধন্যবাদ দিলাম। সিঁড়ী দিয়ে উঠতেই মনে পড়লো আজকে বউ বাচ্চা নিয়ে শশুর বাড়ি যাওয়ার কথা। সে যায় গায় আমার মোবাইল ছিল বন্ধ। ঢুকতেই বউয়ের প্রাপ্য ঘেন ঘেনানি। ছেলেটা ঘুম। গোসল করলাম, ভাত খেলাম। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালাম।
তৃপ্তি বোধ করছি। বিপদ থেকে বেচে ফিরলে যেমন তৃপ্তি অনুভব হয়, তেমন।
কি অদ্ভৎ।
দেশকে মাদকের ভয়াল কবল থেকে বাচাতে যারা অগ্রনি ভুমিকা পালন করছে সেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের থানা থেকে, বেরুতে পেরে আমি তৃপ্তি অনুভব করছি!!!!!!
সি এম পি , “নিরাপত্তায় আস্থার ঠিকানা।”
আমাদেরকে যেখান থেকে ধরা হয়েছে মাদকের স্পট তার থেকে দুই গলি পরে। দুই জন মাদক ব্যবসায়ী সেখানে ক্রস ফায়ারে মারা গিয়েছে। পুলিশের তথ্য মতে স্পট তারা বন্ধ করতে পেরেছে। তার পরেও বিক্রি চলছে মোবাইলে মোবাইলে (মাদকাসক্ত ছেলেটির ভাস্যানুসারে )।কিন্তু স্পট আর নেই। সুতরাং স্পটে যারা মাদক আগে বিক্রি করতো তারা ভুলেও স্পটের দিকে যাবে না। যেহেতু মোবাইলে যোগাযোগের মাধ্যমে বিক্রি চলছে। তাহলে স্পটে বা আসে পাশের এলাকা গুলোতে কারা আসছে? সাধারণ পথচারী বা কিছু মিস কমিউনিকেটেড মাদকাসক্ত। আমি আজকে ছিলাম সাধারণ পথচারী। গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের, কর প্রদান কারী, প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। বাংলাদেশের যে কোণ রাস্তা ব্যবহার করার সাংবিধানিক অধিকার আমার আছে। তেমনি পুলিশেরও অধিকার আছে রাস্তা থেকে আমাকে সন্দেহ বশত চেক করার বা গ্রেফতার করার বা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত থানায় আটকে রাখার। ৫৪ ধাঁরা এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০(সংশোধিত ২০১৪) অনুসারে পুলিশের সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু সংবিধান সেই সাথে আমাকে ৩৪ অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপারে পদ্ধতিগত সুরক্ষা দিয়েছে।
“গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাশীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া পুনরায় আটক রাখা যাবে না এবং গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।”

সেই সাথে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০(সংশোধিত ২০১৪) আইনের, “বেআইনী বা হয়রানিমূলক তল্লাশী ইত্যাদির দণ্ড” অনুচ্ছেদ অনুসারে,
(২৪) যদি এই আইনের অধীন তল্লাশী, আটক বা গ্রেফতার করিবার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন কর্মকর্তা-
(ক) সন্দেহ করিবার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে এই আইনের অধীন তল্লাশীর নামে কোন স্থানে প্রবেশ করেন ও তল্লাশী চালান,
(খ) অযথা বা হয়রানিমূলকভাবে এই আইনের অধীন বাজেয়াপ্তযোগ্য কোন বস্তু তল্লাশী করিবার নামে কোন ব্যক্তির কোন সম্পদ আটক করেন,
(গ) অযথা বা হয়রানিমূলকভাবে কোন ব্যক্তিকে তল্লাশী করেন বা গ্রেফতার করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন৷

আজকে সদর ঘাট থানায় আমরা দুই জন, সেই ছেলে দুইজন আর পরবর্তিতে গ্রেফতার করে আনা যুবক টি,এই ছয় জন মানুষের কাউকেই তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়ার নির্দিস্ট কারণ জানানো হয় নি। এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি আমাদের পরিবার বা উকিল কে জানাতে দেয়া হয় নি।
এত এত ট্যক্সের টাকা খরচ করে এত বড় মাদক বিরোধী অভিযান হচ্ছে। জন গনের টাকায় লালিত পালিত ও প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড ব্যবহৃত হচ্ছে, জন গনের টাকায় কেনা গুলিতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক ব্যবসায়ীর নামে কিছু নির্দোষ লোকের প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হচ্ছে, অথচ জনগনের টাকায় বেতন ভুক্ত, জন গনের এই চাকর শ্রেণিটিকে(পুলিশ), আরও সামান্য কিছু জন গনের টাকা খরচ করে হলে ও সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ এবং মাদক আইনের “বেআইনী বা হয়রানিমূলক তল্লাশী দন্ডের” ধাঁরা গুলো কি তোতা পাখির বুলির মত অন্তরে গেথে দেয়া যেত না!!!!!!!!
আর সামান্য কিছু টাকা খরচ করে হলে ও কি এস আই মুসার মত এস আইদের “আই কিউ” একটু বাড়ানো যেত না!!!!!!
আর সামান্য কিছু টাকা খরচ করে হলে ও কি কনস্টেবল লেভেলের কর্মচারি গুলোকে ন্যুন তম সহবত শেখানো যেত না!!!!!!!
যে কোণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে, আইন বানিয়ে সে আইন বল বত রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ে কর্ম রত ব্যক্তির, ব্যক্তি গত সততার ওপর নির্ভর করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে,
মাত্র বিশ হাজার টা টাকার জন্য একজন এস আই কেন এত টা নিচে নামবেন?!! তার নৈতিকতা বলতে কি কিছুই নেই! আমি জানি না শেষে আসা যুবকটির কাছ থেকে কত টাকা নেয়া হয়েছে। তাকে দেখে মনে হয় নি খুব একটা সমর্থবান পরিবারের ছেলে। যদি ডি আই জি পুত্রের আগমন না হত তাহলে আমাদের কেও হয়ত সম পরিমাণ টাকা গুনতে হোত। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাটানো সাত ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সদর ঘাট থানার উপার্জন হত ন্যুনতম ষাট হাজার টাকা। “থানার উপার্জন” বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারন টাকা চাওয়ার স্টাইলেই বোঝা যায় ওপরের লেভেলের সম্মতি ছাড়া একজন সাধারণ কনেস্টেবল ক্যামেরা লাগানো কক্ষে বসে এই সাহস অন্তত করবে না।
অতি উৎসায়ি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাদক বিরধি অভিযান মাদক পুরা পুরি বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাবার পক্ষ পাতি। মানে অনির্দিস্ট কালের জন্য আমরা প্রশাসনের এই কর্মচারীদের টাকা কামানোর মেশিন হিসাবে ব্যবহৃত হব।কারন মাদক এই ধরনের অভিযান করে নির্মুল করা যাবে না। আগে মাদক সেবীদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ যেদিক দিয়ে চলা চল করতে ভয় পেত, এখন পুলিশের অত্যাচারে সেদিক দিয়ে চলা চল করতে ভয় পাবে। আমাদের কাজই হচ্ছে ভয় পাওয়া। কিন্তু কত দিন?
সিগারেট শেষ করে রুমে ঢুকলাম। আমার আড়াই বছরের ছেলেটা ঘুমুচ্ছে। নিশ্চিন্ত ঘুম। কি নিস্পাপ সুন্দর। সব বাবার কাছেই তার সন্তান সুন্দর। শ্রেস্ট সন্তান।আজকে থানায় আসা সেই ছেলেটি শিশু অবস্থায় যখন ঘুমাত, তার বাবার চোখেও নিশ্চয় এমনই লাগতো। গর্বিত ভাবে মায়া নিয়ে তিনিও নিশ্চয় অপলক তাকিয়ে থাকতেন। কেমন লেগেছিল তার যখন কনেস্টেবল টিটকারী আর ঘেন্না নিয়ে বলেছিল, “আপনের পোলা তো শেষ। ইয়াবা খায়। আপনে খবর রাখেন না মিয়াঁ?”
বাবার সামনে ছেলেকে অপমান করা অথবা ছেলের সামনে বাবা কে ছোট করাটা কি খুব বেশি ই জরুরি। হোক না সে মাদকাসক্ত বা আসামী।
দিশে হারা বাবার মাথা নত করা ছাড়া কি বা করার ছিল!!
পাচ বছর আগে আমার বাবারও মাথা নত করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
আমাকেও কি মাথা নত করতে হবে?!!
ছেলেটা ঘুমের মধ্যে মুচকি হাসছে। হাসলে ডান গালে টোল পড়ে।
সে কি জানে?তার জন্ম এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে তার বাবা মেরুদন্ড সোজা করে নিজের প্রাপ্য অধিকার চাইতে পারে না!!!

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:০৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহূর্ত কথাঃ সময়

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



সামুতে সবসময় দেখেছি, কেমন জানি ভালো ব্লগাররা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়! যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচণ্ড নেগেটিভ স্বভাবের মানুষ। অন্যকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে, গারবেজ গারবেজ বলে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

NVR (No Visa Required) এর জন্য জেনে রাখা দরকার

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৯
×