সাধারণ আলোচনাঃ
০১।
বাংলাদেশে যারা ইসলামকে নিয়ে মৌলিক বইপুস্তক লেখেন তাদের সাথে আমাদের অপরিচয়ের দেয়াল পর্বতপ্রমান।মার্ক্সবাদের সৃজনশীল ও ধ্রুপদী ব্যখ্যাদানে ব্রতীদের আমরা কিছুটা হলেও চিনি;সমাজ-রাজনীতি,দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে যারা লেখেন তাদেরও পরিচিতি সমাজের প্রগতিশীল ও চিন্তাশীল মহলে আছে।তবে বাংলাদেশে যারা ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেছেন, মৌলিকভাবে ভাবার চেস্টা করেছেন ও লিখেছেন তারা আমাদের সমাজের ভাবুক অংশের কাছে প্রায় অপরিচিত।এ কথা সত্য নয় যে,বাংলাদেশে বিশ্বমানের ইসলামি গবেষক একেবারেই নাই।শিক্ষিত মহলে ঘুরে ফিরে পাশ্চাত্যে বসবাসকারি তারিক রামাদান, ফযলুর রহমান বা জিয়াউদ্দীন সরদারদের কথাই আসে, বা আসে আই আই টির লেখকদের কথাই।সময় এসেছে বর্তমান বাংলাদেশে লিখিতভাবে যেসব ‘আলেম’ ইসলাম নিয়ে ভাবছেন তাদের চিন্তার সাথেও পরিচিত হওয়া।আমাদের যাদের শেষ গন্তব্য বাংলাদেশ, যারা একটা ‘মানবিক’ সমাজের প্রত্যাশা করি, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও পরমতসহিষ্ণু সমাজ যারা আমরা যাচনা করি,যারা আমরা ভিন্নমতকে দমন করতে চাইনা, যারা আমরা অপরের যুক্তি,জীবন ও চর্চাকে আন্তরিকভাবে বুঝতে চাই, তাদের প্রয়োজন এ অঞ্চলের ইসলামের রূপ অনুসন্ধান ও বোঝা, ও এখানকার ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’দের ভাবনার সাথে পরিচিত হওয়া
০২।
বর্তমান বাংলাদেশে তারুন্যের একটা অংশ ইসলাম নিয়ে, ভাবছেন, লিখছেন ও পড়ছেন।এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধারা আমি লক্ষ্য করিঃ একটি ধারা মূলত মার্ক্সবাদী যারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার কৌশল হিসেবে ইসলামের একটা অবয়ব নির্মান করতে চান। তবে এদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা প্রথাগত বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত নন। কেউ আবার আস্তিক,কেউ ঘোষিত বা অঘোষিত নাস্তিকও। ইসলামের ইতিহাস থেকে তারা তাদের পছন্দসই ইতিবাচক উদাহারন সংগ্রহ করে নিজেদের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনার উপযোগী করে ব্যাখ্যা করেন।এরা মুলত ইতিহাস আশ্রয়ী;ইসলামের মৌলিক টেক্সট ‘ কোরআন ও হাদীস’ থেকে তারা খুব কম উদাহারন টানেন; ইতিহাসে ইসলাম চর্চার বৈচিত্রের ধারা উনারা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন।খুব সহানুভূতি ও সংবেদনশীলভাবে তারা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের সমালচনা( পরযালচনা?) হাজির করেন।ধর্মের ঐশীত্ব(divinity) নিয়ে তারা সাধারণত প্রশ্ন করেন না,ইসলামকে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করে ‘গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সেকুলার’ সমাজের উপযোগী করে ইসলাম কে উপস্থাপন করতে তারা উদ্যোগী ও উৎসাহী।ইসলাম ধর্মাবলম্বী বা ইসলাম পালনকারী insider হিসেবে থেকে তারা কথা বলেন না; বরঞ্ছ তারা compassionate observer হিসেবে ইসলাম প্রশ্নে আলাপ তোলেন।এ ধারারই একটি অংশ মার্ক্সীয় পরিভাষা ব্যবহার করে ইসলামকে ব্যাখ্যা করেন অথবা ইসলামি পরিভাষার মার্ক্সীয় ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন।
৩।
আরেকটি ধারা আছে।তারাও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিন্তু তারা ইসলামকে ধর্ম বা দীন হিসেবে ‘own’ করে কথা বলেন, কথা বলেন ইসলামি ইবাদাহ ও এলেমের ভেতর থেকে।তাদের আগ্রহ ইসলামি দর্শন,জ্ঞানতত্ত্ব ও রাষ্ট্রতত্বে ও আধুনিকতার বিপরীত প্যারাডাইম নির্মানে।ইসলামের কোন মৌলিক ও অভিনব বক্তব্য আছে কিনা বর্তমান পুঁজিবাদী-বিশ্বায়নের এই যুগে তা তাঁদের সাগ্রহ অনুসন্ধানের বিষয়।বিশ্বইতিহাসে ইসলামের প্রবল ভুমিকার সম্ভাবনার কথা মাথা রেখে আধুনিক-উত্তরাধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করে একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক পাটাতন তারা তৈরী করতে চান। এরা আরবী পরিভাষাও ব্যবহার করেন,তবে সেগুলোর ‘মানে’ তৈরিতে পাশ্চাত্য দর্শনের সহায়তা গ্রহন করেন প্রায়শই।এ ব্যাপারে তারা নির্ভর করেন প্রধানতঃ ইংরেজি ভাষায় লেখা বা অনুবাদিত আধুনিক কালের ফকীহদের লেখালেখির উপর।প্রাচীন ফকীহদের লেখাও তারা পুনর্পাঠ করেন।এ ধারা ইসলামের জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্ভাবনা উন্মোচনে আগ্রহী।
৪।
তৃতীয় আরেকটি ধারা আছে যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করেছেন বা করছেন। ইসলামের আমলী ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাসের সাথে তাদের রয়েছে অন্তরঙ্গ পরিচয়।ইসলাম কে ‘মডারনাইজ’ করার প্রয়াস তারা করেন না।ইসলামি পরিভাষাই তারা সরাসরি ব্যবহার করেন।তারা ইসলাম পালনকারী,বা নিয়মিত পালনের ঘোষণাকারি।তারা অবয়বে ও আমলে বস্তুত ‘ইসলামি’।তারা কোরআন ও হাদিস থেকে রেফারেন্স দিয়ে লেখেন বা বলেন।বাংলাদেশে ভার্চুয়াল জগতে এরা তেমন প্রভাবশালী নন,তবে সমাজে ইসলাম ধর্মের মানে তৈরিতে উনারাই প্রধান ভূমিকা পালনকারী।বাংলাদেশে শহরে ও গ্রামে ইসলামের শিক্ষা প্রচারে ও প্রসারে তারাই মূল ভুমিকা রাখেন।রাষ্ট্রের প্রভাবশালী ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ মহলের সাথে এদের কোন যোগাযোগ নাই বললেই চলে।সমাজে রাষ্ট্রে যারা আইডিয়া প্রপাগেট করেন,তারা বেশীর ভাগই এই আলেমদের লেখার সাথে পরিচিত নন।এই তৃতীয় ধারার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আন্তরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।তৃতীয় এই ধারার ভেতরে আরও নানা উপধারা রয়েছে।তৃতীয় ধারায় আমাদের কওমি মাদ্রাসা গুলো যেমন পরে, তেমনি আছে আলিয়াও। কিন্তু এই দুই ধারার সিলেবাস ও পাঠপদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা হয়,হচ্ছে ও হবে।তবে এখানকার পাঠদান ও পাঠগ্রহন পদ্ধতির অনন্যতা নিয়ে কোন কথা শুনিনি বা লেখা দেখিনি।আমাদের মাদ্রাসাগুলতে শর্সিনা,ফুরফুরা,চরমনাই প্রমুখ পীরের মতাদর্শিক প্রভাবও লক্ষণীয়।সালাফি বা আহলে হাদিস মাদ্রাসাও আছে অনেক।যারা পড়াশুনা শেষ করেছেন আরবি-উর্দু ভাষার উপর তাদের দখল উল্লেখযোগ্য।আমাদের কাওমি মাদ্রাসাগুলোতে এখনো উর্দু ভাষার প্রচলন আছে; যদিও ধীরে ধীরে আরবী ভাষায় পাঠ ও বাংলায় অনুবাদের আগ্রহ বাড়ছে,সময়ের তাগিদেই।উর্দু গদ্যের বিকাশে ‘আলেম’দের ভুমিকা আছে; বাংলা অনুবাদেও শিবলী নোমানী, সোলায়মান নাদবী বা হাসান আলি নাদবী এর গদ্যের অপুর্ব সুষমা সহজেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, বাংলা লিখিত গদ্যের বিকাশে আমাদের আলেম সমাজের ভূমিকা নাই বললেই চলে(আছে কি?)।তবে তাদের গদ্যে বাক্য গঠন ও শব্দ চয়নে ভিন্ন স্বাদ ও গতি লক্ষ্য করেছি;তাদের গদ্যের বিশিষ্টতা নিয়ে গবেষণা করলে আমদের গদ্যভাষার নতুন কোন দিগন্ত উন্মোচিত হলে হতেও পারে। যাহোক, এই তৃতীয় ধারা সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক প্রচারনা আছে বাংলাদেশে।আমাদের অধিপতি বুদ্ধিজীবী মহলে তারা ‘দরিদ্র,পশ্চাদপদ,অনাধুনিক’ ইত্যাদি নানা ‘বিশেষণে’ সম্বোধিত হয়ে তারা ‘অপর’ হিসেবেই বিরাজ করেন।
৫।
আমাদের জনপরিমণ্ডলে(public sphere) ইসলাম সম্পর্কে জানাশুনার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার আলোচনায় যে তৃতীয় ধারার কথা বললাম সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার্থে অনেকেই মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়,আল-আজহার ও রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছেন ও অনেকেই আবির্ভুত হচ্ছেন মিডিয়ায় ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে।সমাজে ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনায় রেডিকাল পরিবর্তন আসছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে।আমাদের দেশে ধর্মীয় আচার হিসেবে পালনীয় অনেক অনুষঙ্গকেই তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন; ফলে দীর্ঘ দিন ধরে অনুসরনীয় অনেক ধর্মীয় চর্চা সম্পর্কে অনেকে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাই অনেকেই বলছেন, আমাদের সমাজের ‘সালাফিকরন’ ঘটছে।কারণ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত অনেকেই শুধু ‘সহি হাদিস’ ও কোরআন অনুসরণের কথা বলছেন।ধর্মকে ধর্ম হিসেবে টিকিয়ে রাখতে তারা ‘দলিল’ এর বিশুধতার কথা বলেন ও টেক্সচুয়াল অথোরিটিকেই চূড়ান্ত গণ্য করেন কারণ তা নাহলে, তাদের যুক্তি অনুসারে,ধর্ম তার ঐশিত্ব হারিয়ে মানুষের নির্বিচার ইচ্ছার বলিতে পরিণত হতে পারে। তবে,সালাফিদের ভেতরেও যে কট্টর ও উদারপন্থী উভয়ই আছেন,এ-সম্পর্কে অনেকেই অনবহিত।literalist হিসেবে তাদের একমাত্রিক চিত্রায়নও সঠিক নয়।বাংলাদেশে তাঁরা ‘আহলে হাদিস’ নামে পরিচিত এবং তাদের নিজেদের মধ্যেই টেক্সচুয়াল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ভিন্নতার কারনে নানা উপদল রয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ রাত ১০:৪০