somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্প ৷৷দ্য টি-শপ ৷৷

০৩ রা মে, ২০১৫ রাত ২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাস্তা পার হয়ে রেলওয়ের স্টেশনে প্রবেশ করতেই চায়ের দোকানটি দেখে মিস গ্রেটা আনন্দিত হয়ে উঠলেন ৷ পঁচিশ মিনিট দেরি ছিল যে ট্রেনে সে স্টেশনে পৌঁছায় কিন্তু পরের যাত্রার ট্রেনটি আবার যথাসময়ে ছেড়ে যায় ৷ সম্ভাব্য পরেরটা আড়াই ঘন্টা পর ছাড়বে ৷ সেই সময়টা সে কাটাতে পারবে অপেক্ষমাণ কামরায় বই পড়ে, যদিও তার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না সেরকমটা ৷ আদতে ঐ কামরাটাই পছন্দ না তার ৷ পরে ট্রেনেই বা কি পড়বে ? প্রায় ৮০ পৃষ্টার মত এখনও বাকি ৷ শেষ যাত্রাক্ষণের জন্য যথেষ্ট ৷ তাহলে তো চায়ের দোকানটা উত্তম হবে ৷ আর যাই হোক সময়টা ছিল দুপুরের চায়ের ৷

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মূল প্রবেশদ্বারে আর চায়ের দোকান থেকে কয়েকগজ দূরে থেকে ভাবছিল কি করবে তার স্যূটকেসটা নিয়ে ৷ বেশ ভারি ছিল সেটা ৷ ঝরঝরো পড়া বৃষ্টি এখন বেশ জোঁড়েসোড়ে পড়ছে, এর মাঝে একা এটাকে টেনে নেওয়ার কোন মানে হয় না ৷ এ দিকে ঘুরে দাড়াতে মালামাল রাখার কাউন্টারের ঘরটি খুঁজতে থাকা চোখে পড়লো ৷ বেঁটে,বয়স্ক কাউন্টারের ওপাশে থাকা গাঢ় লালচে নাকওয়ালা লোকটাকে দেখা গেল ৷ এ ধরণের লোকেরা সারাদিন বিয়ারে পড়ে থাকে যদিও এ্যলকোহলের গন্ধ পাচ্ছে না তার নাক ৷ পলকে এক হাতেই তুলে নিল বেশ ভারি স্যুটকেসটা সাথে ধরিয়ে দিল একটা কূপন ৷

কোট, জুতো, হ্যাণ্ডব্যাগের সাথে মানানসই দু’পরতের খয়েরি রঙের বড় ছাতাটা উল্টো করে মেলে ধরলো মিস গ্রেটা ৷ ছিঁটকে গায়ে জল আসতে পারে বলে দুটো গাড়িকে পার হতে দিল ৷ তারপর ছোট পদক্ষেপে মৃদুছন্দে সামনে এগিয়ে গেল ৷ দেখে বুঝে পা ফেললেও জলের ছলকে ভিজে গেল ৷ দোকানের সামনের ছাউনিতে পৌঁছেই ঘুঁরে দাঁড়িয়ে বন্ধ করে ফেলল ছাতাটা ৷ আর তাতে আটকে থাকা বৃষ্টির জলও ছিঁটকে পড়ল কিছুটা ৷

দরজায় দাঁড়িয়েই সে দেখে নিল লম্বা কামরার চারপাশটা ৷ সাদা রঙের শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা, চেহারায় চিকন গোঁফওয়ালা, লোমশ পাশটা ঝলসানো বেশ ভারি চল্লিশ বয়সী ওয়েটার কাউন্টারের ডানে দাঁড়িয়ে ছিল ৷ পাতলা, উজ্জল-লালচে চুলের বড় ফ্রেমের চশমাওয়ালা হিসাবরক্ষক নিঁচু হয়ে হিসেবের খাতায় লিখছিল কি যেন কিছু একটা ৷ তারও পরনে একই পোষাক ৷
খুব বেশি খরিদদার তখন ছিল না ৷ দরজার বা-পাশের কোণায় বয়স্ক লোকটা খবরের কাগজটা পড়ছিলেন ৷ মিস গ্রেটা যখন ভেতরে ঢোকলেন কিছু সময়ের জন্য সে তাকিয়েও তার পড়ার মাঝে ফেরত গেলেন ৷ বড় জানালার পাশেই বসেছিল কমবয়সি একজোড়া দম্পতি ৷ টেবিলে সামনা সামনি বেশ ঝুঁকে তারা আর তাতে দুজনের প্রায় নাক ছুঁইছুঁই আর তার মাঝে নিঁচু স্বরে আলাপ চালাচ্ছিল ৷ কামরার শেষটায় গাঢ় নীল রঙের জামা আর একই রঙের হ্যাট পরা অবস্থায় এক মহিলাও ছিল ৷ কঁনুই ভাজ করে টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে বেশ চিন্তায় মগ্ন হয়ে সামনে রাখা কাপগুলো দেখছিলেন ৷

জানালা থেকে একটু দূরে খালি একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সে ৷ অপরিচিতদের সামনে বেশ আরষ্টতা লাগছিল তার ৷ কোট খুলে রেকে ঝুঁলিয়ে দিয়ে সঙ্গে তার নিচের স্ট্যান্টে ছাতাটা রেখে দিল ৷ যখন নীল কুশনের মজবুত চেয়ারে বসে মনে হল যেন ডুবে গেলেন ৷
নীল কভারের লম্বা, চিকন মেনুটা খুলেই দেখতে ইচ্ছা করল না ৷ দুপুরে সাধারণত ক্যামোমিলের চায়ে অভ্যস্থ সে ৷ হঠাৎ করেই ব্যতিক্রম কিছু একটা করবেন বলে ভাবলেন ৷ সেই সঙ্গে চারপাশটা বেশ অদ্ভূত লাগছিল ৷ খুব বেশি ব্যতিক্রম নেই তার নিত্যদিনের জীবনে ৷ এমনটা লাগেনি এই চায়ের দোকানের আসার আগেও ৷ সুযোগটা কেন লুফে নিবে না ! একটা অবদমিত অভিলাষ কিছু একটা ঘটাতে চাচ্ছিল এমন জায়গায় যেখানে কেউ তাকে মোটেই চিনে না ৷ দিতেই পারে খানিক অপ্রচলিত কোন চায়ের অর্ডার !

পুরো চার পৃষ্টায় লেখায় ভরা মেনুটা ৷ বেশিরভাগ চায়ের নামই শোনেনি আর স্বাদ জুটেছিল অল্পকিছুর ৷ যদিও সেই ছোটবেলা থেকেই এ গরম পানীয়টা সকালে ও বিকালে যথারীতি পানে অভ্যস্থ ৷ দীর্ঘ তালিকা পড়তে পড়তে সে অবাক হচ্ছিল কতটা একগুয়েতে আটকে ছিল এতদিন ৷ এক সময় মনে হতো সেটা একটা ভাল গুণ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, না কেন এমন হলো ! এমন অভ্যাস করা উচিত হয়নি যতক্ষণ চা ছিল ভীতিকর ৷ এখন সময় ছোট কিছু উপভোগ করা, যা এতদিন বাদ পড়ে ছিল ৷ শুভস্য শীঘ্রম ৷
চায়ের নামগুলোর সাথে তাদের সুফলের দিকটিও সংযোজিত করা ছিল ৷ কিছু বর্ণনা অবাক করার মতন, কিছু পড়ে হাসি খেলে গেল ঠোঁটে, আবার কয়টা পড়ে তো লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল কিছুক্ষণ ৷ ক্যাবেজ, স্পিনাজ আর গাঁজর দিয়ে যে চা হয় সেরকমটা সে জানত না ৷ নেটেলের চায়ে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায় ৷ মসের চা ধীরে ধীরে স্নায়ুকে শান্ত করে ওদিকে প্যাপিরাসের চায়ে অভিসারের সলতেটা উসকে দেয় ৷

পৃষ্টা চারে দেওয়া আছে চমকপ্রদ কিছু চায়ের নামের তালিকা ৷ পড়ে বেশ পুলকিত অবস্থা তার ৷ এদের তৃপ্তি না পেলে অপূর্ণতা রইবে জীবনে ৷ নামগুলোর মাঝেই চমকের স্বাদ আছে ৷ হয়ত জিজ্ঞাসা করতে পারে কি দিয়ে তৈরী এরা কিন্তু রহস্য উন্মোচনের আশঙ্কায় তা থেকে বিরত থাকল ৷

বাতাসের চা আলস্য দূর করে, মেঘের চায়ে নিয়ে আসে উঁড়ার অভিলাষ, জ্যোৎস্না চায়ে প্রলুব্ধ হয় ধীর বহমানতা, বসন্তের চা নিয়ে আসে তারুণ্যের উপলব্দি, নিশিতের চায়ে আসে কামুকতার স্বপ্নেরা, নৈঃশব্দ্যের চা পুর্ণতা আনে নিরাবতার, প্রাবল্যতার চায়ে আনে আনন্দচ্ছটা, শীতল চায়ে প্রত্যাশা আশার ৷ যেকোন একটা পছন্দ করতেই পারে ৷ সর্বমিশ্রণ হতে পারে সর্বোৎকৃষ্ট ৷ তাদের প্রস্তাবনার অনেককিছুই তার কাছে অজানা ৷

সব পড়েও কিছুই অর্ডার দিল না ৷ তার পছন্দ হলো মেন্যুর সবশেষেরটা - গল্পের চা ৷ ‘এটাই দরকার আপনার’ – নির্দেশিত এই পরামর্শে প্রতিদিনের সঙ্গী গল্পই বেছে নিল ৷ভাল লাগে প্রত্যহ চা পানের মত প্রার্থনার ধ্যানে পড়তে ৷ মানসিক অবস্থা নিম্নগামী হলে বাস্তবের চেয়ে গল্পের ভুবনের মু্গ্ধতা জীবনপ্রবাহে মিশে যায় ৷ যদিও সমাপ্তিতে ফিরে আসে প্রবাহমান কালে তবু বইয়ের সংযোগে বিচ্যুতি ঘটে না ৷ পরের গল্প পাঠেই সব মর্মবেদনা বিস্মৃতি হয়ে যায় ৷ এ অভূতপূর্ব চায়ের আকর্ষণ যথার্থই পছন্দ হয়ে গেল তার ৷
মেন্যু বন্ধ করে টেবিলে রাখতে না রাখতেই হাস্যোজ্জ্বল ওয়েটার এসে বলল, ‘শুভদিন, আপনার জন্য কি সেবা করতে পারি ?’
স্মিতহাস্যে প্রতিউত্তরে শুভদিন জানিয়ে বললো ‘গল্পের চা ৷’

খুব নিচু স্বরে বললেও নিজেকে স্বান্তনা দিল যে সে হয়ত খুব সাধারণ চা-ই চেয়েছেন ৷ তবুও পুরো টি-শপের সেই নিরাবতায় তার মৃদু উচ্চারণ সবার কানে পৌঁছে গেল ৷ হিসাবরক্ষক লেখা থামিয়ে চেয়ে রইল তার টেবিলের দিকে ৷ প্রবেশ পথের সেই বয়স্ক লোকটা খবরের কাগজের উপর দিয়ে এদিকে ফিরে তাকাল ৷ আর দম্পত্তি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত চোখেরা যুগপৎভাবে মাথা ঘুরিয়ে তার পানে দিকে চেয়ে রইল ৷ এমনকি অন্য টেবিলের গাঢ় নীল রঙের পোষাক পরিহিতা কাপ ঘুরানো থামিয়ে দিয়ে কৌঁতুহল চোখে ফিরে তাকালো ৷
কিছুটা লজ্জ্বিত হয়ে মাথা নামিয়ে রাখল ৷ নিজেকে মনে হল যেন অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পরে গেছেন ৷ সেটা আবার নিজেরই দোষেই ৷ হয়ত ক্যামোমিলের চায়ের অর্ডার দেওয়া উচিত ছিল তাতে বোধহয় কেউ ফিরেও তাকাতো না ৷ নিজের অজান্তেই চেয়ে ফেলল গল্পের চা, কি ভাববে সবাই ?

হাস্যোজ্জ্বল ওয়াটারের আগমনে বেঁচে গেল এ যাত্রায় ৷
‘ঠিক আছে ম্যাম, এখনই আনছি ৷’

এতই অবস্বাদগ্রস্থ মনে হল নিজের হাতটাও উঠাতে ভুলে গেল ৷ পর মুহূর্তে হারানো আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলে চোখ তুলে টি-শপের চারপাশটা দেখে নিল ৷ সবাই যে যার মত ব্যস্ত দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ৷ কয়েক মিনিট পরে ওয়েটারের সাদা রঙের ইঁদুর সদৃশ হাতলওয়ালা পেয়ালায় চা নিয়ে আগমন ৷ টি-শপের কর্মচারীটির নীল বর্ণের পোষাকের মতনই চায়ের রঙ ৷ মৃদু হেঁসে মাথা ঝুঁকে ওয়াটারকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিল সে ৷

চলে না গিয়ে টেবিলের পাশটায় দাঁড়িয়ে রইল ওয়েটার ৷ এতে খানিকটা মুহূর্ত বিব্রতকর লাগছিল ৷ কেনই বা দাঁড়িয়ে রইল আর কি তার করা উচিত তা ভেবে পেল না ৷ শেষটায় তার অবস্থান উহ্য রেখেই চায়ের প্রতি মনযোগী হলো ৷ কারণ সে-ই তো চায়ের অর্ডার দিয়েছে, এছাড়া তার কিই-বা করার আছে এক্ষেত্রে ৷

ঠোঁটে ধরে খানিকটা ফুঁ দিয়ে দিল সবুজ লিকারে ৷ ধীরে ধীরে সাবধানে চুমুক দিলেও এর স্বাদ অচেনাই মনে হলো ৷ চা-টা খুব সুন্দর করে মিশ্রিত করা ছিল ৷ তার কাছে আবার মনে হলো আগে হয়ত স্বাদ পেয়েছে এর কিন্তু সেটি কিরকম ছিল ধরতে পারল না ৷ মনে হল কাঠবাদাম, পেস্তা আর অজানা আরো কি’র যেন সংমিশ্রণ ৷ পিরিচে আবার রেখে দিল কাপ’টা ৷
‘আপনার পছন্দ হয়েছে ?’ জিজ্ঞাসা করল ওয়েটার ৷
এক মুহূর্ত ভেবে উত্তর দিল ‘হ্যাঁ, অনেক ৷’
‘চমৎকার! তাহলে আমরা এখন গল্পের দিকে যেতে পারি’- বলতে বলতে খালি চেয়ারে দেখিয়ে বসার অনুমতি চাইল ৷
অবশ্য সম্মতির অপেক্ষা না করেই সে চেয়ারে বসে পড়লো ৷
বসতে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল ‘গল্প ?’
‘হ্যাঁ, এই চায়ের সাথে গল্প ৷ আপনি তো গল্পের চা পছন্দ করেছেন, তাই নয় কি ?’
বলতে চাইছিল এমনটা সে কল্পনা করেনি বা কি ঘটবে সে জানতো না, সাথে বেড়ে যাচ্ছিল অস্বস্তি ৷ এখন কি করবে বুঝতেই পারছিল না কারণ পেছনে ফেরত আসার পথ জানা নেই ৷ শুধু দেখে যাওয়া তার অযাযিত অভিলাষ কোথায় নিয়ে যায় ৷
‘অবশ্যই’ বলে সম্মতি তার ৷

ওয়েটার খানিকটা কেঁশে নিল যেন কোন অভিনেতা মঞ্চে উঠছেন আর এখনই আরম্ভ করবেন ৷

‘তেত্রিশ-তম শিরচ্ছেদ পর্যন্ত শিরচ্ছেদকারী যথাযথভাবেই তার দায়িত্ব পালন করলেন ৷ ছয় পুরুষ ধরে পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তার অর্পিত কর্মে ছিল নিষ্ঠাবান ৷ অভিযোগবিহীন, সযত্নে সংগঠিত, পরিশ্রমী, সূক্ষ্মতায়, সাধনায় সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকছে ৷ অসময়ে স্বজন হারানো পরিবারেরা ধন্যবাদন্তে মাঝে মাঝে চিঠি লিখেন আর চমৎকার কাজে পৃথিবীতে কম যাতনাময় প্রশান্তিতে দিনযাপনের আশায় থাকেন ৷’

‘অজ্ঞাত কারণে এক সময় এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কনিষ্ট সদস্য রুখে দাড়ালো রীতির বিরুদ্ধে ৷ এরূপ কারণের কোন ব্যখ্যায় আগ্রহী ছিল না ফলে নানান জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হলো ৷ হয়ত তার কর্তৃক সর্বশেষ শিরচ্ছেদে ইচ্ছার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার ফেলেছে ৷ আবার হয়ত সাতজন স্বাধীনতাপন্থীকে হত্যায় অভিযুক্ত শিশুসুলভ চেহারার অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তিকরণে তার উপর রেশ ফেলেছিল ৷ প্রথমে সে তাদেরকে হত্যার আগে বাধ্য করেছিল অগ্নিনির্বারকের পোষাক পরিধানে ৷ সে সময় প্রাচীন রূপকথা থেকে পাঠ করেছিল শ্লোক ৷ এতঃপর চৌবাচ্চায় ডুবিয়ে দেয় সাঁতারের পোষাক পরাবস্থায় ৷’

‘আরো বলা হচ্ছিল যে ইদানিংকালে সাদা ভাল্লুক রক্ষাকরণ সংস্থায় যোগদান হয়ত এ পেশা থেকে অব্যাহতিতে ভূমিকা রেখেছে ৷ নাড়িয়ে দিয়েছে সুনিপূণ শিরচ্ছেদকারীর ভূমিকার মূলশিকড়ে ৷ যদিও শেষ কারণ এমনটি নয় হয়ত ৷ কথিত আছে যে পশুর প্রতি সহৃদয়তা মানুষের প্রতি একইভাবে কাজ করবে না ৷ আসলে কি, পেছনে ফেলে আসা রক্তস্নাত পথ মাড়ানো কাউকে কি সামনের বিড়াল,কুকুর,ঘোড়া,টিয়া বা কুমিরের প্রতি অনুভূতিপ্রবণতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে ?’

‘তাই হয়ত শিরচ্ছেদকারীকে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত যক্ষার হাসপাতালে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল যদিও সে যথেষ্ট সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ৷ তখনই এমনটা করা হয় যখন সে পাহাড়ের ফুলগুলো তোলতে শুরু করেছিল ৷ সৌখিন উদ্ভিদ সংরক্ষণকারী প্রধান সেবিকা তাকে এ কাজে যথেষ্টই সহায়তাও দিতে লাগল ৷ আবার যখন তার ডিউটি না থাকতো তখন হয়তো দুজন একসাথে উচুঁ-নিচু পাহাড় পেরিয়ে নতুন কোন প্রজাতির নমুনা নিয়ে আসত তাদের সংগ্রহশালায় ৷’

‘হাসপাতাল জুড়ে গালপল্পে হিউমার ছড়িয়ে যায় তাদের আবেগীয় সংযোগের কল্পকথার ৷ যদিও তারা মানুষজনের এ ধারণাকে পাত্তা না দিয়ে মাটিতেই বসতে দিতো না ৷ ফলে ডাক্তার ও রোগীর চোখের আড়ালে কি হচ্ছে, কি ঘটছে তা কল্পনায়ও আনা যাচ্ছিল না ৷ তবে কিছু একটা হচ্ছে কিনা তাও মহৎ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সতর্কতার সাথে সংরক্ষিত করা হচ্ছিল ৷ সবটাই ততক্ষণ পর্যন্ত চেপে রাখা হয় যতক্ষণ না সেই যুগলের ভাগ্যে ট্রাজিডি না ঘটতো ৷’

‘এদিকে সেখানকার একজন রোগি, অবসরপ্রাপ্ত খনি বিষয়ক অধ্যাপক, যার সবকিছু থাকার পরও তিনি বাঁচবেন আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ ৷ বেশ চিন্তিত সেই ছোটবেলা থেকে জমানো মাথার স্কার্ফ-ভর্তি বাক্সটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ৷ চুলশূণ্য মাথা হওয়ার পর থেকে এগুলো রাখার মত আর কেউ নেই ৷ কত চিঠি লিখেছে কত জাদুঘরকে নিয়ে যেতে এদেরকে এমনকি তাদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচাপাতি দিতেও রাজি সে ৷ যদিও কোন প্রতিউত্তর পাননি ৷ তাদের নিঃস্পৃহতা যারপর নাই তাকে ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয় ও অসম্মানিত করেছে ৷’

‘স্নায়ুবৈকল্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে এ অবস্থায় অধৈর্য হয়ে সব স্কার্ফ ঘরের মধ্যে একত্রে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিল ৷ মুহূর্তেই আগুনের উর্ধগামী লেলিহান শিখা ছড়িয়ে এগোলো পাশের কামরায় দিকে ৷ একেক তলা করে পুরো হাসপাতাল ভষ্মিভূত হতে লাগলো, যা অপ্রতুল আগুন নিবারণ ব্যবস্থাদির বেশ পুরানো দালানের উপর অবস্থান ছিল ৷ বিভীষিকাময় কোলাহলে সবার মনযোগ ছিল অসহায় রোগিদের প্রতি ৷ তাতে সবার অজান্তেই সেই শিরচ্ছেদকারী ভিতরের দিকটায় চলে গেল ৷’

‘যদিও বড্ডো দেরি হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে সে প্রজ্জলিত দালানের ভিতরে ৷ অবাক ব্যপার সে ঢুকতে পেরেছিল একতলার তার কামরায়ও ৷ সেখান থেকে অনেক হাসপাতালের কাপজপত্র ফেলে দিচ্ছিল জানালার বাইরে ৷ সবার সম্মিলিত চিৎকার সত্ত্বেও নিজেকে নিরাপদে রাখতে সমর্থ হয় ৷ আবারও যায় অবশিষ্ট কাগজগুলো আনতে যদিও ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে ফেলে তার চারপাশ ৷

‘এরপর কিছুই জানালা দিয়ে উড়তে দেখা যায়নি এবং তার টিকিটিও আর নজরে আসেনি ৷ পুরো হাসপাতাল মাটিতে মিশে যায় নিমিষে ৷ অবশিষ্ট আটটি লাশ পাওয়া গেল ভস্মিভূত ধ্বংসবশেষে ৷ যদিও হারিয়ে যওয়া নয়জনের সংখ্যার সাথে মিল ছিলনা এদের ৷ সম্মিলিত কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টায় ভষ্মীভূত দেহগুলোর পরিচয় উদ্ধার করা গেলে সবশেষে বুঝা যায় একমাত্র শিরোচ্ছেদকারীর কোন ছাপবিহীন নিরুদ্দেশ হওয়া ৷ শেষে সিদ্ধান্তে উপমিত হওয়া গেল যে, তার দেহ আগুনে পুড়ে গেছে ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো ৷’
গল্প শেষে ওয়েটার তৃপ্তি নিয়ে প্রীতি সম্ভাষণ জানালো ৷ হাততালির প্রস্তুতি নিল মিস গ্রেটা কিন্তু কনুঁইয়ে ভর করে শুধু হাসি ফেরত দিল ৷ এমন রহস্যময় ও ভালবাসার গল্পই তার পছন্দ ছিল ৷ সত্যি বলতে তার রুচির বিবেচনায় অনেকবেশি নিষ্ঠুরতা ছিল এ কাহিনীজুড়ে ৷ একমাত্র শিরোচ্ছেদকারী এ গল্পের নায়ক ছিল না বরং অনেকেই মারা গেল সেই ভয়াবহ আগুনে ৷ যদিও তার উচিত ছিল না এ বিষয়ে বাজি ধরা, কারণ সর্বোপুরি এটা তো ছিল আসলে শুধুই গল্প ৷

এমন চায়ের অর্ডারে আর তার কোনো দুঃখবোধ রইল না ৷ অবাক হতে হয় এমন আইডিয়া দেখে সুপেয় পানীয়ের সাথে চমকপ্রদ গল্প পরিবেশনায় ৷ একটাই আক্ষেপ গল্পটা বেশ ছোট ৷ ভাবেতেই অবাক লাগে যদি আবার চায়ের অর্ডার দেয় তাহলে কি হবে ! প্রতি চায়ের জন্য কি নুতন নুতন গল্প থাকবে ? এখন এ চা টা শেষ করা দরকার ৷ যদিও গল্প শুনতে শুনতে চা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছে ৷ কাপ ধরে বেশ জোরেই দীর্ঘ এক চুমুক দিল ৷ সাথে সাথে কিছুটা গরম চায়ের তৃপ্তিতে অবাকই হলো ৷
‘চমৎকার’ বলেই কাপ রেখে ওয়েটারকে বলল ‘তাহলে আমরা আবার চালিয়ে যেতে পারি ৷’

কিছুই না বলে ওয়েটার উঠে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল ৷ এতক্ষণ ধরে হিসাবরক্ষক এদিকটায় তাকিয়ে ছিল ৷ এদিকে অনুমতি না নিয়েই লম্বা মহিলাটি ওয়েটারের ছেড়ে দেওয়া চেয়ারে বসে পড়লো ৷ তারপর জামার বুক পকেট থেকে নীল টিস্যু বের করে বড় ফ্রেমের চশমা খুলে মুছতে থাকলো ৷ ফলে তার পুরনো কৌতুকময় বাদামি চোখগুলি দেখাচ্ছিল বেশ ছোট্ট ৷ যখন চশমা যথাস্থানে ফিরে গেল সাথে সাথেই গল্প বলা শুরু করলো না সে ৷ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মিস গ্রেটার দিকে যেন তার ভিতরটা অবলোকন করতে পারছেন ৷
‘হাসপাতালের ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে যাওয়ার পর প্রধান সেবিকা সিদ্ধান্ত নিল পেশা পরিবর্তনের ৷ যদিও সেই আগুন থেকে রোগিদের উদ্ধারের কৃতিত্ব হিসেবে আর্কষনীয় সম্মানীও তাকে এ মনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারলো না ৷ কয়েক সপ্তাহের জন্য দুনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন এক রূপে প্রত্যাবর্তন ঘটে তার ৷ সবকিছুতেই তার পরিবর্তন ৷ কৃঞ্চকেশ তার স্বর্ণালীতে রূপান্তর ৷ প্রথাগত কালো রঙের পোষাকের জায়গায় উজ্জ্বল রঙের চামড়ার আলোকচ্ছটার বেশভূষা ৷ আদর্শময়ী ও ভদ্রতার পরিবর্তে সূতীক্ষ্ন ও উগ্র-মেজাজীতে চোখে পরার মত পরিমার্জন ৷’

‘তবে তার সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ আকর্ষন হলো নতুন পেশাতে ৷ সে এখন স্ট্যানওমেন বা পার্শ্ব ছলঅভিনেত্রী ৷ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে শারিরীক-কসরতের কৌশল ও উদ্দীপনা যা ছিল তার চেনাজানাদের নিকট অভূতপূর্ব ৷ সে ভয়হীনভাবে করে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সব জটিল কাজগুলো ৷ ফলে যথাশীঘ্রই নামী পরিচালকেরা শুরু করতে চাচ্ছিল তার সাথে কথা বলতে ৷ সাফল্যময় পেশা তার অপেক্ষায় কিন্তু এমন কিছু একটা ঘটলো যাতে সবটা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল ৷’

‘এবারের কাজ ভয়ঙ্কর উঁচু জলপ্রপাত থেকে আরো দুজন স্ট্যানম্যানের সাথে এক রাবারের নৌকায় লাফ দিতে হবে ৷ সব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আর দৃশ্যচিত্রায়ন যথারীতি রেকর্ড করা হচ্ছিল ৷ এমতাবস্থায় নিরাপত্তা রশি ছিঁড়ে গেল ৷ ফেরত আসতে ব্যর্থ হয়ে নৌকাসমেত যাত্রীসহ জলপ্রপাতের শেষটায় পাথরে আছড়ে পড়লো ৷ আশ্চর্যভাবে একমাত্র প্রাক্তন সেবিকা অল্প আঘাত নিয়ে বেঁচেবর্তে রইলেন ৷’

‘এ ঘটনার তদন্তে দেখা গেল যেমনটা প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এটি আসলে দুর্ঘটনা নয় ৷ রশিটি ছিঁড়ে যায়নি, সেটি কেটে ফেলা হয়েছে ৷ কে করেছে সেটি রহস্যাবৃতই রইল যদিও মৃত দু’ব্যক্তি একটি ঘটনার অণুঘটক ৷ আসলে তারা এক ত্রিভূজ প্রেমের শিকার ৷ তাদের একজন নতুন স্ট্যানওমেনের প্রেমে মশগুল, তবে সে নিয়মিতই তাকে প্রত্যাখাত করে আসছিল ৷ অপর নারী তার প্রতি ঈর্ষান্বিত কারণ তার প্রাণেশ্বর প্রেমিককে নতুন স্ট্যানওমেন কেড়ে নিয়েছে বলে বিশ্বাস করেছিল ৷’

‘আবার সেবিকা ওরেফে স্ট্যানওমেন দীর্ঘকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেল আর ফিরে আসল বেশ পরিবর্তন সঙ্গে করে ৷ তার গোলাপি চুল এখন লাল, খেলার পোষাকের পরিবর্তে চামড়ার পোষাক ৷ একই সাথে ব্যবহারেরও পরিবর্তন এখন সে হাস্যোজ্জ্বল ও উৎফুল্ল ৷ পরিবর্তিত পেশা আরও চমকপ্রদ ৷ সে এখন পরিভ্রমণরত সার্কাসে যোগ দিয়েছে ৷’

‘প্রথমে সে চাকরিতে নিম্নপদস্থ পদ পেয়েছিল ৷ তাতে বইগুলো দেখভাল করতো, যত্ন নিতো প্রশিক্ষিত জন্তুগুলোর, ক্লাউনদের মেকআপ দিতো ৷ এগুলো পরিবর্তন হতো না, যদি নতুন আসা দু’জন যাদুকরের একজন সহকারীর প্রয়োজন না পরতো ৷ তারা নিজেদেরকে ভাইবোন বলে পরিচয় দিতো ৷ তবে বাইরে থেকে তাদের আচরণ ছিল বেশ সন্দেহজনক ৷ প্রয়োজনে হাত ধরতেও দ্বিধা করতো ৷ ফলে রটে যায় যে তারা প্রেমিক-প্রেমিকা, আর তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ৷ তবে তাদের কর্মযজ্ঞ শো’র বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠায় এ নিয়ে আর কথা বেশি উঠল না ৷’

‘তাদের সব কলাকৌশলই অনেক মুগ্ধকর তবে প্রাক্তন সেবিকার অংশগ্রহনটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো ৷ সার্কাসের মাঝখানে জলপূর্ণ কাচের বাক্স থাকে, পরে সহকারি ঝলমল সাঁতারের পোষাক পরে তাতে ডুঁব দেয় ৷ তারপর যাদুকরেরা তালাবদ্ধ করে দেয় সে বাক্সকে আর চকচকে কাপড়ে ঢেকে ফেলা হয় ৷ সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের সাথে চলে পিলে চমকানো বাদ্যঝঙ্কার ৷ যখন দর্শকেরা উত্তেজনায় চরমে উঠে তখনই কাপড়টা সরিয়ে ফেলা হয় ৷ দেখা যায় খালি বাক্স কিন্তু সেটা যথারীতি তালাবদ্ধ ৷ একই সাথে ড্রামের সাথে সাথে পেছনের পর্দা সরে যায় আর সেই সহকারির প্রবেশ ৷ সম্পূর্ণ শুকনো অবস্থায় ৷ দর্শকদের বাঁধ ভেঙ্গে যায় করতালি-উচ্ছ্বাসে ৷’
‘সতেরটি শো করার পর আচমকা সবাই যাদুকরদেরকে বাধ্য করলো এটি বন্ধ করে চলে যেতে ৷ ছাড়ার পেছনে ছিল কোন রহস্যময় কারণ ৷ রটনা ছিল, সেই শো শুরু করার আগে ভাই ও বোনের মাঝে নিরাবতা নেমে আসতো ৷ দু’জনে হাত ধরা ছেড়ে দিয়ে নিচু স্বরে ঝগড়া শুরু করে দিতো ৷ এমনও বলা হলো ভায়ের চোখে জলও দেখা যেত ৷ এই সব গল্পগুলো আর যাই হোক বিশ্বাসযোগ্য ছিল না ৷’
‘সতের নাম্বার শো-এর আগের শো-তে কিছু একটা হয়েছিল ৷ যখন কাপড় দিয়ে ঢাকা পড়ে গেল তখন পর্দা সরিয়ে কেউ আসলো না ৷ যাদুকরেরা বাদে সবাই অবাক হয়ে গেল ৷ তারা স্থির হয়ে রইল যদিও বাদবাকি সবকিছুই পুরোপুরি ঠিক আছে ৷ তারপর আবারও একটা কাপড় মোড়ে দেওয়া হয় তবুও দর্শকের সামনে কেউ আসলো না ৷ এ অসম্পূর্ণতা বুঝা যেতো না যদি দর্শকেরা আগে থেকেই কি হবে তা জানতো ৷ বাক্সে সহকারির রহস্যময় অনুপস্থিতি যতটা না অবাক করার মত ছিল তার চেয়ে পেছন পর্দা ভেদে তার গরহাজির বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে সবার মাঝে ৷ এতে হই-হুল্লোড় পড়ে যায় ৷ ফলে পুরো শো’র প্রায় যবনিকাপাত ঘটে যায় ৷’

‘শো শেষ হলে সবাই প্রাক্তন স্ট্যান্ট মহিলার খোঁজে বের হয় কিন্তু আশার গুঁড়ে বালি ৷ তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মনে হল যেন ধরিত্রী তাকে গিলে ফেলেছে ৷ ভাইবোনকে প্রশ্ন করা হল কিন্তু তারা জানতোই না তার কপালে কি ঘটেছে ৷ তারা অস্বীকার করল এরূপ কোন দুর্ঘটনার ৷ আকারে ইঙ্গিতে বলল সহকারি সম্ভবত তার নিম্নপদস্থ কাজে অসন্তুষ্ট ছিল যার দরুন তার এমন প্রস্থান ৷’
‘রিংমাস্টার ভেবেছিল পুলিশকে জানাবে কিন্তু পরিশেষে অবশ্য জানালো না ৷ কারণ হয়তো এতে সে আরো দু-শ্চিন্তায় নিমজ্জিত হতো ৷ তার কানদুটো করতালির শব্দে আচ্ছন্ন ছিল ৷ তবে পুলিশ যদি পুরো সার্কাস জুড়ে তল্লাশি চালাতো তবে দর্শকশূণ্য হয়ে যওয়ার আশঙ্কা ছিল নিমিষেই ৷ ফলে কোন অভিযোগ উঠলই না যাতে পুল্লিশের অনুসন্ধান দরকার পড়বে ৷ যে কারো অধিকার আছে নিজের পছন্দসই সময়ে সরে দাড়াবার ৷ শেষে দুই যাদুকরকে সার্কাস ছাড়তে বাধ্য করা হলো ৷ আর তাতে সার্কাস হারালো জনপ্রিয় একটি খেলাকে তবে হয়ত এমনটাই প্রাপ্য ছিল এর ৷’

ওয়েটারের মতই হিসাবরক্ষক শেষে এসে মাথা বিনয়ে নুয়ে রাখল ৷ এইবার মিস গ্রেটা নিঃশব্দে হাতজোড়া মিলিয়ে হাততালির মতন করলো ৷ গল্প শোনে ধরণটা মনে হলো ভালবাসার প্রাগলতায় ও গোপনীয়তায় কম মারপিটে ভরপুর ৷ যদিও দু’জন মূল চরিত্রের মৃত্যুবরণ ছিল স্ট্যান্ড ঘটনায় কিন্তু মনে হলো এটি অপরিবর্তনীয় ৷ স্বান্তনা এমন ছিল ভালবাসাই তাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় ৷ প্রেমই ছিল সার্কাসের ঘটনাবলির পেছনের নিয়ামক ৷ সে বেশ উৎসাহী ছিল ভাই-বোনের মধ্যকার সম্পর্কের রহস্য জানতে এবং হয়ত এ দোষেই এমনটা ঘটলো সহকারির বেলায় ৷

সে ভাবছিল হিসাবরক্ষককে জিজ্ঞাসা করবে এরপর এ টেবিলে কে গল্প শোনাবে ৷ ধারাবাহিকতা থাকা দরকার কারণ প্রথম দুটো গল্পের মাঝে সেতুবন্ধন ছিল ৷ এরপর মনে হল শেষটায় সে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই ৷ যদি তার ভুল না হয় এখনও যথেষ্ট চা আছে, হয়ে যাক চায়ের সাথে আরেকটি গল্প ৷
চুমুক দিতে দিতে ভাবছিল এখন কে কথা বলবে সম্ভবত ওয়েটার ৷ আর এভাবেই খদ্দেরেরা সব চা শেষ করে ফেলবে ৷ এরা তো পেশাদার অভিনেতা নয় যে দীর্ঘক্ষণ বজায় রাখতে পারবে যদিও তাদের প্রাপ্তি যথেষ্ট হওয়ার দাবিদার ৷ তারা বেশ পটু গল্পকথনে আর শ্রোতাও সহজে মিশে যায় গল্পে ৷ কোন পূনরাবৃত্তি না করেই এক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা তাদের ৷ তাই নিঃসন্দেহে গল্পের চা-ই পছন্দের শীর্ষে এ টি-শপের ৷

কিন্তু যখন হিসাবরক্ষক ক্যশের পিছন থেকে মাথা নুয়ে দেখালো যার পর নাই অবাক ঘটনা অপেক্ষা করছে দোকানে ৷ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সে দেখলো জানালার পাশে বসা অল্পবয়সী দম্পতি’রা ওয়েটারের পরিবর্তে এগিয়ে এলো ৷ হাসতে হাসতে কোন কথা না বলে তারা দুই চেয়ারে বসে পড়ে ৷ অন্যকিছু ভাবার মতন সময়ই পেল না, কারণ ততক্ষণে যুবক গল্প বলা শুরু করে দিয়েছে ৷

‘সার্কাস ছাড়ার পর দুই যাদুকর আলাদা হয়ে গেল ৷ পুরুষটি সমুদ্র তীরবর্তী দামি প্রমোদতরীর রেস্টোরেন্টে পাচক হিসেবে চাকরি পেল ৷ ভূমধ্যসাগরে থাকা অবস্থায় পরিচয় হয় ধনী যুবতী বিধবার সাথে ৷ তার স্বামী ছিল উৎশৃঙ্খল, যার মৃত্যু ঘটে কপালে গল্ফ বলের প্রচণ্ড আঘাতে ৷ তারপর মুখরোচক ট্রেবলয়েডগুলো ইহা নিছক দুর্ঘটনা নয় বলে ছড়ায় নানাবিধ কাহিনী ৷ যদিও থাকে কোন দ্বিধাগ্রস্থতা তবু তাড়াতাড়ি মিটে যায় সব ৷’

‘মাশরুম, শৈবাল আর শামুকের প্রাচীন রেসেপি’র তৈরী চমৎকার স্যুপ তৈরী করে সেই বিধবার নজর কেড়ে নেন ৷ কথিত আছে সে স্যুপের আছে সম্মোহনকারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ৷ পরে যুবতী চাইলো তার সাথে দেখা করতে ৷ দেখা করার শুরুতে প্রথম দর্শনেই যুবতী তার মুগ্ধতায় মজে্ গেল ৷ এরপর যুবতী নানান উছিলায় তার সাথে দেখা করতে লাগলো ৷ সাথে রইল বিপুল টিপস্ যদিও সেখানে কোনই কারণই ছিল না ৷

‘নেশাতুর আকর্ষনে তার কেবিনে আমন্ত্রণ সংগোপনে ব্যর্থ হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য ৷ জাহাজের ক্রুরা যথেষ্ট সতর্ক যাত্রীদের মেলামেশায় ফলে কেউ অন্য কারো কেবিনে প্রবেশাধিকারে গুরুতর অনায্য হিসেবে বিবেচ্য হয় ৷ কোন এক ঘোরলাগা বিকেলে বিধবার প্রত্যাশার পূরণ ঘটে ৷ যুবক পাচক তার শ্লীলতা ও এ্যালকোহলের জন্য কৃতজ্ঞতা জানায় যদিও সে পানীয় পানে অক্ষমতা প্রকাশ করে ৷
‘কেউ জানে না আসলে কি ঘটেছিল ঐ রাতে কেবিনে ৷ সকালে যখন পরিচালিকা সেখানে প্রবেশ করে পাচককে পায় মেঝেতে ঘুমন্ত অবস্থায় ৷ তখন বিধবা শুয়েছিল বিছানায় ৷ পরে জাহাজের ডাক্তার পরীক্ষা করে ঘোষণা দেন বিধবার মৃত্যু হয়েছে হার্ড এট্যাকে ৷ তাই তার মৃত্যুতে দোষ পড়ে না পাচকের উপর ৷ তবু সে মুহূ্র্তে তার চাকরি চলে যায় আর পরের পোর্টে তাকে নামতে বাধ্য করা হয় ৷’
গল্পের এ পর্যায়ে যুবকটি মেয়েটির কাছে ফেরত আসে ও মাথা নত করে ৷ পরিবর্তে মেয়েটিও মাথা নত করে আর গল্পটি বলতে শুরু করে ৷

‘সার্কাস ছেড়ে যাবার পর মেয়ে যাদুকর কাজ পায় যাদুঘরের রেস্তোরার পরিচারিকা হিসেবে ৷ শীঘ্রই নজরে পরে যায় পরিচালকের যার আবার রমণী মোহের কুখ্যাতি আছে ৷ তার ইতিহাসে ছিল চারটি বিবাহবিচ্ছেদ ও সাতটি কন্যাসন্তান সাথে অগণিত পরিভ্রমণ ৷ তা সত্ত্বেও তাকে নুতন নুতন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে বাধা হয়ে দাড়ায়নি ৷ যদিও এখন সে আর বসন্তের মোরগ নয় মোটেও ৷’
‘পরিচারিকা বেশ শীতল ভাবে তার এডভেঞ্চারের আকাঙ্ক্ষাকে বঞ্চিত করে ৷ তবে এতে তার অভিলাষে আরো অগ্নিউৎপাতের সৃষ্টি করে ৷ সব চেষ্টা বৃথা যাওয়ার পর শেষ অস্ত্রের সাহায্য নেয় সে ৷ নিজের মনঃবাসনা পূরণ করার ইঙ্গিত দেয় আর সাথে এও বলে যদি তার কামনা পূরণ না হয় তবে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হবে তাকে ৷’

‘এদিকে মাঝে মাঝে ছবি আঁকায় বেশ মনযোগ ছিল তার ৷ আরো জানালো যে তার কাজ শুধু পেশা হিসেবে নয় তাকে বিখ্যাতও করবে ৷ রেনেসাঁ যুগের কিছু ছবির ক্ষয়ে যাওয়া অংশে রি-মাস্টারিং কাজে হাত দিয়েছে সে ৷ তাকে তার কাজ দেখার আমন্ত্রণ জানালো ৷’
‘পরে পরিচালক এক ছবিতে খুব নজর দিয়ে দেখতে লাগলো ৷ ছবিটার গভীরটা দেখে যেন পাথর হয়ে গেলেন খানিকটা ৷ নরকের দৃশ্যায়নের ছবি ৷ বিষম মুখশ্রীর শয়তান উপভোগ্য করছে কোন পাপীর উপর অত্যাচারের ভয়ঙ্কর দৃশ্য যে নাকি তার জীবনে নানা পাপে নিমজ্জিত ছিল ৷ যখন সে পাপীর মুখ দেখতে উঁবু হয়ে ঝুঁকলো মনে হলো যেন নিজেকে আয়নায় দেখছে ৷ আশ্চার্যজনক ভাবে আবিষ্কার করলেন মূল শিল্পী তার মুখোবয়বই সেখানে দারুণভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন ৷’

‘সেই মুহূর্তেই নিজের ভিতর কি যেন ভেঙ্গেচুঁড়ে গেল ৷ পরিচারিকাকে বহিষ্কারের পরিবর্তে সে নিজেই পদত্যাগ করলো ৷ তারপর প্রত্যন্ত এক ধর্মশালায় বসবাস শুরু করলো ৷ যেখানে ছিল শারিরীক চাহিদার উর্ধ্বে আর সবার মত কামহীন সরল জীবনযাপন ৷ এদিকে তার কৃতিত্বের খাতিরে পরিচালক পদে নিয়োগ দিতে চাইল কর্তৃপক্ষ ৷ কিন্তু কোন ব্যাখা ছাড়াই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে যাদুঘর থেকে চলে আসলো ৷’

এরপর দম্পত্তিরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো ক্ষাণিকটা পরে ছেলেটি শুরু করল ৷
‘প্রাক্তন জাহাজের পাচক বন্দরে এসেই পড়ে গেল বিপদে ৷ একাই বসেছিল অখ্যাত এক বন্দরের পানশালায় যেখানে মাতাল নাবিকেরা চেচাঁমেচি হই-হুল্লোড়ে মত্ত ছিল ৷ তারা খদ্দেরদের উপরও উম্মাদনা শুরু করে দিল ৷ বিশেষ করে সুন্দরী, যৌবনবতী, নম্র পানশালার পরিচালিকাটির উপর ৷ তারা উম্মাদের মতন ছোঁতে চেষ্টা করলো তাকে ৷ তাদের মধ্যে একজন বেশি তোড়জোড় করছিল সে তাকে শক্ত করে ঝাঁপটে ধরে পায়ের উপর তুলে নিয়ে জোর করে চুমু দিতে চেষ্টা করতে থাকলো ৷ এ দেখে প্রাক্তন যাদুকর আর সহ্য করতে পারলো না একমুহূর্তের জন্য ৷ লাফিয়ে পড়ে অসহায় মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গেল ৷’

‘মুহূর্তেই ঘটে গেল সবকিছু ৷ ঘুষিগুলো উঁসকে উঠলো, জগ ও চেয়ারগুলো উড়তে লাগলো, ছোরাগুলো ঝঁলছে উঠলো ৷ যুদ্ধ যখন শেষ হলো মাতাল নাবিকেরা মেঝেতে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে, তার পেটে চির দেখা গেল, বাকিরা সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ৷ অসহায় মেয়েটি মুক্তিদাতাকে অনুরোধ করতে লাগলো সে যেন কেটে যাওয়া হাত বেঁধে ফেলে, পালিয়ে যেতে বললো আর না হলে উপরে তার কামরায় লুকিয়ে থাকতে ৷ কিন্তু তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে পুলিশের পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকে সে ৷’

‘যদিও বিচারে সেই অসম আত্মরক্ষার মল্লযুদ্ধে মেয়েটি ও অন্যান্য প্রতক্ষ্যদর্শীর সাক্ষ্য সত্ত্বেও সে দোষী সাব্যস্থ্ হলো ৷ আর সাড়ে বার বছরের সশ্রম করাদণ্ড হয়ে গেল ৷ জেলে তার স্থান হলো পুরানো এক আসামীর সাথে যে কিনা পঁচিশবছর যাবৎ বন্দী, তবে শীঘ্রই মুক্তি পাবে ৷ সৌখিন ও আক্রোশের অপরাধের শাস্তিভোগ করছিল সে ৷ সে তার বউকে খুঁজে পায় বন্ধুর সাথে বিছানায় ৷ তারপর তার অন্ধক্রোধের ধণুকের এক নিশানায় গেঁথে ফেলে দুজনকেই ৷’

‘বৃদ্ধ লোকটির এখনও পঠনজ্ঞান বেশ ভাল ৷ নবিসও তার শিক্ষায় গর্বিত ৷ ফলে অনেক সময় কেটে যায় দুজনের কথোপকথন, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার মিলিত অংশগ্রহণে ৷ যতই মুক্তির দিন কাছে আসতে থাকে ততই বৃদ্ধ উৎগ্রীব হতে থাকে তার জেলকক্ষের সাথীকে জানাতে সত্যিকারের কাকে সে বিশ্বাস করেছিল আর কিছু গোপনকথা যা কাউকে সে আজও বলেনি ৷’

‘বলতে থাকে তার কথা - আশ্চার্যজনকভাবে জেলখানার পাঠাগারটি বেশ সমৃদ্ধ ছিল কিছু বইয়ের দুষ্পাপ্য সংষ্করণ সহযোগে ৷ সন্ধান পেয়ে যায় একটি বইয়ে রহস্যময় গোপন বিশ্বাসী সংঘের উল্লেখযোগ্য কথা ৷ সব প্রাণীরই নিজস্ব বিবেচনাবোধ নিয়ন্ত্রণ হয় কসমসের কোন সুনির্দিষ্ট পর্যায়ের সেলের কাছ থেকে যার একেকটি অনেকটা অর্থবোধক ৷ প্রাক্তন পাচক কাহিনী শুনে বেশ উৎসাহ পেল তাই সময় নষ্ট না করে বইটা পড়তে চাইলো ৷ কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না ৷ বুড়ো বলল সে বইটা ফেরত দেওয়ার পর থেকেই আর পাওয়া যায়নি ৷ এমনকি ক্যাটালগেও কোন চিহ্নই নেই ৷’

‘সৌভাগ্যক্রমে বুড়োর ছিল বেশ স্মৃতি শক্তি ৷ ফলে কসমসের জটিল অংশ ও এতদসংক্রান্ত যৌগিক সংযোজন মনে ছিল ছবির মতন ৷ আলোক উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল যে ধরে রাখতে সেটাকে ৷ পেয়ে যাবে স্বর্গীয় গুণবাচক যা কিছু ৷ প্রথমদিকে বুড়ো সে রূপ অনুযায়ী পালন করতে চেষ্ঠা করেছিল যদিও সাহসের অভাবে শেষপর্যন্ত বেশি দূর যাওয়া হয়নি ৷ সাহস থাকলে সঙ্গীকে এগোতে বলল ৷ কোন দ্বিধাদ্বন্ধ ছাড়াই সঙ্গীও রাজি হয়ে গেল ৷’

‘পরের দিন সকালে কারা রক্ষীরা যখন বুড়োকে ছাড়িয়ে নিতে আসলো তারা তাকে বিছানার এককোণে বিধ্বস্ত, এলোমেলো, গণনায়রত, অনবরত মাথা ঝাঁকানো অবস্থায় আবিষ্কার করলো ৷ সঙ্গ বুঁনো চাহনি আর তার হাতগুলো ঘূর্ণায়মান এদিক সেদিক ৷ অপর জনের কোন হদিশই নেই ৷ কি ঘটেছিল গত রাত্রে তা অনুমান করা অসম্ভব ৷ বুড়োকে কেউ দমালো না, ছেড়ে দেবার বদলে আবার কারারুদ্ধ করা হলো ৷ এবার গরিবদের জন্য মানসিক পুনর্বাসনে কেন্দ্রে ৷’

গল্প শেষ করেই যুবক মাথা নুয়ে সম্মান করলো মিস গ্রেটার প্রতি ৷ প্রত্যুত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই যুবতী বলতে শুরু করে দিলেন ৷
‘যাদুঘর ছাড়ার পরে প্রাক্তন যাদুকর ওরফে পরিচারিকা যোগ দিল জঙ্গলে অভিযাত্রী সাথে ৷ যেখানে পুরনো মন্দিরে প্রাচীন সভ্যতার হদিশ পাওয়া যায় ৷ এ দলের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘদেহী, পণ্ডিত, বাদামি চুলের সুদর্শন চেহারার এক প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রফেসর ৷ প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেল কিন্তু তৎক্ষণিকভাবে প্রফেসরের স্ত্রীর উপস্থিতির কারণে আবেগটুকু লুকিয়ে ফেললো ৷ সেও প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক যদিও বিগত যৌবনা ৷’

‘এ সমস্ত ঘটনা না দেখে এদিকে প্রফেসরের দুজন সহকারিরও চোখ পড়ে পরিচারিকার উপর ৷ তার সু-নজরে আসার প্রাণন্তকর চেষ্টা ছিল তাদের যদিও সে এদের সেই প্রচেষ্টাকে সুকৌশলে ব্যর্থতায় ঢেকে দেয় ৷ কে জানতো দু’জনের দুষমনি চুল পরিমান কারণে দ্বৈতযুদ্ধ হতে বিরত রাখে ৷ অবশেষে বুঝতে পারে পেছনের দেয়ালে লেপটে গেছে তীরবিদ্ধ হৃদয় ৷ যাই হোক, এদিকে সেই মন্দিরের নীচে সন্ধান পাওয়া গেল অমূল্য সম্পদের এক গলির ৷ সাথে দেয়ালজুড়ে অজানা হায়রোগ্লিফিকস্ ৷’

‘তারা উত্তেজনায় যার যার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল তবে বেশিদিন নয় ৷ শীঘ্রই দলের তিনজন লোকের অজানা এক রোগ ধরা পড়লো ৷ লক্ষণ ছিল কাঁপানো জ্বর, বেগতিক শরীলের অবস্থা আর সাথে বমি ৷ সেই গলির অশীরীরি বাতাসই মনে হয় এগুলোর কারণ ৷ এদের ভর্তি করতে হবে বলে অনুসন্ধান বাতিল ঘোষিত হলো ৷’

‘এরপরে প্রাচীন অভিশাপের দোহাই দিয়ে দু’মেয়েমানুষকে বিরত রাখতে চেয়েছিল প্রফেসর তবু তারা হেলিকপ্টার আসার আগেই শেষবারের মতন নিচে নেমে আবার একটা সুযোগ নিতে চাইলো ৷ গলিতে পৌঁছালেই আশপাশটা নড়েচড়ে উঠলো আর সরে গেল খানিকটা ৷ মনে হলো প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প পরে বুঝা গেল ঝাঁকানো ব্যপারখানা প্রাকৃতিক ছিল না ৷ সবাই বের হতে হুঁলোস্থুল পড়ে গেলে শুধুমাত্র প্রফেসরের বউই কম আঘাত পেল ৷’

‘এদিকে সে ধাক্কাটা থেকে বেঁচে গিয়ে একাই ধীরে ধীরে প্রফেসরের কাছে এগিয়ে গেল ৷ যদিও দুজনে বেঁচে গেল তবু বুঝতে পারলো না শেষ মুহূর্তে কি হয়েছিল নীচে ৷ যখন আস্বস্ত হয়ে সিঁড়ির দোরগোরায় পৌছালো দু’জনে তখনই পেছনে থেকে জ্বলে উঠলো সার্জলাইটের প্রখর আলো ৷ মুহূর্তে চোখ অন্ধকারে ঢেকে গেল আর দৃষ্টি ফিরে পেতেই দেখলো যুবতী মেয়েটি আবার নীচে নেমে যাচ্ছে ৷ সে চিৎকার করে তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো যেকোন সময় এই গলিটা ভেঙ্গে যাবে কিন্তু ও কোন কর্ণপাতই করলো না ৷ হামাগুড়ি দিয়েও চলতে লাগলো যদিও এতে হাতদুটি বেশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল ৷ সেদিকে তাকানোর আর সুযোগ পেল না ৷ ততক্ষণে প্লাস্টার দেয়া গ্রানাইডের মেঝেটা নড়েচড়ে উঠতে লাগলো ৷ কোনমতে লাফ দিয়ে বেঁচে যেতে পারলেন ৷’

আগের যুবকটির মতই এ মেয়েটিও গল্প শেষ করে মাথা নত করলো ৷ এবার কিন্তু উচ্ছ্বাসটা প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র দেরি করলো না যদিও এতে টি-শপের শান্ত পরিবেশটুকু খানিকটা ছেদ পড়লো ৷ ভাল লাগাটুকু চেপে রাখতে পারলো না বিনিময়ে নম্রতায় দুই যুবক-যুবতীর মাথা আবার নত হয়ে আসলো ৷ পরের গল্পটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল তাদের কাছে ৷ বিশেষকরে মেয়েটি ছিল উচ্ছ্বসিত, উৎকন্ঠিত ও রহস্যপ্রিয় ৷ ছেলেটির গল্পের কারাগার পর্বটি তার খুব একটা পছন্দ হয় নাই ৷ যদিও এ অংশটি বেশ চমকপ্রদ ছিল তবে নারী চরিত্র নেই বলে সে বেশ আশাহত ৷ তবে জানতো পুরুষদের জেলে তাদেরকে আনা কতো কঠিন ৷ পানশালার অংশটা সবদিক থেকেই মুগ্ধ করার মত ছিল ৷

গল্পগুলোর মধ্যে কোন সংযোগ না থাকলেও একই সমান তালে উৎসাহের মাঝে পরিবেশিত হয় ৷ প্রথমদিকে তাদেরকে ভুল ভেবে দোকানের খদ্দের মনে করেছিল সে ৷ তারা অত্যন্ত পেশাদারি অভিনেতা ৷ একমাত্র অভিনেতারাই পারে দক্ষতায় ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে এমন কর্ম সাধনে ৷ যেভাবেই একজন যেখানে ছেড়েছে অপরজন সেখান থেকেই শুরু করেছে ৷ এমনটা মনে হতেই মুগ্ধতায় হাততালি দিয়ে উঠলো ৷ অবিশ্বাস্য প্রাপ্তি ছিল তার ৷ তাদেরকে সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলো যতক্ষণ না অন্য খদ্দের গল্পের চায়ের অর্ডার না দেয় ৷
এবং হঠাৎ করেই একটা চিন্তায় বিমূর্ত করে দিল তাকে ৷ তার অর্ডারের চায়ের দামের ব্যপারে এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না তার ৷ প্রয়োজনই মনে করেনি ৷ সাধারণ চায়ের দাম বেশি না তবে এমন চায়ের মূল্য অত্যাধিক হবে ৷ মনে হয় হিসাবরক্ষক ও ওয়েটারের গল্পগুলো ফ্রি তবে অভিনেতাদেরকে অবশ্যই কিছু দেয়ার কথা ৷ কে আর নিজের খেয়ে বিনামূল্যে এখানে সময় নষ্ট করে বসে থাকবে ! ধৈর্য্য না রাখতে পেরে মনমরা ও বিষন্ন মুখে মেন্যুটা আবার খুলে দেখলো যদিও টেবিলে সে একলা ছিল না তখন ৷ আর তার মনে হতে লাগলো সামনের দু’জন অভিনেতা তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে ৷ তবে তারা তো জানে না সে কি ভাবছে ৷ নজর চলে গেল চতুর্থ পৃষ্টায়, শেষে খানিক দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো ৷ সেখানে একমাত্র গল্পের চায়ের দাম উল্লেখ করা নেই ৷

খানিকটা আত্মভোলা হয়ে দ্বন্দে জড়ানো হাত তুলেই এক চুমুকে বাকি চা শেষ করে ফেললো ৷ চায়ের রঙ আগে মনে হয় গাঢ় সবুজ ছিল এখন খানিকটা ফ্যাঁকাশে ৷ তবে একটুও স্বাদ কমেনি ৷ এদিকে শেষবারের মত সম্মান জানিয়ে দম্পতিটি জানালার পাশের তাদের টেবিলে ফিরে গেল ৷

ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সে আসলে গল্পের চায়ের পর্ব শেষ হলো কিনা ৷ মনে হতে লাগল অসম্পূর্ণই রয়ে গেল শেষে ৷ হয়ত হিসাবরক্ষক বা ওয়েটার ফিরে আসবে মঞ্চে নয়তো দুজনেই একসাথে ৷ এমন হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না ৷ দেখা যাক তারপর কি ঘটে ৷ নতুন এক জোড়া টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো ৷ নীল রঙের জামা পড়া মেয়েটি আর এতক্ষণ খবরের কাগজ পড়া সেই লোকটি ৷
লোকটি সম্মান করল নত হয়ে আর মেয়েটি হেসে দু’জনেই চেয়ারে বসে পড়ল ৷ আর ভূমিকা না রেখেই মেয়েটি গল্প বলা শুরু করে দিল ৷

‘প্রত্নতত্ত্বের প্রফেসরের জ্বর সেরে গেলে তার বউ তাকে ছেড়ে চলে গেল ৷ অসুখে পড়ে সে অনেকটা বদলালো ৷ দোষ দিল বউকে না বলে শেষ সময়ে কেন সে নীচের দিকটায় চলে যাওয়াটাকে ৷ আর আফসোস করতে লাগল তার সহকারির জন্য যতটা না গৌরবোজ্জ্বল প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন হারানোর চেয়েও ৷ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল স্ত্রী ও অভিজ্ঞতার আলোকে ৷’

‘তারপর সে (প্রাক্তন স্ত্রী) প্রত্নতত্ত্ব-ই ছেড়ে দিল ৷ যোগ দিল এক দাতব্য সংস্থায়, যারা লোক নিয়োজিত করত বিশ্বের নানা অঞ্চলে দুর্ভাগাদের সাহায্যের জন্য ৷ প্রথম নিয়োগকৃত কাজেই সে মরুর প্রান্তে ক্ষুধা আর নানান রোগে জর্জরিত হলো ৷ সেখানে পরিচয় হলো এক সুদর্শন মিশনারির সাথে, যে এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করছিল ৷ নিঃস্বার্থভাবে সারাদিনভর তার সাথে কাজ করতে করতেই তার প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষন অনুভব করতে লাগলেন ৷ যদিও সে প্রায় তার ছেলের বয়সী ৷’

‘নিজের মাঝেই এ গোপনকথা চেপে রাখল ৷ তবে মিশনারি ছেলেটি এ রোগে আক্রান্ত হলো না অবশ্যই ৷ এ অভিশাপ কখনই ছেড়ে যায় না ৷ অভিশাপটি নিয়ে যায় প্রথমে অন্ধত্বে পরে মৃত্যুর দিকে ৷ এর ফলশ্রুতিতে মনে হলো কিছুই আর করার নেই ৷ হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানালো, শেষ পর্যন্ত রয়ে গেল মিশনে ৷ কখনই ছাড়লো না ছেলেটির পাশটা, ততদিনে মিশনারি তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে ৷ যখন তার প্রায় শেষ মুহূর্ত, সে তার ভালবাসার আর্তি তাকে জানালো ৷’

‘সে তার কথা বিশ্বাসই করতে চাইলো না ৷ বলতে লাগলো তার অবস্থা দেখে তার প্রতি মায়ায় বলছে এমনটা ৷ এ দ্বিধা শোনে তার মনে হতে লাগল সেও সেই রোগে জর্জরিত হবে তার ভালবাসার প্রমাণ দেখাতে ৷ তার মনঃষ্কামনা অপূর্ণই রইল কারন মৃত্যু আরো দ্রুত গতিশীল ৷ তার হাতেরই উপর মিশনারি মারা গেল ৷ বিশ্বাসই করল না তার ভালবাসার কথা এতে সে আরো পুড়তেই লাগল ৷ এবার সিদ্ধান্ত নিল বাড়ি ফেরার ৷’

পুরোটাই বিরতিহীন ৷ নীল রঙা জামা পরা মহিলাটি যেই মাত্র শেষ করল লোকটি দক্ষতায় সুতার সেই প্রান্তটি ধরে ফেলল ৷
‘বুড়ো সাড়ে তিনমাস কাটালো গরিবদের জন্য তেরী পাগলা গারদে ৷ অবশেষে সে সেরে উঠল যদিও তার কাছ থেকে উদ্ধার করা গেল না সেই বিভীষিকাময় রাতে কি ঘটেছিল জেলখানায় ৷ শেষটায় মুক্ত মানুষ হয়ে সে শান্ত, ছোট শহরের এক গোরস্থানের পাহাড়াদার হিসেবে কাজ জুটে গেল ৷ বার বার তার নজরে পরে গেল এক অল্পবয়সী মহিলার, যে সপ্তাহের প্রতি সোমবারে সকাল এগারোটার পর আসতো ৷ তখন খুব একটা দর্শনার্থী থাকে না ৷

‘পরনে থাকে দামি জামা আর সবসময় চোখে রোদ চশমা ৷ এসেই সোজা হাঁটা দেয় পঁচাশি বছরেরও বেশিদিন ধরে শোয়ে থাকা অবসরপ্রাপ্ত এক পক্ষিবিশারতের কবরে ৷ তারপর পাশেই বাদামী রঙের চাদর বিছিয়ে বসে ব্যাগ থেকে দাবার বোর্ডটা বের করবে ৷ এক এক করে গুটিগুলো সাজিয়ে খেলা শুরু করত, সাদা-ই বেছে নিত সবসময় ৷ আর একটা চাল দিত আর কিছুক্ষণ কবরের দিকে তাকিয়ে একটা কালো গুটি সামনে বাড়াতো যেন মনে হয় সে নির্দেশনা শুনছে কারো ৷ মাঝে মাঝে নিষ্পত্তি ছাড়াই খেলা শেষ হতো ৷ প্রায় বিকেল পাঁচটার দিকে গোরস্থান ছেড়ে চলে যেত সে ৷’

‘বুড়ো নিজে একজন নিবেদিতপ্রাণ দাবাড়ু ছিলেন তাই বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন এমন অভূতপূ্র্ব খেলায় ৷ শুরুর দিকে গোপনে দূর থেকে দেখতেন পরে চোখের দৃষ্টির স্বল্পতায় দরুন ধীরে ধীরে মাঝের দূরত্ব কমতে লাগলো ৷ যদিও তার মাঝে ভয় কাজ করতো হয়ত বিধবা মহিলা তাকে বিরক্ত করার জন্য খারাপ কিছু একটা বলবে ৷ কিন্তু ভৎসনার মত কিছুই ঘটতো না এমনকি যখন সে এত কাছে মানে তার পিছনেই দাড়িয়ে থাকতো ৷’

‘আর বেশ অবাক হয়ে যেতেন তাদের খেলা দেখে আসলে সেটা কোন সৌখিন খেলাই ছিল না ৷ সমকক্ষীয় প্রতিযোগিতার জটিল খেলা ৷ দীর্ঘসময় যু্দ্ধের পর ফলাফল প্রায় অমিমাংসিতই রয়ে যেত ৷ প্রত্যেক বারই চলে যাওয়ার সময় ব্যাগ থেকে মার্জিপানের (বাদামের গুড়া, ডিম, চিনি ইত্যাদি মিশ্রিত ছোট কেক) মিশ্রিণের তৈরী রাণীর গুটি বের করে কবরের উপর রেখে যেতেন ৷ পরেরদিন সকালের মধ্যে পাখিরা খেয়ে সাবাড় করে দিত পুরোটাই ৷’

‘এভাবে গোরস্থানের পাহাড়াদারের অনেকগুলো মাস কেটে গেল তার সাথে খেলতে বলার সাহস জোগাতে ৷ তার ধারণা ছিল বিধবা মহিলা হয়তো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিবেন কিন্তু শোনার মুহূর্তের মধ্যেই রাজি হয়ে গেল ৷ মুখে কিছু না বলে চাদরের অপর দিকে মুখোমুখি বসতে ইঙ্গিত দিলো ৷ তিন ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পর সে উঠে দাড়ালো; পরাজিত হয়ে ৷ অবিশ্বাস্য পরাজয় যদিও বেশ নিশ্চিত যে, সে কোন ভুল করেনি ৷’

‘অতঃপর প্রথমবারের মত মহিলা তার রোদ-চশমা খুঁলে কথা বলে উঠলো ৷ বলল- যদি বাঁচতে চাও আর কখনোই দাবা না খেলতে, গোরস্থানের চাকরি ছেড়ে চলে যেতে শহরে থেকে ৷ যেমনটা সে বলল শুনেই এতটুকু দ্বিধা না করে সোজা গোরস্তানের অফিসে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দিলো ৷ ফিরেই ভাড়ার এপার্টমেন্টের গিয়ে যা কিছু ছিল তার, গুছিয়ে পিঠে ফেলে সোজা রেল স্টেশনে ৷ সঙ্গে দূরবর্তী দূরত্বের পরের ট্রেনের টিকেট ৷’

‘এদিকে বিধবা মহিলা সেই মরুভূমি অঞ্চলের কষ্টকর যাত্রার শেষ ট্রেনে চড়ে বসলো ৷ আর ঝেড়ে ফেললো স্মৃতিগুলো, যারা এতদিন শৃংঙ্খলাবদ্ধ রেখেছিল তাকে ৷ পুরো বগিতেই অনেকটা সময় একাই ছিল ৷ পরে ছোট্ট শহরের স্টেশনে এক সঙ্গী জুটলো, সে শহরের পাশেই ছিল লম্বা সাইপ্রাস গাছ ভর্তি ছিমছাম এক গোরস্থান ৷’

‘ভদ্র, বয়স্ক যাত্রাসঙ্গীকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন ৷ লোকটি মহিলাকে দেখে সম্ভাষণ করে জানালার পাশটায় বসে গভীর দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো ৷ এমন স্বল্প কথোপকথনে সন্তুষ্টি হলো না তার ৷ বিমানবন্দর থেকে কিনে আনা প্রত্নতাত্ত্বিক পত্রিকায় ডুবে গেল সে ৷’
‘দুই স্টেশন পরে নতুন এক যাত্রী বগিতে উঠে আসলো ৷ মধ্য বয়সী, কেতা-দুরস্ত, তার ঝলসানো লোমশ পাশটা আর চিকন গোঁফওয়ালা একজন ৷ মৃদু মাথা নুয়ে বিনাবাক্যে দরজার পাশটায় বসে পড়লো ৷ নিস্তব্ধ নিরাবতা পুরো বগি জুড়ে থাকলো কোন এক ট্যানেলে অপ্রত্যাশিত থেমে না যাওয়া পর্যন্ত ৷ ট্রেনের ইথারে ভেসে আসল- বড় এক পাথরখন্ড লাইন জুড়ে আছে আর সেটা সরাতে প্রায় পনের মিনিট মতো লাগতে পারে ৷ কেউ উঠে গিয়ে বাতি জ্বালালো না এমনকি কেউ কাউকে কিছু বললও না ৷’

‘যখন ট্যানেল থেকে ট্রেন বেড়িয়ে আসল দেখা গেল সর্বশেষে উঠা যাত্রীটি একমাত্র একই জায়গায় সোজা হয়ে বসে আছে ৷ অপর দুই যাত্রীর কি ঘটেছে তা অন্ধকারে ঢাকা রইল ৷ কোনও চিহ্নই নেই এমনকি তাদের বাক্স-পেটরাও ৷

‘বড় এক জংশনে যাত্রীটি নেমে পড়লো ৷ প্লটফরমে যেই পা পড়লো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত নিল সে ৷ সে আর শিরোচ্ছেদকারী হিসেবে থাকবে না ৷ ছয় পুরুষের ঐতিহ্যধারায় বাধা দিবে আর এর কারণটা কাউকে বলবেও না ৷ আসলে সেটা তাদের বিষয়ই নয় ৷’

‘যেই মাত্র সে ট্রেন থেকে নেমেই হঠাৎ করে ব্যাগের এদিকটায় ঘোরে থাকা টোকেনঘর খুঁজায়রত মহিলার উদ্দেশ্যে দৌড়াতে লাগলো ৷ যদিও সে তার দিকে নজর দিল না তবু নিরবে বলার কিছু ছিল বলে সেদিকটায় এগিয়ে যেতে লাগলো ৷’

গল্পের পরিসমাপ্তি ৷ কিন্তু মিস গ্রেটা হাত তালি না দিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো ৷ তাকিয়ে রইলো গাঢ় নীল রঙা জামা পরা মহিলা ও বয়ষ্ক ভদ্রলোকটির দিকে ৷ যারা এইমাত্র মাথা নুয়ে মৃদু সম্ভাষণ জানিয়ে ফিরে গেল নিজেদের পূর্বের বসার জায়গায় ৷ তারা বসার পর সে চোখ নামিয়ে সামনে রাখা খালি কাপটার দিকে তাকিয়ে রইলো ৷

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইলো ৷ তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক দূরদৃষ্টির গভীরে, যা অন্যেরা কিছুই বুঝলো না ৷ অবশেষে ঘোরেই কোট রাখার রেকের দিকে এগিয়ে গেলেন আর বের করে আনলো ব্যাগ জমা রাখার টোকেনটা ৷ উল্টাপাল্টে দেখলো কয়েকবার আবার উঁচিয়ে ধরলো যেন সবাই দেখতে পায় ৷ তারপর খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে ৷ চারপাশের হাস্যোজ্জ্বল করতালিতে উৎবেদিত হয়ে উঁচিয়ে ধরে থাকা কাগজটা কাপের পাশে রাখা পিরিচে ঢুবিয়ে দিলো ৷


==============================
*সার্বিয়ান থেকে ইংরেজি ভাষান্তর এ্যলিস কপল-তসিক ৷
*ইউরোপের ফ্যান্টাস্টিকা ধারার শীর্ষস্থানীয় সার্বিয়ান জোরান জিভকভিক [জন্ম ১৯৪৮] একাধারে লেখক, শিক্ষাবিদ, প্রবন্ধকার. গবেষক, প্রকাশক ও অনুবাদক ৷
*লেখকের Impossible stories II গল্পগ্রন্থ থেকে the teashop গল্পটি সংগৃহীত ৷
*কৃতজ্ঞতায়ঃ অন্তর্জাল/জোরানের নিজস্ব অন্তর্জালিক পাতা/WLT.
_-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-__-*-_
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:২৬
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×