ইদানিং নূরা পাগলারে এড়াইয়া চলি। কারণ অনেক। একটা কারণ আমি তো আর নূরার মত পাগল না। আর দ্বিতীয় কারণ হইল মুখে বলা যত সহজ, কাজ করা কিন্তু সেই তুলনায় কঠিন। দেশে যে খালি খারাপই ঘটে তাতো না, খারাপ আর কয়টাই বা ঘটে, বরং ভালো জিনিসের ছড়াছড়ি। একেবারে নগদ একখান উদাহরণ দেখাই। কয়দিন আগে এক মন্ত্রী এক এমপিরে চটকনা দিছে আর দুইটা ঘুষা দিছে। ঢিশুম ঢিশুম শব্দও নাকি হইছে। লোকজন এইডারে নিয়া কত কথা যে কইলো, আল্লাহ মাবুদ জানে। আচ্ছা, এইডা নিয়া সমালোচনা করার কি আছে? বাংলাদেশে প্রতি জেলায় তো এমপি আছে। কয়জন কিলঘুষা খাইছে, কেউ বলতে পারবেন? তাইলে এই একটা কি উদাহরণ হইতে পারে! শালার লোকজন সামান্য জিনিসগুলারেও ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া বিশাল কইরা ফালায়। আর মন্ত্রী তো পদে বড়, আবার পার্টির মা-বাপ, হেয় শাসন করতেই পারে। জানি, আপনেরা বলবেন, সেই এমপির কি দোষ ছিল! আরে দোষ গুণের ব্যাপার না। ব্যাপার হইল শাসন করা। ছোটবেলায় কত মাইর খাইছি স্কুলে এসব নিয়া। দোষ করছে আমিন মেম্বারের পোলা, মাইর খাইছি আমরা আমজনতা। এইটাইতো স্বাভাবিক, তা না লোকজন খালি প্যাঁচায়।
যাক চায়ের দোকানে বইসা চা খাইতাছিলাম, নূরা পাগলা ঢুইকা পড়ল। ভাবছিলাম চা খাইয়াই পগার পার হমু, কিন্তু এখন আর কিইবা কওন যায়। তাই হাসিমুখে বললাম, "কিরে নূরা, আছোস কেমন?"
নূরা আমারে দেইখা বেশ খুশি হইল মনে হয়। 'ভালো আছি' বইলা পাশে বসল। আমারেও জিগাইলো, 'ভাই আপনি কেমন আছেন?'
- আছি রে! বেশ ভালো আছি। একটু কাজ ছিলরে, সাইরা আসি।
- আরে যাইবেন আর কই! শহর তো ছোটই। আমার একখান জিজ্ঞাসা আছিল, বেশি সময় লাগব না। এরপর যাইয়েন ভাই।
মনে মনে বেশ বিরক্ত হই। নূরার কথার আগামাথা থাকে না। শেষই কি শুরু না শুরুই শেষ, কে জানে? কিন্তু এখন কি আর করা! পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। জিজ্ঞাস করি, "বল, কি জানতে চাস!"
- এই যে ভাই আমরা গণতন্ত্র বলি, সমান অধিকার বলি, আসলে ভাই এইগুলার কি কোন ভিত্তি আছে, না খালি বইয়েই লেখা থাকে। আর গণতান্ত্রিক হিসাবে কি আমাদের দেশ আগাইয়া আছে না পিছাইয়া আছে? এই আর কি ভাই, সামান্য প্রশ্ন।
নূরার হাসিমাখা চেহারাডা দেইখা মনে হইল, নতুন থান ইট দিয়া ছেঁচি। ইট দিয়া না, ওই যে পুলিশে গরম পানি ছিডায়, আবার মরিচের গুড়া দিয়া স্প্রে করে, আবার কখনও কখনও বুট দিয়া লাত্থি মারে, নাইলে ডাণ্ডা দিয়া বাড়ি মারে - ওইরকম করি। আকবর আলি খান অথবা মাল মুহিতরে যে প্রশ্ন করার কথা সেইটা আমারে কইলে কি আমি কইতে পারুম? কিন্তু নূরা পাগলা যেমন নাছোড়বান্দা, কিছু তো কইয়া বুঝ দিতে হইব। তাই বললাম,
"দেখ, বাংলাদেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস সেইরকম বাড়ছে। দেখছ না আমরা এখন আমেরিকা, বিশ্বব্যাংক, সুন্দরবন আন্দোলন সবাইরেই চ্যালেঞ্জ করতে পারি, ওগোরে নিয়া হাসি ঠাট্টা করতে পারি।
আবার দেখ, আমাগ নিজেগো টাকা পয়সা এতো বেশি হইছে আমরা এখন আর ভিক্ষা করতে বিদেশ যাইতে হয় না, উলটা হেরা আমাগো দেশে আইসা বইসা থাকে।
তারপর দেখ, ইউরোপ আমেরিকায় মন্দা অথচ আমাগো রিজার্ভ এর ট্যাকা খালি বাড়ে আর বাড়ে, উড়ে আর উড়ে।
আরো আছে, শিক্ষায় আমাগ ছেলেমেয়েরা এখন গোল্ডেন পায়, সব ইস্কুল কলেজেই খালি পাশ। ফেল করা কত কষ্ট হইয়া গেছে। কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এখন কত উন্নত।
আমাগ দেশের চিকিৎসা কত উন্নতমানের, গলির মোড়েও তুই সিটি স্ক্যান করাইতে পারবি।
আবার সব মিলাইয়া ৬২,০০০ পত্র পত্রিকা আছে আমাগ দেশে, যা ইচ্ছা তাই কইতে পারবি। এর চাইতে স্বাধীনতা কি আর কোথাও আছে। এর চাইতে গণতন্ত্র আর কোন দেশে আছে বল?"
একদমে কথা শেষ করে আমি হাঁপাই। এক গ্লাস পানি খাইয়া আবার চা দিতে বলি দোকানকদাররে। লগে একটা সিগারেট ধরাই। কইষা দুইডা টান দিয়া, নূরার মুখের দিকে চাই। আইজকা যুইতমতো পড়ছে, কোন শব্দ বারায় না নূরার মুখ থাইকা। নূরাও আমার দেখাদেখি একটা সিগারেট ধরায়, দুইটা টান দেয় তারপর বলে, "ভাই, আপনের কথায় একমত হইলাম না।"
- একমত না হওয়াডাই তো গণতন্ত্র। তো তোর কি মনে হয়, বল এবার। আমি কিছুটা রাগী রাগী গলায় বলি।
নূরা হাসে, মিচকা হাসি। দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। কি বিপদে পড়লাম যে আজকে। নূরা বলে ভাই, "আত্মবিশ্বাস বাড়ছে এটা আপনার মনকরা পর্যবেক্ষণ, কোন তথ্য ছাড়া এমনে ঢালাওভাবে বলা যাইব নাকি, ভাইবা দেখবেন। আর সবাই চুপ কইরা অন্যায় মাইনা নেয়া কি আত্মবিশ্বাস, নাকি না বুইঝা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হইয়া কিছু করারে আত্মবিশ্বাস কইতাছেন, জানাইলে ভালো হইত।
আবার কইলেন, এখন আর সদকা যাকাত লাগে না আমাগ। কার লাইগা লাগে না ভাই। যেই মানুষগুলা দেশের বাইরে কুত্তার মত খাইটা টাকা পাঠায় ওগোরে বিমানবন্দর আইলে গরু ছাগলের মতো ব্যবহার করে। যাগো ট্যাকায় স্যুট পইরা বিদেশ যাইয়া ভাব লয় আমাগ দেশের নেতা মন্ত্রীরা, আপনের মত চুনাপুঁটিরা, সেই লোকগুলারেই আপনেরা মাইনষের অধম মনে করেন। গার্মেন্টস এর চল্লিশ লাখ নারীপুরুষ কাম কইরা খায় দেইখা যে উন্নতি দেখতাছেন, হেগো লাইগা কি কিছু করছেন আপনেরা?
মন্দার কথা কইলেন না। ইউরোপ আমেরিকার কাজ করতে পারা মাইনষের সংখ্যা কত খোঁজ নিয়েন, আর আমাগ কত তাও জাইনা নেন। তাইলেই মন্দা ছন্দার কারণ বুঝবার পারবেন! আরে মিঞা, এমন কোন জিনিস আছে যে দাম বাইড়া আকাশে উঠে নাই, আর গরীব কৃষকের উৎপাদন করা চাইল, আপনেগো দশ টাকায়ই খাইতে হইব। লোভেরও একটা সীমা আছে না ভাই! কি কন?
আর পদ্মা সেতু, নতুন নতুন রাস্তাঘাটের কথা কইয়া লজ্জা দিয়েন না। মানি এগুলা দরকার, তাই বইলা সতেরো হাজার কোটি টাকার প্রোজেক্ট বাহাত্তর হাজার কোটি টাকা কেমনে হয় ভাই? আবার সারা পৃথিবীতে এক কিলোমিটার রাস্তা বানাইতে আমাগো যেই পরিমাণ টাকা লাগে, তার তিনভাগের একভাগ দিয়া আমেরিকায় রাস্তা হয়। তাইলে আমরা কি সোনাচান্দি দিয়া রাস্তা বানাই নি? একটা ব্যাংক আছেনি যে লুটপাট হয় নাই, কার বিচার করছেন, কবে করছেন, সরকারের কি কোন দায় আছে এই ব্যাপারে? অর্থমন্ত্রীর চাকরি ইস্তফা দেয়া কি উচিত ছিল না ভাই?
আবার কি কইলেন, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নতি হইছে। আমি তো পাগল, কবরের তো কাউরে উডান হেও কইবো কি দুরাবস্থা শিক্ষা ব্যবস্থায়। পোলাপান একুশে ফেব্রুয়ারি কি আর বিজয় দিবস কি জানেনা, শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হইছে। দেশের ষাইট ভাগ পোলাপান মাদ্রাসায় পড়ে, দশ ভাগ পড়ে ইংরেজি বাংলা জগাখিচুড়ী স্কুলে, আরও আছে খালি ইংরেজি, খালি আরবি। এইগুলার পরে মাত্র পঁচিশভাগ, সাধারণ স্কুল কলেজে পড়ে, যেইডারে আপনেরা কন 'মেইন স্ট্রিম' লেখাপড়া! দেশের উন্নতি কি তাইলে মাদ্রাসার ছাত্ররা করব! হেগোরে ত আপনেরা স্বীকারই করবার চান না!
স্বাস্থ্যসেবা তো আরো ভালো। প্রতিবছর তেরো লাখ বাংলাদেশি ভারত যায় চিকিৎসা করতে, পাঁচ লাখ যায় থাইল্যান্ড সিংগাপুরে। আমাগ না অনেক ট্যাকা, আমরা কেন পারিনা হেগো মত হইতে, জিগাইছেন কোনদিন কাউরে?
- ভাইরে এবার থাম! হইছে আমার ভুল হইছে! তুই মাইক লইয়া যাইয়া ঘোষণা কইরা বেড়া। খবরদার আমারে কিছু কইবি না আর। আমি সখেদে বলি নূরা পাগলাকে।
- হ, এইসব কইলেই তো খালি আমার দোষ, আমি পাগল। গেলো এক সপ্তাহে রাস্তায় দুর্ঘটনায় ৭৩ জন মারা গেছে। কিন্তু মিশুক মুনিরের বিচার ঠিকমতো হয় নাই, এইডাই সবাই ফলাও কইরা কইতাছে। তা কইতেই পারে। উনি তো কাজের মানুষ ছিল। কিন্তু এইযে লোকগুলা মারা গেলো, এদের মরার জন্য যারা দায়ী হেগো যদি উচিত বিচার হয়, সমান অধিকারে মুনির সাহেবের মতই যদি হেগো বিচার হয় তাইলেই বুঝবেন দেশে গণতন্ত্র আছে।
হুনেন ভাই, গণতন্ত্র হইল, আমার ইচ্ছা হইলে আমি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করুম। সরকার আমারে জবাব দিতে বাধ্য থাকব, সেইটারেই কয় গণতন্ত্র। আপনাগ এইসব স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্রের লাইগা ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ হয় না। ভারত আর হেফাজতের কোলে উইঠা বইসা থাকনের লাইগা মুক্তিযুদ্ধ হয় নাই, সুন্দরবন নিয়া মুর্খামির লাইগা এই দেশ স্বাধীন হয় নাই। আমার কথার জবাব দিবো দেইখাই এই দেশ স্বাধীন হইছে। আর যেইদিন সরকার যেকোন নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেশের প্রধানের মত করব, সেদিনই গণতন্ত্রের দেখা পাইবেন, বুঝলেন ভাই।
নূরা পাগলার সাথে আর কথা বাড়াই না। পাগলে আবার কি কইতে কি কইব! কোনমতে সিগারেট শেষ কইরা বিল দিয়া চায়ের দোকান থাইকা বার হই। পাগল ছাগলের পাল্লায় পইড়া সময়ডা নষ্ট করার কি মানে আছে! গণতন্ত্র দিয়া কি হইব! ছাতা হইব! একটা রিক্সা ডাক দিয়া নূরা পাগলারে চায়ের দোকানে ফালাইয়া সভ্য দুনিয়ায় পাড়া দেই।