somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অছিয়তনামা

২৩ শে মে, ২০১৯ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





মৃত্যু শব্দটিকে নিয়ে মানুষ ও ঈশ্বর দু’জনেই এত বেশী বালখিল্যপণা করেছে যে মানুষ আর এখন মরতে ভয় পায় না। মৃত্যুর মত এরকম আরও একটা শব্দ আছে, “ভালোবাসা”। ভালোবাসাকেও আজকাল সবাই এড়িয়ে চলে, যেন সেটা এমন একটা কিছু যা ছিল, শুনেছি অনেক আগে--- এখন বিলুপ্ত। শুনতে ভালো লাগে কেউ কাউকে ভালোবাসে, অথচ নিজের সেই হিম্মত নেই পরখ করে দেখবার! তাই, আজকে দু’টি শব্দ’কে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে চলছি---



প্রিয় কবি সাহিত্যিক ও বোদ্ধাগণ,
আপনাদের অনেকের লেখা আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে না মানে এই নয় যে আপনাদের লেখার সাথে আমার মতের ঐক্য নেই; আমরা নিশ্চয়ই সম্মিলিত ঐক্যজোট করতে আসিনি।
একজন কবি’র জীবন অতটা কাব্যিক নয়; অথচ কবিতার নামে আপনারা কেউ কেউ যে দাঁত ভাঙ্গা এবং হৃদয়-ভাঙা নেতানো মুড়ির ঠোঙা লিখে যাচ্ছেন, সেসব আমার বড্ড অপছন্দ।
ক্ষমা করবেন, আমি বিপ্লবী হতে পারিনি বলে, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কিছু একটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ায় রোজ রাত্রে, সকালে, বিকালে। বিপ্লব আমি করতে পারিনি। তবে, দেখেছি কোনো বিপ্লবী মারা গেলে তার পোষ্টার ছাপানো হয়, সেখানে তার সাদাকালো ছবি থাকে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা থাকে, তারপর দুপুরটা গড়িয়ে দেলেই কুকুর গিয়ে পোস্টারের সামনে সঙ্গম করে। শুনেছি, তাদের শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার এজেন্ডার কথা; বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা আমিও পেতে চেয়েছি, অথচ বিপ্লব করার জন্য আমার পকেটেও কোনো টাকা ছিল না।


প্রিয় কবি সমাজ,
আপনারা কীভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে উঠলেন? এরিস্টটল পড়েছেন বলে? পশু না হয় না’ই হতেন, দেবতাও তো হতে পারতেন! অথচ আপনারা সাহিত্য সংঘ করলেন, সাহিত্য সমাজ করলেন! আপনাদের এই মেলবন্ধন কীভাবে হলো আর আমি’ই বা কীভাবে এর বাইরে রয়ে গেলাম!
আমি মূলত প্রেমের কবি, প্রেম ছাড়া কোথাও কিছু দেখি না। দেশপ্রেম, মানব-প্রেম, প্রেমিকার প্রেম, আত্ম-প্রেম--- এরকম কয়েক হাজার প্রেমের প্রেমিকা আমি। যে ‘পরম’ থেকে প্রেমের সৃষ্টি; সে সত্তার প্রেমিক আমি; কবিতা কেবল’ই বহিঃপ্রকাশ!


প্রিয় বন্ধু,
বন্ধু’র কথা উঠলে আমি শত্রু খুঁজে পাই না, কখনো কাউকে শত্রুর মত পাইনি। সবাই যেন কীভাবে কীভাবে এসে বন্ধু হয়ে গেছে। শত্রু হতে গেলে যতটা যোগ্যতা লাগে বন্ধু তাতটাই সহজে হয়ে যাওয়া যায়। কাকে শত্রু ভাববো? প্রিয় বন্ধু, তুমি আমার শত্রু হবে? এই প্রপোজাল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বন্ধুত্বের দ্বারে দ্বারে—কেউ শত্রুত্ব গ্রহণ করেনি।


প্রিয় দেশ, প্রিয় স্বদেশ--

তুমি স্বাধীন, তুমি সেই নারীর মত স্বাধীন; যে নিজেকে পেঁচিয়ে রাখে শাড়ির ভেতরে। তুমিও নিজেকে বেঁধে রেখেছ কাঁটাতারে। তোমাকে ভালোবেসেছি প্রেমিকার চাইতেও বেশী, প্রেমিকার অবহেলা তাও সওয়া যায়, রাষ্ট্রের নয়।
একটি রাষ্ট্রীয় আদেশের অপেক্ষায় আমি জেগে ছিলাম সারারাত, সারা মাস – সারা বছর, এমনকি আমি জেগে ছিলাম সারা জীবন। শেষ পর্যন্ত বেসরকারি মানুষ বলেই ফিরে যেতে হল।



প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার,

আপনাকে দেখে এসেছি দেবীর মত। মত বললে ভুল হবে, দেবী’কে দেখেছি আপনার মত। প্রেমিকার পায়ে চুমু খেতে চেয়েছি জলের মত। ভালোবেসে নিষিদ্ধ শব্দগুলো বৈধ করতে চেয়েছি, অসম্ভবকে চেয়েছি সম্ভব করতে; অথচ কেউ আমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা অবহেলা পর্যন্ত দেয়নি।


প্রিয় শিল্পী- চিত্রকর,
বহু দিনের ইচ্ছে কেউ আমার একটা ছবি আঁকুক, যেখানে আমি নিজেকে দেখতে পাব। ছবির গভীর মাহাত্ম্য আমি বুঝি না, রঙ এর খেলা বুঝি না। আমাকে একটা ছবি এঁকে দিও- ঠিক যেমন আমাকে ভাবো তুমি। আমার চুলগুলো পেকে গেলে সাদা না হয়ে আমের মত হলুদ হয়ে যাক, আমার ভালোবাসাকে কষ্টের মত নীল না দেখে, সাদা দিয়ে শুভ্রতায় এঁকো। আমার প্রাপ্তবয়স্কতা দেখাতে গিয়ে আমাকে নগ্ন করে ফেলো না যেন, আমি যৌনতাকে অবাধ ভাবি, শিল্পকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবি--- কেবল নিজের কাপড় কেউ টান দিয়ে খুলে ফেলছে; কল্পনাও করতে পারি না।


প্রিয় সুরকার- গায়ক,

আমার আফসোস হয়, নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়; সংগীতের মত এত ধ্রুপদী একটা শিল্প আমি আত্মস্থ করতে পারিনি বলে। গানের কথা আমি আঊরে দেখেছি—সুর গুণগুনিয়ে দেখেছি—আমার গলায় কোনো সুর নেই। আমার আঙুলে বাঁশি বাজে না, আমি ঠোঁট দিয়ে বাঁশিতে বাতাস ভরে দিতে পারি না, আমার ফুসফুসে দম নেই---- নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হয়।
আমার একটা গানে সুর দিয়ে গেয়ে দিবে কেউ? নিচু স্বরে—কাহারবা, দাদরা, ভৈরবী—মালশ্রী—
যে কোনো রাগে—অনুরাগে!

প্রিয় আবৃত্তিকার,

কতটা অসহায় লাগে নিজেকে আপনাকে বুঝাই কী করে? ইচ্ছে করে নিজের হাত আমি নিজে চিবিয়ে খাই, আমার লেখা কবিতা আমি পাঠ করতে পারি না! আমি গলায় কম্পন উঠিয়ে, স্পন্দন তুলে ভাব ও ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে পারি না। আমাকে দ্বারস্থ হতে হয় একজন আবৃত্তিকারের! তার মুখে যখন আমার কবিতা শুনি--- নিজেকে বোবা মনে হয়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই মনে মনে, ‘আমাকে কথা বলার শক্তি দাও’- ‘আমাকে বলতে দাও’, ‘আমার বাকযন্ত্রে সক্রিয়তা দাও’!

প্রিয় ধার্মিক এবং অধার্মিক,
মূলত আমরা ঘুরে ফিরে একই সত্তা ধারণ করি। একজন এমন কাউকে বিশ্বাস করি, সর্বশক্তিমান ভেবে নিজেকে সমর্পণ করি যা’কে কখনো দেখিনি, জানিনি। অন্যজন এমন কাউকে মানি না যাকে জানিও না। পার্থক্য কিছুই দেখি না।
আমি সেই জীবন ধারণ করি যেখানে কিছু একটা অস্তিত্ব টের পাই, যেখানে নাড়ীর স্পন্দন আছে। আমার ধর্ম আমার অস্তিত্বে, আমার আচরণে আমার মানবিকতায়, মানসিকতায়। আমার ঘরে বাইবেল, কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক নেই; আমি মানুষের চোখে তাকিয়ে পড়ে নেই ঐশিবানী।

প্রিয় প্রকাশক,
সবচেয়ে গুরুতর দায়িত্ব আপনার; আমাকে প্রকাশ করবেন নাকি অপ্রকাশিত রাখবেন সে দায় আপনার কাঁধে। আমি চাইব এই অছিয়তনামা আমার মৃত্যুর পরেই প্রকাশ পাক। যদি মনে হয় আজ এখুনি এই লেখা প্রকাশ করতে হবে, তবে জেনে নিব এখন এই মাত্রই আমার মৃত্যু হলো। যদি মনে হয় এই লেখা প্রকাশ অযোগ্য, তবে যেন কখনোই আমার মৃত্যু না হয়।









জাহিদ অনিক
কবি ও ব্লগার




সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৯ দুপুর ২:৫৯
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×