somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আসল সমস্যা কোথায়? ধর্মান্ধতা নাকি জাতীয়তাবাদ?

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিলয়ের​ হত্যার পর সংবাদকর্মী এবং পুলিশ অনেকবারই প্রশ্ন ​করেছেন-- কবে কবে হুমকি পেয়েছেন? আপনার বন্ধুরা কে কে হুমকি পেয়েছেন?
আমি উত্তরটা সহজেই দিতে পারিনি। কারণ হুমকি পাওয়াটা এতো সাধারণ একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে আমাদের কাছে, এসবের হিসাব রাখা বা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা আর হয়ে ওঠে না।
তাছাড়া এই হুমকির রূপও তো বিভিন্ন। কখনো স্ট্যাটাসে মন্তব্য করা হচ্ছে সরাসরি, কখনোবা ম্যাসেজ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আল-কোরআনের কিছু নির্দিষ্ট আয়াত (যেমন- সূরা মায়েদা'র ৩৩ নং আয়াত, সূরা আহযাবের ৫৭ নং আয়াত) পাঠানো হচ্ছে ইনবক্সে।
তাই এসবের হিসাব রাখা আর হয় না। হয়তো খুব মন খারাপ হলে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই হুমকিদাতাকে নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও অবশ্য তা ঠাট্টা করেই দেয়া হয়। হয়তো হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাই ভয়টাকে। নইলে যে বাঁচাই অসম্ভব হয়ে উঠবে!

অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন-- বিদেশে চলে যাও। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মাকে ছেড়ে যাবো কোথায়? আমি নাহয় পিঠ বাঁচালাম, কিন্তু আমার উত্তরাধিকারীর কী হবে? তাদের প্রতি কী আমার কোন দায় নেই?
না, আমি যাবো না। আমার মতো অসংখ্য মানুষ আছেন যারা আমার মতোই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ-- শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশেই লড়ে মরবো।
অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলেন-- আপনার ভয় লাগে না!
অবশ্যই লাগে। আর দশটা সাধারণ মানুষের সব অনুভূতি আমার মধ্যেও আছে। তাই রাতে বা দুপুরে বাড়ীর সামনে লোকসমাগম দেখলেই হার্টবিট বেড়ে যায়-- এই বুঝি এলো! কারো মোবাইল ফোন আমার দিকে তাক করা দেখলেই হার্টবিট মিস হয়-- এই বুঝি আমার ছবি তুলে নিচ্ছে! চলার পথে বারেবারে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনটা পরীক্ষা করি, কেউ অনুসরণ করছে না তো! প্রতি মুহূর্তেই আমরা তৈরী থাকি মরণের জন্য। নিজেকে মনে হয় হাত-পা বাঁধা কোরবানীর পশু। সবই বুঝি, কিন্তু পালানোর উপায় নেই।
তবুও থাকি। তবুও লিখি। কেন? যদি একজনকেও মানুষ হতে আগ্রহী করতে পারি। হয়তো নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অযথাই দাগ রেখে যাওয়ার চেষ্টা।

আমরা যারা মুক্তচিন্তার চর্চা করি, মানুষের অধিকারের কথা বলি, তাদেরকে একটা সাধারণ তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে-- নাস্তিক। অথচ আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত উপাসনা করেন, ধর্মাচার পালন করেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম আমরা নাস্তিক। তাতেই কী আমাদের হত্যাকাণ্ড অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে? ধর্ম না মানার 'শাস্তি' দেয়ার দায়িত্ব পায় কেউ? আর সেই হত্যাকাণ্ড দেখে চোখ বুজে থাকার অধিকার পায় রাষ্ট্রযন্ত্র?
মতৈক্য যদি থাকে তবে মতবিরোধও থাকবে --এটাই তো স্বাভাবিক। যে মুহূর্তে কেউ নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দেবে সাথে সাথেই তো আরেকজনের অধিকার জন্মায় নিজেকে নিধার্মিক দাবী করার। সাদা বিনে কালোর কী মূল্য?
অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবি খুব ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন, "সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে কোনকিছু বলতে যাওয়াটা সীমা লঙ্ঘন"। অত্যন্ত লজ্জার বিষয়, আমাদের পুলিশ বাহিনীর প্রধানও এই কথাটাই বলেছেন বারবার। তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে চাই, আমাদের এই প্রিয় দেশটা কী তাহলে জঙ্গলের আইনে চলে, যেখানে শক্তিই সবকিছুর মানদণ্ড? যদি তা-ই হয়, তাহলে কী দরকার বছর বছর শিক্ষা খাতে শত কোটি টাকার বাজেট দিয়ে? সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ছেড়ে দিলেই হয় ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ শেখানোর দায়িত্ব! তাহলে আজই বিলুপ্ত করা হোক সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বদলে বাড়ানো হোক মাদ্রাসার সংখ্যা। আমরা বরং ফিরে যাই মধ্যযুগেই। তবু একটা সান্তনার জায়গা তো পাবো।

দেখতে নতুন মনে হলেও, এই আস্তিক-নাস্তিক খেলাটা কিন্তু অনেক পুরনো। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও মুক্তিকামী মানুষগুলোকে নাস্তিক উপাধি দিয়েই 'খুনের বৈধতা' দেয়া হতো। পাকি সেনাদল আর রাজাকারেরা কিন্তু 'কাফের-মালায়ুন' মারার 'পবিত্র দায়িত্ব' নিয়েই গণহত্যা আর ধর্ষণ করেছে সেসময়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওরা পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের চিন্তা যে কতোটা হঠকারী আর অবাস্তব স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মধ্য দিয়ে তা-ই প্রমাণ করে দিয়েছে বাংলার জনগণ।
অবশ্য তার পরে সময় বদলেছে, পট বদলেছে। অপরিণামদর্শী রাজনীতিকের লোভের ফলে আবার রাষ্ট্র ও সমাজে আধিপত্য বিস্তার করেছে একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি। ধীরে ধীরে পেট্রো-ডলারের জোরে কিনেছে মানুষের হৃদয় আর আত্মা। আত্মবিক্রিত সেই জনগণ এখন তাই তাদেরই শেখানো বুলি আউড়িয়ে মধ্যযুগে ফিরতে চায়। এটাকে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের থাবা থেকে বাঁচার চেষ্টা বলে জাস্টিফাই করা যায়, তবে সেটা কতোটা বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা তা ব্যাখার প্রয়োজন আছে বৈকি।

শুধু কৌশল নয়, ১৯৭১ আর ২০১৫ উভয়েই আক্রমণের লক্ষ্য কিন্তু অপরিবর্তিত। একটা বিষয় কী খেয়াল করেছেন, যেসব 'নাস্তিক' খুন হয়েছেন বা হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণছেন তারা প্রত্যেকেই কিন্তু সার্বভৌম উন্নত বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলা মানুষ। ২০১৩ সালে তারাই কিন্তু রাজপথে আওয়াজ তুলেছিলো-- আমার মাটি আমার মা পাকিস্তান হবে না! দীর্ঘ চার দশক পর সব ভুলে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সেসময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো এক স্লোগানে-- জয় বাংলা! ধারাবাহিক ইতিহাস বিকৃতির ফাঁদে ফেলে আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধান্বিত তরুণ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে-- আমরা সবাই বাঙালী। আর এসবের সামনে-পিছনে কাজ করা মানুষগুলোকেই ঠান্ডা মাথায় টার্গেট করে করে খুন করা হচ্ছে এখন।
আমার চোখে তাই সমস্যাটা শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা নয়। মূল সমস্যা জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ আত্মপরিচয়। আমাদের সংস্কৃতি শিক্ষা দেয় সম-অধিকার নিয়ে সমানভাবে বাঁচতে। আর এই জায়গাতেই মূল বিরোধ। জাতীয়তাবাদের জায়গায় যদি ধর্মীয় আবেগ প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে যে শাসন ও শোষণ দুই-ই খুব সোজা। সেই পুরনো কৌশলে "ঈশ্বর আমাকে তোমাদের শাসক করে পাঠিয়েছেন" বলে যা খুশি তা-ই করা যেমন চলে, একইভাবে শোষণের বৈধতা দেয়া যায় "এ জগতে যা না পেলে তা পাবে পরকালে" জাতীয় সান্তনাবাণী দিয়ে। তাই তো আমরা যখন বলি, বাস্তব পথে চলো, যুক্তি দিয়ে বিচার করো, তখন তাদের গাত্রদাহ তো হবেই।
তাদের বানানো পথকে ধর্ম হিসেবে মানতে যেহেতু নারাজ, সেই অর্থে 'নাস্তিক' তো আমরা বটেই।

অনেকেই বোঝাচ্ছেন, এভাবে জীবন দেয়ার কী মানে? দেশের সিংহভাগ মানুষ তো আমাদের মৃত্যুতে খুশিই হয়। যাদের জন্য এতো ত্যাগ তারাই যখন ভুল বুঝছে, কী দরকার শুধু শুধু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর?
ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, সূর্যসেন-ক্ষুদিরাম তো বটেই, এমনকি নেতাজী সুভাষ বসুকেও সন্ত্রাসী তকমা নিয়ে মরতে হয়েছে। কিন্তু এখন সারা ভারতবাসী তাঁদের স্মরণ করে বীর দেশপ্রেমিক হিসেবেই।
গ্যালিলিও, এ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, ইবনে সিনা --সত্য বলায় খুন হতে হয়েছেন বা নির্বাসিত হয়েছেন এমন দার্শনিক-বিজ্ঞানীর সংখ্যা কিন্তু কম না।
আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবন যদি অন্ধকার পথে জোনাকি হয়ে আলো দিতে গিয়ে নিঃশেষ হয়, ক্ষতি কী! অন্ততঃ একটা সান্তনা তো পাবো-- চেষ্টা করেছি।

মূল লেখা এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×